নামের ছাড়পত্র থেকে ট্রেড লাইসেন্স, সবই পাবেন এক জায়গায়, জেনে নিন পদ্ধতি
Published: 25th, June 2025 GMT
আপনি যদি বাংলাদেশে নতুন বিনিয়োগ বা ব্যবসা শুরু করতে চান, তাহলে শুরুতেই আপনাকে কয়েক ধরনের নিবন্ধন নিতে হবে। প্রতিষ্ঠানের নামের ছাড়পত্র, ব্যাংক হিসাব খোলা, কোম্পানির নিবন্ধন, টিআইএন খোলা প্রভৃতি কাজ একসময় পৃথক পৃথক সংস্থায় গিয়ে করতে হতো। এখন প্রক্রিয়াটি অনেক সহজ হয়েছে। মাত্র এক আবেদনেই পাওয়া যাচ্ছে ব্যবসা শুরুর প্রয়োজনীয় পাঁচটি নিবন্ধন।
বিনিয়োগকারী বা ব্যবসায়ীদের জন্য এ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) ওয়ান–স্টপ সার্ভিস (ওএসএস) বা এক দরজায় সেবা প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে। বিডার ওএসএসে কীভাবে নিবন্ধন করবেন এবং ব্যবসা শুরুর জন্য অন্যান্য নিবন্ধন নিতে কীভাবে আবেদন করবেন, সেটি নিয়েই এই লেখা।
পোর্টালে নতুন ব্যবহারকারী নিবন্ধন
আপনি যদি প্রথমবারের মতো বিডার সেবা নিতে চান, তাহলে আপনাকে বিনিয়োগকারী হিসেবে বিডার ওএসএস (ওয়ান–স্টপ সার্ভিস) সিস্টেমে নিবন্ধন করতে হবে। এ জন্য বিডার ওএসএস পোর্টালে গিয়ে হোম পেজে থাকা ওএসএসপিআইডি অপশনে ক্লিক করে ও প্রয়োজনীয় তথ্য পূরণের পর সাইন আপ করতে হবে। এই পদ্ধতিতে আপনি ওএসএস পোর্টালে লগইনের জন্য ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড পাবেন। এই আইডি–পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে পরবর্তী যেকোনো সময় পোর্টালে সেবা গ্রহণের জন্য প্রবেশ (লগইন) করতে পারবেন। পাসওয়ার্ড ভুলে গেলে দুশ্চিন্তার কারণ নেই, সেটি পুনরুদ্ধার বা পরিবর্তন করা যাবে।
প্রথমবার লগইনের পরে শুরুতেই ব্যবহারকারীদের একটি ইউজার রেজিস্ট্রেশন ফরম পূরণ করতে হয়। এখানে ব্যক্তির নাম, লিঙ্গ, জন্মতারিখ, প্রতিষ্ঠানের নাম ও ধরন, জাতীয়তা, জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর ও যোগাযোগের ঠিকানা প্রভৃতি তথ্য দিতে হবে। সফলভাবে রেজিস্ট্রেশন ফরম পূরণ করলে আপনি ইউজার ড্যাশবোর্ডে প্রবেশ করতে পারবেন।
কোম্পানির তথ্য প্রদান
ওপরের কাজগুলো হয়ে গেলে আপনাকে ওএসএস পোর্টালের ড্যাশবোর্ডে কোম্পানির প্রাথমিক তথ্য (বেসিক ইনফরমেশন) দিয়ে একটি ফরম পূরণ করতে হবে। এই প্রাথমিক ফরমে কিছু সাধারণ তথ্য থাকে, যেগুলো আপনি প্রতিবারই যেকোনো আবেদন করার সময়ই ব্যবহার করে থাকেন। যেমন কোম্পানির নাম (বাংলা ও ইংরেজিতে), কোম্পানির ধরন, দেশ, ব্যবসায়ের খাত–উপখাত, মূল পণ্য বা সেবা বা কাজ প্রভৃতি বিষয়। সব তথ্য দিয়ে সাবমিট অপশনে ক্লিক করতে হবে।
বিডার কর্মকর্তারা এই ফরম এক ঘণ্টার মধ্যে অনুমোদন করবেন। আর ফরমটি অনুমোদনের পরেই আপনি আপনার ইউজার প্রোফাইল থেকে সব ধরনের প্রয়োজনীয় সেবার আবেদন জমা দিতে পারবেন।
এক আবেদনে পাঁচ নিবন্ধন
