গত ২১ মে থেকে ৩ জুন। এই ১৪ দিন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। তার অনুপস্থিতি ব্যাপক জল্পনা-কল্পনার জন্ম দিয়েছে। বিশেষ করে এ সময়ে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির (সিসিপি) অস্বাভাবিক তৎপরতা দেখা গেছে। এই পরিস্থিতে অনেকের প্রশ্ন, দেশটিতে নেতৃত্বে কী পরিবর্তন আসছে?

মনে রাখতে হবে, শি জিনপিং গত ১২ বছর ধরে প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে রয়েছেন। করোনা ভাইরাস বিশ্ব অর্থনীতিতে যে আঘাত হেনেছে, তার ক্ষত এখনও পুরোপুরি কাটেনি। বিশেষ করে চীনের অর্থনীতি যে শ্লথ প্রবৃদ্ধির কবলে পড়েছে, তা থেকে বের হতে পারছে না। এজন্য স্থানীয় সরকারের ঋণ, রিয়াল এস্টেট ব্যবসায় ধস, বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাওয়ার মতো নানা কারণ দায়ী। এর সঙ্গে রয়েছে ভোক্তা চাহিদা কমে যাওয়া। বয়স্ক মানুষ বেড়ে যাওয়া। তাদের পেনশনের জন্য বিপুল ব্যয়। আর এদের হাত ধরে দেশটি উন্নয়নশীল অবস্থা থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত উন্নত হওয়ার আগেই নিরাময়অযোগ্য এক অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে দেশটি। সরকার অর্থনীতিতে গতি আনতে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদে নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। কিন্তু সমস্যা কাটাতে পারছে না।

এরই মধ্যে শি জিনপিংয়ের এই লোকসমক্ষে না আসার ঘটনা। এ সময় একজন গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ব্যক্তির রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে সূক্ষ্ম পরিবর্তন ঘটেছে। এসব দেখে সর্বোচ্চ স্তরে একটি সম্ভাব্য ক্ষমতার লড়াইয়ের ইঙ্গিত পাচ্ছেন চীনা রাজনীতির বিশ্লেষকরা।

এটা ঠিক, চীন কোন পথে যাবে- এর বৈশ্বিক এবং আঞ্চলিক প্রভাব রয়েছে। সিসিপি চলার পথ না পাল্টালে স্থানীয় ঋণ এবং ব্যাংকিং ব্যবস্থার পতন কি অনিবার্য? অভ্যন্তরীণ সংকট থেকে দৃষ্টি সরাতে যুদ্ধ বা অন্য কোনো কৌশল নিতে পারে কি? চীনের অভ্যন্তরে এমন অনেক ঘটনা ঘটছে, যা এই অঞ্চল, বিশেষ করে এশিয়াসহ বাকি বিশ্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ। এসব নিয়েই জাপান ফরোওয়ার্ডের বিশ্লেষণী প্রতিবেদন।

শি জিনপিংয়ের অনুপস্থিতি নজিরবিহীন

শি জিনপিংয়ের সাম্প্রতিক ১৪ দিনের অনুপস্থিতি নজিরবিহীন ঘটনা। ২০১২ সালের মতো আগের অনুপস্থিতিগুলোর থেকে এটা ভিন্ন। তখন তিনি সাধারণ সম্পাদক হওয়ার জন্য ক্ষমতা সংহত করছিলেন। আবার ২০২৩ সালের মতোও নয়। তখন মস্তিষ্কের অস্ত্রোপচার করায় পর্দার আড়ালে ছিলেন বলে খবর রটেছিল। এবার তার অনুপস্থিতি ক্ষমতার লড়াইয়ের ক্রমাগত গুঞ্জনের পরে ঘটেছে।

চীনের স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো জানায়, ২০২৪ সালের এপ্রিলেই প্রভাব হারিয়ে থাকতে পারেন শি। তার কর্তৃত্ব পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে সামরিক বাহিনীর অনুগত অংশ।

