নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানপরবর্তী বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা থেকে জুলাই–পরবর্তী সময়ের রাজনীতি একটি ভিন্ন আঙ্গিকে পরিচালিত হবে, তেমন এক প্রত্যাশা জাতির মনে তৈরি হয়েছে। কারণ, চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থান রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে একটি বৈপ্লবিক ও ঐতিহাসিক বদল নিয়ে আসার সুবর্ণ সুযোগ তৈরি করেছে। 

এ সুযোগকে যথাযথভাবে নিতে চাইলে প্রথমেই রাজনৈতিক দলগুলোকে জাতীয় স্বার্থে একটি ঐকমত্যে পৌঁছানোর জন্য ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে হবে, যে প্রক্রিয়া বর্তমানে চলমান। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য থাকবে, সেটিই স্বাভাবিক; কিন্তু জাতীয় প্রশ্নে আবার একটি ঐকমত্যে পৌঁছানোর প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা থাকা ও তার চর্চার অভ্যাসও জরুরি। মতপার্থক্যের মধ্য দিয়েই আমরা একটি বৃহত্তর ঐক্যে পৌঁছাতে পারব। তাই বর্তমান প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক দলগুলোর জাতীয় স্বার্থে এক থাকার কোনো বিকল্প নেই।

জাতীয় স্বার্থে একসঙ্গে কাজ করার এই তাগিদ আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর নানা সময়ের বিবৃতির মধ্যে দেখতে পাই। একে কেবল তাদের বক্তব্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে এর বাস্তবায়নের পথ দেখাতে হবে। নিজেদের মধ্যে সংলাপের মাধ্যমে জাতীয় স্বার্থসংবলিত বিষয়াবলি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চিহ্নিত করা জরুরি। এর সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর জনগণের প্রত্যাশা পূরণে একসঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার করা প্রয়োজন। কেননা বিগত সময়ে জনগণের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থতার পরিণতি ছিল গণবিচ্ছিন্নতা ও আস্থাহীনতা। ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের জনগণ সেই অর্থে কখনোই ক্ষমতার কেন্দ্রে ছিল না। 

গণবিচ্ছিন্নতা নয়, বরং গণসম্পৃক্ততার ওপর অধিক জোর দেওয়া প্রয়োজন। আমাদের সব উন্নয়ন–পরিকল্পনা গণমানুষের চাহিদাকে কেন্দ্রে রেখে বাস্তবায়ন করার দিকে মনোযোগ দেওয়া জরুরি। বছরের পর বছর ধরে আমাদের যতটা উন্নয়ন সাধিত হয়েছে, তার সুফল খুব একটা দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর দ্বারপ্রান্তে আমরা পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছি। সব সময় তথাকথিত উন্নয়নের সুফল কেবল একটি সুবিধাবাদী গোষ্ঠীর হাতের নাগালে ছিল। তাই আমাদের জন্য গণমানুষকেন্দ্রিক একটি কল্যাণমুখী রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। যার অনেক অবকাঠামো ও চর্চা আমাদের দেশে অনেক আগে থেকেই বিদ্যমান; কিন্তু সুশাসনের অভাবে তার সুফল আমাদের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী পাচ্ছে না।

এ প্রসঙ্গে মাও সে-তুংয়ের একটি উদ্ধৃতি বেশ প্রাসঙ্গিক, ‘উন্নয়ন মানুষের ক্ষুধা ও দারিদ্র্য থেকে মুক্তি দিয়ে একটি সুন্দর জীবনের নিশ্চয়তা প্রদান করতে পারে।’ সেই মুক্তির স্বাদের প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবায়নের রূপরেখা জনগণের সামনে তুলে ধরতে পারলে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তাদের আস্থা অর্জন করা সহজ হবে।

