অবৈধভাবে প্যানেল তৈরি করে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিলেন বিএনপি নেতা
Published: 23rd, April 2025 GMT
যশোরের অভয়নগরে প্রেমবাগ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যানের প্যানেল অবৈধভাবে ভেঙে নতুন প্যানেল তৈরি করা হয়েছে। চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতে ইউনিয়ন পরিষদের দায়িত্ব নিতে স্থানীয় এক বিএনপি নেতার নেতৃত্বে এ কাজ করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
নতুনভাবে তৈরি করা চেয়ারম্যানের প্যানেলের প্যানেল চেয়ারম্যান-১ জসিম উদ্দীন ইউনিয়ন পরিষদ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছেন। তিনি ওই ইউপির ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য এবং ওই ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি।
প্রেমবাগ ইউনিয়ন পরিষদ সূত্র জানায়, ২০২২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রেমবাগ ইউনিয়ন পরিষদের প্রথম বৈঠকে ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আমিনুর রহমানকে প্যানেল চেয়ারম্যান-১, ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মো.
গত ১৯ আগস্ট সরকার একটি পরিপত্র জারি করে। এতে ধারাবাহিকভাবে কর্মস্থলে অনুপস্থিত চেয়ারম্যানদের কাজ পরিচালনা এবং জনসেবা অব্যাহত রাখার জন্য স্থানীয় সরকার ইউনিয়ন পরিষদ আইন, ২০০৯ অনুযায়ী বিভাগীয় কমিশনার বা জেলা প্রশাসক নিজ নিজ অধিক্ষেত্রের সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যানদের অথবা প্যানেল চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতিতে অথবা যেকোনো জটিলতা পরিলক্ষিত হলে বিভাগীয় কমিশনার বা জেলা প্রশাসক নিজ নিজ অধিক্ষেত্রে তাঁর অধীনস্থ কর্মকর্তা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বা সহকারী কমিশনার (ভূমি)-কে আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা অর্পণ করে ইউনিয়ন পরিষদগুলোকে সচল রাখতে বলা হয়।
প্রেমবাগ ইউনিয়ন পরিষদ সূত্র জানায়, গত ২২ আগস্ট ইউনিয়ন পরিষদে প্যানেল চেয়ারম্যান-১ আমিনুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় নতুন চেয়ারম্যানের প্যানেল তৈরি করা হয়। সভায় ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য জসিম উদ্দীনকে প্যানেল চেয়ারম্যান-১, ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মো. আমিনুর রহমানকে প্যানেল চেয়ারম্যান-২ এবং ৭, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য হালিমা পারভীনকে প্যানেল চেয়ারম্যান-৩ নির্বাচিত করা হয়। সভায় মো. আমিনুর রহমান প্যানেল চেয়ারম্যান-১–এর দায়িত্ব মো. জসিম উদ্দীনকে অর্পণ করেন। সভার তিন দিন পর গত ২৫ আগস্ট অভয়নগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে প্যানেল চেয়ারম্যান-১ থেকে পদত্যাগের আবেদন করেন আমিনুর রহমান। পদত্যাগের কারণ হিসেবে তিনি তাঁর শারীরিক ও পরিবারিক সমস্যার কথা উল্লেখ করেন।
