দেশে গ্যাসের উৎপাদন নিয়মিত কমছে। ঘাটতি মেটাতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি বাড়িয়েও পরিস্থিতি সামলানো যাচ্ছে না। চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ তেমন বাড়ছে না। ফলে গ্যাস সরবরাহের সংকট কাটছেই না। বসিয়ে রাখতে হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা। গ্যাস না পেয়ে বিতরণ সংস্থাগুলোতে নিয়মিত অভিযোগ করছেন আবাসিক ও শিল্প খাতের গ্রাহকেরা।
বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) সূত্র বলছে, বর্তমানে দিনে গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। ৩০০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ পেলে রেশনিং করে (এক খাতে কমিয়ে, আরেক খাতে বাড়ানো) পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হয়। দিনে এখন সরবরাহ হচ্ছে গড়ে ২৭০ কোটি ঘনফুট। বিদ্যুৎ খাতে কমিয়ে সম্প্রতি শিল্পে গ্যাস সরবরাহ বাড়ানো হয়েছে।
দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদন বাড়াতে কূপ খননে জোর দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। যদিও এতে শিগগিরই উৎপাদন বৃদ্ধির তেমন সম্ভাবনা নেই। নতুন তিনটি কূপ থেকে কিছু উৎপাদন বেড়েছে।দেশে একসময় দিনে ২৭০ কোটি ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন হতো। ২০১৮ সালে উৎপাদন কমতে থাকলে এলএনজি আমদানি শুরু হয়। উৎপাদন কমে এখন ১৮৫ কোটি ঘনফুটে নেমে এসেছে। মূলত এলএনজি আমদানির ওপর সরবরাহ বাড়া-কমা নির্ভর করে। আমদানি করা এলএনজি থেকে ১০৫ কোটি ঘনফুট সরবরাহের পরিকল্পনা পেট্রোবাংলার। ২৫ মে একটি এলএনজি কার্গো জাহাজ আসার কথা ছিল। জাহাজটি ২৮ মে এলেও আবহাওয়ার কারণে এলএনজি খালাসে সময় লাগছে। গত মঙ্গলবার এলএনজি থেকে সরবরাহ করা হয়েছে ৮০ থেকে ৮৫ কোটি ঘনফুট। বৃহস্পতিবার যা ৬০ কোটি ঘনফুটে নেমে আসে। এ ছাড়া দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদন বাড়াতে কূপ খননে জোর দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। যদিও এতে শিগগিরই উৎপাদন বৃদ্ধির তেমন সম্ভাবনা নেই। নতুন তিনটি কূপ থেকে কিছু উৎপাদন বেড়েছে।
গত ২৫ মে ব্যবসায়ীদের শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি সংগঠন যৌথ সংবাদ সম্মেলন করে শিল্প খাতে গ্যাস-সংকটের অভিযোগ করেন। এর পরদিন জ্বালানি বিভাগ বিবৃতি দিয়ে বলেছে, গত বছরের চেয়ে শিল্পে এবার বাড়তি গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে। ২৮ মে থেকে শিল্প খাতে দিনে আরও ১৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস বাড়তি সরবরাহ করা হবে।