জর্জ অরওয়েল: এক সত্যান্বেষীর জন্ম ও উত্তরাধিকার
Published: 24th, June 2025 GMT
২৫ জুন ১৯০৩, ব্রিটিশ ভারতের মোতিহারিতে জন্ম নেন এরিক আর্থার ব্লেয়ার—যিনি পরে বিশ্ববাসীর কাছে চিরপরিচিত হয়ে ওঠেন জর্জ অরওয়েল নামে। সাহসিকতা, স্বচ্ছতা ও নৈতিক দায়বদ্ধতার যে সাহিত্যিক উত্তরাধিকার তিনি রেখে গেছেন, তাঁর ১২২তম জন্মবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি সেই সত্যান্বেষী কলমসৈনিককে।
অরওয়েলের শিক্ষা শুরু হয় ইংল্যান্ডের অভিজাত বিদ্যাপীঠে, কিন্তু কর্মজীবন শুরু হয় ব্রিটিশ উপনিবেশ বার্মায় একজন পুলিশ অফিসার হিসেবে। সেখানেই তিনি প্রথম সরাসরি প্রত্যক্ষ করেন সাম্রাজ্যবাদের নির্মম রূপ—ক্ষমতার নির্দয় প্রয়োগ, মানুষের অসম্মান আর শোষণের বিভীষিকা তাঁকে গভীরভাবে নাড়া দেয় এবং একজন লেখক হিসেবে তাঁকে ঠেলে দেয় আত্মজিজ্ঞাসার পথে। এরপর স্পেনের গৃহযুদ্ধে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেন। সেখানে যুদ্ধের ময়দানে তিনি বুঝে যান, সত্য কেবল বন্দুকের মুখে হারায় না—হারায় প্রচারের ভাষায়, বিকৃত তথ্য আর বিভ্রান্তির কুয়াশায়।
১৯৪৫ সালে প্রকাশিত ‘অ্যানিমেল ফার্ম’ ছিল তাঁর সাহিত্যিক প্রতিবাদের অনন্য দলিল। এক পশু খামারে বিপ্লবের গল্প দিয়ে তিনি যেভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের স্তালিন যুগের বিকৃতি, বিশ্বাসঘাতকতা ও স্বৈরতন্ত্রের বাস্তবতা তুলে ধরেছেন, তা একদিকে সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ, অন্যদিকে ইতিহাসের বেদনাবাহী পাঠ।
এ উপন্যাসের চরিত্রগুলো—নেপোলিয়ন, স্নোবল, বক্সার—তাদের প্রতিটিই বাস্তব রাজনৈতিক চরিত্র বা শ্রেণির প্রতীক। বিপ্লব যেভাবে স্বপ্ন থেকে বিভীষিকায় রূপ নেয়, সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি কীভাবে ক্ষমতাধরের ভাষায় হারিয়ে যায়—এই অনবদ্য রূপক একমাত্র অরওয়েলই তৈরি করতে পারেন।
অ্যানিমেল ফার্ম-এর বাস্তব রূপান্তরএকটি খামারে পশুরা বিদ্রোহ করে, মানুষের শাসন ফেলে দিয়ে ঘোষণা করে স্বাধীনতা। শুরু হয় একটি নতুন সময়—স্বপ্নের, সমতার, মুক্তির। কিন্তু সময়ের প্রবাহে সেই স্বপ্নই পরিণত হয় বিভীষিকায়। বিপ্লবী নেতারা হয়ে ওঠেন নতুন শাসক, যারা পুরনো শাসনের চেয়েও নির্মম, ও ধূর্ত।
অরওয়েলের কালজয়ী বাক্য—‘সব প্রাণী সমান, কিন্তু কিছু প্রাণী আরও সমান’—শুধু যেন একটি ব্যঙ্গ নয়, এটি সভ্যতার গভীরতর রাজনৈতিক সত্য। আজও এ বাক্য অনুরণন তোলে বিশ্বের বহু প্রান্তে, যেখানে বিপ্লবের নামে, নতুন বন্দোবস্তের নামে চলছে শোষণের পুনরাবৃত্তি।
‘অ্যানিমেল ফার্ম’ কেবল একটি রূপক উপন্যাস নয়—এটি সোভিয়েত রাশিয়ার ইতিহাসের এক নির্মম প্রতিচ্ছবি। রুশ বিপ্লবের আদর্শ কীভাবে একনায়কত্বে রূপ নেয়, কীভাবে জনগণের নামে স্বার্থপর গোষ্ঠী ক্ষমতা কুক্ষিগত করে, অরওয়েল সেটিই তুলে ধরেছেন শূকর আর পশুদের গল্পের মধ্য দিয়ে।
জর্জ অরওয়েলের ‘অ্যানিমেল ফার্ম’ শুধু বিপ্লব বা স্বৈরতন্ত্রের প্রতিচ্ছবি নয়, এটি এক বিস্তৃত চরিত্রমালা—যারা বাস্তব ইতিহাসের শক্তিধর ও দুর্বল, আদর্শবাদী ও ষড়যন্ত্রী, নির্যাতক ও নির্যাতিত চরিত্রদের প্রতীক হয়ে উঠেছে। উপন্যাসের চরিত্রগুলোর সঙ্গে সোভিয়েত রাজনীতির বাস্তব চরিত্রের তুলনাও গভীর তাৎপর্য বহন করে।
