চারটি রোডম্যাপ: বিএনপির কাছে জনগণের প্রত্যাশা
Published: 11th, June 2025 GMT
বর্তমানে বাংলাদেশ এমন একটি সময় অতিক্রম করছে, যখন একতা ও সম্প্রীতিকে ভিত্তি করে দেশকে অনেক দূর এগিয়ে নেওয়ার এক অনন্য সুযোগ তৈরি হয়েছে। এই মুহূর্তে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। ফলে দেশগঠনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব তাদের কাঁধেই অনেকাংশে বর্তায়। শুধু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়া বিএনপির একমাত্র উচিত হতে পারে না; বরং নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে নেতৃত্ব প্রদান করা এখন সময়ের দাবি এবং দলের প্রতি জাতির প্রত্যাশা। এই সময় যদি সঠিকভাবে কাজে লাগানো না যায়, যদি কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন সাধিত না হয়, তবে বিএনপি কোনোভাবেই এই দায়ভার এড়িয়ে যেতে পারে না।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সাম্প্রতিক ঘোষণামতে, ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথমার্ধে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। বড় দল হিসেবে বিএনপির এই নির্বাচনে জয়লাভের সম্ভাবনা স্বাভাবিকভাবেই অনেক বেশি। বিএনপি যদি এই নির্বাচনে বিজয়ী হয়, তবে দলটির জন্য জনগণের প্রত্যাশা ও গণ–অভ্যুত্থানের লক্ষ্য পূরণের উদ্দেশ্যে এখন থেকেই চারটি সুপরিকল্পিত রোডম্যাপ প্রণয়ন করা অত্যন্ত জরুরি।
রোডম্যাপ কেন ও কীভাবেবিএনপি যদি আগামী দিনে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে, তবে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ও গণতান্ত্রিক অভিযাত্রাকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে দলটিকে সুপরিকল্পিতভাবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশেষ করে, যেসব কাঠামোগত দুর্বলতা ও শাসনব্যবস্থার বিকৃতি আওয়ামী লীগকে একটি কর্তৃত্ববাদী বা ফ্যাসিবাদী সরকারে পরিণত করেছিল, সেই সব বিষয় চিহ্নিত করে তা সংস্কার করাই হবে বিএনপির প্রধান দায়িত্ব।
জুলাই অভ্যুত্থান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মূলত চারটি প্রধান দাবিকে কেন্দ্র করে জনগণের মধ্যে ঐক্য গড়ে উঠেছিল এবং এই দাবিগুলোই ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থার পতনের ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছিল। সেই পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপির এখন উচিত হবে এই চার মূল দাবিভিত্তিক চারটি পৃথক রোডম্যাপ ঘোষণা করা। এই রোডম্যাপগুলো হবে:
১.
২. দুর্নীতি ও চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে রোডম্যাপ;
৩. ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে রোডম্যাপ এবং
৪. গুম, খুন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে রোডম্যাপ।
শুধু রোডম্যাপ প্রণয়ন করলেই চলবে না, বরং তা বাস্তবায়নের জন্য একটি সময়ভিত্তিক পূর্বপরিকল্পনাও থাকা প্রয়োজন। এই বাস্তবায়ন পরিকল্পনাটি তিনটি ধাপে সম্পন্ন করা যেতে পারে। প্রথম ধাপে, সরকার গঠনের পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে জরুরি কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে; যেমন অন্তর্বর্তী সরকারের সময় যেসব সংস্কার–উদ্যোগ সংসদ বিদ্যমান না থাকার কারণে বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না, তা দ্রুত কার্যকর করা।
দ্বিতীয় ধাপে, ছয় মাসের মধ্যে চারটি রোডম্যাপ ও সার্বিক সংস্কার বাস্তবায়ন কতটুকু হয়েছে এবং আরও কী কী প্রয়োজন, তা পর্যালোচনা করে একটি মধ্যবর্তী প্রতিবেদন জনগণের সামনে পেশ করা।
