জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত হত্যা, গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে শহীদ পরিবারসহ নানা মহলে অসন্তোষ রয়েছে। অথচ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক পদে এক মাসের বেশি সময় ধরে কেউ নেই।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন অনুযায়ী, ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় সমন্বয়ক নিয়োগ দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের। সমন্বয়কের কাজ হলো তদন্ত সংস্থার সার্বিক কার্যক্রম তদারকি করা। ট্রাইব্যুনালের বিদ্যমান কার্যবিধি অনুযায়ী, মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্তের জন্য ‘নীতিগতভাবে দায়ী’ তদন্ত সংস্থা। আইনে বলা আছে, তদন্ত সংস্থাকে দক্ষভাবে পরিচালনার জন্য অন্য যেকোনো কাজ সম্পন্ন করাও সমন্বয়কের দায়িত্ব।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা পুনর্গঠন করা হয়। পুনর্গঠিত তদন্ত সংস্থায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলাগুলো তদন্তের জন্য সমন্বয়ক পদে নিয়োগ দেওয়া হয় মো.

মাজহারুল হককে। তিনি পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (অ্যাডিশনাল ডিআইজি)।

আমাদের কাছে যখন তদন্ত সংস্থা তদন্ত প্রতিবেদন দেবে, সেটার পর থেকে চিফ প্রসিকিউটরের কাজ শুরু হবে। তদন্ত করার কাজটা কমপ্লিটলি (সম্পূর্ণভাবে) তদন্ত সংস্থার ওপর। সে কারণে তদন্ত সংস্থা রিপোর্ট না দেওয়া পর্যন্ত চিফ প্রসিকিউটর তাড়াতাড়ি করে মামলা হেয়ারিং (শুনানি) করতে পারেন নাট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম

নিয়োগের প্রায় পাঁচ মাসের মাথায় গত ১৩ ফেব্রুয়ারি মাজহারুল হককে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে পদায়ন করা হয়। তবে এ–সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে প্রক্রিয়াগত ভুল ছিল। তবে তখন থেকেই ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা ‘ছাড়ার প্রস্তুতি’ শুরু করেন তিনি। প্রজ্ঞাপন সংশোধন করে পুনরায় আদেশ জারি করতে দুই মাসের বেশি সময় লাগে।

অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত হবে দক্ষতা ও যোগ্যতাসম্পন্ন কোনো ব্যক্তিকে তদন্ত সংস্থার প্রধান (সমন্বয়ক) হিসেবে দ্রুত নিয়োগ দেওয়া। —রবিউল আউয়াল সাধারণ সম্পাদক ‘জুলাই ২৪ শহীদ পরিবার সোসাইটি’

মাজহারুল হক ২৪ এপ্রিল প্রথম আলোকে বলেন, গত ১৯ মার্চ সংশোধিত প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রণালয়। এর পরের দিনই তিনি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের জাতীয় নিরাপত্তাসংক্রান্ত সেলে যোগ দেন।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, জাতীয় নিরাপত্তাসংক্রান্ত সেলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে এখন দায়িত্ব পালন করছেন মাজহারুল হক।

তদন্তের অগ্রগতিতে অসন্তোষ

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে হত্যা, গণহত্যা এবং আওয়ামী লীগ সরকারের বিগত সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে গুম, খুনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করা হচ্ছে।

বিচারের অগ্রগতিতে অসন্তোষ প্রকাশসহ বেশ কিছু দাবিতে গত ২৪ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাব্যুনালের সামনে বিক্ষোভ করেন শহীদ পরিবারের সদস্যরা। এর পরদিন ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘আমাদের কাছে যখন তদন্ত সংস্থা তদন্ত প্রতিবেদন দেবে, সেটার পর থেকে চিফ প্রসিকিউটরের কাজ শুরু হবে। তদন্ত করার কাজটা কমপ্লিটলি (সম্পূর্ণভাবে) তদন্ত সংস্থার ওপর। সে কারণে তদন্ত সংস্থা রিপোর্ট না দেওয়া পর্যন্ত চিফ প্রসিকিউটর তাড়াতাড়ি করে মামলা হেয়ারিং (শুনানি) করতে পারেন না।’

