রাউজানে খুনোখুনি রাজনৈতিক কারণে নয়, নেপথ্যে চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি
Published: 26th, April 2025 GMT
রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর চট্টগ্রামের রাউজানে সাম্প্রতিক সময়ে যেসব খুনোখুনির ঘটনা ঘটছে সেগুলো রাজনৈতিক কারণে নয়, বরং মাটি কাটা, বালু উত্তোলন, টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজির কারণে এসব ঘটনা ঘটছে বলে দাবি করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক গোলাম আকবর খোন্দকার।
আজ শনিবার বেলা সাড়ে ১১টায় নগরীর নাসিমন ভবনে দলীয় কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলন তিনি এই দাবি করেন। এ সময় গোলাম আকবর খোন্দকার বলেন, ‘রাউজানে সন্ত্রাসীরা চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজির টাকায় বিপুল অস্ত্রশস্ত্র কিনছে এবং প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের পর মামলার আসামি করা নিয়ে টাকা দাবি করা হচ্ছে। এ থেকেই বোঝা যায় হত্যাকাণ্ডগুলো রাজনৈতিক কারণে ঘটছে না। এর পেছনে অন্য কারণ রয়েছে।’
গেল সপ্তাহে রাউজানে সংগঠিত মানিক আব্দুল্লাহ ও ইব্রাহীম হত্যাকাণ্ড নিয়ে গোলাম আকবর দাবি করেন, সেই হত্যাকাণ্ড দুটি রাজনৈতিক কারণে হয়নি। মাটি কাটা ও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে এসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।’
প্রসঙ্গত, সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলায় অন্তত ১২টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। যার মধ্যে বেশিরভাগই রাজনৈতিক কারণে ঘটেছে বলে মনে করেন এলাকার মানুষ। আর বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী ও দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও চট্টগ্রাম উত্তর জেলা কমিটির আহ্বায়ক গোলাম আকবর খোন্দকারের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণে এসব ঘটনা ঘটছে বলেও এলাকায় প্রচার রয়েছে। কারণ, হতাতদের বড় একটি অংশ তাদের অনুসারি হিসেবে পরিচিত।
এই বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ঘটনাপ্রবাহে অনেক তথ্য পত্রিকায় আসে, যেগুলো পুরোপুরি সঠিক নয়। পত্রিকায় যেসব ঘটনা আসে সেগুলো প্রকৃত ঘটনাকে আড়াল করে। ফলে সাধারণ মানুষ অধিকার রাখে প্রকৃত ঘটনা কী, তা জানার। এ জন্য সংবাদ সম্মেলন করে বিষয়টি পরিস্কার করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব এবং আগামী দিনের মনোনয়নের কারণে সাম্প্রতিক সময়ে রাউজানে সংগঠিত হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটছে বলে পত্রিকায় আসছে। কিন্তু কেন এ হত্যাকাণ্ড ঘটছে- তার সত্য জানা এবং আগামীতে যেন এ ধরনের হত্যাকাণ্ড না হয় তার ব্যবস্থা গ্রহণ দরকার।
পরিস্কারভাবে আমি বলতে পারি, রাউজানে যে হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটেছে সেগুলো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা কিংবা কোন নেতার দ্বন্দ্বের কারণে ঘটেনি।’
সংবাদ সম্মেলনে গোলাম আকবর খোন্দকার বলেন, রাউজানে মূলত হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়েছিল ১৯৮৫ সালে কলেজছাত্র ফারুক হত্যার মাধ্যমে। এ পর্যন্ত শতাধিক ছাত্র-যুবকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। সেসময় ছাত্রলীগ ও আধুনালুপ্ত এনডিপির সন্ত্রাসীরা এসব হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল। এবার দেশে পট পরিবর্তনের পর থেকে নতুনভাবে হত্যাকাণ্ড শুরু হয়েছে। এগুলোর মূল কারণ হচ্ছে- মাটি কাটা, বালু উত্তোলন, বালুর মহাল দখল, বিক্রির দ্বন্দ্ব, চাঁদাবাজি। এছাড়া সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের ঠিকাদার থেকে কমিশন বাণিজ্য করার প্রতিযোগিতা, সাধারণ ব্যবসায়ীদের তালিকা করে চাঁদা করা, না দিলে বাড়ি ঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে আগুন দেওয়ার মত ঘটনাও ঘটছে। বিভিন্ন উপায়ে সন্ত্রাসীরা টাকা জোগাড় করে সেগুলো দিয়ে অস্ত্র কিনছে। যেগুলো হত্যাকাণ্ডে ব্যবহার হচ্ছে। আর সন্ত্রাসীরা নিজেদের কর্মকাণ্ডকে আড়াল করার জন্য রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় বিএনপির নাম ব্যবহার করছে।’