তৃতীয় এবং সর্বশেষ ধাপে এক বছরের মধ্যে চারটি রোডম্যাপের পূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করে একটি নতুন বাংলাদেশের ভিত্তি রচনা করতে হবে।
অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচনের রোডম্যাপবাংলাদেশে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নির্বাচন মানেই যেকোনোভাবে জয়লাভ করার প্রবণতা। এই সংস্কৃতির অংশ হিসেবে দেখা যায়, ভোট কেনাবেচা, কেন্দ্র দখল, জাল ভোট প্রদান, এমনকি ফলাফল ঘোষণার সময় ফলাফল পাল্টে দেওয়ার মতো ঘটনাও যেন স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। এটি শুধু গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগের শাসনামলেই ঘটেছে, এমন নয়। আসলে এই অসুস্থ নির্বাচনী সংস্কৃতির সূচনা স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়েই শেখ মুজিবুর রহমানের আমলেই শুরু হয়, যা পরবর্তী প্রতিটি সরকারের আমলে বহাল থাকে।
অতএব নির্বাচনব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা শুধু আওয়ামী লীগের ব্যর্থতা দূর করার বিষয় নয়; বরং এটি পুরো রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে নতুনভাবে গঠনের একটি ঐতিহাসিক সুযোগ।
চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানের পরও যদি পুরোনো ভঙ্গুর নির্বাচনী ব্যবস্থা বহাল থাকে, তবে তা হবে খুবই দুঃখজনক। এই পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপির দায়িত্ব হবে একটি সুস্পষ্ট, সময়ভিত্তিক ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন সংস্কারের রোডম্যাপ প্রণয়ন করা। যদিও দলটি জাতীয় নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আয়োজনের পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছে, তবু তাদের স্মরণ রাখতে হবে যে ২০০৬ সালে দলটি যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করেছিল, তা বিরোধী পক্ষের কাছে একপেশে ও পক্ষপাতদুষ্ট হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল; যা কিনা ‘ওয়ান ইলেভেন’ ঘটার অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়।
যেহেতু বিএনপি স্থানীয় সরকার নির্বাচন নির্বাচিত সরকারের অধীনেই আয়োজন করতে চায়, সে ক্ষেত্রে কোন প্রক্রিয়ায় তারা স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজন করবে, তা সবার কাছে পরিষ্কার থাকা প্রয়োজন, যাতে স্থানীয় সরকার নির্বাচনও সব পক্ষের আস্থার প্রতীক হয়ে উঠতে পারে। সার্বিকভাবে, এই নির্বাচনবিষয়ক রোডম্যাপ হবে জাতির প্রতি বিএনপির একটি প্রতিশ্রুতি এবং একই সঙ্গে আগামী দিনের ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার নির্বাচন নিশ্চিত করার একটি কর্মপরিকল্পনা।
দুর্নীতি এবং চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে রোডম্যাপগত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে দেশে যে দুর্নীতির সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, তা জাতির শরীরে এক গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করেছে। প্রশাসন থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, আর্থিক প্রতিষ্ঠান কিংবা স্থানীয় রাজনীতি—সবখানেই দুর্নীতির বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়েছিল। বিগত সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোটি কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণ করে, আওয়ামী সরকার কতটা দুর্নীতিপ্রবণ ছিল।