শির স্ত্রী পেং লিউয়ান সাম্প্রতিক বিদেশ সফরে তার সঙ্গী হননি। দেশের ভেতরে শির পরিষদবর্গের পদমর্যাদা কমান হয়েছে। উপপ্রধানমন্ত্রী হে লাইফেংয়ের মতো নিম্নপদস্থ কর্মকর্তারা সিসিপির দপ্তর সম্পাদক কাই কির মতো সিনিয়র ব্যক্তিদের স্থলাভিষিক্ত হচ্ছেন।

সিসিপির কেন্দ্র থেকে অস্বাভাবিক সংকেত

সিসিপির কার্যক্রমেও অনিয়ম দেখা গেছে। পলিটিক্যাল ব্যুরো নিয়মিত মাসিক বৈঠক করে। তারা গত মে মাসের শেষে বৈঠক করতে ব্যর্থ হয়েছে। এর আগের বৈঠকে গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল, শি-কে ক্ষমতাচ্যুত করা হতে পারে।

রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম পিপলস ডেইলি গত ২ থেকে ৪ জুন প্রথম পাতায় শি জিনপিং এবং অন্যান্য শীর্ষ নেতার খবর ছাপেনি। তারা কার্বন হ্রাস এবং আঞ্চলিক উন্নয়নের মতো বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে ছেপেছে। একে অস্বাভাবিক বলে মনে করছেন স্থানীয় সাংবাদিকরা।

লিবারেশন আর্মি ডেইলি গত ৩০ মে একটি নিবন্ধের শিরোনাম করেছে, ‘জনগণের ক্ষমতা অবশ্যই জনগণের সেবা করবে’। এতে শি-কে সমালোচনা করে ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে সতর্ক করা হয়েছে। এই খবরটি অন্যান্য সরকারি মাধ্যমগুলোও প্রচার করে। এই ব্যতিক্রমগুলো শির নেতৃত্ব থেকে ইচ্ছাকৃত দূরত্বের ইঙ্গিত বহন করে।

জু কিলিয়াংয়ের রহস্যজনক মৃত্যু

কেন্দ্রীয় সামরিক কমিশনের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান জু কিলিয়াংয়ের মৃত্যু এই জল্পনায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। তিনি শির ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন।

এই মৃত্যুর খবর আনুষ্ঠানিকভাবে ৩ জুনে ঘোষণা করা হয়। এর পাঁচ দিন আগে জুর মৃত্যুর খবর প্রাক্তন চীনা সাংবাদিক ঝাও লানজিয়ান জানিয়েছিলেন। তিনি দাবি করেন, জু তীব্র চাপের মধ্যে ‘ভয়ে মারা গেছেন’।

১৯৮০-এর দশকের শেষের দিকে এবং ১৯৯০-এর দশকের প্রথম দিকে শির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন জু। শির সামরিক সংস্কারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তার এই মৃত্যুর কোনো স্পষ্ট কারণ প্রকাশ করা হয়নি। এছাড়া হে ওয়েইডং এবং মিয়াও হুয়ার মতো অন্যান্য সামরিক অনুগতরা সম্প্রতি শির কাছ থেকে দূরে সরে গেছেন।

প্রাদেশিক পর্যায়ে নীরব রদবদল

শির এই অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে বেশ কয়েকটি উচ্চ-পর্যায়ের পদে পরিবর্তন আনা হয়েছে। গত ৩০ মে ঝেং ইয়ানক্সিয়ংকে হংকংয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের যোগাযোগ অফিসের পরিচালক পদ থেকে অপসারণ করা হয়। কেউ কেউ এই পদক্ষেপটিকে ওয়াং ইয়াং-এর সম্ভাব্য উত্থানের সঙ্গে যুক্ত করেছেন। তিনি সংস্কারপন্থী নেতা হিসেবে পরিচিত। শির উত্তরসূরি বলে তাকে পরিচিত করানো হচ্ছে।

ওয়াং ২০১১ সালের উকান গ্রামের বিক্ষোভে মধ্যপন্থী ব্যবস্থাপনার জন্য পরিচিত। শির কঠোর নীতির সঙ্গে এ ঘটনা বৈসাদৃশ্যপূর্ণ। তিনি ২০১৬ সালে উকানের গণতান্ত্রিক নির্বাচনের ওপর দমনপীড়ন চালিয়েছিলেন।

