থাকতাম চট্টগ্রাম শহরের এক প্রান্তে। ধানের জমিতে খানিক দূরে দূরে ভবন নির্মাণ করা হচ্ছিল, নব্য শহরের ছোঁয়া। ধান কাটার পর বিশাল খালি জমি এবং বর্ষায় সেই জমি পানিতে থই থই করত। খাল–বিলে ঘুড়ি ওড়াতাম। বর্ষায় বিলের পানিতে ভিজে প্রায় সময়ই বাসায় ফিরতাম। মায়ের বকুনি আর বাবার চোখরাঙানি কোনো সময় এসব মজা নেওয়া থেকে দূরে রাখতে পারেনি। স্কুল ছিল বাসার কাছেই।
আমার বাবা একটি ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করতেন। কোনো কোনো দিন তাঁকে উপকূলীয় দ্বীপ মহেশখালী, কুতুবদিয়া, সন্দ্বীপ ও হাতিয়ায় যেতে হতো। খানিকটা আর্থিক অসচ্ছলতা ছিল আমাদের পরিবারে।
সময়টা ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি। সকালবেলায় শহরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক। ২৮ এপ্রিল বাবা কুতুবদিয়ায় গেছেন। ফিরবেন তিন-চার দিন পর। রেডিওতে আবহাওয়া বিভাগ ৯-১০ নম্বর সতর্কসংকেত প্রচার করছে। বাবার কোনো খবর পাইনি—কখন আসবেন বা এই ঘূর্ণিঝড়ে কুতুবদিয়ার মতো জায়গায় কীভাবে থাকবেন, কোথায় আশ্রয় নেবেন ইত্যাদি।
প্রতিদিনের মতো ওই দিন (২৯ এপ্রিল) স্বাভাবিক দিন পার করে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরলাম। সন্ধ্যায় বাতাস বইতে লাগল। মা আমাদের দুই ভাই ও ছোট বোনকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন। রাত ১২টার পরে মা হন্তদন্ত করে আমাদের দুই ভাইকে সামনের রুম থেকে ডেকে ওনার রুমে নিয়ে এলেন। ভেতরের রুমে আমার ছোট বোন মায়ের সঙ্গে ছিল। যতটুকু মনে পড়ে, সামনের রুমের দরজা বাতাসের প্রচণ্ড বেগে ছিটকিনিসহ উড়ে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছিল, মা পড়ার টেবিল দিয়ে দরজাটা চাপা দিলেন। দোতলা বাড়ির সামনে বিল থাকায়, বাতাসের বেগ এত বেশি ছিল যে মা এবার সোফা দিয়ে দরজা চাপা দিলেন। মা বুদ্ধি করে রাখলেন, যদি দরজা কোনো কারণে ভেঙে যায়, তবে আলমারিটা দরজার সামনে রাখবেন। এবার আমাদের দুই ভাইকে মা বললেন, এই বিপদে আল্লাহকে ডাকতে আর দোয়াদরুদ পড়তে। আম্মা যা পড়ছিলেন, ওনাকে অনুসরণ করছিলাম।
এভাবে একসময় ভোর হলো। বাতাসের বেগ কমল। আমরা দুই ভাই ঘুমিয়ে গেলাম। উঠলাম সকাল ১০টার দিকে। বাইরে উঁকি দিতেই দেখি, চারদিকে কোমরসমান পানি। একধরনের শোরগোল। মা চিন্তা করছিলেন বাবার জন্য। ওনার কোনো খবর নেই। দুশ্চিন্তায় মায়ের সারা দিন কেটে গেল। সন্ধ্যায় পুরো এলাকায় বিদ্যুৎ নেই। চারদিকে হারিকেন ও চার্জলাইটের আলো। আমরা দুই ভাই পড়ছিলাম। তখন রাত ৯টা। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কে?
