বাংলাদেশের ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট ২ জুন প্রকাশিত হবে। এই বাজেট এমন এক সময়ে আসছে, যখন দেশের অর্থনীতি এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে রয়েছে। সুতরাং জাতীয় বাজেট দেশের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

দুর্ভাগ্যবশত, আগের সরকারের দুর্বল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও সুশাসনের অভাবে দেশ এক গভীর সংকটে নিপতিত হয়েছে, যার বোঝা এখন দেশকে বহন করতে হচ্ছে। দেশ ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি, রাজস্ব আহরণে দুর্বলতা, বিনিয়োগের নিম্নহার, কর্মসংস্থান সৃষ্টির সীমাবদ্ধতা, ব্যাংক খাতে উচ্চ খেলাপি ঋণ, বৈদেশিক ঋণ পরিষেবার চাপ বৃদ্ধি এবং সরকারি অর্থের অদক্ষ ব্যবহারের মতো গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।

এই পটভূমিতে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট নিয়ে প্রত্যাশা অনেক। এই প্রত্যাশা আরও বেড়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে বৈষম্যহীন সমাজ গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতির কারণে। স্বাভাবিকভাবেই বাজেট প্রণয়নের মাধ্যমে এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব সরকারের। এবারের বাজেটের লক্ষ্য উচ্চাভিলাষী প্রবৃদ্ধি অর্জন নয়; বরং এটি সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং সাধারণ মানুষের কল্যাণে মনোযোগী হবে—সেটাই সবার চাওয়া।

জানা যাচ্ছে, আগামী বাজেটের আকার হবে ৭ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন টাকা, যা চলতি ২০২৫ অর্থবছরের বাজেটের তুলনায় শূন্য দশমিক ৮৮ শতাংশ কম। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার হবে প্রায় ২ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন টাকা, যা ২০২৫ অর্থবছরের মূল বরাদ্দের তুলনায় ১৩ দশমিক ২ শতাংশ কম। এই সংকোচন সরকারের রাজস্ব শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যকে প্রতিফলিত করে। বাজেটে সামষ্টিক আর্থিক ঘাটতি জিডিপির প্রায় ৩ দশমিক ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য রয়েছে, যা এক দশকের বেশি সময়ের মধ্যে সর্বনিম্ন। এটি সুশৃঙ্খল আর্থিক ব্যবস্থাপনার প্রতিশ্রুতি প্রদর্শন করছে। তবে চ্যালেঞ্জ হলো এই রাজস্ব সংযমের নীতি স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষা খাতের বিনিয়োগকে যেন বাধাগ্রস্ত না করে।

বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ এখনো মোট জিডিপির ১ শতাংশের নিচে রয়েছে, যা কয়েক দশক ধরে অপরিবর্তিত আছে। একইভাবে শিক্ষা খাতে বরাদ্দও জিডিপির ২ শতাংশের মতো, যা মানবসম্পদ উন্নয়নের প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করছে। তাই আর্থিক কৃচ্ছ্রসাধনের ফলে সামাজিক খাতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যাতে কোনো ধরনের টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়, সেদিকে নজর রাখতে হবে।

সরকারের জন্য আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো রাজস্ব আহরণ শক্তিশালী করা, যা সম্ভাবনার তুলনায় অনেক কম। এক দশক ধরে রাজস্ব আহরণের নিম্নহার থাকায় ২০২৪–২০২৫ অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্য থেকে ৭ দশমিক ৬ শতাংশ রাজস্ব বৃদ্ধির পরিকল্পনা অবাস্তব মনে হচ্ছে। সরকারের উচিত করহার বৃদ্ধি না করে করভিত্তি সম্প্রসারণ, সঠিকতা নিশ্চিতকরণ এবং করব্যবস্থার ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে রাজস্ব আহরণ বাড়ানো। উচ্চ আয়ের ব্যক্তিরা ও অনানুষ্ঠানিক খাতকে কর নেটের আওতায় আনা গুরুত্বপূর্ণ।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড পুনর্গঠন পরিকল্পনা স্থগিত হওয়া এবং এর মাধ্যমে রাজস্ব প্রশাসন উন্নত করার প্রচেষ্টা, যা কর্মকর্তাদের প্রতিরোধের মুখে পড়ে, রাজস্বব্যবস্থার সংস্কারের জটিলতা তুলে ধরছে। রাজনৈতিক প্রতিরোধ সত্ত্বেও আধুনিক কর প্রশাসন, সঠিকতা রক্ষা এবং কর ফাঁকির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।