আপনি যদি বাংলাদেশে নতুন বিনিয়োগকারী হয়ে থাকেন, তাহলে আপনি একটি আবেদনেই পাঁচটি লাইসেন্স সেবা পেতে পারবেন। এই পাঁচ সেবা হলো—নামের ছাড়পত্র, করপোরেট ব্যাংক হিসাব খোলা, কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন (নিবন্ধন), করপোরেট টিআইএন (কর শনাক্তকরণ নম্বর) গ্রহণ ও ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণ। তবে এ জন্য ধাপে ধাপে যেতে হবে। ওপরের লাইসেন্সগুলো পেতে হলে আপনাকে নিচের নির্দেশনাগুলো অনুসরণ করতে হবে—
শুরুতে ওএসএস অ্যাকাউন্ট থেকে ‘বিজনেস লাইসেন্স’ মেনুতে ক্লিক করতে হবে। একাধিক লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে চাইলে ‘মাল্টিপল লাইসেন্স’ মেনু বেছে নিতে হবে। তখন নতুন একটি উইন্ডো চলে আসবে। এরপর টার্মস ও কন্ডিশন অপশনে ক্লিক করলে লাইসেন্সগুলোর জন্য আবেদন ফরমটি ধাপে ধাপে আসবে।
১.
নামের ছাড়পত্র
এখানেও প্রথমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পূরণ করা (কারণ, এরই মধ্যে তথ্য দেওয়া হয়েছে) একটি বেসিক ফরম আসবে। তারপর সেখানে কোনো তথ্য না থাকলে তা পূরণ করে পরবর্তী ধাপে যেতে হবে। এরপর, ‘নেম ক্লিয়ারেন্স’ (নামের ছাড়পত্র) ফরমটি আসবে। এটি মূলত যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মগুলোর পরিদপ্তরের (আরজেএসসি) একটি উইন্ডো। এখানে সার্চ অপশনে গিয়ে আপনার কোম্পানির নাম যাচাই করতে পারবেন।
সঙ্গে সঙ্গে আরজেএসসি আপনাকে জানিয়ে দেবে এরই মধ্যে এই নামে কোনো কোম্পানি নিবন্ধিত রয়েছে কি না। নামটি যদি নিবন্ধিত না থাকে, তাহলে আপনি নামের ছাড়পত্র আবেদন ফরম জমা দিতে পারবেন। এরপর তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে আরজেএসসি সিস্টেমে চলে যাবে এবং আপনাকে প্রযোজ্য ফি জমা দিতে হবে।
২. ব্যাংক হিসাব খোলা
এবার আসবে দ্বিতীয় ধাপের নিবন্ধন। আপনাকে বাংলাদেশে একটি করপোরেট ব্যাংক হিসাব (অ্যাকাউন্ট) খুলতে হবে। নামের ছাড়পত্র আবেদন অনুমোদনের পর আপনার সামনে বাংলাদেশে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার একটি আবেদন আসবে। আগে পূরণ করা বেসিক ফরমের তথ্য অনুযায়ী ব্যাংক হিসাবের ফরমও স্বয়ংক্রিয়ভাবে পূরণ হয়ে যাবে। শুধু ব্যাংক বাছাই বা দু–একটি অপশন আপনাকে নিশ্চিত করতে হবে। এরপর ‘কনফার্ম’ অপশনে ক্লিক করে আবেদন জমা দিতে হবে।
৩. কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন
ব্যাংক হিসাবের আবেদন অনুমোদিত হলে আসবে বাংলাদেশে কোম্পানি রেজিস্ট্রেশনের আবেদন। বেসিক ফরম, নামের ছাড়পত্র ও ব্যাংক হিসাবের তথ্য অনুযায়ী কোম্পানি রেজিস্ট্রেশনের ফরমও স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রদর্শিত হবে। এটি আপনাকে জমা দিতে হবে। তবে এখানে অতিরিক্ত কিছু ঘর রয়েছে। আরজেএসসির নির্দেশনা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় অতিরিক্ত তথ্যের ঘরগুলো ফরমে দেখানো হবে। এসব তথ্যের মধ্যে রয়েছে পরিচালকের সংখ্যা, শেয়ারধারীর সংখ্যা, এমডি বা চেয়ারম্যানের মেয়াদ প্রভৃতি। আপনাকে শুধু এসব তথ্য পূরণ করে আবেদনটি জমা দিতে হবে।
