বোধের আলোর নিষ্ঠুর রসিকতাগুলো বরাবরই এড়িয়ে গেছেন। সমালোচনার কাঁটাগুলো প্রতিবাদ না করে সোচ্চার নিজস্বতায় একা একা বেছে তুলেছেন। তথাকথিত তারকা স্বীকৃতি ক্রিকেট তাঁকে কখনোই দেয়নি। বরং ক্যামেরা তাঁকে আতঙ্কিত করেছে বারবার। যতবারই ক্যাপ্টেনস ফটোসেশনে এসেছেন, ততবারই ট্রল হতে হয়েছে। ঘুমিয়ে পড়ার ছবি দিয়ে ‘বডি শেমিং’ করা, মিম বানিয়ে নিয়ে হাসিঠাট্টা– সহ্যের বাইরে সব সমালোচনাতেও স্থিরবিন্দু ছিলেন টেম্বা বাভুমা। দক্ষিণ আফ্রিকার সেই অধিনায়কই সম্মান আদায় করে নিল আইসিসি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে। সাতাশ বছরের প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে তিনিই দক্ষিণ আফ্রিকাকে এনে দিলেন আরাধ্যের আইসিসির দ্বিতীয় কোনো শিরোপা। গ্যারি কার্স্টেন থেকে গ্রায়েম স্মিথ, শন পোলক থেকে ডি ভিলিয়ার্স– প্রোটিয়াদের কিংবদন্তি তারকারা যা এনে দিতে পারেননি, তাই কিনা এলো বাভুমার হাত ধরে। হ্যান্সি ক্রনিয়ের পর তিনিই দ্বিতীয় অধিনায়ক দক্ষিণ আফ্রিকা যাঁর কপালে খুঁজে পেল ‘রাজযোটক’।
অথচ ১১ বছর আগে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটার হিসেবে অভিষেক হয়েছিল টেম্বা বাভুমার। দক্ষিণ আফ্রিকান বোর্ড থেকে বলে দেওয়া হয়েছিল নির্দিষ্ট সংখ্যক কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটার রাখতেই হবে দলে। তখন এ ব্যবস্থার সমালোচনা হয়েছিল প্রবল। বছর দুই পরে কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটাররাই প্রথাটি তুলে নেওয়ার দাবি তুলেছিলেন। কবিগুরুর ভাষায়– ‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি, কালো বলে তারে গাঁয়ের লোক।’ লর্ডসে টেস্টের শ্রেষ্ঠত্বের মুকুটজয়ী বাভুমাকে ক্রিকেটও যেন স্বীকৃত দিল বিকেলের ফুল ‘কৃষ্ণকলি’ বলে। মেঘলা দিনে নয়, লর্ডসের রৌদ্রকরোজ্জ্বল মাঠেই বাভুমার কালো হরিণ চোখ দেখল বিশ্বক্রিকেট।
লর্ডসের ফাইনালে প্রথম ইনিংসে আড়াই ঘণ্টা ক্রিজে থেকে বাভুমা যখন ৩৬ রান করে আউট হয়ে যান, তখন বুঝতে পেরেছিলেন ধৈর্য আর সংযম দিয়ে স্নায়ু শক্ত রাখতে হবে। দ্বিতীয় ইনিংসে সেই তিনিই দাঁতে দাঁত চেপে ১৯৫ মিনিট স্টার্ক-কামিন্সদের বাউন্সার আর সুইং সামলেছেন। চার নম্বরে নেমে এইডেন মার্করামের সঙ্গে ১৪৭ রানের মহামূল্যবান জুটি বেঁধেছেন। এতটুকু তাড়াহুড়া না করে ১৩৪ বলে মাত্র চারটি বাউন্ডারি হাঁকিয়েছেন। প্রতিটি বলে, প্রতিটি মুহূর্তে একটু একটু করে অসিদের আত্মবিশ্বাসে ভাঙন ধরিয়েছেন।
শুধু ৬৬ রান দিয়ে তাঁর এই ইনিংস হয়তো ব্যাখ্যা করা যাবে না, এই ইনিংসটুকুর মধ্যেই তাঁর বহু বছরের গোপন নিবিড় নিলয় জড়িয়ে ছিল। সমস্ত অবহেলার, হরণের অবিকল্প আশ্রয় ছিল তাঁর এই ইনিংসটুকুর মধ্যে। শারীরিক উচ্চতার কারণেই তিনি হয়তো ভালো পুল বা হুক মারতে পারেন না, সেভাবে ছক্কাও নেই তাঁর হাতে। তবে ব্যাকফুটে গিয়ে শটস খেলার অসাধারণ দক্ষতা তাঁর মায়াবী ব্যাটিংয়ের বড় আশ্রয়। জোহানেসবার্গের সেন্ট ডেভিডস ম্যারিয়েস্ট কলেজে পড়ার সময় বাকিরা যখন শারীরিক শক্তি দিয়ে রাগবি খেলতেন, ক্রিকেটে কেউ পেসার হয়ে নামতেন, তখন বাভুমা খুঁজে নিয়েছিলেন ব্যাট হাতে তাঁর নিজস্ব শৈলী।