বিচারের ধীরগতি নিয়ে শহীদ পরিবারের স্বজনেরা গত আট মাসে সড়ক অবরোধসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছেন, এখনো করছেন।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আট মাসের বেশি সময় পর তদন্ত সংস্থা প্রথম কোনো মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন জমা হয় ২০ এপ্রিল। এ মামলার তদন্ত শেষ করতে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার সময় লেগেছে ৬ মাস ১৩ দিন। রাজধানীর চানখাঁরপুলে গুলি করে ছয়জনকে গণহত্যার (৫ আগস্টের ঘটনা) ঘটনায় ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে তদন্ত সংস্থা। এই তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে তা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) আকারে দাখিলের জন্য ট্রাইব্যুনালের কাছে এক মাস সময় নিয়েছেন চিফ প্রসিকিউটর। আগামী ২৫ মে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল হলে এবং ট্রাইব্যুনালে তা গ্রহণ করলে এই মামলার মধ্য দিয়ে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আনুষ্ঠানিক বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হবে।

তদন্ত সংস্থায় সমন্বয়ক পদে নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব পদ মর্যাদার একজন কর্মকর্তা গতকাল রোববার প্রথম আলোকে বলেন, অবসরপ্রাপ্ত একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবটি প্রক্রিয়াধীন।

ওই কর্মকর্তা বলেন, এর আগে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক পদে নিয়োগ দিয়েছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তবে এখন থেকে এই কাজটি করবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

যা বলছে প্রসিকিউশন

গণ-অভ্যুত্থানের পর যখন ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা পুনর্গঠন করা হয়, তখন তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন ১০ জন। ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, এখন ২৫ জন তদন্ত কর্মকর্তা রয়েছেন।

তদন্ত সংস্থায় সহসমন্বয়ক হিসেবে আছেন মুহম্মদ শহীদুল্যাহ চৌধুরী। উপপরিচালক পর্যায়ের কর্মকর্তা রয়েছেন ছয়জন। সহকারী পরিচালক হিসেবে আছেন তিনজন। ১৫ জন আছেন উপসহকারী পরিচালক হিসেবে।

তদন্ত সংস্থার তদন্ত কার্যক্রম দেখভাল করে থাকে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন (রাষ্ট্রপক্ষ)। ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটরদের মধ্যে তদন্ত সংস্থায় সমন্বয়ক না থাকা নিয়ে দুই ধরনের মতামত পাওয়া যাচ্ছে। একটি পক্ষ বলছে, সমন্বয়ক না থাকায় তদন্ত কার্যক্রম কিছুটা ব্যাহত হচ্ছে। আরেকটি পক্ষ বলছে, সমন্বয়ক না থাকলেও খুব একটা সমস্যা হচ্ছে না।

নাম না প্রকাশের শর্তে একজন প্রসিকিউটর প্রথম আলোকে বলেন, ট্রাইব্যুনালের তদন্ত কার্যক্রমে মূলত তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক ও সহসমন্বয়ক সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকেন। সমন্বয়ক না থাকায় সহসমন্বয়কের ওপর বেশি চাপ পড়ছে। তা ছাড়া প্রধান (সমন্বয়ক) না থাকলে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স (ভারসাম্য) কম থাকে। আগে যেখানে দুজনে মিলে সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন, এখন সেই সুযোগ থাকছে না।

ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর (প্রশাসন) গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামীমের দাবি, তদন্ত সংস্থায় সমন্বয়ক না থাকলেও তদন্তের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে না। তবে তিনি বলেন, সরকার যদি শিগগিরই সমন্বয়ক পদে কাউকে নিয়োগ দেয়, তাহলে কাজের ক্ষেত্রে আরও সুবিধা হবে।