এরপর গত ২৮ অক্টোবর যশোরের জেলা প্রশাসক আজাহারুল ইসলাম নতুন করে তৈরি করা প্রেমবাগ ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান-১ জসিম উদ্দীনকে ইউনিয়ন পরিষদ পরিচালনার জন্য আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা অর্পণ করেন।
স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন, ২০০৯–এ বলা হয়েছে, পরিষদ গঠিত হওয়ার পর প্রথম অনুষ্ঠিত সভার ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে সদস্যরা তাদের নিজেদের মধ্য থেকে অগ্রাধিকারক্রমে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি চেয়ারম্যানের প্যানেল নিবার্চন করবেন। অনুপস্থিতি, অসুস্থতা হেতু বা অন্য যেকোনো কারণে চেয়ারম্যান দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হলে তিনি পুনরায় স্বীয় দায়িত্ব পালনে সমর্থ না হওয়া পর্যন্ত চেয়ারম্যানের প্যানেল থেকে অগ্রাধিকারক্রমে একজন সদস্য চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করবেন। চেয়ারম্যানের প্যানেলভুক্ত সদস্যরা অযোগ্য হলে অথবা ব্যক্তিগত কারণে দায়িত্ব পালনে অসম্মতি জ্ঞাপন করলে পরিষদের সিদ্ধান্তক্রমে নতুন চেয়ারম্যানের প্যানেল তৈরি করা যাবে।
অনুপস্থিতি, অসুস্থতা হেতু বা অন্য যেকোনো কারণে চেয়ারম্যান দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হলে তিনি পুনরায় স্বীয় দায়িত্ব পালনে সমর্থ না হওয়া পর্যন্ত চেয়ারম্যানের প্যানেল থেকে অগ্রাধিকারক্রমে একজন সদস্য চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করবেন। চেয়ারম্যানের প্যানেলভুক্ত সদস্যরা অযোগ্য হলে অথবা ব্যক্তিগত কারণে দায়িত্ব পালনে অসম্মতি জ্ঞাপন করলে পরিষদের সিদ্ধান্তক্রমে নতুন চেয়ারম্যানের প্যানেল তৈরি করা যাবে।আমিনুর রহমান বলেন, ‘২২ আগস্ট পরিষদে আমার সভাপতিত্বে মিটিং দেখানো হলেও আমি মিটিংয়ে উপস্থিত ছিলাম না। ২২ আগস্ট সকালে প্যানেল চেয়ারম্যান-২ এবং ইউনিয়ন পরিষদের সচিব আমাকে ফোন করে ইউনিয়ন পরিষদে যেতে নিষেধ করেন। ২৫ আগস্ট বিকেলে আমি পাশের গ্রাম থেকে বাড়ি ফেরার পথে রাস্তায় চৌকিদার আমাকে পরিষদের মিটিংয়ের সভাপতিত্ব করার রেজল্যুশন, প্যানেল চেয়ারম্যান-১ থেকে পদত্যাগপত্র এবং দায়িত্ব হস্তান্তরের পত্রে সই করতে বলেন। প্রথমে আমি সই করতে রাজি না হওয়ায় প্যানেল চেয়ারম্যান-২ এবং ইউনিয়ন পরিষদের সচিব আমাকে ফোন করে সই করতে বলেন। ভয়ে আমি সব কাগজপত্রে সই করে দিয়েছি। আমি শারীরিকভাবে সুস্থ এবং আমার কোনো পরিবারিক সমস্যা নেই।’
এ সম্পর্কে জসিম উদ্দীন বলেন, ‘৫ আগস্টের পর চেয়ারম্যান ও প্যানেল চেয়ারম্যান-১–ও হারিয়ে গেলেন। আমরা সব মেম্বার (ইউপি সদস্য) বসে ২২ আগস্ট প্যানেল চেয়ারম্যান-১–কে পরিষদের মিটিংয়ে আমন্ত্রণ জানালাম। সব মেম্বার মিটিংয়ে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু প্যানেল চেয়ারম্যান-১ আমিনুর রহমান মিটিংয়ে আসতে পারেননি। তিনি রাস্তায় দাঁড়িয়ে মিটিংয়ের রেজল্যুশনে সই করে দিয়েছেন। তবে ২৫ আগস্টের মিটিংয়ে তিনি উপস্থিত ছিলেন। সেদিন তিনি পদত্যাগপত্রে সই করেন।’