অন্যান্য প্রাদেশিক এবং মন্ত্রী পর্যায়ের কর্মকর্তা পদে রদবদল আনা হয়েছে। এসবই ক্ষমতা পরিবর্তনের একটি চলমান প্রক্রিয়ার ইঙ্গিত দিতে পারে।

মিলে যাচ্ছে অতীতের ক্ষমতা পরিবর্তনের সঙ্গে

ইতিহাস বলছে, নেতারা ক্ষমতা হারালে তা বিলম্বে ঘোষণা করে সিসিপি। দেং জিয়াওপিংয়ের সংস্কার কার্যক্রমের সমালোচনার পর ১৯৭৮ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত (প্রায় তিন বছর) আড়ালে ছিলেন মাও সেতুংয়ের উত্তরসূরি হুয়া গুওফেং।

১৯৮৭ সালের জানুয়ারিতে সাধারণ সম্পাদক পদ ছাড়েন হু ইয়াওবাং। এর নয় মাস পরে অক্টোবরে নিশ্চিত করা হয়েছিল ঘটনাটি।

১৯৮৯ সালের মে মাসে ছাত্র বিক্ষোভকারীদের প্রতি সহানুভূতি দেখানোয় ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন ঝাও জিয়াং। আনুষ্ঠানিক অপসারণ হওয়ার আগেই তিয়ানআনমেন স্কোয়ারে ভাষণ দিতে এসেছিলেন তিনি। এ ঘটনাগুলো থেকে বোঝা যায়, শি হয়তো নামমাত্র নেতা হিসেবে রয়েছেন। এমনকি তার ক্ষমতা কমানো হয়ে থাকলেও সিসিপি ঐক্যের মুখোশ খুলবে না।

সামাজিক অস্থিরতা এবং উদ্বেগ

তৃণমূল পর্যায়ে উত্তেজনা সুস্পষ্ট। গত ২০ মে ৮০০ আরএমবি (১১১ মার্কিন ডলার) মজুরি না পাওয়ায় টেক্সটাইল কারখানায় আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এ আগুন ৩৭ ঘণ্টা ধরে জ্বলে এবং উল্লেখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতি হয়।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জনসাধারণের সহানুভূতি ছিল বেতন না পাওয়া কর্মীর পক্ষে। এটা পদ্ধতিগত বৈষম্যের প্রতি গভীর হতাশার প্রতিফলন।

চীনা রাজনীতির বিশ্লেষক ইউয়ান হংবিং জানিয়েছেন, মধ্য ও নিম্ন-স্তরের সিসিপি নেতারা পরিবর্তনের প্রত্যাশায় সামরিক, রাজনৈতিক এবং ব্যবসায়িক জোট তৈরি করছেন। এটা চীনা সমাজে বিরাজমান উদ্বেগের প্রতিফলন।

চীন কি ক্ষমতার সড়কের মোড়ে দাঁড়িয়ে?

চীন এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছে। আগামী আগস্টে সিসিপির আসন্ন চতুর্থ পূর্ণাঙ্গ অধিবেশন। সেখানে হয়তো শি জিনপিংয়ের ভাগ্য নির্ধারণ হতে পারে। সেটাই বলে দেবে কোন পথে যাবে চীন। নতুন নেতারা কি পার্টির স্বৈরাচারী মডেল ত্যাগ করবেন? নাকি তারা শি-কে বলির পাঠা বানিয়ে ব্যবস্থাটি টিকিয়ে রাখবেন? আপাতত গুজব ডালপালা মেলছে। ইতিহাসের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ। পরিস্থিতি ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছে বিশ্ব। আপাতত, শি-কে ঘিরে অস্বাভাবিক ঘটনা এবং সিসিপির মুখোশের ফাটলগুলো চীনের ভবিষ্যৎ গতিপথ সম্পর্কে একটি গভীর অনিশ্চয়তার ইঙ্গিত দেয়।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: অন য ন য ক ষমত র পর য য ঘন ষ ঠ সরক র ব যবস

