ট্রাম্পের ‘শুল্ক হামলা’ আসিয়ানের ঐক্যকে পোক্ত করবে
Published: 7th, June 2025 GMT
ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছেন, যেসব দেশ এখনো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি করেনি, সেসব দেশের ওপর তিনি বাড়তি হারে শুল্ক (ট্যাক্স) বসাবেন। এই শুল্ক ৮ জুলাই থেকে কার্যকর হবে।
এই ঘোষণা শুনে অনেক দেশ দুশ্চিন্তায় পড়েছে; কারণ এতে তাদের রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাই তারা ভাবছে কীভাবে এই সমস্যার সমাধান করা যায়।
বিশেষ করে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুরসহ আসিয়ান গোষ্ঠীর দশটি দেশ খুব দ্রুত ও সক্রিয়ভাবে এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় কাজ শুরু করেছে।
এই দেশগুলোর নেতারা খুব ভালোভাবে বুঝেছেন, গত কয়েক দশকে অর্থনীতিতে তাঁদের দেশ অনেক এগিয়ে গেছে।
একসময় জাপানের অর্থনীতি আসিয়ানের চেয়ে অনেক বড় ছিল, এখন সেটি প্রায় সমান–সমান। অনুমান করা হচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে আসিয়ানের সম্মিলিত অর্থনীতি জাপানকে ছাড়িয়ে যাবে।
আরও পড়ুনট্রাম্পের শুল্ক আরোপ, বাংলাদেশের সামনে পথ কী১৬ মে ২০২৫ইতিমধ্যেই ২০১০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত আসিয়ান বিশ্বের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) চেয়েও বেশি অবদান রেখেছে।
আসিয়ানের এই অগ্রগতির পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে মুক্ত বাণিজ্য। ২০০৩ সালে আসিয়ানের বাইরের বিশ্বের সঙ্গে তাদের ৬১৮ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হয়েছিল। ২০২৩ সালে সেটা বেড়ে হয়েছে ২.
তবে আসল সাফল্যের রহস্য ছিল শক্তিশালী নেতৃত্ব। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সিঙ্গাপুরের লি কুয়ান ইউ এবং ইন্দোনেশিয়ার সুহার্তো—দুই ভিন্ন ধরনের নেতা হলেও তাঁরা একসঙ্গে কাজ করে আসিয়ানকে ঐক্যবদ্ধ রেখেছিলেন।
আজকের দিনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন আনোয়ার ইব্রাহিম (মালয়েশিয়া), প্রাবোও সুবিয়ান্তো (ইন্দোনেশিয়া), তো লাম (ভিয়েতনাম) এবং লরেন্স ওং (সিঙ্গাপুর)। তাঁদের কেউ কেউ দীর্ঘ সময় রাজনীতির বাইরে ছিলেন; কিন্তু এখন তাঁরা একসঙ্গে কাজ করছেন।
আসিয়ানের নেতারা নিজেদের দেশ এবং গোটা অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতি রাখার জন্য সব সময় মিলেমিশে, পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেন। ইন্দোনেশীয় ভাষায় এই পরামর্শ ও ঐকমত্যের নীতিকে বলা হয় ‘মুস্যায়াওয়ারাহ’ ও ‘মুফাকাত’।
আরও পড়ুনট্রাম্পের প্রতিশোধমূলক শুল্ক থেকে বাংলাদেশ যেভাবে লাভবান হতে পারে০৪ এপ্রিল ২০২৫বিশ্বের অনেক উন্নয়নশীল দেশে রাজনীতি নিয়ে হিংসা, সংঘাত ও বিশৃঙ্খলা দেখা যায়, কিন্তু আসিয়ানে এমনটা খুব একটা হয় না।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়—সম্প্রতি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ লাগার মতো পরিস্থিতি হয়েছিল। মধ্যপ্রাচ্য সব সময়ই যুদ্ধ ও অশান্তিতে থাকে। এমনকি ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার মতো বড় দেশগুলোর নেতারাও একে অপরের সঙ্গে কথাই বলেন না।
কিন্তু আসিয়ান ৪৮ বছর ধরে নিয়মিত বৈঠক করছে। তাদের মধ্যে প্রতি বছর প্রায় ১,০০০টি মিটিং হয়। এই নিয়মিত আলোচনার মাধ্যমেই তারা গঠনমূলক সম্পর্ক গড়তে শিখেছে।
কেউ কেউ বলে আসিয়ান খুব ধীরে চলে, কিন্তু এই ধীর-স্থির ও মিলে-মিশে চলার নীতিই আসিয়ানকে এতগুলো বছর, এমনকি অর্থনৈতিক সংকটের সময়ও একসঙ্গে টিকিয়ে রেখেছে।