রেজিস্ট্রেশন ফি স্বয়ংক্রিয়ভাবে গণনা হবে। আবেদন জমা দেওয়ার সময় আপনাকে পেমেন্টের প্রক্রিয়াও সম্পন্ন করতে হবে।
৪. করপোরেট টিআইএন
কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন আবেদন অনুমোদনের পর আপনি করপোরেট টিআইএন (ই–টিআইএন) খোলার আবেদন করার জন্য যোগ্য হবেন। আপনার সামনে একটি ই–টিআইএন আবেদন ফরম চলে আসবে। সেখানে প্রয়োজনীয় সব ঘর স্বয়ংক্রিয়ভাবে পূরণ হয়ে যাবে। আপনাকে শুধু ‘নিশ্চিত’ করে আবেদনটি জমা দিতে হবে।
৫. ট্রেড লাইসেন্স
নামের ছাড়পত্র, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা, কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন ও ই–টিআইএন আবেদন সম্পন্ন হওয়ার পর আপনি ট্রেড লাইসেন্সের আবেদন করার জন্য যোগ্য হবেন। এ জন্য ড্যাশবোর্ডে ট্রেড লাইসেন্সের নির্দিষ্ট ফরমে ক্লিক করুন। তখন সব প্রাসঙ্গিক ঘর স্বয়ংক্রিয়ভাবে পূরণ হয়ে যাবে।
তবে সংশ্লিষ্ট সিটি করপোরেশনের নির্দেশনা অনুযায়ী আপনাকে কিছু অতিরিক্ত তথ্য পূরণ করতে হতে পারে। এরপর আবেদনটি জমা দিন। আবেদন জমা দেওয়ার পর সিস্টেম স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফি নির্ধারণ করবে। পেমেন্ট সম্পন্ন করে সফলভাবে আবেদন জমা দিতে পারবেন।
ইউজার ড্যাশবোর্ডে প্রতিটি আবেদন ও সর্বশেষ কার্যক্রমের অবস্থা দেখা যাবে। সব স্টেকহোল্ডারের কাছ থেকে অনুমোদন সম্পন্ন হলে আপনার ইউজার ড্যাশবোর্ডে সনদগুলো প্রদর্শিত হবে। এ ছাড়া লাইসেন্স আবেদনের অগ্রগতি সম্পর্কে ই–মেইল নোটিফিকেশনও পাঠানো হবে। এক ফরমে সব আবেদন না করে ড্যাশবোর্ড থেকে পৃথক পৃথকভাবেও সব কটি আবেদন সম্পন্ন করা যাবে।
যদি আবেদন অসম্পূর্ণ হয় অথবা তাতে ভুল তথ্য বা ভুয়া নথি থাকে, তাহলে বিডার প্রতিনিধি আবেদন গ্রহণে অস্বীকৃতি জানাতে পারবেন এবং আবেদনকারীকে সে বিষয়ে অবহিত করা হবে। আর সব ঠিক থাকলে ওএসএসের ড্যাশবোর্ড থেকে আবেদনকারী ব্যক্তি তাঁর আবেদনের সর্বশেষ অবস্থা দেখতে পারবেন।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ন ম র ছ ড়পত র অ য ক উন ট ক ল ক কর করপ র ট ব যবহ র ট আইএন প রব ন অন ম দ অন য য় র জন য ন র পর ন বন ধ ক ফরম গ রহণ আপন র ব যবস ইউজ র আপন ক
এছাড়াও পড়ুন:
লকডাউনের দিনগুলোতে ভ্যাট–যুদ্ধ
১২ এপ্রিল ২০২০, বেলা ১১টা।
বাসায় টেলিভিশনে করোনা সংক্রান্ত ভয়াবহ সব খবর দেখছি। অফিস-আদালত, দোকানপাট, গণপরিবহন সব বন্ধ। মানুষ গৃহবন্দী। মনে হচ্ছিল যেন পৃথিবী থমকে আছে। শহর নিঃশব্দ, আতঙ্ক চারদিকে। কারণ, ২৬ মার্চ থেকে দেশজুড়ে সরকারঘোষিত লকডাউন চলছে।