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) সূত্রে পাওয়া তথ্য বলছে, আশুলিয়ার লিটল স্টার স্পিনিং মিলের সঙ্গে তিতাসের চুক্তি অনুসারে দিনে ১০ পিএসআই (প্রতি বর্গইঞ্চি) চাপে ঘণ্টায় ৩৭ হাজার ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করার কথা। চাপ কম থাকায় সরবরাহ বাড়ছে না। তাঁরা পাচ্ছেন গড়ে ৯ হাজার ঘনফুট।তবে কয়েকজন ব্যবসায়ী প্রথম আলোকে বলেছেন, গত বছরও গ্যাসের সংকট ছিল। দেড় মাস ধরে তাঁরা বেশি ভুগছেন। গ্যাসের অভাবে কারখানা চালাতে পারছেন না, সেটাই তাঁদের উদ্বেগের বিষয়। শিল্প খাতে সরবরাহ বাড়ানোর কথা বলা হলেও তাঁরা তেমন উন্নতি দেখছেন না। মঙ্গলবার বেশ কয়েকটি কারখানার গ্যাস সরবরাহের তথ্য সংগ্রহ করা হয় তাঁদের কাছ থেকে। এতে দেখা যায়, পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি নেই। বরং কোথাও সরবরাহ আরও কমেছে।
বস্ত্র খাতের লিটল গ্রুপ অব কোম্পানিজের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ খোরশেদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৪ সালে গ্যাসের সরবরাহ থাকায় ১২৫ কোটি থেকে বাড়িয়ে ৪০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। এখন গ্যাসের অভাবে কারখানার ৬০ শতাংশ সক্ষমতা বন্ধ আছে। মঙ্গলবার শিল্পে সরবরাহ আরও বাড়ানোর কথা থাকলেও কোথায় বাড়ানো হয়েছে, তা তিনি জানেন না। তাঁর কোনো কারখানায় বাড়েনি।
জানুয়ারিতে দিনে গড়ে ১০ কোটি ঘনফুট, ফেব্রুয়ারিতে ৪ কোটি ঘনফুট ও মার্চে ১২ কোটি ঘনফুট বাড়তি সরবরাহ করা হয়েছে। তবে গত বছরের তুলনায় এবারের এপ্রিলে দিনে গড়ে ১০ কোটি ঘনফুট গ্যাস কম সরবরাহ করা হয়েছে। মে মাসেও আগের বছরের তুলনায় সার্বিক সরবরাহ কমেছে বলে জানা গেছে।বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) সূত্রে পাওয়া তথ্য বলছে, আশুলিয়ার লিটল স্টার স্পিনিং মিলের সঙ্গে তিতাসের চুক্তি অনুসারে দিনে ১০ পিএসআই (প্রতি বর্গইঞ্চি) চাপে ঘণ্টায় ৩৭ হাজার ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করার কথা। চাপ কম থাকায় সরবরাহ বাড়ছে না। তাঁরা পাচ্ছেন গড়ে ৯ হাজার ঘনফুট। গত বুধবার বিকেল ৪টা ১৩ মিনিটে চাপ ছিল ২ পিএসআই। অথচ গত ৯ মে চাপ ছিল ৬ পিএসআই। নান্নু স্পিনিংয়ে এদিন সকাল সাড়ে ১০টায় চাপ ছিল ১ পিএসআই। একই সময়ে আনোয়ার গ্রুপের একটি কারখানায় চাপ ছিল ১–এর কম। এনজেড টেক্সটাইলে চাপ ছিল আড়াই পিএসআই। মঙ্গলবার কোনো গ্যাস না পেয়ে কারখানা বন্ধ রাখে ইনটিমেট স্পিনিং মিল।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান মো.