অভিষেকের দুই বছর পর প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি পেয়েছিলেন তিনি। দ্বিতীয় সেঞ্চুরিটি পেতে সময় লাগে আট বছর। এ সময় সমালোচনার সঙ্গে তীব্র ব্যক্তিগত আক্রমণও সহ্য করতে হয়েছিল তাঁকে। গত দুই বছরে এই বাভুমা দলের সেরা পারফরমার। ‘এ নিয়ে আমি আবেগী নই। আমরা (কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটাররা) এটি মেনে নিয়ে মাঠে নামি যে, যদি দুটি বা তিনটি ম্যাচে রান না করতে পারি, তাহলে আমাদের বিশেষ নামে ডাকা হবে। এমনকি আমরা ভালো করলেও বলবে তুমি কেন দলে? তুমি কেন দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছ। সুতরাং এটি মেনে নিয়েই আমি খেলে যাচ্ছি।’ লর্ডসে ফাইনালের আগে ইএসপিএনক্রিকইনফোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ভেতরের জমানো ব্যথা কিছুটা হালকা করে নিয়েছিলেন বাভুমা।
তাঁর সেই ব্যথাটা বোধহয় চিরতরে গতকাল মুছিয়ে দিতে পেরেছে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি। এদিন পুরস্কার মঞ্চে ওঠার সময় লর্ডসের গ্যালারি থেকে তাঁর নামে জয়ধ্বনি ওঠে। সঞ্চালক নাসির হুসেন বাভুমাকে পেয়ে জিজ্ঞাসা করে বসেন। ‘এভাবে তোমার নামে গ্যালারিতে ধ্বনি উঠছে, নিশ্চয় ব্যাপারটি তোমার কাছে অন্যরকম।’ সত্যটা লুকাননি বাভুমা। ‘এটি আমাদের জন্য বিশেষ মুহূর্ত। এই মুহূর্তটির জন্যই আমরা অনেক অনেক দিন অপেক্ষা করেছিলাম। প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিলাম ভালো কিছু করার। এই জয় আমাদের দেশের সামনে একটি নতুন সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে, দেখিয়ে দিয়েছে দ্বিধা ভুলে আমরা এক হলে অনেক কিছুই করতে পারি।’
লর্ডসের বারান্দায় মুখ ভারী করে থাকা বাভুমা জয় নিশ্চিত হওয়ার পরেও উচ্ছ্বাসে মাতেননি। যখন রাজদণ্ডের মতো ট্রফিটা হাতে পেয়েছেন, তখনই কেবল সতীর্থদের নিয়ে নেচেছেন। তাঁর ভয় নেই আর ক্যামেরায়, কারণ কেউ আর তাঁকে বিরক্ত করবে না।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: হয় ছ ল
এছাড়াও পড়ুন:
শাহরুখের ব্যাপারে সাবধান করলেন জুহি চাওলা
বলিউড বাদশা শাহরুখ খান। অভিনয় গুণে কোটি কোটি ভক্তের হৃদয়ে দোলা দিয়েছেন তিনি। দীর্ঘ অভিনয় ক্যারিয়ারে যশ-খ্যাতি যেমন পেয়েছেন, তেমনি আয় করেছেন মোটা অঙ্কের অর্থও। রবিবার (২ নভেম্বর) ৬০ বছর পূর্ণ করে একষট্টিতে পা দেবেন এই তারকা।
অভিনয় ক্যারিয়ারে অনেক নায়িকার সঙ্গে জুটি বেঁধে অভিনয় করেছেন শাহরুখ খান। তাদের মধ্যে অন্যতম জুহি চাওলা। ‘রাজু বান গায়া জেন্টলম্যান’, ‘রামজানে’, ‘ডর’, ‘ইয়েস বস’, ‘ডুপ্লিকেট’সহ আরো কিছু জনপ্রিয় সিনেমা উপহার দিয়েছেন এই জুটি। একসঙ্গে অভিনয় ছাড়াও, এই দুই তারকা বাস্তব জীবনে খুবই ভালো বন্ধু। কেবল তাই নয়, ব্যবসায়ীক অংশীদারও তারা।
আরো পড়ুন:
শাহরুখের অজানা এই সাত তথ্য জানেন?
