১২ এপ্রিল ২০২০, বেলা ১১টা।
বাসায় টেলিভিশনে করোনা সংক্রান্ত ভয়াবহ সব খবর দেখছি। অফিস-আদালত, দোকানপাট, গণপরিবহন সব বন্ধ। মানুষ গৃহবন্দী। মনে হচ্ছিল যেন পৃথিবী থমকে আছে। শহর নিঃশব্দ, আতঙ্ক চারদিকে। কারণ, ২৬ মার্চ থেকে দেশজুড়ে সরকারঘোষিত লকডাউন চলছে।

এমন সময় বিভাগীয় প্রধান মোহাম্মাদ জসিম উদ্দিন স্যারের ফোন। সার্বিক খোঁজখবর নিয়ে শেষে জানালেন, ট্রান্সকম গ্রুপ থেকে জরুরি বার্তা এসেছে—ভ্যাট রিটার্ন সময়মতোই জমা দিতে হবে এবং সেটা সঠিক নিয়ম মেনেই। সবকিছু বন্ধ থাকলেও রিটার্ন জমা দেওয়ার শেষ সময় ১৫ তারিখ ঠিকই নির্ধারিত ছিল। প্রথমে আমাদের মনে হয়েছিল, এই উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সময় হয়তো বাড়বে। কিন্তু জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ভ্যাট রিটার্ন জমার ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেয়নি।

মুহূর্তেই বুঝতে পারলাম এটি এখন আর কোনো সাধারণ দায়িত্ব নয়, এক অদৃশ্য যুদ্ধ। কারণ, প্রথম আলোর মতো প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি লেনদেন স্বচ্ছ ও সঠিকভাবে রিপোর্ট করতে হবে। সময় কম, কাজ বিশাল। আমাদের ওপর চাপ—যেন মাথার ওপর পাহাড়।

বলার অপেক্ষা রাখে না, সামনে তখন এক অসম্ভব মিশন। বাসা থেকে বের হওয়া কঠিন, অফিসে ঢোকার অনুমতি সীমিত, কোনো সহায়তাকারী নেই। আর কাগজপত্র, তথ্য উপাত্ত—সে তো অফিসে!
বলছিলাম করোনার সেই ভয়াবহ দিনের কথা।

আমার এত বছরের চাকরিতে বহু চ্যালেঞ্জ এসেছে, তবে সবচেয়ে রোমাঞ্চকর ও চ্যালেঞ্জিং অভিজ্ঞতা হয়েছিল তখন। যখন একদিকে ছিল প্রাণঘাতী করোনা, অন্যদিকে ছিল ভ্যাট রিটার্ন জমা দেওয়ার অবকাশহীন সময়সীমা। যেখানে আমরা কেউ সাংবাদিক ছিলাম না, কেউ আলোচনায় ছিলাম না, তবু আমরা যুদ্ধ করে প্রতিষ্ঠানের সম্মান বাঁচিয়ে ছিলাম। আমরা ভাবিনি সেই কাজে কেউ বাহবা দেবে কি না, পত্রিকায় আসবে কি না। শুধু ভেবেছিলাম—প্রথম আলোর আলো শুধু পত্রিকার পাতায় নয়, দায়িত্বের মধ্যেও। সেদিন কেউ দেখেনি, কেউ জানেও না—কীভাবে অদৃশ্য এক ভয়কে জয় করে আমরা প্রথম আলোর দায়িত্ব পালন করেছি। যেখানে অফিস ছিল যুদ্ধক্ষেত্র, কি-বোর্ড ছিল অস্ত্র, আর সততা ছিল ঢাল। পেশাগত জীবনে বহু চাপ সামলেছি, বহু রাত জেগে কাজ করেছি, কিন্তু ২০২০ সালের মার্চে শুরু হওয়া কোভিড-১৯ পরিস্থিতির সেই বিশেষ ঘটনার কথা মনে পড়লে আজও গায়ে কাঁটা দেয়।