জ্বালানি বিভাগ থেকে পাঠানো বিবৃতির তথ্য বলছে, গত বছরের তুলনায় এ বছরের প্রথম চার মাসে শিল্পে বাড়তি গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে। যদিও পেট্রোবাংলার দৈনিক গ্যাস উৎপাদন ও সরবরাহ প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, দেশে মোট গ্যাস সরবরাহ তেমন বাড়েনি। গত জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত প্রথম তিন মাস গত বছরের তুলনায় দিনে গড়ে বাড়তি গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে। এর মধ্যে জানুয়ারিতে দিনে গড়ে ১০ কোটি ঘনফুট, ফেব্রুয়ারিতে ৪ কোটি ঘনফুট ও মার্চে ১২ কোটি ঘনফুট বাড়তি সরবরাহ করা হয়েছে। তবে গত বছরের তুলনায় এবারের এপ্রিলে দিনে গড়ে ১০ কোটি ঘনফুট গ্যাস কম সরবরাহ করা হয়েছে। মে মাসেও আগের বছরের তুলনায় সার্বিক সরবরাহ কমেছে বলে জানা গেছে।
ভোর ৬টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত চুলা জ্বালানো যায়। বাকি সময় একটু গ্যাসও থাকে না। এক মাসের বেশি সময় ধরে এই অবস্থা। তিতাসে একাধিকবার অভিযোগ করেও সুরাহা হয়নি।এলিফ্যান্ট রোডের বাসিন্দা কামাল ভূঁইয়াজ্বালানি খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিদ্যুৎ খাতে দিনে গ্যাসের চাহিদা ২০৫ কোটি ঘনফুট। এর বিপরীতে এবার সর্বোচ্চ ১০৫ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করা হয়। এপ্রিলে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ চাহিদার কথা বিবেচনায় রেখে গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানো হয়। এতে করে শিল্প ও আবাসিকে গ্যাসের সংকট তৈরি হয়। এরপর সম্প্রতি বিদ্যুৎ খাতে সরবরাহ কমিয়ে ৯২ কোটি ঘনফুটে নামিয়ে আনা হয়। এর ফলে কম খরচের গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে বেশি খরচের তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে হচ্ছে। এতে সরকারের ভর্তুকি বাড়ছে। তবে বিদ্যুৎ খাতে কমানোয় শিল্পে সরবরাহ কিছুটা বাড়লেও আবাসিকে বাড়ানো যাচ্ছে না। এতে করে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকার গ্রাহকেরা রান্নার চুলায় গ্যাস পাচ্ছেন না।
মঙ্গলবার এলিফ্যান্ট রোডের বাসিন্দা কামাল ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ভোর ৬টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত চুলা জ্বালানো যায়। বাকি সময় একটু গ্যাসও থাকে না। এক মাসের বেশি সময় ধরে এই অবস্থা। তিতাসে একাধিকবার অভিযোগ করেও সুরাহা হয়নি।
তিতাস গ্যাস বলছে, তাদের দিনে চাহিদা ১৯০ কোটি ঘনফুট। এর বিপরীতে পাচ্ছে ১৫২ থেকে ১৫৫ কোটি ঘনফুট। তাই গ্রাহকদের চাহিদামতো গ্যাস সরবরাহ করা যাচ্ছে না।