৫ আগস্টের গণ–অভ্যুত্থানের পর মানুষ অর্থনৈতিক মুক্তি ও শুদ্ধি অভিযানের যে স্বপ্ন দেখেছিল, বিএনপি তা পূরণে এখনো কার্যকর পরিকল্পনা হাজির করতে পারেনি; বরং দেখা যাচ্ছে, যেসব জায়গায় আগে আওয়ামী লীগ চাঁদাবাজি ও মাস্তানি চালাত, সেসব স্থান এখন বিএনপির কর্মীদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। আওয়ামী লীগের যেসব ‘পকেট লিডার’ ক্ষমতার অপব্যবহার করতেন, সেসব জায়গায় এখন বিএনপির সমর্থকদের তৎপরতা বাড়ছে, যা জনমনে গভীর উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে এবং বিএনপির ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
এমন বাস্তবতায় বিএনপির উচিত দুর্নীতি ও চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট ও বাস্তবমুখী রোডম্যাপ জনগণের সামনে উপস্থাপন করা। তাদের জানাতে হবে, সরকার গঠনের পর কোন কোন খাতে তারা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুদ্ধি অভিযান চালাবে, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কী ধরনের আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে, প্রশাসন ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে পুনর্গঠন করা হবে এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে জবাবদিহি কীভাবে নিশ্চিত করা হবে।
ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে রোডম্যাপসাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা এক সংবাদ সম্মেলনে মন্তব্য করেছিলেন, ‘আমরা ভারতকে এত কিছু দিয়েছি যে ভারত তা আজীবন মনে রাখবে।’ তাঁর এই বক্তব্য শুধু রাজনৈতিক সৌজন্যের সীমা অতিক্রম করেনি, বরং এটি বাংলাদেশের স্বার্থ বিসর্জনের এক স্বীকারোক্তি।
বিগত সময়ে আওয়ামী লীগ সরকার ও ভারতের সম্পর্ক ছিল যেন প্রাচীন আমলের রাজা-বাদশাহদের করদরাজ্য ব্যবস্থার মতো, যেখানে ছোট রাজ্যগুলো বড় রাজ্যের অনুকম্পা লাভের আশায় নিজেদের সম্পদ ও সম্মান বিসর্জন দিত। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের প্রতীকী চিত্রটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে ফেলানী হত্যাকাণ্ডে, যেখানে বিএসএফ সদস্যরা এক নিষ্পাপ কিশোরীকে গুলি করে হত্যা করে কাঁটাতারে ঝুলিয়ে রেখেছিল। এ ছাড়া ফারাক্কা ও তিস্তা বাঁধের দিকে লক্ষ করলে দেখা যায়, এগুলো বাংলাদেশে পানিসংকট ও লবণাক্ততা বৃদ্ধি এবং কৃষিকাজের ক্ষেত্রে মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি করেছে।
২০২৪ সালের জুলাই গণ–আন্দোলনে এই ক্ষোভগুলোরই বিস্ফোরণ ঘটেছে। তবে জনগণের মনে এখনো প্রশ্ন আছে যে ভবিষ্যতে যারা ক্ষমতায় আসবে, তারা ভারতের সঙ্গে কেমন সম্পর্ক বজায় রাখবে? তারা কি পুরোনো তোষণনীতি বজায় রাখবে, নাকি আত্মমর্যাদার ভিত্তিতে নতুন সম্পর্ক গড়ে তুলবে?
এই প্রসঙ্গে বিএনপির জন্য একটি সুস্পষ্ট, বাস্তবমুখী ও কৌশলগত রোডম্যাপ ঘোষণা করা জরুরি। এই রোডম্যাপে থাকতে হবে ১. সীমান্তে হত্যা ও পুশ ইন বন্ধে কূটনৈতিক কৌশল; ২. অভিন্ন নদীগুলোর পানিবণ্টন চুক্তি বাস্তবায়নের রূপরেখা; ৩. ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্যের ভারসাম্য আনার পরিকল্পনা এবং ৪. কোনোভাবেই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থকে বন্ধক না রাখার সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি।
গুম, খুন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে রোডম্যাপআওয়ামী লীগের শাসনামলে বিরোধী দলের লাখ লাখ নেতা–কর্মী হামলা-মামলার শিকার হয়েছেন এবং কয়েক হাজার মানুষ গুম ও খুনের শিকার হয়েছেন। এমনকি নৌকা মার্কায় ভোট না দেওয়ার কারণে নারীরা সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকারও হয়েছেন। এই ভয়াবহ পরিস্থিতির পরিবর্তন আনতে বিএনপির একটি সুস্পষ্ট ও কার্যকর পরিকল্পনা থাকা অত্যন্ত জরুরি। যদি বিএনপি সরকার গঠন করে, তবে তাদের রোডম্যাপে অবশ্যই স্পষ্ট করতে হবে যে তারা কীভাবে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে সুরক্ষা প্রদান করবে এবং নিজেদের দলীয় নেতা–কর্মীদের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করবে।