জুলাই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ট্রাইব্যুনালে করা বিভিন্ন মামলার তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে আসছেন শহীদ পরিবারের সদস্যরা। বিচারের ধীরগতি নিয়ে শহীদ পরিবারের স্বজনেরা গত আট মাসে সড়ক অবরোধসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছেন, এখনো করছেন। বিভিন্ন সংগঠনও বিচার দৃশ্যমান করার দাবিতে আন্দোলন করে আসছে। যেমন ২১ এপ্রিল আইন উপদেষ্টার কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে জুলাই রেভল্যুশনারি অ্যালায়েন্স, অ্যান্টি ফ্যাসিস্ট কোয়ালিশন, প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ, স্টুডেন্ট অ্যালায়েন্স ফর ডেমোক্রেসি এবং জুলাই যোদ্ধাদের প্রতিনিধিরা।

দ্রুত নিরপেক্ষ তদন্ত ও দৃশ্যমান বিচার কার্যক্রম শুরু করতে হবে উল্লেখ করে ওই স্মারকলিপিতে বলা হয়, ‘দুঃখজনক হলেও সত্য, এই গণহত্যার বিচার এখনো শুরু হয়নি।’

শহীদ পরিবারের সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত একটি সংগঠন ‘জুলাই ২৪ শহীদ পরিবার সোসাইটি’। এর সাধারণ সম্পাদক রবিউল আউয়াল। তাঁর ছোট ভাই ইমাম হাসান ভূঁইয়া (তাইম) গত ২০ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলার সময় যাত্রাবাড়ীর কাজলা পদচারী-সেতুর কাছে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন।

রবিউল আউয়াল প্রথম আলোকে বলেন, ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অথচ সেখানে দীর্ঘদিন সমন্বয়ক নেই। এতে তদন্ত কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। দলনেতা ছাড়া কোনো কাজই সম্পূর্ণ হয় না। যিনি প্রধান, তাঁর কাজ অন্য কেউই সেভাবে করতে পারবেন না। অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত হবে দক্ষতা ও যোগ্যতাসম্পন্ন কোনো ব্যক্তিকে তদন্ত সংস্থার প্রধান (সমন্বয়ক) হিসেবে দ্রুত নিয়োগ দেওয়া।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: তদন ত স স থ র স ম নবত ব র ধ প রথম আল ক সমন বয়ক ন কর মকর ত তদন ত কর ন মন ত র ন তদন ত অপর ধ র তদন ত র অসন ত ষ গণহত য র জন য র প রস অন য য় র সমন

এছাড়াও পড়ুন:

ডলার ও বিদেশিদের ব্যাংক হিসাবে আমানত এক বছরে বেড়ে দ্বিগুণ

হঠাৎ করে দেশে অবস্থানকারী বিদেশিরা বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যাংকে অর্থ জমার পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছেন। আবার বাংলাদেশিরাও দেশের ব্যাংকগুলোতে আগের চেয়ে বেশি বিদেশি মুদ্রা জমা রাখছেন। এতে ব্যাংকগুলোতে বিদেশি মুদ্রার যে হিসাব আছে, সেটিও বাড়ছে অন্যান্য আমানত হিসাবের চেয়ে বেশি। গত এক বছরে দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে বিদেশি মুদ্রায় রক্ষিত আমানত বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। যদিও বিদেশি মুদ্রার বাইরে দেশীয় মুদ্রার আমানত হিসাবে এক বছরে আমানত বেড়েছে ১ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। সম্প্রতি প্রকাশিত ব্যাংকগুলোর আর্থিক তথ্য নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ত্রৈমাসিক এক প্রতিবেদন থেকে এই তথ্য পাওয়া গেছে।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, মূলত ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে এসব হিসাবে অর্থ জমা বেশি বেড়েছে। এর ফলে ঘরে রাখা ডলার ও অন্যান্য বিদেশি মুদ্রা আবার ব্যাংকে ফিরতে শুরু করেছে। এটা শুরু হয়েছে আবাসিক বৈদেশিক মুদ্রা আমানত বা রেসিডেন্ট ফরেন কারেন্সি ডিপোজিট (আরএফসিডি) হিসাব ও বৈদেশিক মুদ্রার হিসাবের ওপর সুদসহ বাড়তি সুবিধা দেওয়ার কারণে।