কারখানা চালাতে হিমশিমগ্যাসের চাপ ওঠানামায় সংকটে নারায়ণগঞ্জে শিল্পকারখানার উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। সদর উপজেলা ফতুল্লার পঞ্চবটী বিসিক শিল্পনগরীতে অবস্থিত ফেয়ার অ্যাপারেলস লিমিটেডের ডাইং ইউনিটে মঙ্গলবার সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত গ্যাসের চাপ ছিল ১ পিএসআই। বেলা তিনটার দিকে গ্যাসের চাপ বেড়ে হয় ৪ পিএসআই। চাপ বাড়লেও আবার কমে যায়, স্থির থাকে না। প্রতিষ্ঠানের উপমহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ মাসুম প্রথম আলোকে জানান, গ্যাসের চাপ কম থাকায় বয়লারে তাপমাত্রা উঠতে সময় লাগছে। এক শিফটে কাপড় ডাইং করতে ১০ ঘণ্টার জায়গায় লাগছে ১৬ থেকে ১৭ ঘণ্টা। এতে উৎপাদন কমে যাচ্ছে।
একই দিনে বিসিকের এমএস ডাইং অ্যান্ড প্রিন্টিং ফিনিশিং লিমিটেডে সকাল ৬টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত গ্যাসের চাপ ছিল শূন্য দশমিক ৮ পিএসআই থেকে ১ পিএসআই। বেলা দুইটার দিকে চাপ আসে ৪ পিএসআই। ফোপ টেক্স লিমিটেড ডাইংয়ে প্রতিদিন উৎপাদন ক্ষমতা ৮ টন। গ্যাস–সংকটের কারণে প্রতিষ্ঠানটিতে উৎপাদন ৩ টনে নেমে গেছে।
গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার মৌচাক এলাকার সাদমা গ্রুপের পরিচালক সোহেল রানা বলেন, কয়েক মাস ধরে গ্যাসের সংকট চলে আসছে। গাজীপুরের কাশিমপুর এলাকার একটি পোশাক কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক হজরত আলী বলেন, গ্যাসের চাপ থাকলে কারখানার উৎপাদন খরচ কম হয়। ডিজেল–নির্ভর হওয়ার কারণে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, গত বছরের চেয়ে কিছুটা বাড়তি সরবরাহ করাটা কোনো যৌক্তিক বিবেচনা নয়। গ্রাহকেরা চাহিদামতো গ্যাস পেলেন কি না, সেটা হলো আসল বিবেচ্য। আসলে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারের কৌশলে কোনো পরিবর্তন আসেনি।
[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন মাসুদ রানা, গাজীপুর ও মুজিবুল হক, নারায়ণগঞ্জ]
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: সরবর হ ব ড় ন ঘনফ ট গ য স হ জ র ঘনফ ট প রথম আল ক পর স থ ত গ র হক র প এসআই ১০ ক ট সরক র ব যবস আমদ ন
এছাড়াও পড়ুন:
ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধে জয় হচ্ছে বোয়িংয়ের
বাণিজ্যযুদ্ধে সাধারণত কেউ জেতে না। তবে মার্কিন বিমান কোম্পানি বোয়িং প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুরু করা বাণিজ্যযুদ্ধ থেকে কিছুটা লাভবান হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যেসব বাণিজ্য চুক্তিগুলো করছে, সেগুলোর অংশ হিসেবে বোয়িং ধারাবাহিকভাবে নতুন নতুন বিমান সরবরাহের কার্যাদেশ পাচ্ছে। এ ধরনের বিক্রি বোয়িংয়ের জন্য ইতিবাচক হতে পারে, কেননা, কোম্পানিটি কয়েক বছর ধরে নানা সংকটে আছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দাবি করতে পারেন, তাঁর ব্যতিক্রমী বাণিজ্যনীতি মার্কিন উৎপাদন খাতের পালে হাওয়া দিচ্ছে।
এই মাসেই ইন্দোনেশিয়া ও জাপান বোয়িংয়ের শত শত যাত্রীবাহী বিমান কেনার ঘোষণা দিয়েছে। এর আগে বছরের শুরুতে বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব ও কাতার বোয়িংয়ের বিমান কেনার ঘোষণা দেয়।