এ বাস্তবতায় জাতীয় উন্নয়নের এমন একটি সমন্বিত রোডম্যাপ বা কর্মপরিকল্পনা গড়ে তুলতে হবে, যা আমাদের বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্নকে প্রতিফলিত করবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের একটি ‘বাংলাদেশি ড্রিম’ বা স্বপ্ন গড়ে তুলতে হবে, যেখানে গণমানুষের স্বপ্ন ও প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটাবে; যা আমরা অনেক উন্নয়নশীল দেশের প্রেক্ষাপটে দেখতে পাই, যারা তাদের উন্নয়নের রোডম্যাপ বাস্তবায়ন করে আজ বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। 

আমরা সব সময় দেখি যে উন্নয়ন–পরিকল্পনায় জাতিগত প্রত্যাশার চেয়ে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের একক বা একপক্ষীয় স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার তাগিদ দেখা যায়, যা বিশেষ করে বিগত দশকের দিকে তাকালেই পরিষ্কার হবে।

তাই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্য থেকে যদি ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি সমন্বিত জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করা যায়, তা হবে এক অভূতপূর্ব বিষয়। এতে রাষ্ট্রীয় পরিসরে ক্ষমতার পালাবদল ঘটলেও মৌলিক উন্নয়ন–আকাঙ্ক্ষা ও কাঠামোর কোনো বদল ঘটবে না। ফলে উন্নয়নপ্রক্রিয়া কোনো পরিস্থিতিতেই বাধাগ্রস্ত হবে না। যদিও এটি সহজ বিষয় নয়, আবার কঠিন বলে আমরা তা বাস্তবায়ন করতে পারব না ভেবে হাত গুটিয়ে বসে থাকাও উচিত হবে না। 

সাম্প্রতিক সময়ে দেখেছি, জাতীয় স্বার্থসংবলিত বিষয়, যেমন রাখাইনে মানবিক করিডর, চট্টগ্রাম বন্দর এবং সংস্কারবিষয়ক নানা খাতের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলগুলো একসঙ্গে তাদের অবস্থান ব্যক্ত করেছে। যদিও অন্তর্বর্তী সরকারের সব সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে এখনো একটি সমন্বিত ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব না হলেও অনেক বিষয়েই তারা একমত, যা প্রমাণ করে জাতীয় স্বার্থের ক্ষেত্রে একসময় একটি ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব। তবে এর জন্য সময় প্রয়োজন এবং মনে রাখা জরুরি যে সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া; তাই একটি স্বল্প সময়ে অন্তর্বর্তীব্যবস্থায় আমরা সব বিষয়ে একমত হতে পারব; সেই প্রত্যাশাও একটি উচ্চাভিলাষী আকাঙ্ক্ষা। 

এর জন্য যেমন যথাযথ সময় প্রয়োজন, তেমনি আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোরও সেই ইতিবাচক মানসিকতারও প্রয়োজন। পৃথিবীর কোনো দেশই সংস্কারপ্রক্রিয়া এক দিনে বাস্তবায়িত করতে পারেনি। আমরা যদি প্রতিবেশী বন্ধুদেশ চীনের দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাই ১৯৪৯ সালের বিপ্লবের পর থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত তাদের জাতীয় পরিসরে সংস্কারপ্রক্রিয়া ও সংলাপ জারি রেখেছে। তাদের সেই সংস্কার ছিল অগ্রাধিকার ও খাতভিত্তিক। 

একটি নির্দিষ্ট সময়ের প্রেক্ষাপটে প্রয়োজনীয় ও অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সংস্কারযোগ্য খাতকে চিহ্নিত করতে হবে। এই প্রক্রিয়ায় যখন সবার অংশগ্রহণ ও অংশীদারত্ব থাকে, তখনই তা বাস্তবায়ন করা বাস্তবসম্মত, ফলপ্রসূ ও দীর্ঘ মেয়াদে স্থায়ী হয়। 