পাকিস্তানের সন্ত্রাসী তালিকায় সালমান খান কেন?
বন্ধু শাহরুখের জন্মদিন উপলক্ষে হিন্দুস্তান টাইমসের সঙ্গে কথা বলেছেন জুহি। এ আলাপচারিতায় স্মৃতিচারণ তো করেছেনই, পাশাপাশি শাহরুখের বিষয়ে সতর্কবার্তা দিয়েছেন এই অভিনেত্রী।
শাহরুখের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের বিষয়ে জুহি চাওলা বলেন, “আমি যখন প্রথম ‘রাজু বান গায়া জেন্টলম্যান’ সিনেমায় চুক্তিবদ্ধ হই, তখন সহপ্রযোজক বিবেক ভাসওয়ানি আমাকে বলেছিলেন, ‘আমার নায়ক দেখতে আমির খানের মতো।’ আমি শাহরুখকে দেখে ভীষণ অবাক হয়েছিলাম। দেখি, শাহরুখের চুল চোখের ওপরে নেমে এসেছে। আর সে একেবারেই আমার কল্পনার সেই ‘চকলেট বয়’ নয়! যখন কাজ শুরু করি, তখন বুঝতে পারি, সে একদম নতুন অভিনেতাদের মতো নয়, সে পরিশ্রমী, দিনে তিন শিফটে কাজ করছে।”
একটি ঘটনা বর্ণনা করে জুহি চাওলা বলেন, “আমার মনে আছে, ‘ইয়েস বস’ সিনেমার শুটিংয়ের সময়, কোনো দৃশ্য ঠিকমতো লেখা না থাকলে পরিচালক আজিজজি (আজিজ মির্জা) বলতেন, ‘শাহরুখ আসুক, সব ঠিক হয়ে যাবে।’ রোমান্স আর মজার মিশেলে থাকা দৃশ্যগুলো আমাদের সবচেয়ে ভালো ছিল। সেই সূত্রেই আমরা অনেকগুলো সিনেমায় একসঙ্গে কাজ করেছি।”
শাহরুখের পাশে অবস্থান করলে সাবধান থাকার কথার কথা বলেছেন জুহি। হাসতে হাসতে এ অভিনেত্রী বলেন, “শাহরুখের আশেপাশে থাকলে সাবধানে থাকবেন। কারণ সে কথা দিয়ে আপনাকে যেকোনো কিছু করাতে রাজি করিয়ে ফেলতে পারে। ওর কথাবলার ভঙ্গি এমন যে, আপনি ‘না’ বলতেই পারবে না। আমি ‘ডুপ্লিকেট’ সিনেমা করতে চাইছিলাম না, কারণ সেখানে আমার তেমন কিছু করার ছিল না। আমরা তখন আরেকটি সিনেমার শুটিং করছিলাম, আর শাহরুখ আমাকে সিঁড়িতে বসিয়ে দুই ঘণ্টা বোঝায় এবং আমি সিনেমাটিতে চুক্তিবদ্ধ হই। সে আপনাকে যেকোনো কিছু করতে রাজি করাতে পারে, তাই সাবধানে থাকবেন।”
শাহরুখ খানের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের বিষয়ে জুহি চাওলা বলেন, “অফস্ক্রিনে আমাদের সম্পর্কেও উত্থান-পতন রয়েছে। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা কোনো না কোনোভাবে আমাদের যুক্ত রেখেছেন, এমনকি আইপিএলের মাধ্যমেও। আমাদের বন্ধন কোনো পরিকল্পনার ফল নয়, এটা একেবারেই ভাগ্যের ব্যাপার।”
শাহরুখ খানের সঙ্গে আইপিএল দল কলকাতা নাইট রাইডার্সের (কেকেআর) সহ-মালিক জুহি ও তার স্বামী জয় মেহতা। এই দলের পেছনে জুহি বিনিয়োগ করেছেন ৬২৯ কোটি রুপি। বর্তমানে এই দলটির মূল্য আছে ৯ হাজার ১৩৯ কোটি রুপি। শাহরুখ খানের সঙ্গে ‘রেড চিলিস গ্রুপ’ প্রতিষ্ঠা করেন জুহি।