এখন ট্রাম্পের শুল্ক নীতির জবাবে আসিয়ান একসঙ্গে কাজ করছে। যদিও ট্রাম্প প্রতিটি দেশের জন্য আলাদা করে শুল্ক ধরেছেন। যেমন কম্বোডিয়ার জন্য ৪৯ শতাংশ আর সিঙ্গাপুরের জন্য ১০ শতাংশ। তবে আসিয়ান দেশগুলো বুঝেছে, এক সঙ্গে থাকলেই শক্তি বাড়ে।
তাই কুয়ালালামপুরে আসিয়ান সম্মেলনে তারা ট্রাম্প ও আসিয়ানের ১০ দেশের নেতাদের নিয়ে একটি সম্মেলনের প্রস্তাব দিয়েছে।
এর আগেও আসিয়ান ঘোষণা দিয়েছিল, তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আরও জোরালো ও ভবিষ্যৎমুখী অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়তে চায়। তারা এমন একটা সহযোগিতা চায় যাতে উভয় পক্ষ লাভবান হবে, বিশেষ করে প্রযুক্তি ও উচ্চ-মূল্যের খাতগুলোতে।
আরও পড়ুনট্রাম্পের শুল্কে সি’র খেলা: পূর্ব এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কি ক্ষয়িষ্ণু?১২ এপ্রিল ২০২৫কারণ আসিয়ানের সেবা খাতে যুক্তরাষ্ট্র বড় মুনাফা করে এবং সেখানে আমেরিকার বিনিয়োগও অনেক। ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র সেখানে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে।
তবে আসিয়ান এখন শুধু যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করছে না। তারা চীন ও গাল্ফ কো-অপারেশন কাউন্সিলের সঙ্গে নতুন এক সম্মেলন করেছে।
এই ধরনের সম্মেলন এবারই প্রথম। এতে বোঝা যাচ্ছে, শুধু আমেরিকার দিকে নয়, আসিয়ান তার ভবিষ্যৎ গড়তে নানা দিকেই তাকাচ্ছে।
বিশ্ব যখন ট্রাম্পের একপক্ষীয় শুল্ক নীতির বিরোধিতা করছে, আসিয়ান তখন মুক্ত বাণিজ্যেই আস্থা রাখছে।
এখন তারা নন-ট্যারিফ বাধা দূর করতে চায় এবং গোষ্ঠীর ভেতরে পণ্য চলাচল সহজ করতে চায়। তাদের নিজেদের মধ্যে বর্তমানে ৯৯ শতাংশ শুল্কমুক্ত চলাচল জারি আছে। ট্রাম্পের শুল্ক নীতি হয়তো স্বল্পমেয়াদে আসিয়ানের অর্থনীতিকে কিছুটা ক্ষতি করতে পারে। কিন্তু এই সংকটই আসিয়ানকে আরও এক জোট হতে, নিজেদের মধ্যে ও অন্য দেশের সঙ্গে সহযোগিতা বাড়াতে সাহায্য করতে পারে। এতে আসিয়ান আরও সমৃদ্ধ এবং টেকসই একটি গোষ্ঠীতে পরিণত হতে পারে।এ ছাড়া আসিয়ান দেশগুলো নিজেদের মধ্যে বাণিজ্য বাড়াতেও চায়। যদিও তাদের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য মোট বাণিজ্যের শতাংশ হিসেবে একটু কমেছে (২০০৩ সালে ছিল ২৫ %, আর ২০২৩ সালে তা হয়েছে ২১.৫ %), তবে তার কারণ বাইরের দেশের সঙ্গে তাদের বাণিজ্য অনেক বেড়েছে।
এখন তারা নন-ট্যারিফ বাধা দূর করতে চায় এবং গোষ্ঠীর ভেতরে পণ্য চলাচল সহজ করতে চায়। তাদের নিজেদের মধ্যে বর্তমানে ৯৯ শতাংশ শুল্কমুক্ত চলাচল জারি আছে। ট্রাম্পের শুল্ক নীতি হয়তো স্বল্পমেয়াদে আসিয়ানের অর্থনীতিকে কিছুটা ক্ষতি করতে পারে।
কিন্তু এই সংকটই আসিয়ানকে আরও এক জোট হতে, নিজেদের মধ্যে ও অন্য দেশের সঙ্গে সহযোগিতা বাড়াতে সাহায্য করতে পারে। এতে আসিয়ান আরও সমৃদ্ধ এবং টেকসই একটি গোষ্ঠীতে পরিণত হতে পারে।
সত্ত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত
কিশোর মাহবুবানি ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর-এর এশিয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউট-এর অনারারি ফেলো।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র র ইন দ ন শ য় আস য় ন র একসঙ গ র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
জিল হোসেন মারা গেছেন, আদালতে তাঁর লড়াই শেষ হবে কবে