সেই দিনগুলো শুধু হিসাবের হিসাব নয়, ছিল ভালোবাসার হিসাব—প্রথম আলোর প্রতি।
হিসাব বিভাগ, শুনতে যতটা ‘নিরস’, আসলে কিন্তু আমাদের কাজের মাধ্যমে পুরো প্রতিষ্ঠানের ভিত গড়ে ওঠে। সময়মতো বেতন, সঠিক অডিট, বাজেট পরিকল্পনা—সবই যেন এক নীরব যুদ্ধ। আমিও এই যুদ্ধের এক সৈনিক।

আমরা তিনজন হিসাব বিভাগের সহকর্মী—আমি, এনায়েত কবীর ও ফিরোজ। সিদ্ধান্ত নিলাম ভয় নয়, দায়িত্ব আগে। অফিস থেকে স্যার সিএনজি পাঠিয়েছেন। ওই দিনই ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আমরা যার যার এলাকা থেকে রওনা হলাম—পিপিই না থাকায় রেইনকোট পরে, মুখে মাস্ক, হাতে গ্লাভস, করোনার ভয় পেছনে ফেলে।

রাস্তায় পুলিশের চেকপোস্ট, ‘কোথায় যাচ্ছেন?’
‘অফিশিয়াল জরুরি কাজ,’ প্রথম আলোর পরিচয়পত্র দেখিয়ে বোঝাতে হলো কাজের গুরুত্ব। চেকপোস্ট পার হই, কিন্তু মনে হচ্ছে যেন সিনেমার কোনো দৃশ্য পার হচ্ছি!
অবশেষে গা ছমছম করা ফাঁকা অফিসে ঢুকলাম।

নিঃস্তব্ধ ফ্লোর, একপ্রকার ভুতুড়ে পরিবেশ। লিফট, ফ্লোরের দরজা বন্ধ। বাতাসেও যেন আতঙ্ক মিশে আছে।  
আমাদের লড়াই শুরু হয় ডেটা সংগ্রহ দিয়ে।

সার্ভার স্লো, কিছু ভেন্ডরের তথ্য অনুপস্থিত। ইন্টারনেটও মাঝেমধ্যে বিচ্ছিন্ন। বাইরে তখন থেমে থেমে সাইরেন বাজছে, মুঠোফোনে কোভিড আপডেটের ভয়াবহ বার্তা আসছে।

ফ্লোরে তখন তিনজন কাজ করছি, একটানা। কেউ ফাইল যাচাই করছে, কেউ ডেটা এন্ট্রি করছে, কেউ পুরোনো রিপোর্ট মেলাচ্ছে।

একপর্যায়ে ফাইল খুঁজে, সার্ভারে লগইন করে বুঝতে পারি—অনেক ইনভয়েস ও বিআইএন তথ্য অসম্পূর্ণ। কিছু ভেন্ডরের বিআইএন আপডেট লাগবে। তৎক্ষণাৎ ফোন দিই ওই ভেন্ডরদের। কেউ কেউ তখন হয় বাসায় আইসোলেশনে, নয়তো গ্রামের বাড়িতে। কিছু ভেন্ডরের সঙ্গে যোগাযোগই করা যাচ্ছে না। তবু আমরা লেগে থাকি।

কোনোভাবে হোয়াটসঅ্যাপে তারা বিআইএন পাঠায়। আমরা আপডেট করি। এদিকে আমাদের আরেক সহকর্মী মানিক, যিনি ভ্যাটের কাজের সঙ্গে সরাসরি জড়িত।

লকডাউনের ছুটিতে তিনিও বাড়িতে। তাঁর সঙ্গেও ফোনে ফোনে কাজ সম্পন্ন করি।

এভাবে টানা তিন দিন সকাল–বিকেল কাজ করি। দিন যায়, চোখ ভারী হয়, ক্লান্তি পেয়ে বসে, কিন্তু আমরা থামি না। হাতে গ্লাভস, মুখে মাস্ক, মাথায় দায়িত্ব।

ফিরোজ বলে, ‘করোনার কোনো ভ্যাকসিন নাই, কিন্তু আমাদের দায়িত্ববোধই প্রথম আলোর ভ্যাকসিন।’