এছাড়াও পড়ুন:

‘হাসিনার আমলই ভালো ছিল’—এটা কোন ঘরানার গান

ইদানীং কিছু ভদ্রলোক ইনিয়ে-বিনিয়ে, এমনকি সুযোগ বুঝে সরাসরিও বলে ফেলছেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ের চেয়ে শেখ হাসিনার শাসনেই দেশ ভালো চলছিল। দু–একজন এ-ও বলছেন, গত ৪০ বছরে এখনকার মতো খারাপ অবস্থা নাকি তাঁরা দেখেননি।

এই ‘মহামানবদের’ কথা মান্য করলে প্রশ্ন এসেই যায়, কী লাভ হলো গণ–অভ্যুত্থান করে, এত জীবন বিসর্জন দিয়ে, এত রক্ত ঝরিয়ে?

আওয়ামী লীগের শত্রুরা উত্তর দিক: সরকারি চাকরিতে কোটাবিরোধী আন্দোলনকে হাসিনা পতনের এক দফা দাবিতে রূপান্তরের কী প্রয়োজন ছিল? গণবিস্ফোরণ ঘটিয়ে দেড় দশকে গড়ে ওঠা এক শক্তিশালী ব্যবস্থাকে ভেঙে খান খান করে ফেলার কী এমন প্রয়োজন ছিল?

হাসিনা-পরবর্তী এই ‘ভগ্ন হৃদয়ের’ যুগে ভারতীয় শিল্পী কবির সুমনের সে গানটি ‘প্রথমত আমি তোমাকে চাই...শেষ পর্যন্ত তোমাকে চাই’ শুনি আর ভাবি, ২০২৪-এর ‘ডামি’ নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনাকে আজীবন ক্ষমতায় দেখতে চাওয়া অলিগার্কদের কী যে আকুতি ছিল!

মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে নেত্রীর পতন দেখে হয়তো সেদিন তাঁরা শুনেছেন কিংবা গেয়েছেন অন্য কোনো গান। হতে পারে আরেক ভারতীয় শিল্পী হৈমন্তী শুক্লার গাওয়া সেই গান তাঁরা গেয়েছিলেন, ‘চেয়ে চেয়ে দেখলাম তুমি চলে গেলে...আমার বলার কিছু ছিল না।’

আক্ষেপ কেন, কমরেড, জীবন নিয়ে পালিয়ে তো তিনি নিরাপদেই আছেন দিল্লিতে!

তবু ‘সে কি ভোলা যায়, তুমি আমারই ছিলে’ হে বাংলাদেশ সাম্রাজ্য! সত্যিই তো তাঁর এবং তাঁদের একচেটিয়া অধিকার ছিল যেভাবে খুশি যত বেশি ক্ষমতা, অর্থ, প্রতিপত্তি ভোগের।

একটি অভিজাত গোষ্ঠীকে (অলিগার্কি) হাসিনা-প্রদত্ত সেই লাভজনক স্থিতাবস্থা হারিয়ে কীভাবে চুপ করে বসে থাকবে এর ‘ভাগ্যবান’ সদস্যরা! নতুন রাজনৈতিক বিনিয়োগও কিছু দরকার হবে যদি ভবিষ্যৎ মুনাফার আশা করতে হয়।

টাকাওয়ালাদের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়, বিনা ভোটে বা জালিয়াতির মাধ্যমে সংসদ সদস্য পদ বা মন্ত্রিত্ব উপহার, তাঁর চামচাদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ ও পদোন্নতি এবং দলীয় অনুগতদের মিডিয়ার লাইসেন্স প্রদানসহ কত ধরনের দান-দক্ষিণার ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন ‘ষোলো কোটি মানুষকে খাওয়ানোর’ দাবিদার বর্তমানে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগপ্রধান হাসিনার সরকার।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে কর্ণফুলী টানেল, পদ্মা সেতু থেকে গভীর সমুদ্রবন্দর, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে থেকে টোল রোড, ডজন ডজন নতুন ব্যাংক থেকে শত বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি—এ রকম বড় বড় ব্যয়বহুল প্রকল্প গ্রহণে তাঁর কোনো তুলনাই হয় না।