এ ছাড়া একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্মরণ রাখা দরকার যে আওয়ামী লীগের শাসনামলে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন ঘটেছে র্যাবের হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে। যদিও বিএনপির সময় র্যাব ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সূচনা হয়েছিল সন্ত্রাস দমন কার্যক্রমের অংশ হিসেবে, হাসিনার শাসনামলে তা বিরোধী দল দমনের অস্ত্রে পরিণত হয়। এই বাস্তবতা মাথায় রেখে বিএনপির রোডম্যাপে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা উচিত যে তারা র্যাবের কার্যক্রম কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে কী ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
রোডম্যাপের ফলে বিএনপির কী সুবিধা হবেবিএনপির চারটি সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা রাজনৈতিক অঙ্গনে তাদের বেশ কিছু সুবিধা প্রদান করবে। প্রথমত, বিএনপিকে আওয়ামী লীগের মতো জনগণের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হওয়া এবং ফ্যাসিবাদী পথে পা না দেওয়ার ক্ষেত্রে এগুলো রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করবে।
দ্বিতীয়ত, রোডম্যাপের মাধ্যমে বিএনপি জনগণকে একটি পরিষ্কার বার্তা দিতে পারবে যে তারা আগামী দিনে কী ধরনের বাংলাদেশ গড়তে চায় এবং জনগণ তাদের কাছে কী ধরনের পরিবর্তন প্রত্যাশা করতে পারে। এতে জনগণ জানতে পারবে যে বিএনপি ক্ষমতায় এসে কেবল রাজনৈতিক পরিবর্তন আনবে না, বরং একটি নতুন পথে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
তৃতীয়ত, রোডম্যাপের বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিএনপির কর্মীরা একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা পাবেন, তাঁদের চিন্তাভাবনা ও কাজকর্মে কী ধরনের পরিবর্তন আনতে হবে, যাতে জনগণ তাঁদের প্রতি আরও বেশি আস্থাশীল হতে পারে। একই সঙ্গে এই রোডম্যাপ জনগণকে একটি মানদণ্ড দেবে, যার ভিত্তিতে তারা বিএনপির কার্যক্রম মূল্যায়ন করতে পারবে। ফলে দলটি জনগণের কাছে আরও বেশি জবাবদিহির আওতায় আসবে, যা গণতান্ত্রিক শাসন নিশ্চিত করার পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হবে।
সর্বোপরি, আগামী সংসদ নির্বাচনে যে দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন, জনগণের স্বপ্ন ও প্রত্যাশা পূরণে পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। এই প্রস্তুতি কেবল নির্বাচনী প্রচার বা দপ্তরভিত্তিক কার্যক্রম নয়, বরং জাতীয় পর্যায় থেকে স্থানীয় স্তর পর্যন্ত একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা, নীতিগত প্রতিশ্রুতি এবং বাস্তবায়নযোগ্য রোডম্যাপের মাধ্যমে জনগণের আস্থা অর্জনের প্রক্রিয়া। আমাদের স্মরণে রাখতে হবে, যত দ্রুত বাংলাদেশ গণতন্ত্র, ন্যায় এবং টেকসই উন্নয়নের পথে এগোবে, তত দ্রুত স্বাধীন, মর্যাদাপূর্ণ ও সমৃদ্ধ দেশের স্বপ্ন পূরণ হবে।
এস কে তৌফিক হক অধ্যাপক ও পরিচালক, সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গভর্ন্যান্স (এসআইপিজি), নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়
সৈয়দা লাসনা কবীর অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মোহাম্মাদ ঈসা ইবন বেলাল গবেষণা সহযোগী, সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গভর্ন্যান্স (এসআইপিজি), নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়।
মতামত লেখকদের নিজস্ব
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: সরক র গঠন হত য ক ণ ড ন শ চ ত কর র জন ত ক স ব এনপ র ক ব যবস থ র ক ষমত য় সরক র র জনগণ র পরবর ত র পর ক ন র পর গঠন র ধরন র র একট আওয় ম