জিল হোসেনের ৭২ বছরের জীবনের ৪৭ বছরই কেটেছে আইনি লড়াইয়ে। শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরীক্ষা পাসের সনদ পেতে, এরপর ক্ষতিপূরণের দাবিতে তাঁর এই দীর্ঘ লড়াই। লড়াই এখনো শেষ হয়নি। এর মধ্যেই মারা গেছেন জিল হোসেন।
জিল হোসেনের মৃত্যুর পর তিন বছর ধরে লড়াইটা করে যাচ্ছেন স্ত্রী ও তাঁর সন্তানেরা। কিন্তু পরিবারটির বিচারের অপেক্ষা শেষ হয়নি।
পরিবার ও মামলার নথিতে থাকা তথ্য অনুযায়ী, জিল হোসেনের জন্ম ১৯৫০ সালের ৭ জানুয়ারি। ১৯৭১-৭২ শিক্ষাবর্ষে তিনি ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকের (কৃষি) পরীক্ষার্থী ছিলেন। এই পরীক্ষা হয় ১৯৭৩ সালে। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পরীক্ষার ফলাফলে তাঁকে অকৃতকার্য ঘোষণা করে। ফলাফল পুনর্বিবেচনা চেয়ে একাডেমিক কাউন্সিলে আবেদন করেন জিল হোসেন। কিন্তু সেই আবেদনে কাজ হয়নি।
১৯৭৫ সালে জিল হোসেন আবার পরীক্ষায় অংশ নেন, কিন্তু তাঁকে বহিষ্কার করা হয়। এসবের প্রতিকার চেয়ে ১৯৭৫ সালের ২২ এপ্রিল ময়মনসিংহের প্রথম মুনসেফ আদালতে তিনি মামলা করেন। মামলায় তিনি দাবি করেছিলেন, তাঁর প্রাপ্ত নম্বরের (১৯৭৩ সালে দেওয়া পরীক্ষায়) সঙ্গে ভগ্নাংশ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নম্বরের সঙ্গে ভগ্নাংশ যোগ না করে তাঁকে অকৃতকার্য ঘোষণা করে।
সেই আইনি লড়াইয়ের শুরু। নিম্ন আদালত পেরিয়ে বছরের পর বছর উচ্চ আদালতেও ছুটেছেন তিনি। সিরাজগঞ্জ সদরের চিলগাছা গ্রামে পরিবার নিয়ে থাকতেন জিল হোসেন। ছোটখাটো ব্যবসা করে সংসার চালাতেন। সংসারে স্ত্রী এবং চার ছেলে ও চার মেয়ে রয়েছে। আইনি লড়াই নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই ২০২২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মারা যান জিল হোসেন। এর পর থেকে মামলায় পক্ষ হয়ে তাঁর স্ত্রীসহ উত্তরাধিকারীরা লড়াই করে যাচ্ছেন।
বাবা উচ্চ আদালতের রায় দেখে যেতে পারেননি। বাবা নেই, বুকে চাপা কষ্ট হয়। বাবার কাছে শুনেছি, মামলা চালাতে গিয়ে জমিসহ অনেক কিছুই হারাতে হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের খামখেয়ালির কারণে বাবার জীবন ধ্বংস হয়েছে, আমাদেরও ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।নূর হোসেন, বাদী জিল হোসেনের ছোট ছেলেজিল হোসেনের ছোট সন্তান নূর হোসেন গত শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাবা উচ্চ আদালতের রায় দেখে যেতে পারেননি। বাবা নেই, বুকে চাপা কষ্ট হয়। বাবার কাছে শুনেছি, মামলা চালাতে গিয়ে জমিসহ অনেক কিছুই হারাতে হয়েছে।’ তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের খামখেয়ালির কারণে বাবার জীবন ধ্বংস হয়েছে, আমাদেরও ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।’
আরও পড়ুনশিক্ষাসনদ নিয়ে ৪৮ বছরের আইনি লড়াই: ২ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণের রায় বাস্তবায়নে বাধা নেই০৮ অক্টোবর ২০২৩নূর হোসেন আরও বলেন, ‘মা এবং ভাইবোনেরা এখন মামলা চালাচ্ছি। মায়ের বয়স ৬৯ বছর। তিনিও নানা রোগে ভুগছেন। তিনিও চূড়ান্ত রায় দেখে যেতে পারবেন কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের লিভ টু আপিল এখন আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায় আছে। বাবা মারা যাওয়ার পরও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কোনো অনুশোচনা নেই, এটা কষ্টের।’
আইনি লড়াই
জিল হোসেন যখন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক (কৃষি) দ্বিতীয় পর্বের চতুর্থ বর্ষের পুরোনো পাঠ্যক্রমের চূড়ান্ত পরীক্ষার্থী ছিলেন, তখন তাঁর বয়স ২৩ বছর। ময়মনসিংহের মুনসেফ আদালতে করা মামলায় জয়ী হন তিনি। আদালত ১৯৭৫ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর একাডেমিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করেন। একই সঙ্গে ভগ্নাংশ নম্বর যোগ না করে তাঁকে অকৃতকার্য করাকেও বেআইনি ঘোষণা করা হয়।
