ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের নয়নাভিরাম পাহাড়ি পর্যটনকেন্দ্র পেহেলগামে মঙ্গলবার সন্দেহভাজন বিদ্রোহীরা অন্তত ২৬ জন পর্যটককে হত্যা করেছেন।
গত ২৫ বছরে এটি কাশ্মীরে ঘটা সবচেয়ে ভয়াবহ হামলা, যা কিনা ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক আরও খারাপ দিকে নিয়ে যাওয়ার আশঙ্কাকে বাড়িয়ে দিয়েছে।
হামলাটি ঘটেছে কাশ্মীরের দক্ষিণ অনন্তনাগ জেলায়। হামলার সময় পুরো অঞ্চলটি পর্যটকে ভরপুর ছিল।
যদিও গত তিন দশক ধরে কাশ্মীর বিদ্রোহ ও সংঘাতের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তবু প্রতিবছরের মতো এবারও লাখ লাখ পর্যটক এখানে ছুটি কাটাতে এসেছেন।
হামলার পরপরই পুলিশ ও আধা সামরিক বাহিনী দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়ে আহত ব্যক্তিদের উদ্ধার করে এবং হামলাকারীদের ধরতে অভিযান শুরু করে।
ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ও দেশের শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তারা সেখানে উড়ে যান।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সৌদি আরব সফর সংক্ষিপ্ত করে দেশে ফিরে আসেন এবং আজ বুধবার সকালে এই হামলার জবাব কীভাবে দেওয়া হবে, তা ঠিক করতে জরুরি বৈঠক করেন।
ঘটনাটি এমন সময়েই ঘটেছে, যখন যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স ভারতে সফরে আছেন। তিনি সোমবার এসেছেন এবং বৃহস্পতিবার (আগামীকাল) তাঁর ফিরে যাওয়ার কথা।
এই হামলায় কী কী ঘটেছে, কারা হতাহত হয়েছেন, কারা এর পেছনে আছে, কেন এই হামলা হলো, এর পটভূমি কী এবং এর ফলে কাশ্মীর ও গোটা অঞ্চলের জন্য কী বার্তা বহন করছে—সব বিষয় নিয়েই এখন বিশ্লেষণ চলছে।
ভারত কীভাবে এই ঘটনার জবাব দেবে, তা নিয়েও অনেক আলোচনা চলছে।
আরও পড়ুনমোদি আপাতত ব্যর্থ, কাশ্মীর কি মর্যাদা ফিরে পাবে১৪ অক্টোবর ২০২৪ঘটনা যেভাবে ঘটলকাশ্মীরি ভাষায় ‘পেহেলগাম’-এর অর্থ ‘মেষপালকদের উপত্যকা’। এটি কাশ্মীরের সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটন এলাকাগুলোর একটি। এলাকাটি রাজধানী শ্রীনগর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
প্রত্যক্ষদর্শীরা আল–জাজিরাকে জানান, মঙ্গলবার দুপুরে ওই এলাকায় অনেক পর্যটক ভিড় করেছিলেন।
বেলা পৌনের তিনটার দিকে একটি জঙ্গল থেকে ছদ্মবেশী পোশাক পরা কয়েকজন সশস্ত্র ব্যক্তি বেরিয়ে আসে।
নিজের পরিচয় প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা বলেছেন, হামলাকারীরা বাইসারান নামের একটি পাহাড়ি খোলা এলাকায় হঠাৎ এলোপাতাড়ি গুলি চালায়।
এই জায়গায় পায়ে হেঁটে বা ঘোড়ায় চড়ে যাওয়া যায়। তিনি বলেন, এ সময় অনেক পর্যটক গুলির শব্দে হতভম্ব হয়ে পড়েন।
মহারাষ্ট্রের নাগপুর থেকে আসা পর্যটক সিমরন চাঁদনি বলেন, তিনি যে বেঁচে ফিরতে পারবেন, তা ভাবতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘আমরা সবে চা আর নুডলস খেয়ে রওনা হচ্ছিলাম, ঠিক তখনই হামলা শুরু হয়।’ পেহেলগামকে তিনি ‘ছোট সুইজারল্যান্ড’ বলেও উল্লেখ করেন।
সিমরন চাঁদনি বলেন, ‘এরপর সবকিছু বদলে যায়। দেখি, অনেক মানুষ নিচে নেমে আসছেন। আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম, হয়তো গ্যাসবেলুন ফেটেছে। সবাই একজন আরেকজনকে ধাক্কা দিচ্ছিলেন। এরপর কেউ একজন জানান, হামলা হয়েছে।’
তিনি জানান, হামলাকারীরা মূলত পুরুষদের লক্ষ্য করে গুলি চালাচ্ছিল। চাঁদানি বলেন, ‘আমি তখন ভগবানের নাম নিয়ে দৌড়াচ্ছিলাম।’
সন্ত্রাসী হামলায় নিহত আদিল হুসাইন শাহের জানাজার নামাজ পড়ানো হচ্ছে। ২৩ এপ্রিল দক্ষিণ কাশ্মীরের অনন্তনাগ জেলার হাপতনার গ্রামে এই জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
৫০ শয্যার থানচি হাসপাতাল চলছে একজন চিকিৎসকে
বান্দরবানের থানচি উপজেলার প্রায় ৩০ হাজার মানুষের একমাত্র ভরসার জায়গা ৫০ শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সংকটে এই হাসপাতাল কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। বর্তমানে পুরো হাসপাতাল চালাচ্ছেন মাত্র একজন চিকিৎসক। গত পাঁচবছরে চিকিৎসাধীন ও রেফার্ড করা ২৪ জন রোগী মারা গেছেন।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, ১৯৯৫ সালে ৩১ শয্যার থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স যাত্রা শুরু করে। পরে এটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হয়। এই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১২ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও কর্মরত আছেন মাত্র দুইজন। তাদের মধ্যে একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন। এ কারণে রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ১৮ জন নার্স পদে রয়েছেন মাত্র চারজন। চারজন মিডওয়াইফ থাকার কথা, নেই একজনও।