আমানত কতটা বাড়ল

দেশের ব্যাংকগুলোতে নানা ধরনের আমানত পণ্য রয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে দেশি ও বিদেশিদের জন্য পৃথক আমানত পণ্য। বিদেশি মুদ্রার জন্য রয়েছে পৃথক আমানত পণ্য। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে অবস্থান করা বিদেশিদের জমা অর্থের পরিমাণ এক বছরে বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। বিদেশিরা সাধারণত বিদেশি মুদ্রাকে টাকায় রূপান্তর করে এই ধরনের হিসাব পরিচালনা করেন, ব্যাংকের ভাষায় এসব হিসাবকে কনভার্টেবল টাকা অ্যাকাউন্ট অব ফরেনার্স বা বিদেশিদের জন্য টাকায় রূপান্তরযোগ্য হিসাব বলা হয়। ২০২৪ সালের মার্চে এই ধরনের হিসাবে জমা ছিল ১ হাজার ৮০৪ কোটি টাকা, গত মার্চ শেষে তা বেড়ে হয়েছে ৩ হাজার ৮৫৯ কোটি টাকা।

একইভাবে বৈদেশিক মুদ্রার হিসাবেও (এফসিএ) জমা অর্থের পরিমাণ বেড়েছে। গত বছরের মার্চে এই ধরনের হিসাবে জমা ছিল ৬ হাজার ৫৪ কোটি টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা। গত ডিসেম্বর শেষে তা বেড়ে হয়েছে ১৪ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার সমপরিমাণ। আমদানি-রপ্তানির কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোই সাধারণ এফসিএ হিসাব খুলে থাকে। প্রবাসী বাংলাদেশিরাও এ ধরনের হিসাব খুলতে পারেন।

এ ছাড়া শুধু প্রবাসীদের জন্য আলাদা আমানত হিসাবও রয়েছে, তাতে স্থিতি খুব বেশি বাড়েনি। গত বছরের মার্চে প্রবাসীদের আমানত হিসাবে স্থিতির পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৪৭৭ কোটি টাকা, যা গত মার্চে বেড়ে হয়েছে ৪ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকা।

অন্যদিকে বিদেশ সফর শেষে দেশে ফেরত আসা বাংলাদেশিদের বৈদেশিক মুদ্রার হিসাবে (আরএফসিডি) আমানতও বেড়েছে। গত বছরের মার্চে এই ধরনের হিসাবে আমানত ছিল ২৬ হাজার ১৩০ কোটি টাকা, যা গত মার্চে বেড়ে হয়েছে ৩৩ হাজার ২৭৩ কোটি টাকা।

তবে সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে আমানত সেভাবে বাড়েনি। ২০২৪ সালের মার্চে পুরো খাতে আমানত ছিল ১৭ লাখ ৬২ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা, যা গত মার্চে বেড়ে হয় ১৯ লাখ ২৩ হাজার ৫০৪ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংক খাতে আমানত বেড়েছে ১ শতাংশের কিছু বেশি।

কেন বাড়ছে ডলার ও বিদেশিদের জমা অর্থ

দেশে ডলার–সংকট দেখা দেওয়ায় ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে মানুষের ঘরে থাকা ডলার ব্যাংকে ফেরাতে আবাসিক বৈদেশিক মুদ্রা আমানত বা রেসিডেন্ট ফরেন কারেন্সি ডিপোজিট (আরএফসিডি) হিসাবের ওপর সুদসহ বাড়তি সুবিধা দেওয়ার সুযোগ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপরই দি সিটিসহ কিছু ব্যাংক বাড়তি উদ্যোগ নিয়ে এই ধরনের হিসাব খুলতে শুরু করে। বর্তমানে নগদ ডলারের বড় অংশ মজুত আছে ইস্টার্ন, দি সিটি, ব্র্যাক, ডাচ্-বাংলা, প্রাইম, পূবালী, বহুজাতিক স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ও এইচএসবিসি এবং দেশীয় মালিকানাধীন ইসলামীসহ আরও কয়েকটি ব্যাংকে। মার্কিন ডলারের পাশাপাশি পাউন্ড, ইউরো, অস্ট্রেলিয়ান ডলার, কানাডিয়ান ডলার, সিঙ্গাপুরি ডলারেও আরএফসিডি হিসাব খোলা যায়।