একটু–আধটু দুর্নীতি হলেও অন্তত মধ্য আয়ের দেশ হওয়ার স্বপ্ন তো দেখাচ্ছিলেন তাঁর সভাসদরা। এই ধরুন, লাখো কোটি টাকার ব্যাংকঋণ জালিয়াতি, খেলাপি, দলীয় নেতা মাস্তানদের হাজার হাজার কোটি টাকার চাঁদাবাজি ও সম্পদ লুণ্ঠন, বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার পাচার ইত্যাদি বিষয় দেড় দশকের স্থিতিশীলতার তুলনায় এমনকি বাড়াবাড়ি!

যাদের ‘এতিম’ করে রেখে উনি চলে গেলেন, তাদের কারও কারও বক্রোক্তি এ রকম: এক অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের পর বহুত শখ করে তো ক্ষমতায় বসিয়েছিলেন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে; তাঁর সরকার এখন পর্যন্ত কী করতে পেরেছে? নির্বাচন, সংস্কার, হত্যা ও দুর্নীতির বিচার, আইনশৃঙ্খলার উন্নতি, অর্থনীতি জোরদার—কোনটি পেরেছে?

জনগণকে কষ্ট করে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার বিকল্প ব্যবস্থাও করে দিয়েছিলেন জনদরদি হাসিনা সরকার। ২০১৪ সালের ১৫৪ সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত, ২০১৮ সালে নৈশকালীন ভোট এবং ২০২৪ সালে ডামি নির্বাচন করে হাসিনা তাঁর বাবা শেখ মুজিবের তৈরি একদলীয় বাকশাল ব্যবস্থার নতুন মডেল দাঁড় করান পৃথিবীর সামনে।

যাঁরা এই আওয়ামী শাসনের ‘স্থিতিশীলতা’ নস্যাৎ করতে চেয়েছে তাদের ‘ঠ্যাং ভেঙে’ দিতে একটুও দ্বিধা করেনি হাসিনা সরকার। সরকারের ধারাবাহিকতা নষ্টের চেষ্টাকারীদের ‘উচিত শিক্ষা’ দেওয়া হয়েছে গুম, খুন, সহিংসতা, জঙ্গিনাটক, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, প্রতিবাদ দমন ও বাক্‌স্বাধীনতা হরণের মাধ্যমে। সে জন্য আপনারা তাঁকে ফ্যাসিবাদী বলার সাহসও পাননি তখন।

জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে হাজারো তরুণ ও সাধারণ মানুষ নিহত (শহীদ) হওয়ার দায় নিতে চাননি হাসিনা। উল্টো তাঁর দাবি, ৫ আগস্ট তাঁকে মারতেই লক্ষ জনতা গণভবন অভিমুখে যাত্রা করেছিল।

আরও পড়ুন‘আমি কী অপরাধ করেছি’— সবাই জানেন শিরোনামটা...৩০ জুলাই ২০২৫

আরও রক্তপাত এড়াতেই নাকি তাঁর নিজের লোকদের মায়া ছেড়ে ‘একলা চলো’ নীতি অবলম্বন করে ভারতে পাড়ি জমান শেখ হাসিনা।

তাই আজ তাঁর ফেরার অপার ইচ্ছা যেন স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদের পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি গানের মতোই, ‘তোমাদের পাশে এসে বিপদের সাথি হতে আজকের চেষ্টা আমার।’

যাদের ‘এতিম’ করে রেখে উনি চলে গেলেন, তাদের কারও কারও বক্রোক্তি এ রকম: এক অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের পর বহুত শখ করে তো ক্ষমতায় বসিয়েছিলেন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে; তাঁর সরকার এখন পর্যন্ত কী করতে পেরেছে? নির্বাচন, সংস্কার, হত্যা ও দুর্নীতির বিচার, আইনশৃঙ্খলার উন্নতি, অর্থনীতি জোরদার—কোনটি পেরেছে?