যুক্তরাষ্ট্রের লবিস্ট প্রতিষ্ঠান ক্যাপিটল কাউন্সিলের বাণিজ্যনীতি বিশ্লেষক ব্রুস হার্শ বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রথম মেয়াদ থেকেই এ ধরনের চুক্তি করে আসছেন; তাঁর এসব চুক্তির আওতায় দেশগুলোর সঙ্গে বড় অঙ্কের পণ্য কেনাবেচার চুক্তি হয়। আমাদের বাণিজ্য অংশীদারেরাও তা জানে। সে জন্য তারা বোয়িংয়ের মতো বড় জিনিস কেনার প্রস্তাব দেয়।’
বিমান বিশ্লেষকেরা বলছেন, এসব কার্যাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে খুব একটা চাপ দিতে হয়নি। এয়ারলাইনসগুলো বিমান কেনার মতো সিদ্ধান্ত সাধারণত মাসের পর মাস, এমনকি বছরের বেশি সময় ধরে সরবরাহের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এ ছাড়া বিশ্বে বড় যাত্রীবাহী বিমান সরবরাহ করে কেবল দুটি কোম্পানি—বোয়িং ও ফ্রান্সের এয়ারবাস।
এরপরও বোয়িংয়ের নতুন এসব কার্যাদেশ পাওয়ার ঘটনাকে ট্রাম্প প্রশাসন নিজেদের বাণিজ্য চুক্তির বড় সফলতা হিসেবে তুলে ধরছে। বোয়িং যুক্তরাষ্ট্রের লাখো মানুষের কর্মসংস্থানের উৎস এবং অন্যতম প্রধান রপ্তানিকারক। এপ্রিলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বিভিন্ন দেশের ওপর নতুন শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেই বোয়িংয়ের শেয়ারের দাম বাড়তে থাকে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এসব চুক্তির ঘোষণা আরও নতুন কার্যাদেশের পথ সুগম করতে পারে। অন্য গ্রাহকেরা হয়তো ভাববে, প্রয়োজনের সময় বিমান না পেলে কী হবে—তাই এখনই কার্যাদেশ দেওয়া নিরাপদ। তবে এখন কার্যাদেশ দেওয়া বিমান হাতে পেতে কয়েক বছর লেগে যেতে পারে।
বোয়িং এ বিষয়ে মন্তব্য করেনি। তবে ট্রাম্পের আগ্রহে যে তারা সন্তুষ্ট, সেটা বোঝা যায়। মে মাসে কাতারের সঙ্গে বোয়িংয়ের বিমান চুক্তির সময় কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কেলি ওর্টবার্গ ট্রাম্পের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্য সফরে যান।
অ্যাভিয়েশন পরামর্শক প্রতিষ্ঠান অ্যাভিটাসের প্রেসিডেন্ট আডাম পিলারস্কি বলেন, ‘যদি প্রেসিডেন্ট নিজে বলেন আমার সঙ্গে চলুন, যুক্তরাষ্ট্রে অনেক কর্মসংস্থান হবে, এমন চুক্তি করা হবে—এ কথা বললে তখন কেউ না বলতে পারেন না।’
তবে পিলারস্কি ও অন্যান্য বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এসব কার্যাদেশের আকার যতটা দেখানো হচ্ছে, বাস্তবে বিষয়টি তার চেয়ে ছোট হতে পারে। এসব চুক্তি নিয়ে এখনো তেমন কোনো তথ্য প্রকাশিত হয়নি। অনেক চুক্তি হয়তো এখনো বিমান কোম্পানি ও এয়ারলাইনসগুলোর মধ্যে আলোচনার পর্যায়ে আছে।
এই মাসেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, ইন্দোনেশিয়া ৫০টি বোয়িং বিমান কিনতে রাজি হয়েছে। তবে পরে এক ইন্দোনেশীয় কর্মকর্তা জানান, এটি এখনো গারুদা নামের রাষ্ট্রায়ত্ত বিমান সংস্থা ও বোয়িংয়ের মধ্যে আলোচনার পর্যায়ে আছে।