এছাড়াও পড়ুন:
নির্বাচিত সংসদে সংস্কার নয়, সংস্কারের ভিত্তিতেই নতুন সংসদ দরকার
বিগত কয়েক সপ্তাহের জল্পনাকল্পনার শেষে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ঈদুল আজহার আগের সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিলেন। দীর্ঘ ভাষণে তিনি নানা প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন। বিচার, সংস্কার ও নির্বাচনের বহুল কাঙ্ক্ষিত রোডম্যাপের পাশাপাশি তিনি তাঁর সরকারের গত ১০ মাসের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রমের ফিরিস্তি তুলে ধরেছেন। ভুল তথ্যের ভিত্তিতে বন্দর ও করিডর নিয়ে যে অপরাজনীতি ঘটেছে, তার জবাবও তিনি দিয়েছেন।
সংগত কারণেই প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের দিকে সারা দেশের মানুষের নজর ছিল। বিএনপি ও বিএনপিমনা কিছু রাজনৈতিক দল অনেক দিন ধরেই নির্বাচনের রোডম্যাপ চেয়ে আসছে। প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য থেকে তারা রোডম্যাপে নিশ্চয়তা প্রত্যাশা করেছে। যদিও ড. ইউনূস বারবার নিশ্চয়তা দিয়েছেন, কোনোভাবেই নির্বাচন আগামী বছরের জুন মাসকে অতিক্রম করবে না, তবু বিএনপির দাবি ছিল ‘সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ’। ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে—এই প্রতিশ্রুতি কেন রোডম্যাপ নয়, বিএনপির তরফে অবশ্য তার বিপক্ষে জোরালো যুক্তি মেলেনি।
অবশেষে প্রধান উপদেষ্টা তাঁর ভাষণে জানালেন, আগামী বছরের এপ্রিল মাসের প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সুনির্দিষ্ট মাস ঘোষণার পরও অবশ্য বিএনপিকে সন্তুষ্ট করা যায়নি। তারা এ বছরের ডিসেম্বরে নির্বাচন দাবি করে এসেছে। একটা মাসের ব্যাপারে অনড় থেকে প্রধান উপদেষ্টার কাছ থেকে নির্বাচনের রোডম্যাপ দাবি করার কী অর্থ, তা অবশ্য স্পষ্ট হয়নি।
যা হোক, এত দিন বিএনপি নির্বাচনের রোডম্যাপ চেয়ে এলেও প্রধান উপদেষ্টা কর্তৃক নির্বাচনের মাস ঘোষণার পর তারা এখন বলছে, এপ্রিলে নির্বাচনের মাস ঘোষণা নাকি ‘জাতির প্রত্যাশা’ পূরণ করতে পারেনি।
নির্বাচন ডিসেম্বর নাকি এপ্রিলে হবে—এই ডামাডোলে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দিক রীতিমতো তলিয়ে গেছে। টক শোগুলোতে এত দিন আলোচনা হতো নির্বাচনকে ঘিরে ‘অনিশ্চয়তা’, ‘টানাপোড়েন’, ‘ষড়যন্ত্র’ ইত্যাদি বিষয়ে।
নির্বাচনের মাস ঘোষণার পর টক শোগুলোতে নির্বাচনের মাস হিসেবে এপ্রিলের সঠিকতা-বেঠিকতাই প্রাধান্য পাচ্ছে। অথচ প্রধান উপদেষ্টা যে তাঁর সরকারের গত ১০ মাসের কাজের ফিরিস্তি দিলেন, সে বিষয়ে মিডিয়ায় পিনপতন নীরবতা লক্ষ করা যাচ্ছে। বিশেষত গত বছরের অক্টোবর থেকে এ বছরের মার্চ পর্যন্ত দেশে নেট বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে ৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা। এই জরুরি অর্থনৈতিক তথ্যও মূলধারার মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনার বিষয়বস্তু হতে পারেনি। অথচ বারবার বলা হচ্ছিল, দেশে ‘অনির্বাচিত’ সরকার থাকলে কোনো বিনিয়োগ আসবে না।
বর্তমান নিবন্ধে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক নিয়ে আলোচনা করব। সেটিও নির্বাচনের মাসকেন্দ্রিক অর্থহীন আলোচনার তলে চাপা পড়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণের ভাগ্যের দিক বিবেচনায় বিষয়টি অতিগুরুত্বপূর্ণ।
প্রধান উপদেষ্টা তাঁর বক্তব্যের একপর্যায়ে বলেছেন, ‘আমি দেশবাসীর কাছে আহ্বান জানাই, আপনারা সকল রাজনৈতিক দল এবং আপনাদের এলাকার প্রার্থীদের কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার আদায় করে নেবেন, যেন আগামী সংসদের প্রথম অধিবেশনেই যেসব সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য অর্জিত হয়েছে, তা কোনো প্রকার কাটাছেঁড়া ছাড়াই যেন তাঁরা অনুমোদন করেন।’