ওল্ড মেজর—অনেকটা যেন কার্ল মার্ক্স ও ভ্লাদিমির লেনিনের যৌথ প্রতিরূপ। ওল্ড মেজর ছিলেন সেই আদর্শবাদী, যিনি পশুদের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখান, বিদ্রোহের প্রেরণা দেন। বাস্তব ইতিহাসেও মার্ক্স তাঁর কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোতে সমতার সমাজের রূপরেখা দিয়েছিলেন আর লেনিন সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের সূচনা করেন ১৯১৭ সালে। ওল্ড মেজরের মৃত্যুর পর যেভাবে তাঁর আদর্শকে বিকৃত করে ব্যবহার করা হয়, তেমনি লেনিনের মৃত্যুর পর স্তালিন তাঁর ভাবমূর্তিকে কাজে লাগিয়ে নিজের একচ্ছত্র শাসন প্রতিষ্ঠা করেন।
নেপোলিয়ন—অরওয়েলের সবচেয়ে ভয়ংকর সৃষ্টি, যে স্পষ্টতই স্তালিনের প্রতিচ্ছবি। সে ধীরে ধীরে ক্ষমতা দখল করে, প্রচারযন্ত্র নিয়ন্ত্রণে নেয়, প্রতিদ্বন্দ্বীদের নির্মূল করে, এমনকি নিজের অপরাধ ঢাকতে ইতিহাসও বিকৃত করে। স্তালিনের ‘গ্রেট পার্জ’ ছিল এমনই এক নিষ্ঠুর পর্ব—যেখানে বিপ্লবী সহচর থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত কেউ রক্ষা পায়নি।
স্নোবল—চরিত্রটি গড়া হয়েছে লিওন ট্রটস্কির আদলে। আদর্শবাদী, মেধাবী, সংগঠক এ শূকরটি খামারের উন্নয়নের স্বপ্ন দেখায়, যেমনটি ট্রটস্কি করেছিলেন সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার ভবিষ্যৎ নির্মাণে। কিন্তু নেপোলিয়নের ষড়যন্ত্রে স্নোবল বিতাড়িত হয়, পরে তাকে রাষ্ট্রশত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ট্রটস্কিও স্তালিনের দ্বারা একই ভাগ্য বরণ করেন—নির্বাসন এবং শেষ পর্যন্ত গুপ্তহত্যা।
স্কুইলার—খামারের সেই শূকর, যার কাজ ‘ভাষা’র মাধ্যমে সত্যকে ধ্বংস করা, মিথ্যাকে ন্যায় বলে প্রতিষ্ঠিত করা। সে নেপোলিয়নের প্রতিটি অত্যাচার, অন্যায় ও বৈপরীত্যকে রূপান্তর করে দেয় ‘চমৎকার ব্যাখ্যায়’। স্কুইলার যেন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রোপাগান্ডা মেশিন—বিশেষত প্রাভদা পত্রিকার প্রতীক। বাস্তবেও প্রাভদা ছিল স্তালিনের মুখপত্র, যা তথ্যকে নিয়ন্ত্রণ করে জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে দিত।
বক্সার—নীরব, পরিশ্রমী, নিষ্ঠাবান এক ঘোড়া। তার নীতি: ‘নেপোলিয়ন সব সময় ঠিক’ এবং ‘আরও কঠোর পরিশ্রম করতে হবে।’ বক্সার সোভিয়েত সর্বহারা শ্রেণির প্রতীক—যারা আদর্শে বিশ্বাস রেখে প্রাণপণে খেটেছে, প্রশ্ন করেনি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি প্রতারিত হয়েছে। বক্সারের মৃত্যু যেন এক বিপ্লব-পরবর্তী শ্রেণিহত্যার প্রতীক; যেখানে শ্রমজীবী মানুষ, যারা সমাজ পরিবর্তনের ইঞ্জিন ছিল, তারাই সবচেয়ে উপেক্ষিত ও নিপীড়িত হয়েছে।
কুকুর দল—নেপোলিয়নের ব্যক্তিগত দমনযন্ত্র, যারা খামারে ভীতির রাজত্ব কায়েম করে। এরা প্রতীক সেই সিক্রেট পুলিশ বাহিনীর, যা স্তালিন ব্যবহার করতেন তাঁর শত্রুদের নির্মূল করতে। বাস্তবে এরা হলো এনকেভিডি (NKVD) বা পরবর্তী কেজিবি (KGB)—যারা গোপনে ধরপাকড়, জিজ্ঞাসাবাদ, নির্যাতন ও হত্যা চালাত। উপন্যাসে এ কুকুররাই স্নোবলকে খেদিয়ে দেয় আর বাকিদের ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে রাখে।
ভেড়ার দল—যারা শুধু মুখস্থ করে স্লোগান, ‘চার পা ভালো, দুই পা খারাপ!’ আর পরে একই গলায় বলে, ‘চার পা ভালো, দুই পা আরও ভালো!’ তারা না বোঝে, না বুঝতে চায়—শুধু যা বলা হয়, তাই আওড়ে যায়। এই ভেড়ারা হলো সেই অন্ধ অনুসারীদের প্রতীক, যারা চিন্তা ছাড়াই নেতার নির্দেশে জোরে চিৎকার করে। আজও তাদের দেখা যায়—রাজপথে, মিছিলের শিরোনামে, সামাজিক মাধ্যমে—যাদের কণ্ঠ জোরালো, কিন্তু চিন্তা নীরব।
মি.