বর্তমান এই সময়টায় দেশটাকে সত্যিকার অর্থেই বদলে দেওয়ার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে এক অভাবনীয় সুযোগ তৈরি করেছে। তাদের উচিত হবে সেই বিষয় নিয়ে কাজ করা। 

বুলবুল সিদ্দিকী সহযোগী অধ্যাপক, রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প রক র য় ঐকমত য আম দ র র জন য ন র জন ক জ কর র একট

এছাড়াও পড়ুন:

সরকার নিরপেক্ষতা হারালে জনগণ মাঠে নামবে: তাহের

সংস্কার ইস্যুতে সব দল ঐক্যবদ্ধ থাকলেও বিএনপি হঠাৎ অবস্থান পরিবর্তন করেছে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নায়েবে আমীর ও সাবেক সংসদ সদস্য ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের।

শুক্রবার (৩১ অক্টোবর) সকালে কুমিল্লার সেন্ট্রাল মেডিকেল কলেজ অডিটোরিয়ামে চৌদ্দগ্রাম উপজেলা ভোটকেন্দ্র পরিচালক সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ মন্তব্য করেন।

ডা. তাহের বলেন, “আরপিও, সংস্কার কিংবা হ্যাঁ/না গণভোট—কোনো কিছুই এখন বিএনপি মানছে না। সরকার যদি তার নিরপেক্ষতা হারায়, তাহলে দেশের জনগণ তার প্রতি আস্থা হারাবে। তখন জনগণ আন্দোলনে নামবে।”

তিনি আরো বলেন, “জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট নিয়ে সরকার যদি অপকৌশল করে, তাহলে জনগণ আন্দোলনের প্রস্তুতি নেবে।”

চৌদ্দগ্রাম উপজেলা জামায়াতের আমীর মাওলানা মাহফুজুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম, কুমিল্লা অঞ্চল টিম সদস্য ও সাবেক জেলা আমীর আব্দুস সাত্তার, কেন্দ্রীয় মজলিশে শুরা সদস্য ও কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা জামায়াতের আমীর অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শাহজাহান, কুমিল্লা মহানগরী জামায়াতের সেক্রেটারি মুফতি মাহবুবুর রহমান এবং শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি মজিবুর রহমান ভূঁইয়া।

উপজেলা জামায়াতের সেক্রেটারি বেলাল হোসাইনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন চৌদ্দগ্রাম পৌর আমীর মাওলানা ইব্রাহীম, জামায়াত নেতা আয়ুব আলী ফরায়েজী, সাবেক উপজেলা দক্ষিণ আমীর শাহ মিজানুর রহমান, উপজেলা জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি আব্দুর রহিম এবং পৌর সেক্রেটারি মোশাররফ হোসেন ওপেল প্রমুখ।

ঢাকা/রুবেল/এস

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • জ্বালানি সুবিচার নিশ্চিতে সংগ্রাম, শপথ যুব সংসদের সদস্যদের
  • ঐকমত্য কমিশনে যারা আছেন, তারা নিজেদের কাজে ফিরে যান: খসরু
  • বন্দরে বিএনপি নেতা তাওলাদের উপর হামলাকারীদের গ্রেপ্তারে আল্টিমেটাম
  • বিএনপি ও জামায়াত কে কোন ফ্যাক্টরে এগিয়ে
  • অন্তর্বর্তী সরকার ও ঐকমত্য কমিশন বিশ্বাসঘাতকতা করেছে: মির্জা ফখরুল
  • অন্তর্বর্তী সরকার জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করেছে: ফখরুল
  • সরকার নিরপেক্ষতা হারালে জনগণ মাঠে নামবে: তাহের
  • ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ জুলাই সনদ বাস্তবায়নকে অনিশ্চয়তায় ফেলেছে: গণসংহতি
  • সংবিধান সংস্কারে জগাখিচুড়ির গণভোট
  • দলগুলোর মতপার্থক্য সামনে এল আরও তীব্রভাবে