এমন সময় বিভাগীয় প্রধান মোহাম্মাদ জসিম উদ্দিন স্যারের ফোন। সার্বিক খোঁজখবর নিয়ে শেষে জানালেন, ট্রান্সকম গ্রুপ থেকে জরুরি বার্তা এসেছে—ভ্যাট রিটার্ন সময়মতোই জমা দিতে হবে এবং সেটা সঠিক নিয়ম মেনেই। সবকিছু বন্ধ থাকলেও রিটার্ন জমা দেওয়ার শেষ সময় ১৫ তারিখ ঠিকই নির্ধারিত ছিল। প্রথমে আমাদের মনে হয়েছিল, এই উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সময় হয়তো বাড়বে। কিন্তু জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ভ্যাট রিটার্ন জমার ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেয়নি।
মুহূর্তেই বুঝতে পারলাম এটি এখন আর কোনো সাধারণ দায়িত্ব নয়, এক অদৃশ্য যুদ্ধ। কারণ, প্রথম আলোর মতো প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি লেনদেন স্বচ্ছ ও সঠিকভাবে রিপোর্ট করতে হবে। সময় কম, কাজ বিশাল। আমাদের ওপর চাপ—যেন মাথার ওপর পাহাড়।
বলার অপেক্ষা রাখে না, সামনে তখন এক অসম্ভব মিশন। বাসা থেকে বের হওয়া কঠিন, অফিসে ঢোকার অনুমতি সীমিত, কোনো সহায়তাকারী নেই। আর কাগজপত্র, তথ্য উপাত্ত—সে তো অফিসে!
বলছিলাম করোনার সেই ভয়াবহ দিনের কথা।
আমার এত বছরের চাকরিতে বহু চ্যালেঞ্জ এসেছে, তবে সবচেয়ে রোমাঞ্চকর ও চ্যালেঞ্জিং অভিজ্ঞতা হয়েছিল তখন। যখন একদিকে ছিল প্রাণঘাতী করোনা, অন্যদিকে ছিল ভ্যাট রিটার্ন জমা দেওয়ার অবকাশহীন সময়সীমা। যেখানে আমরা কেউ সাংবাদিক ছিলাম না, কেউ আলোচনায় ছিলাম না, তবু আমরা যুদ্ধ করে প্রতিষ্ঠানের সম্মান বাঁচিয়ে ছিলাম। আমরা ভাবিনি সেই কাজে কেউ বাহবা দেবে কি না, পত্রিকায় আসবে কি না। শুধু ভেবেছিলাম—প্রথম আলোর আলো শুধু পত্রিকার পাতায় নয়, দায়িত্বের মধ্যেও। সেদিন কেউ দেখেনি, কেউ জানেও না—কীভাবে অদৃশ্য এক ভয়কে জয় করে আমরা প্রথম আলোর দায়িত্ব পালন করেছি। যেখানে অফিস ছিল যুদ্ধক্ষেত্র, কি-বোর্ড ছিল অস্ত্র, আর সততা ছিল ঢাল। পেশাগত জীবনে বহু চাপ সামলেছি, বহু রাত জেগে কাজ করেছি, কিন্তু ২০২০ সালের মার্চে শুরু হওয়া কোভিড-১৯ পরিস্থিতির সেই বিশেষ ঘটনার কথা মনে পড়লে আজও গায়ে কাঁটা দেয়।
সেই দিনগুলো শুধু হিসাবের হিসাব নয়, ছিল ভালোবাসার হিসাব—প্রথম আলোর প্রতি।
হিসাব বিভাগ, শুনতে যতটা ‘নিরস’, আসলে কিন্তু আমাদের কাজের মাধ্যমে পুরো প্রতিষ্ঠানের ভিত গড়ে ওঠে। সময়মতো বেতন, সঠিক অডিট, বাজেট পরিকল্পনা—সবই যেন এক নীরব যুদ্ধ। আমিও এই যুদ্ধের এক সৈনিক।
আমরা তিনজন হিসাব বিভাগের সহকর্মী—আমি, এনায়েত কবীর ও ফিরোজ। সিদ্ধান্ত নিলাম ভয় নয়, দায়িত্ব আগে। অফিস থেকে স্যার সিএনজি পাঠিয়েছেন। ওই দিনই ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আমরা যার যার এলাকা থেকে রওনা হলাম—পিপিই না থাকায় রেইনকোট পরে, মুখে মাস্ক, হাতে গ্লাভস, করোনার ভয় পেছনে ফেলে।
রাস্তায় পুলিশের চেকপোস্ট, ‘কোথায় যাচ্ছেন?’