এই প্রতীকগুলো শুধু ইতিহাসেরই নয়, আজকের সময়েরও প্রতিচ্ছবি। অরওয়েল কেবল চরিত্র নির্মাণ করেননি—তিনি নির্মাণ করেছেন এক ব্যতিক্রমী আয়না, যেখানে প্রতিটি যুগ নিজের মুখ দেখতে পারে। আর পাঠক, যে শুধু ইতিহাস বোঝে না, বর্তমানকেও প্রশ্ন করে।
এভাবে প্রতিটি চরিত্র—যেন রুশ ইতিহাসের একেকটি প্রতিচ্ছবি।
জর্জ অরওয়েলের ‘অ্যানিমেল ফার্ম’ আমাদের দেখায়—কীভাবে বিপ্লবের নামে জন্ম নেয় আরেক স্বৈরতন্ত্র। নেপোলিয়ন ও স্কুইলারের মাধ্যমে গড়ে ওঠে এক ছদ্ম-সমতার শাসনযন্ত্র, যেখানে ‘সব প্রাণী সমান, কিন্তু কিছু প্রাণী অন্যদের চেয়ে বেশি সমান’—এই বাক্য হয়ে দাঁড়ায় ক্ষমতার নিষ্ঠুর সারাংশ।
অরওয়েল বিশ্বাস করতেন, বিপ্লব টিকে থাকে নৈতিকতা ও জবাবদিহির ওপর। সেগুলোর অভাবেই বিপ্লব হারায় তার প্রাণ আর জন্ম নেয় নেপোলিয়নের মতো নতুন শাসক—যে ইতিহাসকে নিজের মতো লিখে নেয়। এ জন্যই ‘অ্যানিমেল ফার্ম’ কেবল অতীতের ব্যঙ্গ নয়, বরং ভবিষ্যতের জন্য একটি তীক্ষ্ণ সতর্কবার্তা।
অরওয়েল আমাদের শেখান, প্রশ্নহীন আনুগত্য, প্রচারনির্ভর শাসন আর নেতার পূজা—এসবই বিপ্লবের আদর্শকে গ্রাস করে। এই উপন্যাস ইতিহাসের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আমাদের বলে—যে বিপ্লব প্রশ্নকে ভয় পায়, সে শেষমেশ নিজ সন্তানদেরই গ্রাস করে।
‘অ্যানিমেল ফার্ম’ বাস্তব না হয়েও বাস্তবতার নির্মম প্রতিবিম্ব।
নাইনটিন এইটি ফোর: ভবিষ্যতের নামে নির্মিত এক শাসনের বিভীষিকা১৯৪৯ সালে আসে অরওয়েলের সবচেয়ে গভীর, সবচেয়ে তীব্র ও পূর্বাভাসমূলক উপন্যাস ‘নাইনটিন এইটি ফোর’। এ যেন কল্পনা নয়, ভবিষ্যতের অন্ধকারের এক ছায়াচিত্র। এক রাষ্ট্র যেখানে স্বাধীন মত নেই, প্রেম নেই, এমনকি ব্যক্তিগত চিন্তাও অপরাধ। ভাষাকে সংকুচিত করা হয়, ইতিহাসকে নতুনভাবে লেখা হয়, তথ্যকে ‘বিকল্প সত্য’ বলে চালানো হয়।
‘বিগ ব্রাদার তোমার দিকে তাকিয়ে আছে’—এই একটি বাক্য হয়ে ওঠে ভয়াবহ এক নজরদারির প্রতীক। ব্যক্তিস্বাধীনতা হারিয়ে ফেলে এবং প্রত্যেক নাগরিক পরিণত হয় রাষ্ট্রের ক্যামেরার নিচে বন্দী এক শ্বাসরুদ্ধ মানুষের ছায়ায়।
‘নাইনটিন এইটি ফোর’ কেবল সোভিয়েত ইউনিয়নের নয়, বরং সমস্ত স্বৈরাচারী রাষ্ট্রব্যবস্থার এক চিত্রকল্প। আজকের প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বেও এর প্রতিধ্বনি শোনা যায়, যেখানে তথ্য নিয়ন্ত্রণ, চিন্তা পর্যবেক্ষণ ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ক্রমেই ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। অরওয়েল দেখিয়ে দেন—যদি মানুষ তার ভাষা হারায়, সত্যকে চিনতে না পারে, তবে সে আর মানুষ থাকে না—সে হয়ে ওঠে ‘পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রাণী’র একটি বশংবদ সংস্করণ।
তাই অরওয়েল শুধু একজন লেখক ছিলেন না—তিনি সময়ের সাক্ষ্যদাতা এবং সতর্কবার্তার দূত।
অন্যান্য রচনাবলি: সাহসী কলমের দায় ও দায়বদ্ধতাজর্জ অরওয়েল শুধু ‘অ্যানিমেল ফার্ম’ কিংবা ‘নাইনটিন এইটি ফোর’–এ সীমাবদ্ধ ছিলেন না। তাঁর সাহিত্যজীবনের পরতে পরতে লুকিয়ে আছে নিপীড়িতের কণ্ঠস্বর, রাজনীতির মুখোশ উন্মোচন এবং সত্যের আপসহীন অনুসন্ধান। তাঁর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রচনার ওপর সংক্ষিপ্ত আলোচনা তুলে ধরা হলো:
Down and Out in Paris and London (1933)
এ লেখা দিয়েই অরওয়েলের সাহিত্যিক আত্মপ্রকাশ। বইটি ইউরোপের নগরজীবনের প্রান্তিক মানুষকে নিয়ে। নিজ অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে তিনি দেখিয়েছেন দরিদ্র মানুষের জীবন কতটা লাঞ্ছনা ও শ্রমে গড়া। এটি শুধু একটি আত্মজীবনীমূলক রচনা নয়, বরং একটি সামাজিক প্রতিবাদ।
The Road to Wigan Pier (1937)