প্রধান উপদেষ্টার এ বক্তব্য উদ্বেগজনক। তিনি আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদের হাতে সংস্কার অনুমোদনের গুরুদায়িত্ব সোপর্দ করতে যাচ্ছেন, তাঁর বক্তব্যে এমন ধারণা পাওয়া যাচ্ছে। এতে পুরো সংস্কার উদ্যোগই একধরনের অনিশ্চয়তার ঝুঁকিতে পড়েছে।
অন্তত দুটি কারণে আগামী নির্বাচিত সংসদের হাতে সংস্কার বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া যায় না। প্রথম কারণটি ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতাজনিত। দ্বিতীয় কারণটি পদ্ধতিগত। এ ছাড়া যেসব জনগুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সুপারিশে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হবে না, সেসব সংস্কারের পরিণতি কী হবে, সেই প্রশ্নও থেকে যায়। ‘যেসব সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য অর্জিত হয়েছে’—কেবল সেগুলোই যদি আগামী সংসদের প্রথম অধিবেশনে ওঠানো হয়, তাহলে ঐকমত্য হয়নি, অথচ জনগুরুত্বপূর্ণ সংস্কার জনগণের মতামত ছাড়াই খরচের খাতায় চলে যাচ্ছে।
আরও পড়ুনসংস্কার সংস্কার শুনছি শুধু, সংস্কার কোথায়০৩ জুন ২০২৫জনগণ রাজনৈতিক দলগুলোকে ভোট দেয় ঠিকই, কিন্তু জনগণ ও রাজনৈতিক দলের পার্থক্য ভুলে যাওয়া উচিত নয়। ভোট দিয়ে জনগণ প্রতিনিধি পাঠানোর মানে এই নয় যে ‘জনগণ’ ওই সংসদে বিলীন হয়ে গেছে। বরং জনগণ সর্বদাই বিরাজ করে। কারণ, ওই সংসদ যখন স্বৈরাচারী বা একনায়কতান্ত্রিক আচরণ করে, তখন ‘জনগণ’ ধারণার বলেই আবার বিদ্রোহ বা আন্দোলন সংঘটিত হয়। জনগণ সংসদে বিলীন হয়ে গেলে তা আর সম্ভব নয়। দার্শনিক জুডিথ বাটলারের মতে ‘জনগণ’ একটি আইনাতিরিক্ত (এক্সট্রা পার্লামেন্টারি) শক্তি, যাকে ছাড়া আবার সংসদীয় রাজনীতি কল্পনা করা যায় না। কাজেই জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়কে জনগণের প্রতিনিধিত্বে সংকুচিত করা উচিত হবে না।
ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা বলছে, সংসদের হাতে সংস্কার বাস্তবায়নের দায়িত্ব দিলে তা মূলত সরকারি দলের সদিচ্ছার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। আশির দশকে সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন চলাকালীন ভিন্ন ভিন্ন তিনটি রাজনৈতিক জোট রাজপথে একই দিনে একই ঘোষণা পাঠ করেছিল। তারা তিন জোটের রূপরেখা হিসেবে পরিচিত ওই ঘোষণা বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু ১৯৯১ সালে সরকারে এসে বিএনপি তিন জোটের রূপরেখা বাস্তবায়ন করেনি।
ওই রূপরেখায় নির্বাচনে ভোট ডাকাতি, মিডিয়া ক্যু ও ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচনী ফলাফল প্রকাশের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান ব্যক্ত করা হয়। ভবিষ্যতে কেউ যেন এ ধরনের কর্মকাণ্ড করতে না পারে, সে লক্ষ্যে ব্যক্ত করা হয় দৃঢ় সংকল্প। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, নব্বই-পরবর্তী নির্বাচনী অভিযাত্রার প্রথম ধাপে তৎকালীন বিএনপি সরকার নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অধীন নির্বাচনের অঙ্গীকার থেকে সরে আসে।