আরো পড়ুন:
ফরিদপুরে পাগলা ঘোড়ার কামড়ে আহত ২০
বক্তব্য দেওয়ার সময় অসুস্থ হয়ে পড়লেন কাদের সিদ্দিকী
প্রাথমিক থেকে শুরু করে জরুরি চিকিৎসার জন্য এই হাসপাতালে ছুটে যান পাহাড়ি ও বাঙালিরা। তাদের অভিযোগ, হাসপাতালটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও আধুনিক চিকিৎসা সুবিধা যোগ হয়নি। প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক না থাকায় গর্ভবতী নারী, শিশু ও বৃদ্ধ রোগীরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ছেন।
দুর্গম এলাকার রোগীরা অনেক সময় নদীপথ কিংবা পাহাড়ি রাস্তা পাড়ি দিয়ে হাসপাতালে এলেও কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসা সেবা পান না। বরং তাদের বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। অনেক সময় বান্দরবানে যাওয়ার পথে রোগীরা মারা যান। এ কারণে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহের দাবি জানিয়েছেন তারা।
হাসপাতালের পরিসংখ্যানবীদ পঙ্কজ বড়ুয়া জানান, ২০২০ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত এখানে ভর্তি হয়েছেন ৫ হাজার ১৯৮ জন রোগী। এর মধ্যে ৪৫৬ জনকে রেফার্ড করা হয় বান্দরবান সদর হাসপাতালে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ১৭ জন রোগী।
থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্স চালক মংক্যসিং মারমা বলেন, “২০১৯ সালে চাকরিতে যোগদান করার পর থেকে অন্তত সাতজন রেফার্ড করা রোগী মাঝপথে আমার গাড়িতেই মারা গেছেন।”
শৈসাই মং মারমা তিন বছর আগে বিনা চিকিৎসায় তার মাকে মারা যেতে দেখেছেন। তিনি জানান, তার মা শৈমেপ্রু মারমা (৩৪) অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর হঠাৎ তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। রেমাক্রী বাজার থেকে নদীপথে থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান মাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে জেলা সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। ভাড়া গাড়িতে জেলা হাসপাতালে যাওয়ার সময় চিম্বুক বারো মাইল এলাকায় তার মা মারা যান।
লেংরু ম্রো নামে চার সন্তানের মা হারিয়েছেন স্বামীকে। তিনি জানান, তার স্বামী রেং য়ুং ম্রো (৪৫) কিডনি জটিলতা নিয়ে থানচি হাসপাতালে যান। সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে তাকে বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। থানচি থেকে বান্দরবান যাওয়ার মাঝপথে মারা যান তার স্বামী।
স্থানীয় বাসিন্দা মংমে মারমা বলেন, “হাসপাতালে চিকিৎসক, ওষুধ ও যন্ত্রপাতির সংকট দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বদলি হলেও অনেকেই থানচিতে যোগ দেন না, ডিপুটেশনে থেকে যান সদর হাসপাতালে। ফলে এ অঞ্চলের পাহাড়ি ও বাঙালি প্রায় ৩০ হাজার মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।”
রিয়েং ম্রো নামে অপর বাসিন্দা বলেন, “পাহাড়ে বসবাসকারীদের অধিকাংশ গরিব। জেলা সদর হাসপাতালে রোগী নিয়ে যাওয়া ব্যয়বহুল ও কষ্টকর। রেমাক্রি, বড় মোদক, তিন্দু থেকে থানচি সদরে রোগী আনতেই অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়। এরপর আবার বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করলে সাধারণ মানুষ কীভাবে চিকিৎসা করাবে?”
থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএইচএফপিও) ডা. মো. ওয়াহিদুজ্জামান মুরাদ বলেন, “বর্তমানে হাসপাতালে আমিসহ দুইজন চিকিৎসক রয়েছেন। একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসাধীন। তিন রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ফলে পুরো হাসপাতাল পরিচালনার দায়িত্ব আমাকে একাই সামলাতে হচ্ছে।”
তিনি আরো বলেন, “জনবল ও সরঞ্জাম সংকটের কারণে গুরুতর রোগীদের রেফার্ড করা ছাড়া উপায় থাকে না। দীর্ঘ পথের কারণে অনেকেই জীবিত অবস্থায় সদর হাসপাতালে পৌঁছাতে পারেন না।”
বান্দরবান জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ শাহীন হোসাইন চৌধুরী বলেন, “শুধু বান্দরবান নয়, পুরো তিন পার্বত্য জেলাতেই চিকিৎসক সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। নতুন করে ৪৮তম বিসিএসের ডাক্তার পদায়ন না হওয়া পর্যন্ত এই সংকট পুরোপুরি সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না। তারপরও বিভাগীয় প্রধানকে বিষয়টি চিঠির মাধ্যমে জানানো হয়েছে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের আট-দশজন চিকিৎসককে বান্দরবানে বদলি করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”
ঢাকা/মাসুদ