বিমান বিশ্লেষক রিচার্ড আবুলাফিয়া বলেন, ‘আমরা একসময় ঠাট্টা করে বলতাম, এই ধরনের চুক্তি হলো এমওইউটিএইচএল, অর্থাৎ মধ্যাহ্নভোজন করার জন্য সমঝোতা স্মারক। প্রেসিডেন্টের সফর শেষে প্রকৃত চুক্তি, অর্থায়নসহ বিস্তারিত আলোচনা শুরু হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চূড়ান্ত চুক্তি না হলেও এসব কার্যাদেশ অনেক সময় এমনিতেই হতো, ট্রাম্প থাকুন আর না থাকুন। যেমন মে মাসে কাতার এয়ারওয়েজ বোয়িংয়ের ১৫০টি দূরপাল্লার বিমান কেনার কার্যাদেশ দেয়। এই চুক্তি নিয়ে সংবাদ সম্মেলন, করমর্দন—সবই ছিল। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই কার্যাদেশ এমনিতেই হতো, হয়তো ট্রাম্পের সফরের কারণে সময়টা একটু এগিয়ে আনা হয়েছে।
তবে কিছু চুক্তিতে রাজনৈতিক চাপ ছিল বলেই মনে করেন কেউ কেউ। যা–ই হোক, বিমান হাতে পেতে যে সময় লাগে, তত দিনে অনেক কিছু বদলে যেতে পারে। বোয়িং ও এয়ারবাসের কাছে এমনিতেই হাজার হাজার কার্যাদেশ জমা আছে। অনেক এয়ারলাইন অর্ডার বাতিল করতে পারে, ডেলিভারি পিছিয়ে দিতে পারে, এমনকি অর্ডার কমিয়ে ফেলতেও পারে। অনেক সময় নির্মাতা কোম্পানিগুলো এসব পরিবর্তন মেনে নেয়, যদি তারা অন্য কোনো ক্রেতার কাছে সেই বিমান বিক্রি করতে না পারে।
তবে বোয়িংয়ের মূল চ্যালেঞ্জ হলো এই কার্যাদেশগুলো থেকে বাস্তব মুনাফা আদায় করা। কোম্পানিটির ৭৩৭ ম্যাক্সের ছোট ও বড় সংস্করণ এবং ৭৭৭-৯ মডেল সরকারি অনুমোদন এখনো পায়নি। এসব বিমান যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল অ্যাভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এফএএ) পরীক্ষা ও অনুমোদন প্রক্রিয়ায় আছে। আরও একটি বিষয় হলো, নতুন বিমানের চাহিদা অনেক দিন ধরেই বেশি। সমস্যা হচ্ছে, সরবরাহ সীমিত।
বোয়িং এই ঘাটতি পূরণে কাজ করছে। তাদের সবচেয়ে জনপ্রিয় মডেল ৭৩৭ ম্যাক্স দুটি বড় দুর্ঘটনার কবলে পড়ার পর এই মডেলের বিমান উৎপাদন প্রায় দুই বছর বন্ধ ছিল। এরপর করোনা মহামারির কারণে সরবরাহব্যবস্থায় বিপর্যয় নামে। গত বছর একটি বিমানের অংশ মাঝ আকাশে খুলে যাওয়ার পর উৎপাদনের গতি আরও কমিয়ে দেওয়া হয়। গত বছর কয়েক সপ্তাহব্যাপী ধর্মঘটেও উৎপাদন পিছিয়ে যায়।
তবুও সমস্যাএমনকি ট্রাম্পের শুল্কনীতির কারণেও বোয়িং সমস্যায় পড়তে পারে। নতুন শুল্কের কারণে বোয়িংয়ের যন্ত্রাংশ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো আর্থিক সংকটে পড়তে পারে। মার্কিন বাণিজ্য অংশীদারেরা পাল্টা শুল্ক আরোপ করলে বোয়িংয়ের বিক্রিতেও প্রভাব পড়তে পারে।
এই সপ্তাহে বাজেট এয়ারলাইনস রায়ানএয়ার বলেছে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন যদি মার্কিন বিমান আমদানিতে শুল্ক আরোপ করে, তাহলে তারা বোয়িংয়ের সরবরাহ পিছিয়ে দিতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বোয়িং যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য চুক্তিগুলো থেকে অতিরিক্ত সুবিধা পেলে ইউরোপ পাল্টা পদক্ষেপ নিতে পারে। তারা অন্যান্য দেশকে এয়ারবাস কেনায় উৎসাহ দিতে পারে।
বিশ্লেষক কোর্টনি মিলার বলেন, যদি এই খেলা খেলাই হয়, তাহলে প্রশ্ন হলো দীর্ঘ মেয়াদে কে বেশি কৌশলে খেলতে পারে। বিমান ব্যবসা, অর্থনীতি ও কূটনীতির পুরোনো যে টানাপোড়েন, সেটা আবার নতুন করে ফিরে এসেছে।