ভয়ে আমি সব কাগজপত্রে সই করে দিয়েছি। আমি শারীরিকভাবে সুস্থ এবং আমার কোনো পরিবারিক সমস্যা নেই।আমিনুর রহমান, ইউপি সদস্য ও পদত্যাগকারী প্যানেল চেয়ারম্যানঅবৈধভাবে চেয়ারম্যানের প্যানেল ভেঙে দেওয়ার বিষয়ে জসিম উদ্দীন বলেন, ‘বোঝা না-বোঝার কারণে ইউনিয়নের পরিষদের মিটিংয়ে প্যানেল চেয়ারম্যান পুনর্গঠন, রেজল্যুশন, প্যানেল চেয়ারম্যান-১ থেকে আমিনুর রহমানের পদত্যাগ এবং দায়িত্ব হস্তান্তরের তারিখ হেরফের হয়েছে। তবে এতে অন্য কোনো কারণ নেই। এখন ইউনিয়ন পরিষদে কোনো সমস্যা নেই। ইউনিয়ন পরিষদের সব কার্যক্রম সুন্দরভাবে পারিচালিত হচ্ছে।’
এ সম্পর্কে যশোরের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক রফিকুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রেমবাগ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অনুপস্থিত থাকায় প্যানেল চেয়ারম্যান-১–কে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করার কথা। কিন্তু প্যানেল চেয়ারম্যান-১ পদত্যাগ করায় প্যানেল চেয়ারম্যান-২–কে ইউনিয়ন পরিষদ পরিচালনার জন্য আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘চেয়ারম্যানের প্যানেল ভেঙে দিয়ে নতুন করে চেয়ারম্যানের প্যানেল তৈরি করার বিষয়ে কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি। এ ব্যাপারে অভিযোগ পাওয়া গেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
আঠারো শতকের সুফি কবি ও সংগীতজ্ঞ সৈয়দ খাজা মীর দর্দ
আবদালি মারাঠিদের উৎপাত ও অত্যাচারে অন্য কবিরা যখন একে একে দিল্লি ছেড়ে লক্ষ্ণৌ চলে গিয়েছিলেন, তখনো প্রিয় শহর দিল্লি ছাড়েননি সৈয়দ খাজা মীর দর্দ (১৭২০-১৭৮৪ খ্রি.), বরং আমৃত্যু সেখানেই থেকে গিয়েছিলেন। লক্ষ্ণৌয়ে অবস্থানকারী কবিদের কাব্যবৈশিষ্ট্যের সঙ্গে তাঁর কবিতার যে পার্থক্য ছিল, শুধু সে কারণেই তিনি সেই জায়গায় যাননি তা নয়, তাঁর আত্মমর্যাদাবোধ ছিল প্রখর, কারও তারিফ করে কখনো কসিদা লিখেছেন বলে শোনা যায়নি, সর্বোপরি তাঁর জীবনদর্শনও ছিল সমকালিক অন্য কবিদের থেকে আলাদা। মধ্যযুগের যে সময়টায় মীর দর্দের জন্ম, সেই সময় উর্দু সাহিত্যে ‘মীর-সওদার যুগ’ বলে পরিচিত—এই দুই কবি পারস্য কবি খাজা শামসুদ্দিন হাফিজ সিরাজি ও শেখ মোসলেহ উদ্দিন সাদির পথ অনুসরণ করে ফারসি কবিতার একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ধারাকে উর্দু কবিতার ধারায় যুক্ত করেন এবং সফল হন। মির্জা রফী সওদার চেয়েও সাত বছরের অগ্রজ মীর দর্দ এই সবকিছুই নিবিড়ভাবে লক্ষ করেছেন, পারস্য ঐতিহ্যের সমৃদ্ধ ভান্ডার থেকে অনেক কিছু গ্রহণও করেছেন, তবু আমাদের ধারণা, পারিবারিক বংশধারার প্রভাবেই তাঁর জীবনদর্শন ও কাব্যচিন্তা শুরু থেকেই ভিন্ন ছিল।
