বাবা মধু বয়াতি ছিলেন বাউলশিল্পী, মা উজালা বেগম গৃহিণী। গান গেয়ে কোনোরকমে চলে তাঁদের সংসার। ছোটবেলা থেকে মমতাজ পথে-প্রান্তরে বাউল গান করতেন। ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন লোকগানের জনপ্রিয় শিল্পী। একটা সময় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়ান। একাধিকবার আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য হন। এলাকায় আধিপত্য বাড়ান। বনে যান বিপুল অর্থসম্পদের মালিক। হত্যা মামলাসহ একাধিক মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে তিনি এখন বিচারের মুখোমুখি।

মমতাজের জন্ম মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলার জয়মন্টপ গ্রামে। ছোটবেলায় তিনি বাবা মধু বয়াতি এবং পরে বাউলশিল্পী মাতাল রাজ্জাক দেওয়ানের কাছে গান শেখেন। এরপর লোকগানের শিক্ষক রশীদ সরকারের কাছে গান শেখেন। কিশোর বয়স থেকেই মমতাজ মানিকগঞ্জে পথে-প্রান্তরে বিচ্ছেদ, পালাগান, উঠান বৈঠকিসহ লোকজ গান করেন। ধীরে ধীরে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংগীতানুষ্ঠানে গান করতে শুরু করেন। পরে তাঁর গানের কয়েক শ একক অ্যালবাম প্রকাশ পায়।

২০০৪ সালে হানিফ সংকেতের জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’তে গান গাওয়ার সুযোগ পান মমতাজ। ধীরে ধীরে তিনি দেশের সংগীতাঙ্গনের জনপ্রিয় মুখ হয়ে ওঠেন। ‘ফোকসম্রাজ্ঞী’ হিসেবে খ্যাতি পান। চার দশকের সংগীতজীবনে সাত শতাধিক অ্যালবাম আছে তাঁর। শ্রেষ্ঠ নারী কণ্ঠশিল্পী বিভাগে তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন।

মমতাজ বেগম ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সদস্য হন। ওই বছরই তিনি নবম জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মনোনীত হন। এর পর থেকে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার শুরু করেন। ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি মানিকগঞ্জ-২ (সিঙ্গাইর ও হরিরামপুর) আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৫ সালে তিনি সিঙ্গাইর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হন। তাঁর আত্মীয়স্বজন ও অনুসারীদের নিয়ে পরিবহনে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, নিয়োগ–বাণিজ্য, পদ–বাণিজ্যসহ বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ ওঠে। ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের সংসদ সদস্য হন। তবে ২০২৪ সালে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের স্বতন্ত্র প্রার্থী জাহিদ আহমেদ টুলুর কাছে হেরে যান তিনি। তবে এখনো তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির পদে আছেন। তাঁর সৎছেলে সিঙ্গাইর পৌরসভার মেয়র, ভাগনে শহিদুর রহমান উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। এ ছাড়া আত্মীয়স্বজন উপজেলা ও বিভিন্ন ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের পদে আছেন।

নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া মমতাজ বেগমের ২০১৪ ও ২০২৪ সালের হলফনামা বিশ্লেষণ করে বিপুল অর্থসম্পদ অর্জনের তথ্য পাওয়া যায়। ২০১৪ সালে তাঁর অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ছিল ১ কোটি ৭ লাখ ৩১ হাজার ২৫০ টাকা। ১০ বছরে তা বেড়ে হয়েছে ৫ কোটি ৭৮ লাখ ৯২ হাজার ৭১৮ টাকা। স্থাবর সম্পদও বেড়েছে তাঁর। ২০১৪ সালের জমা দেওয়া হলফনামায় তাঁর স্থাবর সম্পদ ছিল ৭ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। ২০২৪ সালের হলফনামার হিসাব অনুযায়ী এ সম্পদের পরিমাণ ছিল ৮ কোটি ৫৭ লাখ ৭৩ হাজার ৪৪৪ টাকা।