এখানে তিনি ইংল্যান্ডের খনি অঞ্চলের শ্রমিকদের জীবনচিত্র একদম ভেতর থেকে তুলে ধরেন। কিন্তু শুধু বর্ণনাতেই থেমে থাকেন না—বইটির দ্বিতীয় অংশে তিনি সমাজতন্ত্র নিয়ে তীব্র আত্মসমালোচনা করেন। তত্ত্ব নয়, মানবিকতার ভিত্তিতেই যেন সমাজ গড়ে ওঠে—এটাই ছিল তাঁর আকাঙ্ক্ষা।
Homage to Catalonia (1938)
স্পেনের গৃহযুদ্ধে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তিনি যেসব অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন, তা-ই এ বইয়ের মূল। এখানে উঠে এসেছে বিপ্লবের ভেতরের বিশ্বাসঘাতকতা, বিভাজন আর হতাশা। এটি একটি সাহসী আত্মপোলব্ধির দলিল, যা বিপ্লবকে রোমান্টিক করে না, বরং তার জটিলতা তুলে ধরে।
Politics and the English Language (1946)
একটি ক্ষুদ্র প্রবন্ধ, কিন্তু অরওয়েলীয় চেতনাবোধের ভিত্তিপ্রস্তর। ভাষা যদি অস্পষ্ট হয়, তাহলে চিন্তা ও ন্যায়বোধও ভোঁতা হয়ে যায়—এই ছিল তাঁর মূল বক্তব্য। প্রোপাগান্ডার ভাষাকে কীভাবে শনাক্ত করা যায়, তা এখানেই স্পষ্টভাবে পাওয়া যায়।
Shooting an Elephant (1936)
ঔপনিবেশিক মনস্তত্ত্ব ও ব্যক্তির বিবেকবোধের দ্বন্দ্বের এক গভীর প্রতিচ্ছবি। বার্মার এক ব্রিটিশ পুলিশ অফিসার এক হাতিকে হত্যা করেন জনতার চাপে। কিন্তু আসলে সে নিজেই বন্দী। এই গল্পে ঔপনিবেশিক শাসকের সংকট, দম্ভ আর আত্ম–অপমান একই সঙ্গে উঠে এসেছে।
Why I Write (1946)
এই প্রবন্ধে অরওয়েল জানিয়ে দেন, লেখালেখি তাঁর কাছে শুধুই শিল্প নয়—এটি এক রাজনৈতিক দায়িত্ব। তিনি বিশ্বাস করতেন, সত্য বলা, মিথ্যার মুখোশ খুলে ফেলা এবং নির্যাতিতের পক্ষে থাকা—এটাই একজন লেখকের সবচেয়ে বড় দায়।
এসব রচনার মধ্য দিয়ে অরওয়েল কেবল সাহিত্যিক হয়ে থাকেননি—তিনি হয়ে উঠেছেন বিবেকবান মানুষের কণ্ঠস্বর, যিনি প্রতিটি লেখায় আমাদের জিজ্ঞাসা করতে শেখান: সত্য কোথায়? ন্যায় কোথায়? এবং আমরা কোন পক্ষের মানুষ?
কেন জর্জ অরওয়েল আজও প্রাসঙ্গিক?কারণ, অরওয়েল ছিলেন সত্যের অনড় কণ্ঠস্বর। তাঁর লেখায় আমরা দেখি, কীভাবে ভাষা হতে পারে রাজনৈতিক অস্ত্র, কীভাবে ক্ষমতা লুকায় মিথ্যার মুখোশ। তিনি সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস রাখলেও চোখ বন্ধ করে অনুসরণ করেননি—সমালোচনা করেছেন তার ভুল ও বিকৃতি নিয়ে।
অরওয়েলের সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল জটিল রাজনৈতিক বাস্তবতাকে সহজ ভাষায় তুলে ধরা আর সেই ভাষা কখনোই খামখেয়ালি নয়—ছিল তীক্ষ্ণ, দায়বদ্ধ ও প্রতিরোধমুখী।
অরওয়েল ছিলেন শ্রেণিবিভেদ, সাম্রাজ্যবাদ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে এক আপসহীন কলমযোদ্ধা। ‘অ্যানিমেল ফার্ম’-এ যেমন দেখিয়েছেন বিপ্লবের পেছনের ছদ্মবেশ, তেমনি ‘নাইনটিন এইটি ফোর’-এ রাষ্ট্রীয় দমন ও নজরদারির ভয়াল ভবিষ্যৎ।
‘অ্যানিমেল ফার্ম’ আর ‘নাইনটিন এইটি ফোর’ এখন কেবল সাহিত্য নয়—সময়ের চাবিকাঠি। তাঁর গড়া শব্দবন্ধ—বিগ ব্রাদার, থটক্রাইম, ডাবলথিঙ্ক, নিউস্পিক—আজ বাস্তব দুনিয়ার রাজনৈতিক অভিধানে রূপ নিয়েছে। তিনি বিশ্বাস করতেন—ভয়হীন সমাজ মানেই একটি স্বাধীন সমাজ। তাঁর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের স্বপ্নে ছিল দায়িত্ববোধের সঙ্গে স্বাধীনতার সহাবস্থান।
জর্জ অরওয়েলের উত্তরাধিকার কেবল সাহিত্য নয়, বরং বিবেক, ভাষা ও ন্যায়বোধের এক নিরন্তর অনুসন্ধান। আজকের এই বিভ্রান্ত সময়েও তাঁর লেখা আমাদের শেখায়—ভাষা কেবল প্রকাশের মাধ্যম নয়, তা হয়ে উঠতে পারে শোষণের অস্ত্র বা প্রতিরোধের হাতিয়ার। তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও পুনঃপাঠ।
জর্জ অরওয়েল আমাদের শিখিয়েছেন—যেখানে সত্যের গলা চেপে ধরা হয়, সেখানে নীরবতা নিজেই এক অপরাধ। তিনি ছিলেন এমন একজন লেখক, যিনি কোনো মতাদর্শের অন্ধ পূজারি ছিলেন না, বরং প্রতিটি মতাদর্শকে মানবতার মানদণ্ডে বিচার করতেন।
