সুরা বনি ইসরাইল, পবিত্র কোরআনের ১৭তম সুরা, মক্কায় অবতীর্ণ। এর আয়াত সংখ্যা ১১১। ‘ইসরা’ অর্থ রাত্রিকালীন ভ্রমণ, যা নবীজি (সা.)-এর মিরাজের ঘটনাকে নির্দেশ করে। এ ছাড়া বনি ইসরাইলের বিভিন্ন ঘটনার উল্লেখ থাকায় এটি ‘সুরা বনি ইসরাইল’ নামেও পরিচিত। এই সুরায় মিরাজের অলৌকিক ভ্রমণ, সামাজিক সম্প্রীতির জন্য ১৪টি শিষ্টাচার এবং পিতামাতার প্রতি সদ্ব্যবহারের গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে।
পবিত্র তিনি, যিনি তাঁর বান্দাকে রাতে ভ্রমণ করিয়েছেন মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসায়, যার চারপাশ আমি বরকতময় করেছি, যাতে আমি তাকে আমার নিদর্শনসমূহ দেখাই।(সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত: ১)মিরাজ: ঊর্ধ্বজগতের অলৌকিক ভ্রমণ
মহানবী (সা.
এই ভ্রমণে তিনি জান্নাত-জাহান্নাম পরিদর্শন করেন এবং উম্মতের জন্য পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের হুকুম নিয়ে ফিরে আসেন। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘পবিত্র তিনি, যিনি তাঁর বান্দাকে রাতে ভ্রমণ করিয়েছেন মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসায়, যার চারপাশ আমি বরকতময় করেছি, যাতে আমি তাকে আমার নিদর্শনসমূহ দেখাই।’ (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত: ১)
সামাজিক সম্প্রীতির ১৪ শিষ্টাচার
সুরার ২৩ থেকে ৩৯ আয়াতে সামাজিক সম্প্রীতি ও নৈতিকতার জন্য ১৪টি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, ১. আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও ইবাদত না করা। ২. পিতামাতার সঙ্গে সদাচার করা। ৩. আত্মীয়দের অধিকার আদায় করা। ৪. মিসকিন ও পথচারীদের অধিকার দেওয়া। ৫. অপচয় থেকে বিরত থাকা। ৬. কৃপণতা না করা। ৭. সন্তান হত্যা না করা। ৮. ব্যভিচারের নিকটবর্তী না হওয়া। ৯. অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যা না করা। ১০. এতিমের সম্পদের প্রতি হাত না বাড়ানো। ১১. ওয়াদা পালন করা। ১২. সঠিকভাবে ওজন ও পরিমাপ করা। ১৩. অজ্ঞাত বিষয়ে কথা না বলা। ১৪. পৃথিবীতে দম্ভভরে চলাফেরা না করা।
এই নির্দেশনাগুলো মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
পিতামাতার প্রতি সদ্ব্যবহার
সুরায় পিতামাতার প্রতি সদাচারের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে: ‘তোমার প্রতিপালক আদেশ দিয়েছেন, তাঁর সঙ্গে কাউকে শরিক না করতে এবং পিতামাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করতে। তাদের একজন বা উভয়ে তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে পৌঁছালে তাদের প্রতি ‘উফ’ বলো না, তাদের ধমক দিয়ো না এবং তাদের সঙ্গে সম্মানজনক কথা বলো।’ (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত: ২৩)
এই ভ্রমণে তিনি জান্নাত-জাহান্নাম পরিদর্শন করেন এবং উম্মতের জন্য পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের হুকুম নিয়ে ফিরে আসেন।এই আয়াতে পিতামাতার প্রতি শ্রদ্ধা ও দয়ার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে, যা ইসলামের মৌলিক শিক্ষার অন্যতম।
আরও পড়ুনঅলৌকিক উট১৩ এপ্রিল ২০২৫আল্লাহর সুন্দর সব নাম
সুরায় আল্লাহর সুন্দর নামের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করা হয়েছে: ‘তাঁকে আল্লাহ নামে ডাকো বা রহমান নামে ডাকো, তাঁর সব নামই সুন্দর।’ (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত: ১১০)
এ ছাড়া আল্লাহর একত্ববাদ নিশ্চিত করে বলা হয়েছে যে তিনি কোনো সন্তান গ্রহণ করেননি।