ওপাশ থেকে আওয়াজ, পুত দরজা খুল, আমি। আমি দরজা খুলে একলাফে বাবার কোলে। ক্লান্ত শরীরে খাওয়াদাওয়া শেষ করে বাবা ঘুমিয়ে গেলেন। এর আগে বললেন, সকালে ঘুম থেকে উঠে সব খুলে বলবেন।
সকালে বাবা বললেন, যে বোর্ডিংয়ে উনি ছিলেন, নিচতলা পানিতে ডোবার অতিক্রম হলে দোতলায় ওঠেন। সারা রাত সে কী বাতাস। ছাদ উড়ে যাওয়ার উপক্রম। সকালে পুরো কুতুবদিয়া দ্বীপ পানিতে নিমজ্জিত। লাশও পানিতে ভেসে আছে। ওষুধের দোকানসহ অন্যান্য দোকানে গিয়ে দেখেন, সব পানিতে ভাসছে। বাবা নৌকায় চড়ে, হেঁটে, বোটে করে চট্টগ্রাম ফেরিঘাট পর্যন্ত পৌঁছান। ফেরিঘাট থেকে বাসা পর্যন্ত আসেন হেঁটে, গাড়িতে, কখনো ভ্যানে চড়ে।
কুতুবদিয়া দ্বীপে হাজার হাজার মানুষ মারা গিয়েছিলেন। আল্লাহর অশেষ রহমতে আমার বাবা বেঁচে ফিরলেন। এরপর জীবনের অনেক ঘাত পেরিয়ে তিনি আমাদের উচ্চশিক্ষায় আসীন করেছেন। বাবা গত হয়েছেন বছর চারেক হলো। আমি একটি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকে কর্মরত। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ যখন আমাকে গাড়ি দিল, আমার বাবা বেঁচে ছিলেন না। গাড়িতে যখন একা বসি, তখন মনে হয়, বাবা হাত ধরে বসে আছেন, আমাকে স্কুলের গেটে নামিয়ে দেবেন। তিনি নেই, ওপর থেকে হয়তো আমাদের দেখছেন। শত কষ্ট, বাধাবিপত্তি ধৈর্যের সঙ্গে মোকাবিলা করেছেন।
বাবা, তোমার মতো ধৈর্যশীল হয়ে যেন সামনের দিনগুলো পার করতে পারি। তুমি আমার প্রেরণার বাতিঘর।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আম দ র দ
এছাড়াও পড়ুন:
যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ায় গুলিতে ৩ পুলিশ নিহত
যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্যে গুলিতে অন্তত তিনজন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও দুজন পুলিশ সদস্য।
অঙ্গরাজ্যটির পুলিশ কমিশনার ক্রিস্টোফার প্যারিস বুধবার সংবাদমাধ্যমকে হতাহতের এ তথ্য জানান।
ক্রিস্টোফার প্যারিসের বরাতে বিবিসি জানিয়েছে, স্থানীয় সময় বুধবার দুপুরের এ ঘটনায় সন্দেহভাজন বন্দুকধারীও পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন। আহত দুই পুলিশ সদস্যের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
পেনসিলভানিয়ার গভর্নর জশ শাপিরো ফিলাডেলফিয়া থেকে প্রায় ১৮৫ কিলোমিটার বা প্রায় ১১৫ মাইল পশ্চিমে নর্থ কোডোরাস টাউনশিপে ঘটনাস্থলে গেছেন।
কে বা কারা এ গুলিবর্ষণের পেছনে জড়িত, সে সম্পর্কে প্রাথমিকভাবে পুলিশ কোনো তথ্য দেয়নি।
অ্যাটর্নি জেনারেল পামেলা বন্ডি পুলিশের বিরুদ্ধে সহিংসতাকে ‘আমাদের সমাজের জন্য একটি অভিশাপ’ বলে অভিহিত করেছেন।
পামেলা বন্ডি আরও বলেন, স্থানীয় কর্মকর্তাদের সহায়তার জন্য ফেডারেল এজেন্টরা ঘটনাস্থলে গিয়েছেন।