তবে জিল হোসেনের লড়াই তখনো বাকি। ওই রায়ের বিরুদ্ধে জজ আদালতে যায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৬ সালের ৩১ জানুয়ারি এই আদালতের দেওয়া রায়েও জিল হোসেনের বহিষ্কারাদেশ বেআইনি ঘোষণা করা হয়।
একই বছর হাইকোর্টে আপিল করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। হাইকোর্ট ১৯৭৬ সালের ২৪ আগস্ট মামলাটি পুনর্বিচারের জন্য প্রথম মুনসেফ আদালতে পাঠান। এরপর ১৯৭৮ সালের ২৪ জানুয়ারি প্রথম মুনসেফ আদালত ভগ্নাংশ নম্বর যোগ করে ৩০ দিনের মধ্যে জিল হোসেনের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করার নির্দেশ দেন।
আরও পড়ুনসেবাদাতা বা গ্রহীতাদের সন্তুষ্টির মূল্যায়ন হয়নি২৮ এপ্রিল ২০২২এর বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আবার জেলা জজ আদালতে আপিল করে, যা নামঞ্জুর হয়। পরে হাইকোর্টে আপিল করে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এর ওপর ১৯৮৩ সালের ১৬ জানুয়ারি রায় দেওয়া হয়। এ রায়ে বিচারিক আদালতের সিদ্ধান্ত বহাল থাকে।
অতঃপর সনদ, ক্ষতিপূরণ মামলা
পরিবার ও মামলাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, হাইকোর্টের রায়ের পর ১৯৮৬ সালের ২৮ ডিসেম্বর জিল হোসেনের একটি আবেদন গ্রহণ করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। পরে তাঁকে পাস নম্বর দিয়ে ১৯৯৭ সালের ২২ অক্টোবর নম্বরপত্রের সনদ দেওয়া হয়। তখন জিল হোসেনের বয়স ৪৭ বছর। তখন তাঁর সরকারি চাকরির বয়সসীমা অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে।
লিভ টু আপিল বিচারাধীন উল্লেখ করে একের পর এক সময় নিচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সুপ্রিম কোর্টর স্থগিতাদেশ না থাকায় মামলা চলতে আইনগত বাধা নেই। অথচ মামলাটি চলছে না, যা জিল হোসেনের পরিবারের জন্য ভোগান্তির।চঞ্চল কুমার বিশ্বাস, বাদীপক্ষের আইনজীবীএরপর ২০০০ সালের ১৮ অক্টোবর ক্ষতিপূরণ দাবি করে অধস্তন আদালতে মামলা করেন জিল হোসেন। মামলায় অভিযোগ করেন, হাইকোর্টের রায় ১৪ বছর ৯ মাস পরে কার্যকর করেছে বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন কাজে তাঁর জীবন ধ্বংস হয়ে গেছে। নষ্ট হয়েছে সরকারি চাকরির সম্ভাবনাও।
ক্ষতিপূরণের এ মামলায় ২০০৮ সালের ২৬ আগস্ট রায় দেন ময়মনসিংহের প্রথম যুগ্ম জেলা জজ আদালত। রায়ে ৩০ দিনের মধ্যে জিল হোসেনকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে ২ কোটি টাকা দিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়।
১৪ বছর পর নিষ্পত্তি
বিচারিক আদালতের ওই রায়ের বিরুদ্ধে ২০০৯ সালে হাইকোর্টে আপিল করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৯ সালের ৪ জুন হাইকোর্ট শর্ত সাপেক্ষে ময়মনসিংহের প্রথম যুগ্ম জেলা জজ আদালতের ২ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আদেশ স্থগিত করেন। শর্ত হিসেবে ২ কোটি টাকার ১২ দশমিক ৫ শতাংশ, অর্থাৎ ২৫ লাখ টাকা ৩ মাসের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে সংশ্লিষ্ট আদালতে জমা দিতে বলা হয়। এতে ব্যর্থ হলে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হয়ে যাবে বলেও ওই আদেশে উল্লেখ করা হয়।