যেন এত সব বিষয় নিয়ে জনমনে কোনো ক্ষোভই ছিল না হাসিনার আমলে। এটি সেই বিস্মৃত অতীত, যেটি নিয়ে কল্পিত সংগীত রচিত হয়: ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’।

আরও পড়ুনশেখ হাসিনা স্বৈরশাসকদের টিকে থাকার দুটি মূলমন্ত্রেই ব্যর্থ২২ আগস্ট ২০২৪

তার মানে, তাঁর শাসনকালই জাতির জন্য ছিল আদর্শ। এটা প্রমাণ করার এক অদৃশ্য প্রচেষ্টা রয়েছে আজ এখানে, আমাদের চারপাশে, আশপাশে।

সত্য, মিথ্যা মিশিয়ে এমন দাবি করেন কারা এবং কেন—সেটা আমাদের একটু বোঝা দরকার।

হাসিনার চামচা ও সুবিধাভোগী, তাঁর ঘরানার অসৎ বুদ্ধিজীবী, তাঁর হত্যাকাণ্ড ও দুর্নীতি নিয়ে নির্বিকার নেতা-কর্মী-সমর্থক, বর্তমান আমলে বিশেষ কিছু না পেয়ে প্রবলভাবে হতাশ কতিপয় সুশীল অথবা পরিস্থিতি সম্পর্কে নির্বোধ ব্যক্তির পক্ষেই ফ্যাসিবাদী শাসনামলকে উত্তম বলা সম্ভব।

এতে হাসিনার লোকদের বড় লাভ হতে পারে দায় স্বীকার না করে বা ক্ষমা না চেয়েই তাঁদের হাত ও নামসমূহকে দুর্নীতি, হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের রক্তের দাগ থেকে মুক্ত করা।

এ প্রচেষ্টা ঘটে যাওয়া সত্যকে অস্বীকার, শহীদদের আত্মত্যাগ অগ্রাহ্য, আহত ব্যক্তিদের প্রতি অশ্রদ্ধা এবং মজলুমদের অনুভূতির সঙ্গে মশকরা ছাড়া আর কিছুই না।

এগুলোই আবার জুলাই বিপ্লবের পক্ষের শক্তির বয়ান তৈরিতে ব্যর্থতা প্রমাণ করে।

আরও পড়ুনহাসিনা শাসনের উন্নয়নের বানোয়াট গল্প০৩ অক্টোবর ২০২৪

পরিবর্তনের পক্ষে জনগণের প্রবল আকাঙ্ক্ষার কোনো কমতি ছিল না এবং হত্যা-দুর্নীতিসহ ফ্যাসিবাদী কর্মকাণ্ডের বিচার এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণের লক্ষ্যে কমবেশি সংস্কারের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক চিন্তা, গণতান্ত্রিক ভাবনা, কিংবা আমলাতান্ত্রিক কর্মসূচিকে জনমত তৈরির জন্য সেভাবে উপস্থাপন করা সম্ভব হয়নি। একটা একটা করে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার উত্তম বিকল্প জনগণের সামনে আনলে গণমানুষকে নতুন ধারণা ও আশাবাদ উপহার দেওয়া যেত।

কয়েকটি মডেল নির্বাচন দিয়ে, তরুণদের পরিবেশ রক্ষার মতো সামাজিক আন্দোলনে সম্পৃক্ত করে, রাজনৈতিক দলসমূহকে দুর্নীতি ও চাঁদাবাজি প্রতিরোধে অংশীদার বানিয়ে এবং গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান ঠিকঠাক করে, সাংবাদিকদের স্বাধীনতা, সুরক্ষা ও কল্যাণ নিশ্চিত করে হাসিনার কুশাসনকে যথাযথভাবে চিত্রিত করা যেত।

ধারণা করি, জনগণের সঙ্গে যোগাযোগে ঘাটতি এবং অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগগুলো সম্পর্কে জনসম্পৃক্ততার অভাব হাসিনার উপকারভোগীদের নিজস্ব গান গাওয়ার পরিসর দিয়েছে।