সরকার এ বছরের জুলাই মাসের মধ্যে জুলাই সনদ প্রণয়ন করতে চায়। সেখানে কী কী সংস্কার হবে, তা লিপিবদ্ধ থাকবে। গণপরিষদ গঠন অথবা গণভোটের মাধ্যমে নির্বাচনের আগেই জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করতে হবে। জুলাই সনদ ও সম্মত সংবিধান সংস্কারের খসড়া বিল সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে সাধারণ নির্বাচনের দিন একই সঙ্গে গণভোটের মাধ্যমে জনসম্মতি আদায় করে নেওয়ার সুপারিশ করেছে সংস্কারবাদী সিভিল সোসাইটির সদস্যদের নাগরিক কোয়ালিশন। এ পদ্ধতিও গুরুত্বের সঙ্গে যাচাই করা উচিত।১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি দলীয় সরকারের অধীন একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি আবারও ক্ষমতায় আসে। কিন্তু আন্দোলনের চাপে দেড় মাসের কম সময়ের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনে বাধ্য হয় তারা। নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচনে জেতে আওয়ামী লীগ।
তিন জোটের রূপরেখায় দেশে ‘স্থায়ী গণতান্ত্রিক ধারা’ ও ‘প্রকৃত জনপ্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার’ অঙ্গীকারও করা হয়েছিল। কোনো দল বা গোষ্ঠী কর্তৃক অসাংবিধানিক পন্থায় ক্ষমতা দখলের অবসান ঘটিয়ে সাংবিধানিক পন্থায় অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার হাতবদল ও হস্তান্তর নিশ্চিত করাও আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল। মৌলিক অধিকারবিরোধী কোনো আইন করা যাবে না, এমন অঙ্গীকারও ছিল। গত প্রায় তিন যুগের অভিজ্ঞতা বলছে, ক্ষমতায় গিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের করা অঙ্গীকার নিজেরাই ভঙ্গ করেছে।
শুধু তা-ই নয়, অন্যের প্রস্তুত করে দেওয়া সুপারিশও কি রাজনৈতিক দলগুলো বাস্তবায়ন করে? প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকার (ডিসেম্বর ১৯৯০—মার্চ ১৯৯১) প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার সাধনের লক্ষ্যে ২৯টি টাস্কফোর্স গঠন করেছিল। টাস্কফোর্সগুলোর উদ্দেশ্য ছিল অর্থনীতি ও প্রশাসন প্রক্রিয়ার নানা রকম সমস্যার সমাধান করা।
বিগত সামরিক স্বৈরাচার আমলে ঘনীভূত হওয়া সমস্যা নিরসনের লক্ষ্যে দেশের আড়াই শতাধিক সেরা পেশাদার প্রতিভাবান ব্যক্তি ২৯টি টাস্কফোর্সের মাধ্যমে নানা ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার প্রস্তাব রেখেছিলেন। সাহাবুদ্দীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য এবং টাস্কফোর্স গঠন প্রক্রিয়ার সংগঠক অধ্যাপক রেহমান সোবহান জানাচ্ছেন, ‘টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনগুলো এমনভাবে প্রস্তুত করা হয়েছিল, যেন ১৯৯১ সালের মার্চের নির্বাচনে নির্বাচিত সরকার ও সংসদে বিরোধী দল উভয়কেই পেশ করা যায়। দুঃখজনকভাবে নির্বাচিত বিএনপি সরকার প্রতিবেদনগুলো সামান্যই কাজে লাগিয়েছিল।’
আরও উল্লেখ্য, ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে প্রয়োজনীয় নীতি ও সংস্কারের প্রস্তাব প্রণয়নের জন্য দেশের শীর্ষস্থানীয় ১৬০ জন পেশাদার ব্যক্তিকে নিয়ে ১৬টি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছিল। সেই প্রতিবেদনগুলোকেও তৎকালীন নির্বাচিত সরকার কোনো গুরুত্ব দেয়নি। (রেহমান সোবহান, ১২ নভেম্বর ২০২৪, প্রথম আলো)
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার যেসব সংস্কার সুপারিশ পরবর্তী সংসদের হাতে তুলে দিতে চাচ্ছে, তারা যে সেই সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন করবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
দ্বিতীয় কারণটি পদ্ধতিগত। এ কথা সবাই মানেন, বর্তমান বাহাত্তরের সংবিধানের একব্যক্তিকেন্দ্রিক ক্ষমতাকাঠামোর মধ্যেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বৈরতান্ত্রিকতার বীজ নিহিত। সংগত কারণেই সংবিধান সংস্কার কমিশন আনীত সংস্কার সুপারিশগুলোর মূল লক্ষ্য এই স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতাকাঠামোর নির্মূল এবং স্থায়ী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পত্তন। তথা বিদ্যমান সংবিধানকেই চ্যালেঞ্জ করা বর্তমান সংস্কারের প্রধান এজেন্ডা।