১৪ তারিখ সন্ধ্যায় ভ্যাট রিটার্নের সব ডেটা চূড়ান্ত করি। এবার ট্রেজারি করার পালা। আরেক ঝক্কি—চেকে দুজনের স্বাক্ষর লাগবে। সিগনেটরির বাসায় গিয়ে চেকে স্বাক্ষর করাতে রাত হয়ে যায়। সেটাও একজনের। আরেকজনের স্বাক্ষর সকালে নিতে হবে, তারপর ব্যাংকে জমা দিয়ে চালান সংগ্রহ করতে হবে।

১৫ তারিখ সকালে আরেক সিগনেটরির স্বাক্ষর নিয়ে অবশেষে ট্রেজারির জন্য জমা হয়। সেখানেও সমস্যা, ব্যাংকের সার্ভার ডাউন। সময় লাগবে, কতক্ষণ, কেউ জানে না। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই দৌড়ঝাঁপগুলো করেছেন অফিস সহকারী শাহীন। অবশেষে দুপুর গড়িয়ে বিকেলে আমরা ট্রেজারি চালান হাতে পেলাম। তৎক্ষণাৎ দেরি না করে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ ভ্যাট অফিসে গিয়ে সফলভাবে রিটার্ন জমা করি।

এই অভিজ্ঞতা আমাকে শিখিয়েছে—প্রযুক্তি যতই আধুনিক হোক, তার পেছনে প্রয়োজন মানুষের ধৈর্য, দলগত প্রচেষ্টা আর দায়িত্ববোধ। এ ঘটনা দেখিয়েছে—কখনো কখনো নিউজরুমের বাইরেও সত্যিকারের থ্রিলার গল্প তৈরি হয়।

প্রথম আলোর দীর্ঘ সফল যাত্রায় এমন হাজারো অদৃশ্য যুদ্ধ রয়েছে, যেগুলো প্রতিষ্ঠানটিকে সত্যিকারের ‘আলো’ বানিয়েছে। সেই আলোর যাত্রার ইতিহাসের বইয়ে আমারও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এমন কিছু অধ্যায় আছে, যা হয়তো কেউ জানে না, তবু মূল্যবান। প্রথম আলোর অগ্রগতির পেছনে এমন অনেক আড়ালের যোদ্ধা আছে, যারা প্রতিদিন পরিশ্রম করে প্রতিষ্ঠানের নাম উজ্জ্বল রাখে। আমি গর্বিত যে আমি সেই দলেরই একজন।

আজ থেকে ১৩ বছর আগে এখানে যুক্ত হয়ে দেখেছিলাম সবার মধ্যে একধরনের ‘স্বচ্ছতা, সরলতা ও শৃঙ্খলা’। ঠিক যেমনটি আমরা পত্রিকার পাতায় দেখি। প্রথম দিন অফিসে ঢুকেই অনুভব করেছিলাম—এই জায়গাটা শুধু চাকরির জন্য নয়, আত্মিকভাবে গড়ে ওঠার। অফিসের পরিবেশ এতটাই সহানুভূতিশীল আর পেশাদার যে অল্প সময়েই আপন হয়ে যায়।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছে আমার দ্বিতীয় পরিবার। সহকর্মীরা যেমন পরিবার, তেমনি কর্মকর্তারা পথপ্রদর্শক। এখানে আমি পেয়েছি জীবনের মূল্যবান শিক্ষা—দায়িত্বশীলতা, সময়ানুবর্তিতা, সহমর্মিতা। সবচেয়ে বড় কথা, সততার চর্চা।

প্রথম আলো আমাকে দিয়েছে সংকটে মাথা ঠান্ডা রাখার শিক্ষা, অন্ধকারে আলো খোঁজার প্রেরণা। এখানে বসের চেয়ে সহকর্মী, বিভাগের চেয়ে সম্পর্ক, আর কাজের চেয়ে ভালোবাসার মূল্য বেশি।