ফ্যাসিবাদী শাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট রাজনৈতিক দল এবং ২০২৪-এর আন্দোলনে পুরোভাগে থাকা ছাত্র ও অন্য শক্তিগুলো পরস্পরের মধ্যে লজ্জাজনক কুতর্কে জড়িয়ে পড়ায় গণ–অভ্যুত্থান ও পরিবর্তনের এজেন্ডা এবং উপযোগী বয়ান যথেষ্ট মার খেয়েছে। দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নিয়ে জনগণও কিছুটা বিভ্রান্ত ও হতাশ হয়েছে।

বাংলাদেশিদের বর্তমান হতাশা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা তৈরি হওয়াটাই কাম্য ছিল পরাজিত শক্তির। হাসিনা বিহনে আওয়ামী উপকারভোগী বা অন্ধ সমর্থকেরা গোপালগঞ্জ বা অন্য কোনো অঞ্চলে নিরালায় বসে যেন গুনগুন করে গাইছে গগন হরকরার গান, ‘আমি কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যে রে...।’ তারা বুঝতে পারছে না জাতির জীবনে শেখ হাসিনা এমন এক জুলুমশাহি শাসকের নাম ও ফ্যাসিবাদের প্রতিমূর্তি; যার শাসন পুরো দেশকে বানিয়ে ফেলেছিল ‘জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ’।

নিজেদের বাইরে জনগণের অন্য যেকোনো গোষ্ঠীকে ক্ষমতার ভাগ দিতে না চাওয়া সেই ফ্যাসিবাদী ধারায় ছেদ টেনেছে জুলাই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে অধ্যাপক ইউনূসের সরকার গঠন, যেটিও আশা করি বাংলাদেশের শেষ সরকার নয়।

বিদায় নেওয়া ফ্যাসিবাদ রাজনৈতিক মতাদর্শ হিসেবে যেকোনো দেশেই অনেকটা পুরোনো দিনের গান। এই গান অবশ্যই স্মৃতিজাগানিয়া কিন্তু চলমান বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন। ভবিষ্যতে আবারও ফ্যাসিবাদকে সহ্য করবে, এমন প্রজন্ম এ দেশে সেকেলে এবং অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। তরুণেরা এবং অভিজ্ঞ বিবেকবানেরা এখন অজানা এক নতুন বাংলাদেশের অপেক্ষায়।

ফলে ‘হাসিনার আমলই ভালো ছিল’ গান বাদ দিয়ে হাসিনার মানসপুত্রদের এখন নিরালা নিঝুম ও যথাযথ ভাবগম্ভীর পরিবেশে বসে মুদ্রিতনেত্রে মন্দ্রসপ্তক কণ্ঠে ভক্তিভরে গাওয়া উচিত, ‘মা, আমার সাধ না মিটিল, আশা না পুরিল, সকলি ফুরায়ে যায় মা... ।’

খাজা মাঈন উদ্দিন সাংবাদিক

*মতামত লেখকের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • জুলাই সনদে আমাদের যে সম্মতি সেটি আইনের ঊর্ধ্বে: সালাহউদ্দিন
  • সন্ত্রাস, চাঁদাবাজ ও মাদকমুক্ত বন্দর গড়তে চাই : সাখাওয়াত
  • বিএনপির ৩১ দফা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে রূপগঞ্জে লিফলেট বিতরণ 
  • জুলাই আন্দোলনকে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়াবেন না: টুকু
  • সবাই অপেক্ষা করছে একটা নির্বাচনের জন্য
  • ‘হাসিনার আমলই ভালো ছিল’—এটা কোন ঘরানার গান
  • সরকারের ভুল সিদ্ধান্তে দেশে ফ্যাসিবাদ, উগ্রবাদ মাথাচাড়া দিতে পারে: তারেক রহমান
  • সরকারের একটি অংশ অপকৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে: তারেক রহমান
  • ট্রাম্পের প্রতি মার্কিন জনগণের সমর্থন ৪০ শতাংশে ঠেকেছে
  • জাতিসংঘে সম্মেলনের ফাঁকে বাংলাদেশ-পাকিস্তান বৈঠক, ফিলিস্তিন ইস্যুতে উদ্বেগ