জর্জ অরওয়েলের ১২২তম জন্মবার্ষিকীতে বাংলাভাষী পাঠকদের পক্ষ থেকে আমরা জানাই গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা—এই সাহসী সত্যান্বেষী মানুষটির প্রতি, যিনি আজও আমাদের বিবেকের প্রহরী।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জন ত ক স ব ধ নত র সবচ য় উপন য স ক বল স আম দ র ব স কর ন র মম বক স র চর ত র স ন বল সময় র আদর শ করত ন ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
জর্জ অরওয়েল: এক সত্যান্বেষীর জন্ম ও উত্তরাধিকার
২৫ জুন ১৯০৩, ব্রিটিশ ভারতের মোতিহারিতে জন্ম নেন এরিক আর্থার ব্লেয়ার—যিনি পরে বিশ্ববাসীর কাছে চিরপরিচিত হয়ে ওঠেন জর্জ অরওয়েল নামে। সাহসিকতা, স্বচ্ছতা ও নৈতিক দায়বদ্ধতার যে সাহিত্যিক উত্তরাধিকার তিনি রেখে গেছেন, তাঁর ১২২তম জন্মবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি সেই সত্যান্বেষী কলমসৈনিককে।
অরওয়েলের শিক্ষা শুরু হয় ইংল্যান্ডের অভিজাত বিদ্যাপীঠে, কিন্তু কর্মজীবন শুরু হয় ব্রিটিশ উপনিবেশ বার্মায় একজন পুলিশ অফিসার হিসেবে। সেখানেই তিনি প্রথম সরাসরি প্রত্যক্ষ করেন সাম্রাজ্যবাদের নির্মম রূপ—ক্ষমতার নির্দয় প্রয়োগ, মানুষের অসম্মান আর শোষণের বিভীষিকা তাঁকে গভীরভাবে নাড়া দেয় এবং একজন লেখক হিসেবে তাঁকে ঠেলে দেয় আত্মজিজ্ঞাসার পথে। এরপর স্পেনের গৃহযুদ্ধে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেন। সেখানে যুদ্ধের ময়দানে তিনি বুঝে যান, সত্য কেবল বন্দুকের মুখে হারায় না—হারায় প্রচারের ভাষায়, বিকৃত তথ্য আর বিভ্রান্তির কুয়াশায়।
১৯৪৫ সালে প্রকাশিত ‘অ্যানিমেল ফার্ম’ ছিল তাঁর সাহিত্যিক প্রতিবাদের অনন্য দলিল। এক পশু খামারে বিপ্লবের গল্প দিয়ে তিনি যেভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের স্তালিন যুগের বিকৃতি, বিশ্বাসঘাতকতা ও স্বৈরতন্ত্রের বাস্তবতা তুলে ধরেছেন, তা একদিকে সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ, অন্যদিকে ইতিহাসের বেদনাবাহী পাঠ।
এ উপন্যাসের চরিত্রগুলো—নেপোলিয়ন, স্নোবল, বক্সার—তাদের প্রতিটিই বাস্তব রাজনৈতিক চরিত্র বা শ্রেণির প্রতীক। বিপ্লব যেভাবে স্বপ্ন থেকে বিভীষিকায় রূপ নেয়, সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি কীভাবে ক্ষমতাধরের ভাষায় হারিয়ে যায়—এই অনবদ্য রূপক একমাত্র অরওয়েলই তৈরি করতে পারেন।
অ্যানিমেল ফার্ম-এর বাস্তব রূপান্তরএকটি খামারে পশুরা বিদ্রোহ করে, মানুষের শাসন ফেলে দিয়ে ঘোষণা করে স্বাধীনতা। শুরু হয় একটি নতুন সময়—স্বপ্নের, সমতার, মুক্তির। কিন্তু সময়ের প্রবাহে সেই স্বপ্নই পরিণত হয় বিভীষিকায়। বিপ্লবী নেতারা হয়ে ওঠেন নতুন শাসক, যারা পুরনো শাসনের চেয়েও নির্মম, ও ধূর্ত।
অরওয়েলের কালজয়ী বাক্য—‘সব প্রাণী সমান, কিন্তু কিছু প্রাণী আরও সমান’—শুধু যেন একটি ব্যঙ্গ নয়, এটি সভ্যতার গভীরতর রাজনৈতিক সত্য। আজও এ বাক্য অনুরণন তোলে বিশ্বের বহু প্রান্তে, যেখানে বিপ্লবের নামে, নতুন বন্দোবস্তের নামে চলছে শোষণের পুনরাবৃত্তি।
‘অ্যানিমেল ফার্ম’ কেবল একটি রূপক উপন্যাস নয়—এটি সোভিয়েত রাশিয়ার ইতিহাসের এক নির্মম প্রতিচ্ছবি। রুশ বিপ্লবের আদর্শ কীভাবে একনায়কত্বে রূপ নেয়, কীভাবে জনগণের নামে স্বার্থপর গোষ্ঠী ক্ষমতা কুক্ষিগত করে, অরওয়েল সেটিই তুলে ধরেছেন শূকর আর পশুদের গল্পের মধ্য দিয়ে।
জর্জ অরওয়েলের ‘অ্যানিমেল ফার্ম’ শুধু বিপ্লব বা স্বৈরতন্ত্রের প্রতিচ্ছবি নয়, এটি এক বিস্তৃত চরিত্রমালা—যারা বাস্তব ইতিহাসের শক্তিধর ও দুর্বল, আদর্শবাদী ও ষড়যন্ত্রী, নির্যাতক ও নির্যাতিত চরিত্রদের প্রতীক হয়ে উঠেছে। উপন্যাসের চরিত্রগুলোর সঙ্গে সোভিয়েত রাজনীতির বাস্তব চরিত্রের তুলনাও গভীর তাৎপর্য বহন করে।