সংশ্লিষ্ট আইনজীবী জানান, জিল হোসেন মারা যাওয়ার পর আপিল শুনানির জন্য উঠলে ১৩ বছর আগে হাইকোর্ট ২ কোটি টাকার ১২ দশমিক ৫ শতাংশ সংশ্লিষ্ট আদালতে জমা দিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে যে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তা সামনে আসে। এ অবস্থায় হাইকোর্ট আপিলকারী পক্ষকে ২৫ লাখ টাকা জমা দিয়ে আসতে বলেন। পরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ২০২২ সালে ৪ নভেম্বর ওই অর্থ জমা দেয়।
বিষয়টি আপিল বিভাগে বিচারাধীন। বিচারাধীন থাকলে নিম্ন আদালতে সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী কার্যক্রম স্থগিত থাকে। এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তও আছে। আমরা শুনানির জন্য প্রস্তুত আছি।এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে নিয়োগ দেওয়া জ্যেষ্ঠ আইনজীবীবিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের করা আপিল খারিজ করে ২০২৩ সালের ৭ মার্চ রায় দেন হাইকোর্ট। ২ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে বিচারিক আদালতের দেওয়া রায় সংশোধন সাপেক্ষে বহাল রাখেন হাইকোর্ট। রায়ের দিন থেকে ওই অর্থের বিপরীতে ১০ শতাংশ হারে তারা (জিল হোসেনের পরিবার) লভ্যাংশ পাবেন বলেও জানানো হয়। অবশ্য এর আগে শর্ত অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের জমা করা ২৫ লাখ টাকা ওই অর্থ থেকে বাদ যাবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের লিভ টু আপিল
হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে ২০২৩ সালে লিভ টু আপিল করে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। সেই সঙ্গে হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে আবেদন করা হয়। আবেদনটি ২০২৩ সালের ৮ অক্টোবর আপিল বিভাগে শুনানির জন্য ওঠে। শুনানি নিয়ে সেদিন তৎকালীন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের আপিল বিভাগ স্থগিতাদেশ চেয়ে করা আবেদন খারিজ করে দেন। লিভ টু আপিল ক্রম অনুসারে শুনানি হবে বলে আদেশে উল্লেখ করা হয়। এর ধারাবাহিকতায় লিভ টু আপিলটি শুনানির জন্য আপিল বিভাগের গত ৩১ আগস্টের কার্যতালিকায় ৫০৭ নম্বর ক্রমিকে ওঠে।
জিল হোসেনের পরিবারের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টে মামলাটি পরিচালনার জন্য ২০২৩ সালের ৯ মার্চ আইনজীবী চঞ্চল কুমার বিশ্বাস নিয়োগ পান। তাঁকে নিয়োগ দেয় সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটি। চঞ্চল কুমার বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আবেদন আপিল বিভাগ খারিজ করেছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে নিম্ন আদালতে অর্থ আদায়ে জারি মামলার (২০০৯ সালে করা) কার্যক্রম অগ্রসরের জন্য বাদীর উত্তারাধিকারীকারেরা আবেদন করেন।
আরও পড়ুনসনদ ও ক্ষতিপূরণের জন্য ৪৭ বছরের আইনি লড়াই ১৭ ডিসেম্বর ২০২২চঞ্চল কুমার বিশ্বাস বলেন, লিভ টু আপিল বিচারাধীন উল্লেখ করে একের পর এক সময় নিচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সুপ্রিম কোর্টের স্থগিতাদেশ না থাকায় মামলা চলতে আইনগত বাধা নেই। অথচ মামলাটি চলছে না, যা জিল হোসেনের পরিবারের জন্য ভোগান্তির।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে নিয়োগ দেওয়া জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষয়টি আপিল বিভাগে বিচারাধীন। বিচারাধীন থাকলে নিম্ন আদালতে সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী কার্যক্রম স্থগিত থাকে। এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তও আছে। আমরা শুনানির জন্য প্রস্তুত আছি।’
আরও পড়ুন৩৩ বছর কেটে গেছে, কাজল কথা রেখেছেন০৫ আগস্ট ২০২৫