সুরা বনি ইসরাইল মিরাজের অলৌকিক ঘটনার মাধ্যমে আল্লাহর নিদর্শন ও মহানবী (সা.)-এর মর্যাদা তুলে ধরে। এটি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের মতো গুরুত্বপূর্ণ উপহার উম্মতের জন্য বয়ে আনে। একই সঙ্গে সামাজিক সম্প্রীতির জন্য ১৪টি শিষ্টাচার এবং পিতামাতার প্রতি সদ্ব্যবহারের নির্দেশনা দিয়ে এটি মানবজীবনের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক দিকনির্দেশনা প্রদান করে। এই সুরা আমাদের আল্লাহর একত্ববাদে অবিচল থাকতে এবং সামাজিক দায়িত্ব পালনে উৎসাহিত করে।
আরও পড়ুনজিভের জড়তা কাটাতে মুসা (আ.) যে প্রার্থনা করেছিলেন০৮ এপ্রিল ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: মসজ দ ল হ র ম থ ক মসজ দ ল আকস য় ত র জন য আল ল হ ভ রমণ
এছাড়াও পড়ুন:
প্রতিদিন কেন মৃত্যুকে স্মরণ করতে হবে
মৃত্যু জীবনের একটি অবশ্যম্ভাবী সত্য, যা প্রত্যেকটি মানুষের জন্য নির্ধারিত। ইসলামে মৃত্যুকে ভয়ের বিষয় হিসেবে নয়; বরং আল্লাহর দিকে ফিরে যাওয়ার একটি স্বাভাবিক ধাপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘প্রত্যেক প্রাণী মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৮৫)
মৃত্যুর স্মরণ মুসলিমদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ আধ্যাত্মিক অনুশীলন, যা জীবনের উদ্দেশ্যকে স্মরণ করিয়ে দেয় এবং আমাদের পার্থিব লোভ-লালসা থেকে দূরে রাখে।
মৃত্যু: মুমিনের জন্য স্বস্তিপৃথিবী একটি পরীক্ষার ক্ষেত্র, যেখানে মানুষ নানা দুঃখ-কষ্ট, অভাব, প্রিয়জনের মৃত্যু, দারিদ্র্য ও অন্যান্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। মুসলিমদের জন্য এ পরীক্ষা হলো আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলার মাধ্যমে জীবন যাপন করা।
কোরআনে বলা হয়েছে, ‘(আল্লাহ) যিনি মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন, যাতে তিনি তোমাদের পরীক্ষা করেন, তোমাদের মধ্যে কে উত্তম কাজ করে।’ (সুরা মুলক, আয়াত: ২)
আনন্দের ধ্বংসকারীকে (মৃত্যুকে) বেশি বেশি স্মরণ করো। তিরমিজি, হাদিস: ২৩০৭মৃত্যু মুমিনের জন্য একটি স্বস্তি। এটি পার্থিব পরীক্ষা ও কষ্ট থেকে মুক্তি দেয় এবং আল্লাহর রহমতের আলিঙ্গনে নিয়ে যায়। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘মুমিন মৃত্যুর মাধ্যমে স্বস্তি পায়।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬৫০৭)।
এমনকি নবীজি (সা.)-এর জীবনেও এ সত্য প্রতিফলিত হয়েছে। তাঁর মৃত্যুর সময় মৃত্যুর ফেরেশতা আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁকে মৃত্যু বিলম্বিত করার সুযোগ দিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি আল্লাহর কাছে ফিরে যাওয়ার পথ বেছে নিয়েছিলেন।
আরও পড়ুনমৃত্যু থেকে পালানোর পথ নেই১৮ মার্চ ২০২৫মৃত্যুকে স্মরণ করার গুরুত্বমৃত্যু স্মরণ একটি গভীর আধ্যাত্মিক অনুশীলন। যখন আমরা কোনো প্রিয়জনের মৃত্যু দেখি, তখন পার্থিব বিষয়গুলো তুচ্ছ মনে হয়। আমরা আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য নিয়ে পুনর্বিবেচনা করি।
নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘হৃদয় মরিচার মতো মলিন হয়।’ লোকেরা জিজ্ঞাসা করল, ‘কীভাবে তা পরিষ্কার করা যায়?’ তিনি বললেন, ‘মৃত্যু স্মরণ ও কোরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে।’ (নাহজুল ফাসাহা)।
এ ছাড়া তিনি বলেছেন, ‘আনন্দের ধ্বংসকারীকে (মৃত্যুকে) বেশি বেশি স্মরণ করো।’ (তিরমিজি, হাদিস: ২৩০৭)
হজরত আলী (রা) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি প্রায়ই মৃত্যুকে স্মরণ করে, সে অল্প সম্পদেও সন্তুষ্ট থাকে। সে কখনো লোভী বা কৃপণ হয় না।’ (বিহারুল আনওয়ার)
মৃত্যুর জন্য কী কামনা করা যায়ইসলামে আত্মহত্যা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। তাই কোনো বিপদ বা কষ্টের কারণে মৃত্যুর জন্য প্রার্থনা করা অনুমোদিত নয়। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ যেন বিপদের কারণে মৃত্যু কামনা না করে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬৩৫১)।