১৯৬৫ সালে ২ নভেম্বর ভারতের নয়াদিল্লিতে এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন শাহরুখ খান। তার শৈশবের প্রথম পাঁচ বছর কেটেছে ম্যাঙ্গালুরুতে। শাহরুখের দাদা ইফতিখার আহমেদ স্থানীয় পোর্টের প্রধান ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। যার কারণে সেখানে বসবাস করেন তারা। শাহরুখের বাবার নাম তাজ মোহাম্মদ খান, মা লতিফ ফাতিমা।
দিল্লির হংসরাজ কলেজ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন শাহরুখ খান। তারপর জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়াতে গণযোগাযোগ বিষয়ে মাস্টার্সে ভর্তি হন। কিন্তু অভিনয় জীবন শুরু করার কারণে পড়াশোনা ছেড়ে দেন তিনি। তবে বলিউডে ক্যারিয়ার শুরুর দিকে দিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা-তে ভর্তি হন এই শিল্পী।
১৯৯২ সালে ‘দিওয়ানা’ সিনেমার মাধ্যমে বলিউডে পা রাখেন শাহরুখ খান। রোমান্টিক ঘরানার এ সিনেমায় অভিনয় করে নজর কাড়েন তিনি। সিনেমাটিতে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের কারণে সেরা নবাগত অভিনেতা হিসেবে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার লাভ করেন শাহরুখ।
একই বছর ‘চমৎকার’, ‘দিল আসনা হে’ ও ‘রাজু বান গায়া জেন্টলম্যান’ সিনেমায় অভিনয় করেন শাহরুখ। তার পরের বছর ‘ডর’ ও ‘বাজিগর’ সিনেমায় অভিনয় করে নিজের জাত চেনান শাহরুখ। তার অভিনয়ের জাদুতে মুগ্ধ হন কোটি ভক্ত; পৌঁছে যান সাফল্যের চূড়ায়। তার অভিনয়ের খ্যাতি আরো বাড়তে থাকে যশরাজ ফিল্মসের সিনেমায় ধারাবাহিকভাবে অভিনয় করে। একের পর এক হিট সিনেমা দিয়ে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে অবস্থান করেন শাহরুখ। যদিও তার এই সফলতার জার্নির গল্প মোটেও সহজ ছিল। আর সে গল্প সবারই জানা।
অভিনয় ক্যারিয়ারে অসংখ্য সম্মাননা পেয়েছেন শাহরুখ খান। তার মধ্যে মোট পনেরোবার ফিল্মফেয়ার পুরস্কার লাভ করেছেন তিনি। এর মধ্যে আটবার সেরা অভিনেতা হিসেবে পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। হিন্দি সিনেমায় বিশেষ অবদানের জন্য ২০০২ সালে তাকে পদ্মশ্রী পুরস্কারে ভূষিত করে ভারত সরকার। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি গ্রহণ করেছেন মোট পাঁচবার। তবে শাহরুখ খানের ৩৩ বছরের অভিনয় ক্যারিয়ারে অধরা ছিল জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। চলতি বছর ‘জওয়ান’ সিনেমার জন্য সেরা অভিনেতা বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন শাহরুখ।
ঢাকা/শান্ত