আরও পড়ুনশিল্পী ও সাবেক সংসদ সদস্য মমতাজ গ্রেপ্তার১২ মে ২০২৫

তবে এলাকাবাসীর ভাষ্য, বাস্তবে তাঁর অর্থসম্পদের পরিমাণ আরও বেশি। উপজেলার জয়মন্টপ এলাকায় গ্রামের বাড়িতে বিশাল জায়গার ওপর রেস্টুরেন্ট, মধু উজালা কোল্ড স্টোরেজ নামে হিমাগার, দোতলা বাড়ি এবং বাউল কমপ্লেক্স নির্মাণ করেছেন তিনি। ঢাকার মহাখালীতে ছয়তলা বাড়ি আছে। কানাডার টরন্টোতেও বাড়ি আছে বলে গুঞ্জন আছে।

মমতাজ বেগমের বিরুদ্ধে মানিকগঞ্জের দুই থানায় হত্যাসহ দুটি মামলা আছে। এর মধ্যে সিঙ্গাইর থানায় হত্যার অভিযোগে একটি এবং হরিরামপুর থানায় হামলা, মারধর ও ভাঙচুরের অভিযোগে করা আরেকটি মামলার প্রধান আসামি তিনি। এ ছাড়া ঢাকার বিভিন্ন থানায় তাঁর বিরুদ্ধে হত্যাসহ বিভিন্ন অভিযোগে মামলা আছে।

প্রায় এক যুগ আগে সিঙ্গাইরে হরতালের মিছিলে গুলিতে চারজন নিহত হন। এ ঘটনায় মমতাজকে প্রধান আসামি করে গত ২৫ অক্টোবর উপজেলার গোবিন্দল গ্রামের মো.

মজনু মোল্লা বাদী হয়ে সিঙ্গাইর থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। মামলার বিষয়ে সিঙ্গাইর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তৌফিক আজম বলেন, হত্যা মামলার বেশ কয়েকজন আসামিকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে মামলার প্রতিবেদন আদালতে জমা দেওয়া হবে।

মমতাজের নির্বাচনী এলাকা হরিরামপুর থানায় হামলা, মারধর ও ভাঙচুরের অভিযোগে আরেকটি মামলা আছে। গত ২৯ অক্টোবর হরিরামপুর উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মো. দেলোয়ার হোসেন মামলাটি করেন। এ বিষয়ে হরিরামপুর থানার ওসি মোহাম্মদ মুমিন খান বলেন, মামলায় এখন পর্যন্ত ২২ আসামিকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানো হয়েছে। মামলাটি এখনো তদন্তাধীন।

আরও পড়ুনকাঠগড়ার রেলিং ধরে নির্বিকার ছিলেন মমতাজ১৩ মে ২০২৫

রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে মমতাজ বেগম তাঁর শিল্পীসত্তাকে ধ্বংস করেছেন বলে মন্তব্য করেছেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) মানিকগঞ্জ জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম বিশ্বাস। তিনি বলেন, শিল্পীদের কোনো দল হয় না। সব মতের, পথের ঊর্ধ্বে থাকেন শিল্পীরা। রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে মমতাজকে এখন একাধিক মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে বিচারের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।

গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে মমতাজ আত্মগোপনে ছিলেন। ১২ মে রাত সাড়ে ১১টার দিকে তাঁকে রাজধানীর ধানমন্ডি থেকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ম ন কগঞ জ র উপজ ল আওয় ম

এছাড়াও পড়ুন:

২০১৪, ’১৮ ও ’২৪ সালের মতো নির্বাচন হলে চরম দুর্ভোগ নেমে আসবে: গোলাম পরওয়ার

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচন সর্বশেষ তিনটি (২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪) বছরের মতো হলে জাতির ভাগ্যে চরম দুর্ভোগ নেমে আসবে। আজ শনিবার সকাল সোয়া নয়টার দিকে খুলনার জিরো পয়েন্ট এলাকায় এক পথসভায় প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি এ কথা বলেন।