মধ্যযুগের যে সময়টায় মীর দর্দের জন্ম, সেই সময় উর্দু সাহিত্যে ‘মীর-সওদার যুগ’ বলে পরিচিত—এই দুই কবি পারস্য কবি খাজা শামসুদ্দিন হাফিজ সিরাজি ও শেখ মোসলেহ উদ্দিন সাদির পথ অনুসরণ করে ফারসি কবিতার একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ধারাকে উর্দু কবিতার ধারায় যুক্ত করেন এবং সফল হন।মাহমুদ আলী খান জামী তাঁর ‘দর্দ কে সো শের’ (প্রকাশকাল: ১৯৫৫ খ্রি., দিল্লি) গ্রন্থে লিখেছেন, খাজা মীর দর্দের দাদা বাদশাহ আলমগীরের শাসনামলে বুখারা থেকে এ দেশে এসেছিলেন, আর বাবা খাজা মাহমুদ নাসির আন্দালিব ছিলেন ‘শায়েরে উর্দু’ এবং ব্যক্তিগত জীবনে একজন সুফি। ভিন্ন মতে, তাঁর বাবার নাম (মাহমুদ নাসির নয়) মুহাম্মদ, আর তিনি উর্দু ভাষার কবি ছিলেন না, ছিলেন ফারসি ভাষার কবি। এঁরা ছিলেন নকশবন্দী ঘরানার পথিকৃৎ খাজা বাহাউদ্দিনের বংশধর ও অনুসারী। সুফি পরম্পরার মধ্যে বেড়ে উঠেছিলেন বলেই মাত্র বাইশ বছর—ভিন্ন মতে, সাতাশ বছর বয়সে জাগতিক মোহ ত্যাগ করে সুফি শুদ্ধাচারী হয়ে ওঠেন দর্দ এবং সুফি তত্ত্বসংক্রান্ত একাধিক বই লেখেন। ফলে তিনি যখন শের ও গজল লেখেন, তখন সেগুলোতে স্বভাবগত কারণেই সুফি মরমি কবিতার সহজগভীর ভাবের ছায়া পড়েছে। নিচে দর্দ কে সো শের বই থেকে—অন্যত্র গজলরূপে গণ্য এবং গীত—প্রথম ৩টি শের পড়লে এ কথার সত্যতা মিলতে পারে :
তোহমতে চন্দ অপনে জিম্মে ধর চলে
জিস লিয়ে আয়ে থে হম সো কর চলে
জিন্দেগি হ্যয় য়া কোই তোফান হ্যয়
হম তো ইস জিনে কে হাথোঁ মে মর চলে
শমা কে মানিন্দ হম ইস বজম মে
চশম নম আয়ে থে দামন তর চলে
অর্থাৎ :
কত অপবাদ বয়ে নিয়ে আমি চলছি
অথচ যে কারণে এসেছি তা–ই করে গেছি
এ কোনো জীবন, নাকি তুফান
তার হাতেই তো আমি মারা যাব
এই সভার প্রদীপ ছিলাম আমি
এখন আমার চোখের জলে আঁচল ভিজে যায়
[অনুবাদ: লেখক]
অল্প বয়স থেকে যিনি এমন ভাবনায় তাড়িত, তাঁর গজলে এই প্রভাব পড়াটাই স্বাভাবিক। সুফি কবি ও সাধক হিসেবে স্বীকৃত হলেও গজলকার হিসেবে যেরকম গণ্য হননি খাজা মঈন উদ্দিন চিশতি, ঠিক একই কারণেই গজলকার হিসেবে কেউ কেউ তাঁর নাম সমকালের মীর তকী মীর ও মির্জা রফী সওদার কাতারে রাখতে কুণ্ঠিত। অবশ্য এ ক্ষেত্রে খোদ মীর তকী মীরের একটি মন্তব্য আছে, যা অনেকেই উদ্ধৃত করেন, তা হলো: তিনি নাকি আড়াইজন কবিকে সবিশেষ গুরুত্ব দিতেন, যার মধ্যে একজন তিনি নিজে, অন্যজন মির্জা রফী সওদা আর অর্ধজন হলেন খাজা মীর দর্দ।
তাঁর এমন সহজগভীর ভাষার জন্য বোধ হয় বেশ কিছু অনুসারী তৈরি হয়েছিল, যাঁরা নিয়মিত তাঁর মাহফিলে আসতেন। শুধু ভাবশিষ্যরাই নন, সংগীতশাস্ত্রে পারদর্শী খাজা মীর দর্দ মর্যাদার ক্ষেত্রে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিলেন যে তাঁর পাক্ষিক আসরে অনুরাগী হিসেবে কখনো কখনো বাদশাহ শাহ আলমও আসতেন।শের ও গজলের ক্ষেত্রে মীর তকি মীর শেষমেশ যে উচ্চতায় পৌঁছেছিলেন সেই জায়গা থেকে বিচার করে তাঁর এই কথাটিকে সদর্থে ধরে নিলে কবিতায় খাজা মীর দর্দের অবদানকে বিশেষভাবে মূল্যায়ন না করে উপায় নেই। আসলে পারস্য কবিতার ঐতিহ্য ধারণ করে উর্দু গজলে যখন পরবর্তীকালের জনপ্রিয় বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নারীর সঙ্গে আলাপের আবহ তৈরি হচ্ছে, খাজা দর্দ তখন একই উৎস থেকে গ্রহণ করেছিলেন সুফি ঐতিহ্য। সমালোচকদের মতে, তাঁর শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ ‘দিওয়ান-এ উর্দু’, কিন্তু তাঁর ‘শমা-এ মহফিল’, ‘আহ-এ দর্দ’, ‘দর্দ-এ দিল’ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থের প্রাঞ্জল ভাষা ও সুফিহৃদয়ের ভাব সেই সময় ও পরবর্তীকালের কবিদেরকেও প্রভাবিত করেছে। তাঁর একটি অনবদ্য শের হলো: ‘তমান্না তেরি হ্যাঁয় অগর হ্যাঁয় তমান্না/ তেরি আরজু হ্যায় অগর আরজু হ্যায়’ অর্থাৎ, আকাঙ্ক্ষা যদি থাকে, তা তোমারই আকাঙ্ক্ষা/ আশা তোমার জন্য, আদৌ আশা বলে যদি কিছু থাকে’। প্রেমের এমন একনিষ্ঠ নিবেদন খাজা দর্দের শেরেই পাওয়া সম্ভব। নিচে পড়ে নিতে পারি তাঁর আরও একটি জনপ্রিয় শের:
হাজারোঁ খওয়াহিশেঁ অ্যায়সি কে হর খওয়াহিশ পে দম নিকলে
বহুত নিকলে ম্যারে আরমান ল্যাকিন পির ভি কম নিকলে
অর্থাৎ :
এমন হাজার বাসনা আমার, যার প্রতিটি বাসনার জন্য প্রাণ ওষ্ঠাগত
কিছু আকাঙ্ক্ষা পূরণ হলো বটে; কিন্তু তা খুবই সামান্য
তাঁর এমন সহজগভীর ভাষার জন্য বোধ হয় বেশ কিছু অনুসারী তৈরি হয়েছিল, যাঁরা নিয়মিত তাঁর মাহফিলে আসতেন। শুধু ভাবশিষ্যরাই নন, সংগীতশাস্ত্রে পারদর্শী খাজা মীর দর্দ মর্যাদার ক্ষেত্রে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিলেন যে তাঁর পাক্ষিক আসরে অনুরাগী হিসেবে কখনো কখনো বাদশাহ শাহ আলমও আসতেন।
আরও পড়ুনএকাদশ শতকের সুফি কবি হাকিম সানায়ি গজনভি২৮ আগস্ট ২০২৫মীর দর্দের এমন উচ্চাসনে পৌঁছার অন্য একটি কারণ হলো, তাঁর জন্মের বহু আগে থেকেই গান শোনা ও তার চর্চা বিষয়ে যে তর্ক-বিতর্ক চলে আসছিল, সে বিষয়ে তাঁর সবিস্তার আলোচনা এবং গানবিষয়ক গান লেখার উদাহরণ। আমাদের অজানা নয়, গান বিষয়ে কওয়ালির প্রতিষ্ঠাতা আমির খসরুর একাধিক বাণী আছে, যেমন: ‘গান হলো আত্মার খোরাক’, ‘দরবেশের কাছে গান হলো ঐশ্বরিক জ্যোতির সমতুল’ ইত্যাদি, আর দর্দ লিখেছেন: ‘অগর ঘিনা নফস কো বড়্কায়ে তো হারাম, অগর দিল কো ইলাহ কি তরফ নরম করে তো হালাল’ অর্থাৎ গান যদি মনকে প্রবৃত্তিতাড়িত হতে উসকে দেয় তাহলে হারাম, আর স্রষ্টামুখী করলে হালাল’। এ বিষয়ে দর্দের যে শের রয়েছে, সেটি আরও সুন্দর :
সামা’ আহলে দিল কো হ্যা সোদমন্দ দর্দ
কে ইস সে নরম হোতা হ্যা পাত্থর কা দিল ভি
অর্থাৎ :
হৃদয়বান মানুষের জন্য গান উপকারী, হে দর্দ
কারণ পাথরের মতো হৃদয়ও তাতে গলে যায়।
উল্লেখ্য যে, গান বিষয়ে আলোচনা করবার সময় এ অঞ্চলের গবেষক ও সুফি-বাউল-ফকিরেরা ইমাম গাজ্জালি, মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি ও আমির খসরুর বইয়ের তথ্যের উল্লেখ করেন, কিন্তু প্রকাশ ও প্রচারের অভাবে কোথাও সৈয়দ খাজা মীর দর্দের কথা পাওয়া যায় না। জাভেদ হুসেন দর্দের কয়েকটি গজল অনুবাদ করতে গিয়ে তার ভূমিকায় লিখেছেন: ‘দর্দ ছিলেন একজন বড় সংগীতজ্ঞ। সুফি সাধনায় সংগীতের ভূমিকা নিয়ে হুরমতে ঘিনা নামে পুস্তিকা লিখেছেন। উর্দু গজলের গীতিময়তা আজ দেখা যায় তাতে দর্দের ভূমিকা ব্যাপক ও গভীর।’ এই পুস্তিকাটি দুর্লভ, ভবিষ্যতে এটি অনূদিত হলে শায়ের ও গজলকার মীর দর্দের পাশাপাশি সংগীতচিন্তক হিসেবে তাঁর পরিচয়টাও আমরা জানতে পারব।
অন্য আলো–য় লিখতে পারেন আপনিও। গল্প, কবিতা, প্রবন্ধসহ আপনার সৃজনশীল, মননশীল যেকোনো ধরনের লেখা পাঠিয়ে দিন। পাঠাতে পারেন প্রকাশিত লেখার ব্যাপারে মন্তব্য ও প্রতিক্রিয়া।ই–মেইল: [email protected]