এসব বিষয়ে দলীয় নেতাকর্মীদের সজাগ থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘কোন সন্ত্রাসী দলের নেতাকর্মী হতে পারে না। আবার প্রকৃত নেতাকর্মীরাও সন্ত্রাসী হতে পারে না। কেউ যদি অপরাধ করে বিএনপির নেতাকর্মীর মধ্যে ঢুকে যান তাহলে আমাদের তা ফাইন্ড আউট করা উচিত এবং সেটাকে যথোপুযক্ত শাস্তি দেওয়া উচিত।’
রাউজানের হত্যাকাণ্ডগুলোর পর মামলায় আসামি করা নিয়ে টাকা দাবির অভিযোগও করেন চট্টগ্রামের গোলাম আকবর খোন্দকার। তিনি বলেন, রাউজানে যেসব হত্যাকাণ্ড হয়েছে, সেগুলোতে পরবর্তীতে আসামি দেওয়ার জন্য তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। কাকে কাকে আসামি করা হবে, কাকে আসামি করলে টাকা আদায় করা যাবে, সেটা নিয়ে রীতিমতো গবেষণা শুরু হয়ে যায়।’ এভাবে কী কারণে এসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, তা তুলে ধরেন তিনি।
সাধারণ মানুষ থানায় যেতে পারে না অভিযোগ করে গোলাম আকবর বলেন, ‘কয়েকদিন আগে জেলা যুবদেলের সভাপতির নেতৃত্বে ১৫ জন উপজেলা প্রশাসনে যান, সেখানকার কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করার জন্য। সেখানে তাদের ওপর হামলা হয়েছে। তাদের বলা হয়েছে, সেখানে যেতে পারবে না। সেটা নেতার নির্দেশ। আর এটা কোন নেতার নির্দেশ, সেটা সবাই ভালো করে জানেন।’
এ সময় ইটভাট, মাটি কাটা, বালু উত্তোলন ও গাছের গাড়ি থেকে চাঁদাবাজির টাকা কার পকেটে যায়- এই প্রশ্নও তুলেন তিনি। সাংবাদিকরা তার কাছে জানতে চান- এসব ঘটনার সঙ্গে গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী জড়িত কিনা? তখন তিনি বলেন, ‘আমি দলের দায়িত্বে আছি। যারা নিহত হচ্ছে এবং হত্যার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড দেখলে বুঝবেন, এসবের সঙ্গে কারা জড়িত।’
সংবাদ সম্মেলনে রাউজানের বৈধ-অবৈধ বালু উত্তোলন কয়েক মাস বন্ধ রাখা, মাটি কাটা বন্ধ রাখতে প্রশাসনের কাছে দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, এগুলো করা হলে রাউজানের সমস্যা ৯০ শতাংশ হ্রাস পাবে।
সংবাদ সম্মেলনে অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন উত্তর জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্প্দাক এম এ হালিম, অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউনুস, কাজী সালাউদ্দিন, নুরুল আমিন, প্রকৌশলী বেলায়েত হোসেন, ফটিকছড়ি উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল আজিমুল্লাহ বাহার, রাউজানের সভাপতি বিএনপি অধ্যাপক জসীম চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন প্রমুখ।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ন ত কর ম দ বন দ ব ব এনপ র সব ঘটন
এছাড়াও পড়ুন:
আসামি না হয়েও স্বেচ্ছায় কারাগারে যাওয়া সেই যুবক প্রতারণা মামলায় গ্রেপ্তার
চট্টগ্রামে মাদকের একটি মামলায় আসামি সেজে আদালতে আত্মসমর্পণের পর কারাগারে যাওয়া এক যুবককে জালিয়াতি ও প্রতারণার মামলায় গ্রেপ্তার (শ্যোন অ্যারেস্ট) দেখিয়েছেন আদালত। তাঁর নাম মো. রাকিব। পুলিশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আজ মঙ্গলবার দুপুরে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট এস এম আলাউদ্দিন মাহমুদ শুনানি শেষে এই আদেশ দেন। কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে প্রকৃত আসামি মো. সুমনের হয়ে আদালতে স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করেন রাকিব। আদালতের আদেশে ১ জুলাই থেকে তিনি কারাগারে রয়েছেন।
নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (প্রসিকিউশন) মফিজ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, কারাগারে আটক রাকিবকে জালিয়াতি ও প্রতারণা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন করে কোতোয়ালি থানা-পুলিশ। শুনানি শেষে আদালত তা মঞ্জুর করেন। আসামিকে রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছে।
আদালত সূত্র জানায়, ২০২৪ সালের ৩১ আগস্ট নগরের আকবর শাহ থানার কৈবল্যধাম এলাকায় একটি পিকআপ ভ্যানে অভিযান চালিয়ে ৪০ কেজি গাঁজা উদ্ধার করে র্যাব, যার মূল্য ৪ লাখ টাকা। ঘটনাস্থল থেকে গ্রেপ্তার করা হয় গাড়িচালক রাহাত ইসলামকে। পালিয়ে যান চালকের সহকারী (হেলপার) মো. সুমন। এ ঘটনায় র্যাব কর্মকর্তা বাদী হয়ে আকবর শাহ থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করেন। তদন্ত শেষে চলতি বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ। এতে রাহাত ইসলাম ও মো. সুমনকে আসামি করা হয়।
আদালত পুলিশের দেওয়া অভিযোগপত্রটি গ্রহণ করে পলাতক আসামি সুমনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। এরই মধ্যে সুমনের গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনার পূর্বধলা এলাকায় অভিযান চালায় পুলিশ। বিষয়টি জানতে পেরে সুমন নিজেকে কারামুক্ত রাখতে তাঁর পরিবর্তে নোয়াখালীর রাকিবকে আদালতে আত্মসমর্পণ করায় ১ জুলাই। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. মোস্তফা শুনানি শেষে আসামির জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠান। সুমনের হয়ে রাকিব আত্মসমর্পণের সময় তাঁর পক্ষে আইনজীবী ছিলেন ওয়াহিদ মুরাদ।
আদালতে একজনের পরিবর্তে আরেকজন আত্মসমর্পণের বিষয়টি ধরা না পড়লেও কারাগারে গিয়ে ধরা পড়ে। জাতীয় পরিচয়পত্রের ডেটাবেজে (তথ্যভান্ডার) ভোটারদের আঙুলের ছাপ সংরক্ষিত আছে। এ পদ্ধতিকে বলা হয় ফিঙ্গারপ্রিন্ট আইডেনটিফিকেশন অ্যান্ড ভেরিফিকেশন সিস্টেম। ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এ পদ্ধতি ব্যবহার শুরু করে চট্টগ্রাম কারা কর্তৃপক্ষ। এরই মধ্যে আঙুলের ছাপে ধরা পড়েছে অনেক বন্দীর আসল পরিচয়। এসব ঘটনায় মামলাও হয়েছে। ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি মাসের জুলাই পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করে জালিয়াতির মাধ্যমে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে আসা ১৬ জনের আঙুলের ছাপে শনাক্ত করা হয়।
চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ তত্ত্বাবধায়ক মো. ইকবাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, আদালত থেকে কারাগারে আসা প্রত্যেক নতুন আসামির আঙুলের ছাপ নেওয়া হয়। সেখানে আসামির জাতীয় পরিচয়পত্রে থাকা আসল পরিচয় উঠে আসে। ইকবাল হোসেন আরও বলেন, ‘সুমনের হয়ে কারাগারে আসা রাকিব স্বীকার করেছেন তিনি মাদক মামলার প্রকৃত আসামি নন। ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে তিনি সুমন সেজেছেন। তাঁকে বলা হয়েছে, দ্রুত কারাগার থেকে ছাড়িয়ে নেওয়া হবে। তাই তিনি রাজি হয়েছেন। বিষয়টি চিঠি দিয়ে আদালতকে জানানো হয়েছে।’
আরও পড়ুনচট্টগ্রামে ‘আয়নাবাজি’, ধরা পড়েছে আঙুলের ছাপে০৮ নভেম্বর ২০২৩কারাগার থেকে চিঠি পাওয়ার পর মামলা করার নির্দেশ দেন চট্টগ্রাম চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কাজী মিজানুর রহমান। একই সঙ্গে আসামিকে আত্মসমর্পণকারী আইনজীবী ওয়াহিদ মুরাদের কাছে কারণ ব্যাখ্যা চেয়েছেন আদালত। আদালতের প্রসিকিউশন শাখার আকবর শাহ থানার জিআরও সাইদুর রহমান বাদী হয়ে গত রোববার রাতে নগরের কোতোয়ালি থানায় প্রতারণা ও জালিয়াতির অভিযোগে মামলা করেন। মামলায় মো. রাকিব ও মো. সুমনকে আসামি করা হয়। সুমন এখনো পলাতক।