প্রশাসনের প্রতি নিরপেক্ষ থাকার আহ্বান জানিয়ে জামায়াতের এই নেতা বলেন, ‘আপনারা আগামী নির্বাচন স্বচ্ছ করুন। প্রত্যেক প্রার্থী যেন সমান সুযোগ পেয়ে নির্বাচনী কাজ করতে পারেন। অতীতে যারা কোনো বিশেষ দলের পক্ষে কাজ করেছেন, সেসব ওসি ও এসপি পালিয়ে গেছেন। তাঁরা এখন ট্রাইব্যুনালে হাজির। প্রধান বিচারপতি, বায়তুল মোকাররমের খতিব, ডিআইজি, পুলিশ কমিশনারও পালিয়ে গেছেন। ওসিরা চাকরি ছেড়ে বর্ডার দিয়ে ইন্ডিয়া চলে গেছেন। আপনাদের বিরুদ্ধেও যদি সেই অভিযোগ আসে, আপনারা কিন্তু পালানোর পথ পাবেন না।’

গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘৫৪ বছরে অনেক দল ও মার্কা দেখেছি। নৌকা, লাঙ্গল, ধানের শীষ দেখেছি। প্রতিটি শাসনে দুর্নীতি ও লুটপাট হয়েছে; ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অন্য, বস্ত্র, বাসস্থানের ব্যবস্থা হয়নি। সুতরাং মানবরচিত বিধান দিয়ে দেশ পরিচালিত হলে দেশে শান্তি আসতে পারে না, এটি প্রমাণিত। তাই আসুন ভবিষ্যতে পবিত্র কোরআনের রাষ্ট্র গড়ি।’

জামায়াতে সেক্রেটারি জেনারেল আরও বলেন, ইতিমধ্যে নতুন প্রজন্ম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবর্তন এনেছে। এর ধারাবাহিকতায় জাতি আগামী নির্বাচনেও দেশে একটি পরিবর্তন আনবে ইনশা আল্লাহ।

খুলনা-৫ আসনের (ডুমুরিয়া-ফুলতলা) সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী মিয়া গোলাম পরওয়ারের নেতৃত্বে ওই পথসভার পর মোটরসাইকেল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। শোভাযাত্রাটি খুলনার জিরো পয়েন্ট থেকে শুরু হয়ে গুটুদিয়া, ডুমুরিয়া, খর্ণিয়া, চুকনগর, আঠারোমাইল, রুদাঘরা, রঘুনাথপুর, শাহপুর, ধামালিয়া, জামিরা, ফুলতলা, দামোদর হয়ে শিরোমণি শহীদ মিনার চত্বরে গিয়ে সংক্ষিপ্ত পথসভার মধ্য দিয়ে শেষ হয়।

খুলনার জিরো পয়েন্টের পথসভায় সভাপতিত্ব করেন হরিণটানা থানার আমির জি এম আবদুল গফুর। সেখানে বক্তৃতা দেন খুলনা-১ আসনের জামায়াতের প্রার্থী শেখ মোহাম্মদ আবু ইউসুফ, খুলনা জেলা জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি মুন্সি মিজানুর রহমান, সহকারী সেক্রেটারি মুন্সি মঈনুল ইসলাম, খুলনা জেলা ছাত্রশিবিরের সভাপতি ইউসুফ ফকির ও সেক্রেটারি ইলিয়াস হোসাইন, ডুমুরিয়া উপজেলার আমির মোক্তার হোসেন, ফুলতলা উপজেলার আমির আবদুল আলিম, খানজাহান আলী থানার আমির সৈয়দ হাসান মাহমুদ, হরিণটানা থানার সেক্রেটারি ব ম মনিরুল ইসলাম প্রমুখ।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ২০১৪, ’১৮ ও ’২৪ সালের মতো নির্বাচন হলে চরম দুর্ভোগ নেমে আসবে: গোলাম পরওয়ার
  • মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সাহিত্য বা শিল্পের একটি শর্ত