ভর্তুকি সংস্কার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। জ্বালানি ও কৃষি খাতে অবারিত ভর্তুকি আর্থিক চাপ বাড়াচ্ছে। বাজেটে এ ধরনের ভর্তুকি ধাপে ধাপে কমিয়ে লক্ষ্যভিত্তিক সহায়তার মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সুরক্ষা এবং সম্পদের দক্ষ বণ্টন নিশ্চিত করতে হবে।

বাজেটের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো সরকারি ব্যয়ের সুষ্ঠু ব্যবহার। বাজেটে ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ঋণের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা উচিত হবে না, কারণ এতে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হতে পারে এবং ঋণ গ্রহণ ব্যয়বহুল হয়ে উঠতে পারে। যেখানে সম্ভব সেখানে স্বল্প সুদে বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ করা উচিত। তবে এ ক্ষেত্রে ঋণ পরিশোধসক্ষমতা এবং প্রকল্পের আর্থিক-সামাজিক রিটার্ন মূল্যায়ন করা গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের উচিত সামাজিকভাবে উপকারী ও উচ্চ প্রভাবসম্পন্ন প্রকল্পে বিনিয়োগের ওপর জোর দেওয়া এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, নিম্ন রিটার্নের প্রকল্প বাদ দেওয়া। 

জাতীয় বাজেট থেকে উচ্চ প্রত্যাশার একটি দিক হলো কর্মসংস্থান সৃষ্টি। বাংলাদেশে যুব বেকারত্ব ও আংশিক বেকারত্ব ক্রমবর্ধমান, যা শ্রমবাজারের কাঠামোগত সমস্যার সঙ্গে যুক্ত। বাজেটের অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত শ্রমঘন খাতের, যেমন তৈরি পোশাক, কৃষি, তথ্যপ্রযুক্তি এবং নির্মাণ। বাজারের চাহিদা মেটানোর জন্য দক্ষতা উন্নয়ন, ডিজিটাল সাক্ষরতা এবং উদ্যোক্তা সহায়তার ওপর বিনিয়োগ জরুরি। ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য অর্থায়ন, সক্ষমতা উন্নয়ন এবং বাজার সংযোগের সহায়তা প্রদান করতে হবে।

২০২৫–২৬ অর্থবছরের বাজেটে অবশ্যই আগামী বছরে বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) মর্যাদা থেকে উত্তরণের পরিপ্রেক্ষিতে অর্থনৈতিক দিকনির্দেশনা থাকা উচিত। শুল্কমুক্ত-কোটামুক্ত বাজারসুবিধা এবং কম সুদে ঋণের সুবিধা হারানোর কারণে রপ্তানি প্রতিযোগিতা এবং আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সক্রিয় কৌশল প্রয়োজন। বাজেটে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, বাণিজ্য সহজীকরণ ব্যবস্থা শক্তিশালী করা এবং রপ্তানির বৈচিত্র্যায়ণে বিনিয়োগ বিষয়ে পদক্ষেপ থাকা উচিত, যাতে কয়েকটি পণ্যের ওপর নির্ভরশীলতা কমানো যায়। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশোধমূলক শুল্ক এবং এলডিসি থেকে উত্তরণের পরিপ্রেক্ষিতে বাজেটে শুল্ককাঠামো যৌক্তিকীকরণ করা উচিত, যাতে বৈশ্বিক বাণিজ্য মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখা যায় এবং প্রতিযোগিতা বাড়ানো যায়।

যখন স্থিতিশীলতা ও সংস্কার অপরিহার্য, তখন বাজেটকে সামাজিক ন্যায়বিচারের কথা ভুলে গেলে চলবে না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রস্তাবিত সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির সংখ্যা হ্রাস করে উপকারভোগীর আওতা বাড়ানোর পরিকল্পনা দক্ষতা বৃদ্ধির প্রতিফলন। তবে সামাজিক সুরক্ষার জন্য বরাদ্দ এখনো অপর্যাপ্ত। 

ড.