সুদ বৃদ্ধিসহ ব্যাংকগুলোর নানা উদ্যোগের ফলে ঘরে থাকা ডলার ও অন্যান্য বিদেশি মুদ্রা আবার ব্যাংকে ফিরতে শুরু করেছে। কারণ, ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের এসব হিসাবে জমা বিদেশি মুদ্রার ওপর সুদ দিচ্ছে। পাশাপাশি এই ধরনের হিসাবের ডলার কোনো বাছবিচার ছাড়াই দেশে ও বিদেশে গিয়ে খরচ করা যাচ্ছে। প্রতিবার বিদেশ ভ্রমণের সময় এই হিসাব থেকে নগদ ৫ হাজার মার্কিন ডলার নেওয়া যায়। হিসাবধারী এবং তার ওপর নির্ভরশীলদেরও প্রয়োজনে বিদেশে কয়েকটি খাতে অর্থ খরচের সুযোগ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ভ্রমণ, সন্তানের শিক্ষা এবং চিকিৎসা খাতে খরচ। এসব খাতে খরচের কোনো সীমা রাখেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। আগে শুধু হিসাবধারীরা নিজ প্রয়োজনে বিদেশে অর্থ নেওয়া ও খরচের সুবিধা পেতেন।

এদিকে ব্যবহারযোগ্য সব ধরনের বৈদেশিক মুদ্রায় হিসাব খোলার সুযোগ রয়েছে প্রবাসীদের জন্য। সেই সঙ্গে প্রবাসীদের নামে খোলা বৈদেশিক হিসাবের সুদের হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে সুদের হার নির্ধারিত হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, এত দিন শুধু অনুমোদিত চারটি বৈদেশিক মুদ্রায় প্রবাসীদের হিসাব খোলার সুযোগ ছিল। সেগুলো হলো ডলার, পাউন্ড, ইউরো ও ইয়েন। কিন্তু এখন অনুমোদিত মুদ্রার পাশাপাশি ব্যবহারযোগ্য সব বৈদেশিক মুদ্রায় হিসাব খুলতে পারছেন প্রবাসীরা।

এ ছাড়া যেসব বিদেশি বাংলাদেশে কর্মরত ও বসবাস করছেন, তাঁদের যে টাকার হিসাব রয়েছে, তাতেও আমানত বেড়েছে। এ ধরনের হিসাবে গত সেপ্টেম্বরে আমানত বেশ কমে যায়, তবে ডিসেম্বরে আবার তা বেড়ে যায়। আর গত মার্চ শেষে তা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগস্টে বড় পরিবর্তনের পর দেশের পরিস্থিতি এখন আগের চেয়ে কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। আবার অন্তর্বর্তী সরকারের নানা পদক্ষেপে বিদেশিরা সহায়তা দিচ্ছেন। ফলে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বাড়ছে ও এই ধরনের হিসাবে জমা অর্থের পরিমাণ বাড়ছে।

এ বিষয়ে বেসরকারি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ব্যাংক হিসাবে ডলার জমা রাখলে এখন সুদ পাওয়া যায়, এ ছাড়া রয়েছে নানা সুবিধা। যাঁরা নিয়মিত বিদেশ ভ্রমণ করেন, তাঁরাও এখন নিজ নিজ হিসাবে ডলার জমা রাখছেন। এতে মুদ্রার মান কমলেও কোনো ক্ষতি হয় না। এ ছাড়া চীনের বিনিয়োগকারীরা দেশে আসছেন। এই কারণে বিদেশিদের হিসাবে জমা অর্থের পরিমাণ বাড়তে পারে। এটা অর্থনীতির জন্য ভালো খবর। কারণ, অন্য আমানতে যখন এত প্রবৃদ্ধি হচ্ছে না, তখন ডলার হিসাবে জমা অর্থের পরিমাণ বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