ওল্ড মেজর—অনেকটা যেন কার্ল মার্ক্স ও ভ্লাদিমির লেনিনের যৌথ প্রতিরূপ। ওল্ড মেজর ছিলেন সেই আদর্শবাদী, যিনি পশুদের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখান, বিদ্রোহের প্রেরণা দেন। বাস্তব ইতিহাসেও মার্ক্স তাঁর কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোতে সমতার সমাজের রূপরেখা দিয়েছিলেন আর লেনিন সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের সূচনা করেন ১৯১৭ সালে। ওল্ড মেজরের মৃত্যুর পর যেভাবে তাঁর আদর্শকে বিকৃত করে ব্যবহার করা হয়, তেমনি লেনিনের মৃত্যুর পর স্তালিন তাঁর ভাবমূর্তিকে কাজে লাগিয়ে নিজের একচ্ছত্র শাসন প্রতিষ্ঠা করেন।
নেপোলিয়ন—অরওয়েলের সবচেয়ে ভয়ংকর সৃষ্টি, যে স্পষ্টতই স্তালিনের প্রতিচ্ছবি। সে ধীরে ধীরে ক্ষমতা দখল করে, প্রচারযন্ত্র নিয়ন্ত্রণে নেয়, প্রতিদ্বন্দ্বীদের নির্মূল করে, এমনকি নিজের অপরাধ ঢাকতে ইতিহাসও বিকৃত করে। স্তালিনের ‘গ্রেট পার্জ’ ছিল এমনই এক নিষ্ঠুর পর্ব—যেখানে বিপ্লবী সহচর থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত কেউ রক্ষা পায়নি।
স্নোবল—চরিত্রটি গড়া হয়েছে লিওন ট্রটস্কির আদলে। আদর্শবাদী, মেধাবী, সংগঠক এ শূকরটি খামারের উন্নয়নের স্বপ্ন দেখায়, যেমনটি ট্রটস্কি করেছিলেন সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার ভবিষ্যৎ নির্মাণে। কিন্তু নেপোলিয়নের ষড়যন্ত্রে স্নোবল বিতাড়িত হয়, পরে তাকে রাষ্ট্রশত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ট্রটস্কিও স্তালিনের দ্বারা একই ভাগ্য বরণ করেন—নির্বাসন এবং শেষ পর্যন্ত গুপ্তহত্যা।
স্কুইলার—খামারের সেই শূকর, যার কাজ ‘ভাষা’র মাধ্যমে সত্যকে ধ্বংস করা, মিথ্যাকে ন্যায় বলে প্রতিষ্ঠিত করা। সে নেপোলিয়নের প্রতিটি অত্যাচার, অন্যায় ও বৈপরীত্যকে রূপান্তর করে দেয় ‘চমৎকার ব্যাখ্যায়’। স্কুইলার যেন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রোপাগান্ডা মেশিন—বিশেষত প্রাভদা পত্রিকার প্রতীক। বাস্তবেও প্রাভদা ছিল স্তালিনের মুখপত্র, যা তথ্যকে নিয়ন্ত্রণ করে জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে দিত।
বক্সার—নীরব, পরিশ্রমী, নিষ্ঠাবান এক ঘোড়া। তার নীতি: ‘নেপোলিয়ন সব সময় ঠিক’ এবং ‘আরও কঠোর পরিশ্রম করতে হবে।’ বক্সার সোভিয়েত সর্বহারা শ্রেণির প্রতীক—যারা আদর্শে বিশ্বাস রেখে প্রাণপণে খেটেছে, প্রশ্ন করেনি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি প্রতারিত হয়েছে। বক্সারের মৃত্যু যেন এক বিপ্লব-পরবর্তী শ্রেণিহত্যার প্রতীক; যেখানে শ্রমজীবী মানুষ, যারা সমাজ পরিবর্তনের ইঞ্জিন ছিল, তারাই সবচেয়ে উপেক্ষিত ও নিপীড়িত হয়েছে।
কুকুর দল—নেপোলিয়নের ব্যক্তিগত দমনযন্ত্র, যারা খামারে ভীতির রাজত্ব কায়েম করে। এরা প্রতীক সেই সিক্রেট পুলিশ বাহিনীর, যা স্তালিন ব্যবহার করতেন তাঁর শত্রুদের নির্মূল করতে। বাস্তবে এরা হলো এনকেভিডি (NKVD) বা পরবর্তী কেজিবি (KGB)—যারা গোপনে ধরপাকড়, জিজ্ঞাসাবাদ, নির্যাতন ও হত্যা চালাত। উপন্যাসে এ কুকুররাই স্নোবলকে খেদিয়ে দেয় আর বাকিদের ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে রাখে।
ভেড়ার দল—যারা শুধু মুখস্থ করে স্লোগান, ‘চার পা ভালো, দুই পা খারাপ!’ আর পরে একই গলায় বলে, ‘চার পা ভালো, দুই পা আরও ভালো!’ তারা না বোঝে, না বুঝতে চায়—শুধু যা বলা হয়, তাই আওড়ে যায়। এই ভেড়ারা হলো সেই অন্ধ অনুসারীদের প্রতীক, যারা চিন্তা ছাড়াই নেতার নির্দেশে জোরে চিৎকার করে। আজও তাদের দেখা যায়—রাজপথে, মিছিলের শিরোনামে, সামাজিক মাধ্যমে—যাদের কণ্ঠ জোরালো, কিন্তু চিন্তা নীরব।
মি. জোনস—খামারের সাবেক মালিক, এক নিপীড়ক ও অদক্ষ শাসক। সে হলো রাশিয়ার শেষ জার দ্বিতীয় নিকোলাসের প্রতিচ্ছবি। তার শাসনের অদক্ষতা ও নির্যাতনই ছিল বিদ্রোহের সূচনা। ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি বিপ্লবে দ্বিতীয় নিকোলাস ক্ষমতাচ্যুত হন, যেমন উপন্যাসে পশুরা মি. জোনসকে উৎখাত করে।