তবে শহীদ হওয়ার জন্য দোয়া করা, অর্থাৎ আল্লাহর পথে মৃত্যুবরণের জন্য প্রার্থনা করা ইসলামে অনুমোদিত।
ইসলামের দৃষ্টিকোণে মৃত্যু জীবনের সমাপ্তি নয়; বরং এটি পার্থিব জীবন থেকে চিরস্থায়ী জীবনের দিকে একটি সেতু। মৃত্যু মুমিনের জন্য এটি আল্লাহর সঙ্গে মিলিত হওয়ার একটি সুযোগ।মৃত্যুই শেষ কথা নয়ইসলামের দৃষ্টিকোণে মৃত্যু জীবনের সমাপ্তি নয়; বরং এটি পার্থিব জীবন থেকে চিরস্থায়ী জীবনের দিকে একটি সেতু। এটি ভয় বা দুঃখের বিষয় হলেও মুমিনের জন্য এটি আল্লাহর সঙ্গে মিলিত হওয়ার একটি সুযোগ। মৃত্যু স্মরণ ও এর জন্য প্রস্তুতি আমাদের জীবনকে আরও অর্থবহ করে।
বিপদে পড়লে মৃত্যু স্মরণের দোয়া আমাদের ধৈর্য ধরতে এবং আল্লাহর ওপর ভরসা রাখতে সাহায্য করে। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘যারা বিপদে পড়ে বলে, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন (আমরা আল্লাহর জন্য এবং তাঁর দিকেই ফিরে যাব।)’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৫৬)
এ আয়াত মৃত্যুর সংবাদ শোনার সময়ও পাঠ করা হয়। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে বিপদ আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে এবং তিনি আমাদের সামর্থ্যের বাইরে পরীক্ষা দেন না। (সুরা বাকারা, আয়াত: ২৮৬)।
প্রতিটি বিপদের মধ্যে আমাদের জন্য কল্যাণ নিহিত রয়েছে। এ বিপদ ক্ষণস্থায়ী। কারণ, আমরা আল্লাহর কাছে ফিরে যাব।
আরও পড়ুনসন্তান জন্মের আগে মৃত্যু কামনা করেন নবীর মা৩১ মে ২০২৫কয়েকটি দোয়ামৃত্যু ভাবাপন্ন বিপদ হলে: কঠিন বিপদের সময় পাঠ করা যায়, তা হলো নবীজি (সা.)-এর শেখানো: ‘হে আল্লাহ, যতক্ষণ জীবন আমার জন্য কল্যাণকর, ততক্ষণ আমাকে জীবিত রাখো এবং যখন মৃত্যু আমার জন্য উত্তম, তখন আমাকে মৃত্যু দাও।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬৩৫১)
মৃত্যু নিকটবর্তী হলে: মৃত্যুর সময় শুধু আল্লাহই জানেন। তবে আমরা বা আমাদের প্রিয়জন মৃত্যুর কাছাকাছি থাকি এবং ভয় বা উদ্বেগ অনুভব করি, তবে এই দোয়া পাঠ করা যায়: ‘হে আল্লাহ, মৃত্যুর যন্ত্রণা ও কষ্ট থেকে আমাকে সাহায্য করো।’ (তিরমিজি, হাদিস: ৯৭৮)।
নবীজি (সা.) নিজেও তাঁর মৃত্যুর সময় এই দোয়া পাঠ করেছিলেন।
হে আল্লাহ, যতক্ষণ জীবন আমার জন্য কল্যাণকর, ততক্ষণ আমাকে জীবিত রাখো এবং যখন মৃত্যু আমার জন্য উত্তম, তখন আমাকে মৃত্যু দাও।সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬৩৫১সহজ মৃত্যুর জন্য দোয়া: নবীজি (সা.) একটি দীর্ঘ দোয়ার শেষে বলেছেন, ‘এবং আমার মৃত্যুকে আমার জন্য স্বস্তির উৎস করো, যা আমাকে সব অনিষ্ট থেকে রক্ষা করবে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৬৮৮)
এখানে সহজ মৃত্যু বলতে পার্থিব অর্থে আরামদায়ক মৃত্যু (যেমন ঘুমের মধ্যে মৃত্যু) বোঝায় না; বরং এটি বোঝায় মৃত্যুর ফেরেশতার আগমন থেকে শুরু করে পরকালে স্থানান্তর পর্যন্ত একটি সহজ প্রক্রিয়া।
মৃত্যুর কঠিন পরীক্ষা থেকে আশ্রয়: একটি দোয়ায় নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘হে আল্লাহ, আমি তোমার কাছে অলসতা, বার্ধক্য, কাপুরুষতা, অক্ষমতা এবং জীবন ও মৃত্যুর পরীক্ষা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করি।’ (সুনানে নাসাঈ, হাদিস: ৫৪৯১)
মৃত্যুর সময় শয়তান থেকে বাঁচতে: নবীজি (সা.) এ–সময় দোয়া করেছেন, ‘আমি তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করি যেন শয়তান আমার মৃত্যুর সময় আমাকে ক্ষতি করতে না পারে।’ (আবু দাউদ, হাদিস: ১৫৫২)
ইসলামে মৃত্যুকে ভয়ের বিষয় হিসেবে নয়; বরং আল্লাহর সঙ্গে পুনর্মিলনের একটি সুযোগ হিসেবে দেখা হয়। নিয়মিত মৃত্যু স্মরণ আমাদের জীবনের উদ্দেশ্যকে স্মরণ করিয়ে দেয়, লোভ-লালসা থেকে দূরে রাখে এবং আমাদের ভালো কাজের পথে রাখে।
আরও পড়ুনমৃত্যু কি শেষ, মৃত্যু আসলে কী৩১ জুলাই ২০২৩