বিদ্যমান সংবিধানের অধীন গঠিত সংসদ দুই-তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্যদের সমর্থনে ঠিক সেই সংশোধনীগুলোই আনতে পারে, যা বিদ্যমান সংবিধানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। বিদ্যমান সংবিধানের মৌলিক কাঠামো ‘অসাংবিধানিক’ মনে করে এমন যেকোনো সংশোধনী আদালত বাতিল করে দিতে পারে কিংবা পরবর্তী সংসদ একই ধরনের দুই-তৃতীয়াংশের জোরে বাতিল করার সক্ষমতা ধারণ করে। অর্থাৎ সংসদে আনীত সংশোধনী স্থায়ী ও টেকসই নয়।
সংসদে ততটুকুই সংশোধনী আনা যায়, যতটুকু সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। অন্যদিকে জনগণের সার্বভৌম ইচ্ছা তথা গাঠনিক ক্ষমতার দ্বারা সমর্থিত ও বৈধতাপ্রাপ্ত মৌলিক সংস্কার চাইলেই সংসদ বা বিচার বিভাগ চ্যালেঞ্জ করতে পারেন না। মৌলিক সংস্কারই বরং রাষ্ট্রের উল্লিখিত দুই বিভাগের বৈধতা ও ক্রিয়াশীলতার ভিত্তি হয়।
একদিকে যদি ৭০ অনুচ্ছেদ কার্যকর থাকে, অন্যদিকে সরকারি দলের হাতে যদি দুই-তৃতীয়াংশ আসন থাকে (যা আবার মোট প্রদত্ত ভোটের ৪০-৪৫ শতাংশের বেশি নয়); সে ক্ষেত্রে সংবিধান সংশোধনীগুলো মূলত দলীয় প্রধানের ইচ্ছা-অনিচ্ছাতেই ঘটে। কারণ, ৭০ অনুচ্ছেদ মোতাবেক দলীয় সংসদ সদস্যরা দলের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারেন না।
দুই-তৃতীয়াংশ আপনাকে সংবিধানের যেমন খুশি তেমন পরিবর্তনের ক্ষমতা দেয়, ৭০ অনুচ্ছেদ আপনাকে দলের সংসদ সদস্যদের মুখ বন্ধ রাখার ক্ষমতা দেয়। এই দুই ক্ষমতা মিলে এক প্রকাণ্ড সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র কায়েম হয়। এ কারণে সংবিধান সংশোধনীর ক্ষেত্রে ৭০ অনুচ্ছেদ যেন কার্যকর না হয় তথা দলীয় সংসদ সদস্যরা যেন দলের সিদ্ধান্তের বাইরে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে পারেন—বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী ছাড়া অন্য সব দল ও সুশীল সমাজ এমন মত রেখেছে।
সরকার এ বছরের জুলাই মাসের মধ্যে জুলাই সনদ প্রণয়ন করতে চায়। সেখানে কী কী সংস্কার হবে, তা লিপিবদ্ধ থাকবে। গণপরিষদ গঠন অথবা গণভোটের মাধ্যমে নির্বাচনের আগেই জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করতে হবে। জুলাই সনদ ও সম্মত সংবিধান সংস্কারের খসড়া বিল সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে সাধারণ নির্বাচনের দিন একই সঙ্গে গণভোটের মাধ্যমে জনসম্মতি আদায় করে নেওয়ার সুপারিশ করেছে সংস্কারবাদী সিভিল সোসাইটির সদস্যদের নাগরিক কোয়ালিশন। এ পদ্ধতিও গুরুত্বের সঙ্গে যাচাই করা উচিত।
তিন জোটের রূপরেখার পরিণতি এড়াতে পুনর্লিখিত/সংস্কারকৃত সংবিধানের পরিশিষ্ট হিসেবে এটিকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। বিএনপি সংবিধান সংশোধনীর ক্ষেত্রে দলীয় সংসদ সদস্যদের নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। যদি তারা সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে, তাহলে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয়ে পরিণত হবে।
একই ভুল বারবার করলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না। এক দলের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর জাতীয় আকাঙ্ক্ষা ঝুলে থাকতে পারে না। তাই প্রধান উপদেষ্টা বর্ণিত সময়কালের মধ্যে নির্বাচন হচ্ছে ধরে নিয়ে এর আগেই সংস্কার বাস্তবায়ন করে পরবর্তী সংসদ যেন তা মান্য করার আইনি বাধ্যবাধকতা অনুভব করে, তা নিশ্চিত করতে হবে। আগামী সংসদ সংস্কারের বৈধতা দেবে, তা নয়। বরং সংস্কারই হবে আগামী সংসদের বৈধতার ভিত্তি।
সারোয়ার তুষার যুগ্ম আহ্বায়ক ও কো-অর্ডিনেটর সংস্কার সমন্বয় কমিটি, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)
*মতামত লেখকের নিজস্ব