ফাহমিদা খাতুন নির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব যবস থ সরক র র র জন য বর দ দ স রক ষ আর থ ক লক ষ য দশম ক র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

সোমবার বিকেল চারটায় বাজেট দেবেন অর্থ উপদেষ্টা, বিটিভিতে সম্প্রচার হবে

অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ আগামী ২ জুন সোমবার জাতির উদ্দেশে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করবেন। ওই দিন বিকেল চারটায় বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) ও বাংলাদেশ বেতারে উপদেষ্টার এই বাজেট বক্তব্য সম্প্রচার করা হবে। তথ্য অধিদপ্তর আজ বৃহস্পতিবার এক তথ্য বিবরণীতে এ কথা জানায়।

তথ্য বিবরণীতে বলা হয়, জাতীয় বাজেটের ব্যাপক প্রচার নিশ্চিত করতে সব বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ও রেডিও স্টেশনে বিটিভি থেকে ফিড গ্রহণ করে বাজেট ভাষণটি একই সঙ্গে সম্প্রচার করবে। অর্থ উপদেষ্টা বাজেট উপস্থাপনের আগে একই দিন উপদেষ্টা পরিষদ সেটি অনুমোদন দেবে। এরপর তা কার্যকর হবে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে।

সংসদের বাইরে এর আগেও বাজেট উপস্থাপনার উদাহরণ রয়েছে দেশে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম ২০০৭-০৮ এবং ২০০৮-০৯ অর্থবছরের বাজেট টেলিভিশন ও বেতারের মাধ্যমে ঘোষণা করেছিলেন।

বিগত বছরগুলোর প্রতিবার বাজেট দেওয়া হতো জুনের প্রথম দিকে যেকোনো বৃহস্পতিবার। পবিত্র ঈদুল আজহা আগামী ৭ জুন। ঈদুল আজহার ছুটি শুরু হওয়ার আগেই এবার বাজেট উপস্থাপন করতে যাচ্ছেন অর্থ উপদেষ্টা। সংগত কারণেই বাজেট নিয়ে এবার আলোচনা করার সুযোগ থাকছে না।

আলাদা তথ্য বিবরণীতে তথ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, অর্থ উপদেষ্টা বাজেট–পরবর্তী সংবাদ সম্মেলন ডেকেছেন ৩ জুন মঙ্গলবার বেলা তিনটায়। বরাবরের মতোই এই সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে ঢাকার ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে। সংবাদ সম্মেলনে শুধু গণমাধ্যমকর্মীরাই প্রশ্ন করার সুযোগ পাবেন।

চলতি ২০২৪–২৫ অর্থবছরের বাজেটের আকার ছিল ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার। নতুন বাজেটের আকার কমে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার হতে পারে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বাজেটে সুদ মেটাতে ধরা হয়েছে ১ লাখ সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা
  • সোমবার বিকেল চারটায় বাজেট দেবেন অর্থ উপদেষ্টা, বিটিভিতে সম্প্রচার হবে
  • টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য অভ্যন্তরীণ রাজস্ব সংগ্রহ বাড়াতে হবে
  • বাজেট পেশ হবে ২ জুন, ছোট হচ্ছে আকার
  • সুন্দরবনে প্রবেশে ১ জুন থেকে তিন মাসের নিষেধাজ্ঞা
  • সুন্দরবনে প্রবেশে তিন মাসের নিষেধাজ্ঞা
  • শিক্ষায় বাজেট বৃদ্ধি ও সংস্কার কমিশন গঠনের দাবিতে ঢাকা জেলার শিক্ষা কর্মকর্তাকে স্মারকলিপি
  • চাকরি হারানো উন্নয়ন কর্মীদের নতুন সুযোগ সৃষ্টির আহ্বান
  • জাতীয় সংসদের জন্য ২৩২ কোটি টাকার বাজেট অনুমোদন