এই প্রতীকগুলো শুধু ইতিহাসেরই নয়, আজকের সময়েরও প্রতিচ্ছবি। অরওয়েল কেবল চরিত্র নির্মাণ করেননি—তিনি নির্মাণ করেছেন এক ব্যতিক্রমী আয়না, যেখানে প্রতিটি যুগ নিজের মুখ দেখতে পারে। আর পাঠক, যে শুধু ইতিহাস বোঝে না, বর্তমানকেও প্রশ্ন করে।
এভাবে প্রতিটি চরিত্র—যেন রুশ ইতিহাসের একেকটি প্রতিচ্ছবি।
জর্জ অরওয়েলের ‘অ্যানিমেল ফার্ম’ আমাদের দেখায়—কীভাবে বিপ্লবের নামে জন্ম নেয় আরেক স্বৈরতন্ত্র। নেপোলিয়ন ও স্কুইলারের মাধ্যমে গড়ে ওঠে এক ছদ্ম-সমতার শাসনযন্ত্র, যেখানে ‘সব প্রাণী সমান, কিন্তু কিছু প্রাণী অন্যদের চেয়ে বেশি সমান’—এই বাক্য হয়ে দাঁড়ায় ক্ষমতার নিষ্ঠুর সারাংশ।
অরওয়েল বিশ্বাস করতেন, বিপ্লব টিকে থাকে নৈতিকতা ও জবাবদিহির ওপর। সেগুলোর অভাবেই বিপ্লব হারায় তার প্রাণ আর জন্ম নেয় নেপোলিয়নের মতো নতুন শাসক—যে ইতিহাসকে নিজের মতো লিখে নেয়। এ জন্যই ‘অ্যানিমেল ফার্ম’ কেবল অতীতের ব্যঙ্গ নয়, বরং ভবিষ্যতের জন্য একটি তীক্ষ্ণ সতর্কবার্তা।
অরওয়েল আমাদের শেখান, প্রশ্নহীন আনুগত্য, প্রচারনির্ভর শাসন আর নেতার পূজা—এসবই বিপ্লবের আদর্শকে গ্রাস করে। এই উপন্যাস ইতিহাসের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আমাদের বলে—যে বিপ্লব প্রশ্নকে ভয় পায়, সে শেষমেশ নিজ সন্তানদেরই গ্রাস করে।
‘অ্যানিমেল ফার্ম’ বাস্তব না হয়েও বাস্তবতার নির্মম প্রতিবিম্ব।
নাইনটিন এইটি ফোর: ভবিষ্যতের নামে নির্মিত এক শাসনের বিভীষিকা১৯৪৯ সালে আসে অরওয়েলের সবচেয়ে গভীর, সবচেয়ে তীব্র ও পূর্বাভাসমূলক উপন্যাস ‘নাইনটিন এইটি ফোর’। এ যেন কল্পনা নয়, ভবিষ্যতের অন্ধকারের এক ছায়াচিত্র। এক রাষ্ট্র যেখানে স্বাধীন মত নেই, প্রেম নেই, এমনকি ব্যক্তিগত চিন্তাও অপরাধ। ভাষাকে সংকুচিত করা হয়, ইতিহাসকে নতুনভাবে লেখা হয়, তথ্যকে ‘বিকল্প সত্য’ বলে চালানো হয়।
‘বিগ ব্রাদার তোমার দিকে তাকিয়ে আছে’—এই একটি বাক্য হয়ে ওঠে ভয়াবহ এক নজরদারির প্রতীক। ব্যক্তিস্বাধীনতা হারিয়ে ফেলে এবং প্রত্যেক নাগরিক পরিণত হয় রাষ্ট্রের ক্যামেরার নিচে বন্দী এক শ্বাসরুদ্ধ মানুষের ছায়ায়।
‘নাইনটিন এইটি ফোর’ কেবল সোভিয়েত ইউনিয়নের নয়, বরং সমস্ত স্বৈরাচারী রাষ্ট্রব্যবস্থার এক চিত্রকল্প। আজকের প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বেও এর প্রতিধ্বনি শোনা যায়, যেখানে তথ্য নিয়ন্ত্রণ, চিন্তা পর্যবেক্ষণ ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ক্রমেই ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। অরওয়েল দেখিয়ে দেন—যদি মানুষ তার ভাষা হারায়, সত্যকে চিনতে না পারে, তবে সে আর মানুষ থাকে না—সে হয়ে ওঠে ‘পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রাণী’র একটি বশংবদ সংস্করণ।
তাই অরওয়েল শুধু একজন লেখক ছিলেন না—তিনি সময়ের সাক্ষ্যদাতা এবং সতর্কবার্তার দূত।
অন্যান্য রচনাবলি: সাহসী কলমের দায় ও দায়বদ্ধতাজর্জ অরওয়েল শুধু ‘অ্যানিমেল ফার্ম’ কিংবা ‘নাইনটিন এইটি ফোর’–এ সীমাবদ্ধ ছিলেন না। তাঁর সাহিত্যজীবনের পরতে পরতে লুকিয়ে আছে নিপীড়িতের কণ্ঠস্বর, রাজনীতির মুখোশ উন্মোচন এবং সত্যের আপসহীন অনুসন্ধান। তাঁর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রচনার ওপর সংক্ষিপ্ত আলোচনা তুলে ধরা হলো:
Down and Out in Paris and London (1933)
এ লেখা দিয়েই অরওয়েলের সাহিত্যিক আত্মপ্রকাশ। বইটি ইউরোপের নগরজীবনের প্রান্তিক মানুষকে নিয়ে। নিজ অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে তিনি দেখিয়েছেন দরিদ্র মানুষের জীবন কতটা লাঞ্ছনা ও শ্রমে গড়া। এটি শুধু একটি আত্মজীবনীমূলক রচনা নয়, বরং একটি সামাজিক প্রতিবাদ।
The Road to Wigan Pier (1937)
এখানে তিনি ইংল্যান্ডের খনি অঞ্চলের শ্রমিকদের জীবনচিত্র একদম ভেতর থেকে তুলে ধরেন। কিন্তু শুধু বর্ণনাতেই থেমে থাকেন না—বইটির দ্বিতীয় অংশে তিনি সমাজতন্ত্র নিয়ে তীব্র আত্মসমালোচনা করেন। তত্ত্ব নয়, মানবিকতার ভিত্তিতেই যেন সমাজ গড়ে ওঠে—এটাই ছিল তাঁর আকাঙ্ক্ষা।