‘অফিশিয়াল জরুরি কাজ,’ প্রথম আলোর পরিচয়পত্র দেখিয়ে বোঝাতে হলো কাজের গুরুত্ব। চেকপোস্ট পার হই, কিন্তু মনে হচ্ছে যেন সিনেমার কোনো দৃশ্য পার হচ্ছি!
অবশেষে গা ছমছম করা ফাঁকা অফিসে ঢুকলাম।
নিঃস্তব্ধ ফ্লোর, একপ্রকার ভুতুড়ে পরিবেশ। লিফট, ফ্লোরের দরজা বন্ধ। বাতাসেও যেন আতঙ্ক মিশে আছে।
আমাদের লড়াই শুরু হয় ডেটা সংগ্রহ দিয়ে।
সার্ভার স্লো, কিছু ভেন্ডরের তথ্য অনুপস্থিত। ইন্টারনেটও মাঝেমধ্যে বিচ্ছিন্ন। বাইরে তখন থেমে থেমে সাইরেন বাজছে, মুঠোফোনে কোভিড আপডেটের ভয়াবহ বার্তা আসছে।
ফ্লোরে তখন তিনজন কাজ করছি, একটানা। কেউ ফাইল যাচাই করছে, কেউ ডেটা এন্ট্রি করছে, কেউ পুরোনো রিপোর্ট মেলাচ্ছে।
একপর্যায়ে ফাইল খুঁজে, সার্ভারে লগইন করে বুঝতে পারি—অনেক ইনভয়েস ও বিআইএন তথ্য অসম্পূর্ণ। কিছু ভেন্ডরের বিআইএন আপডেট লাগবে। তৎক্ষণাৎ ফোন দিই ওই ভেন্ডরদের। কেউ কেউ তখন হয় বাসায় আইসোলেশনে, নয়তো গ্রামের বাড়িতে। কিছু ভেন্ডরের সঙ্গে যোগাযোগই করা যাচ্ছে না। তবু আমরা লেগে থাকি।
কোনোভাবে হোয়াটসঅ্যাপে তারা বিআইএন পাঠায়। আমরা আপডেট করি। এদিকে আমাদের আরেক সহকর্মী মানিক, যিনি ভ্যাটের কাজের সঙ্গে সরাসরি জড়িত।
লকডাউনের ছুটিতে তিনিও বাড়িতে। তাঁর সঙ্গেও ফোনে ফোনে কাজ সম্পন্ন করি।
এভাবে টানা তিন দিন সকাল–বিকেল কাজ করি। দিন যায়, চোখ ভারী হয়, ক্লান্তি পেয়ে বসে, কিন্তু আমরা থামি না। হাতে গ্লাভস, মুখে মাস্ক, মাথায় দায়িত্ব।
ফিরোজ বলে, ‘করোনার কোনো ভ্যাকসিন নাই, কিন্তু আমাদের দায়িত্ববোধই প্রথম আলোর ভ্যাকসিন।’
১৪ তারিখ সন্ধ্যায় ভ্যাট রিটার্নের সব ডেটা চূড়ান্ত করি। এবার ট্রেজারি করার পালা। আরেক ঝক্কি—চেকে দুজনের স্বাক্ষর লাগবে। সিগনেটরির বাসায় গিয়ে চেকে স্বাক্ষর করাতে রাত হয়ে যায়। সেটাও একজনের। আরেকজনের স্বাক্ষর সকালে নিতে হবে, তারপর ব্যাংকে জমা দিয়ে চালান সংগ্রহ করতে হবে।
১৫ তারিখ সকালে আরেক সিগনেটরির স্বাক্ষর নিয়ে অবশেষে ট্রেজারির জন্য জমা হয়। সেখানেও সমস্যা, ব্যাংকের সার্ভার ডাউন। সময় লাগবে, কতক্ষণ, কেউ জানে না। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই দৌড়ঝাঁপগুলো করেছেন অফিস সহকারী শাহীন। অবশেষে দুপুর গড়িয়ে বিকেলে আমরা ট্রেজারি চালান হাতে পেলাম। তৎক্ষণাৎ দেরি না করে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ ভ্যাট অফিসে গিয়ে সফলভাবে রিটার্ন জমা করি।
এই অভিজ্ঞতা আমাকে শিখিয়েছে—প্রযুক্তি যতই আধুনিক হোক, তার পেছনে প্রয়োজন মানুষের ধৈর্য, দলগত প্রচেষ্টা আর দায়িত্ববোধ। এ ঘটনা দেখিয়েছে—কখনো কখনো নিউজরুমের বাইরেও সত্যিকারের থ্রিলার গল্প তৈরি হয়।