এখানেই প্রথম বুঝেছি, প্রত্যেক নামহীন মানুষের পরিশ্রমই এক একটি আলোর রেখা। কেউ সাংবাদিক, কেউ পেজমেকার, কেউ হিসাবরক্ষক, কেউ আবার বিক্রয়কর্মী—প্রত্যেকেই প্রথম আলো গড়ার কারিগর।

২৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আমি হৃদয়ের গভীর থেকে কৃতজ্ঞতা জানাই আমার প্রতিষ্ঠানকে, সেই সব সহকর্মীকে, যাঁরা প্রতিদিন নীরবে, নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে যান। প্রথম আলোর এই নিরলস যাত্রায় আমিও ১৩ বছর ধরে এক ক্ষুদ্র যাত্রী। তবু গর্ব হয়, আমি এমন এক প্রতিষ্ঠানে কাজ করি, যার বিশ্বাসযোগ্যতা, গ্রহণযোগ্যতা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বজুড়ে। প্রথম আলো শুধু একটি সংবাদপত্র নয়—এটা দায়িত্ব, মূল্যবোধ আর আলোর প্রতীক। প্রথম আলো সত্য বলার সাহস দেখায়, অন্যায়ের প্রতিবাদ করে, সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ায়। এর সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারাটাও ভাগ্যের ব্যাপার।

মো.

কামরুজ্জামান শাকিল, উপব্যবস্থাপক, হিসাব, অর্থ ও হিসাব বিভাগ

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প রথম আল র সহকর ম ক জ কর আম দ র

এছাড়াও পড়ুন:

ময়মনসিংহে সহকর্মীকে হত্যার দায়ে পুলিশ দম্পতির ফাঁসির আদেশ

পুলিশ সদস্যকে হত্যার দায়ে এক পুলিশ দম্পতিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন ময়মনসিংহের একটি আদালত। আজ বৃহস্পতিবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে এ মামলার রায় ঘোষণা করেন অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালত-১ এর বিচারক হারুন-অর রশিদ।

দণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন কনস্টেবল মো. আলাউদ্দিন ও তাঁর স্ত্রী কনস্টেবল নাসরিন নেলী। আলাউদ্দিনের বাড়ি ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলার ভবানীপুর এলাকায়।

মামলার সংক্ষিপ্ত নথি সূত্রে জানা যায়, ২০১৪ সালে কনস্টেবল নাসরিন নেলীর সঙ্গে সহকর্মী কনস্টেবল সাইফুল ইসলামের পরকীয়া সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এর জের ধরেই ঘটে হত্যাকাণ্ড। ওই বছরের আগস্টে ময়মনসিংহ শহরের কাঁচিঝুলি এলাকায় নেলীর ভাড়া বাসায় সাইফুল ইসলামকে খুন করেন নেলী ও তাঁর স্বামী আলাউদ্দিন। হত্যার পর তাঁরা সাইফুল ইসলামের লাশ বস্তাবন্দী করে গুম করার চেষ্টা করেন। তবে নগরীর টাউন হল মোড়ে পুলিশের তল্লাশির সময় বস্তাবন্দী লাশসহ হাতেনাতে ধরা পড়েন তাঁরা।

ওই ঘটনায় নিহত সাইফুল ইসলামের মা মুলেদা বেগম ২০১৪ সালের ১৩ আগস্ট ময়মনসিংহের কোতোয়ালি থানায় কনস্টেবল আলাউদ্দিন, তাঁর স্ত্রী নাসরিন নেলীসহ আরও দুজনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন। তদন্ত ও বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে আদালত আজ আসামিদের উপস্থিতিতে রায় ঘোষণা করেন।

ময়মনসিংহ আদালত পরিদর্শক পিএসএম মোস্তাছিনুর রহমান বলেন, হত্যা মামলায় দুজনকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আদালত।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ময়মনসিংহে সহকর্মীকে হত্যার দায়ে পুলিশ দম্পতির ফাঁসির আদেশ
  • ময়মনসিংহে সাবেক পুলিশ ও তার স্ত্রীর মৃত্যুদণ্ড