Homage to Catalonia (1938)
স্পেনের গৃহযুদ্ধে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তিনি যেসব অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন, তা-ই এ বইয়ের মূল। এখানে উঠে এসেছে বিপ্লবের ভেতরের বিশ্বাসঘাতকতা, বিভাজন আর হতাশা। এটি একটি সাহসী আত্মপোলব্ধির দলিল, যা বিপ্লবকে রোমান্টিক করে না, বরং তার জটিলতা তুলে ধরে।
Politics and the English Language (1946)
একটি ক্ষুদ্র প্রবন্ধ, কিন্তু অরওয়েলীয় চেতনাবোধের ভিত্তিপ্রস্তর। ভাষা যদি অস্পষ্ট হয়, তাহলে চিন্তা ও ন্যায়বোধও ভোঁতা হয়ে যায়—এই ছিল তাঁর মূল বক্তব্য। প্রোপাগান্ডার ভাষাকে কীভাবে শনাক্ত করা যায়, তা এখানেই স্পষ্টভাবে পাওয়া যায়।
Shooting an Elephant (1936)
ঔপনিবেশিক মনস্তত্ত্ব ও ব্যক্তির বিবেকবোধের দ্বন্দ্বের এক গভীর প্রতিচ্ছবি। বার্মার এক ব্রিটিশ পুলিশ অফিসার এক হাতিকে হত্যা করেন জনতার চাপে। কিন্তু আসলে সে নিজেই বন্দী। এই গল্পে ঔপনিবেশিক শাসকের সংকট, দম্ভ আর আত্ম–অপমান একই সঙ্গে উঠে এসেছে।
Why I Write (1946)
এই প্রবন্ধে অরওয়েল জানিয়ে দেন, লেখালেখি তাঁর কাছে শুধুই শিল্প নয়—এটি এক রাজনৈতিক দায়িত্ব। তিনি বিশ্বাস করতেন, সত্য বলা, মিথ্যার মুখোশ খুলে ফেলা এবং নির্যাতিতের পক্ষে থাকা—এটাই একজন লেখকের সবচেয়ে বড় দায়।
এসব রচনার মধ্য দিয়ে অরওয়েল কেবল সাহিত্যিক হয়ে থাকেননি—তিনি হয়ে উঠেছেন বিবেকবান মানুষের কণ্ঠস্বর, যিনি প্রতিটি লেখায় আমাদের জিজ্ঞাসা করতে শেখান: সত্য কোথায়? ন্যায় কোথায়? এবং আমরা কোন পক্ষের মানুষ?
কেন জর্জ অরওয়েল আজও প্রাসঙ্গিক?কারণ, অরওয়েল ছিলেন সত্যের অনড় কণ্ঠস্বর। তাঁর লেখায় আমরা দেখি, কীভাবে ভাষা হতে পারে রাজনৈতিক অস্ত্র, কীভাবে ক্ষমতা লুকায় মিথ্যার মুখোশ। তিনি সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস রাখলেও চোখ বন্ধ করে অনুসরণ করেননি—সমালোচনা করেছেন তার ভুল ও বিকৃতি নিয়ে।
অরওয়েলের সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল জটিল রাজনৈতিক বাস্তবতাকে সহজ ভাষায় তুলে ধরা আর সেই ভাষা কখনোই খামখেয়ালি নয়—ছিল তীক্ষ্ণ, দায়বদ্ধ ও প্রতিরোধমুখী।
অরওয়েল ছিলেন শ্রেণিবিভেদ, সাম্রাজ্যবাদ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে এক আপসহীন কলমযোদ্ধা। ‘অ্যানিমেল ফার্ম’-এ যেমন দেখিয়েছেন বিপ্লবের পেছনের ছদ্মবেশ, তেমনি ‘নাইনটিন এইটি ফোর’-এ রাষ্ট্রীয় দমন ও নজরদারির ভয়াল ভবিষ্যৎ।
‘অ্যানিমেল ফার্ম’ আর ‘নাইনটিন এইটি ফোর’ এখন কেবল সাহিত্য নয়—সময়ের চাবিকাঠি। তাঁর গড়া শব্দবন্ধ—বিগ ব্রাদার, থটক্রাইম, ডাবলথিঙ্ক, নিউস্পিক—আজ বাস্তব দুনিয়ার রাজনৈতিক অভিধানে রূপ নিয়েছে। তিনি বিশ্বাস করতেন—ভয়হীন সমাজ মানেই একটি স্বাধীন সমাজ। তাঁর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের স্বপ্নে ছিল দায়িত্ববোধের সঙ্গে স্বাধীনতার সহাবস্থান।
জর্জ অরওয়েলের উত্তরাধিকার কেবল সাহিত্য নয়, বরং বিবেক, ভাষা ও ন্যায়বোধের এক নিরন্তর অনুসন্ধান। আজকের এই বিভ্রান্ত সময়েও তাঁর লেখা আমাদের শেখায়—ভাষা কেবল প্রকাশের মাধ্যম নয়, তা হয়ে উঠতে পারে শোষণের অস্ত্র বা প্রতিরোধের হাতিয়ার। তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও পুনঃপাঠ।
জর্জ অরওয়েল আমাদের শিখিয়েছেন—যেখানে সত্যের গলা চেপে ধরা হয়, সেখানে নীরবতা নিজেই এক অপরাধ। তিনি ছিলেন এমন একজন লেখক, যিনি কোনো মতাদর্শের অন্ধ পূজারি ছিলেন না, বরং প্রতিটি মতাদর্শকে মানবতার মানদণ্ডে বিচার করতেন।
জর্জ অরওয়েলের ১২২তম জন্মবার্ষিকীতে বাংলাভাষী পাঠকদের পক্ষ থেকে আমরা জানাই গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা—এই সাহসী সত্যান্বেষী মানুষটির প্রতি, যিনি আজও আমাদের বিবেকের প্রহরী।