প্রথম আলোর দীর্ঘ সফল যাত্রায় এমন হাজারো অদৃশ্য যুদ্ধ রয়েছে, যেগুলো প্রতিষ্ঠানটিকে সত্যিকারের ‘আলো’ বানিয়েছে। সেই আলোর যাত্রার ইতিহাসের বইয়ে আমারও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এমন কিছু অধ্যায় আছে, যা হয়তো কেউ জানে না, তবু মূল্যবান। প্রথম আলোর অগ্রগতির পেছনে এমন অনেক আড়ালের যোদ্ধা আছে, যারা প্রতিদিন পরিশ্রম করে প্রতিষ্ঠানের নাম উজ্জ্বল রাখে। আমি গর্বিত যে আমি সেই দলেরই একজন।
আজ থেকে ১৩ বছর আগে এখানে যুক্ত হয়ে দেখেছিলাম সবার মধ্যে একধরনের ‘স্বচ্ছতা, সরলতা ও শৃঙ্খলা’। ঠিক যেমনটি আমরা পত্রিকার পাতায় দেখি। প্রথম দিন অফিসে ঢুকেই অনুভব করেছিলাম—এই জায়গাটা শুধু চাকরির জন্য নয়, আত্মিকভাবে গড়ে ওঠার। অফিসের পরিবেশ এতটাই সহানুভূতিশীল আর পেশাদার যে অল্প সময়েই আপন হয়ে যায়।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছে আমার দ্বিতীয় পরিবার। সহকর্মীরা যেমন পরিবার, তেমনি কর্মকর্তারা পথপ্রদর্শক। এখানে আমি পেয়েছি জীবনের মূল্যবান শিক্ষা—দায়িত্বশীলতা, সময়ানুবর্তিতা, সহমর্মিতা। সবচেয়ে বড় কথা, সততার চর্চা।
প্রথম আলো আমাকে দিয়েছে সংকটে মাথা ঠান্ডা রাখার শিক্ষা, অন্ধকারে আলো খোঁজার প্রেরণা। এখানে বসের চেয়ে সহকর্মী, বিভাগের চেয়ে সম্পর্ক, আর কাজের চেয়ে ভালোবাসার মূল্য বেশি।
এখানেই প্রথম বুঝেছি, প্রত্যেক নামহীন মানুষের পরিশ্রমই এক একটি আলোর রেখা। কেউ সাংবাদিক, কেউ পেজমেকার, কেউ হিসাবরক্ষক, কেউ আবার বিক্রয়কর্মী—প্রত্যেকেই প্রথম আলো গড়ার কারিগর।
২৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আমি হৃদয়ের গভীর থেকে কৃতজ্ঞতা জানাই আমার প্রতিষ্ঠানকে, সেই সব সহকর্মীকে, যাঁরা প্রতিদিন নীরবে, নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে যান। প্রথম আলোর এই নিরলস যাত্রায় আমিও ১৩ বছর ধরে এক ক্ষুদ্র যাত্রী। তবু গর্ব হয়, আমি এমন এক প্রতিষ্ঠানে কাজ করি, যার বিশ্বাসযোগ্যতা, গ্রহণযোগ্যতা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বজুড়ে। প্রথম আলো শুধু একটি সংবাদপত্র নয়—এটা দায়িত্ব, মূল্যবোধ আর আলোর প্রতীক। প্রথম আলো সত্য বলার সাহস দেখায়, অন্যায়ের প্রতিবাদ করে, সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ায়। এর সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারাটাও ভাগ্যের ব্যাপার।
মো. কামরুজ্জামান শাকিল, উপব্যবস্থাপক, হিসাব, অর্থ ও হিসাব বিভাগ