ইসরায়েল টানা ১১ দিন ধরে ইরানে বোমাবর্ষণ চালাল। কিন্তু এরপর কী হলো? প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দিয়ে বললেন, ‘ইসরায়েলের লক্ষ্য পূরণ হয়েছে।’ কিন্তু বাস্তবতা বলছে, এ দাবি নিছকই প্রোপাগান্ডা।

এই স্বল্পস্থায়ী যুদ্ধের শুরুতে নেতানিয়াহু দুটি প্রধান লক্ষ্য ঘোষণা করেছিলেন– ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করা এবং শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটানো।

প্রথম প্রশ্ন– ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি কি ধ্বংস হয়েছে? সম্ভবত না। যুক্তরাষ্ট্রের হামলার আগেই ইরান ফোর্ডো পারমাণবিক স্থাপনা থেকে বিভাজনযোগ্য পদার্থ সরিয়ে নিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অথচ এটাই ছিল কর্মসূচির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ফলে একে ‘ধ্বংস’ বলা চলে না।

ইসরায়েল কী ধরনের ক্ষতি করতে পেরেছে, সেটাও স্পষ্ট নয়। তারা যুক্তরাষ্ট্রকে রাজি করিয়ে ইরানের স্থাপনায় ‘ম্যাসিভ অর্ডন্যান্স পেনিট্রেটর’ (এমওপি) নামের ‘বাঙ্কার ধ্বংসকারী’ বোমা ব্যবহার করালেও, এর বাইরে যুক্তরাষ্ট্র তেমন কিছু করেনি। আর ইরান আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের প্রবেশ করতে দেবে না বলেই প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ কঠিন।

দ্বিতীয় প্রশ্ন– ইসরায়েল কি ইরানে শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন আনতে পেরেছে? বরং ঠিক উল্টোটা ঘটেছে।
ইসরায়েল বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনীর জ্যেষ্ঠ নেতাদের হত্যা করে জনঅসন্তোষ উসকে দিতে চেয়েছিল। তাদের ধারণা, শীর্ষ পর্যায়ের হত্যাকাণ্ড শাসনব্যবস্থার ভিত নড়বড়ে করে। কিন্তু অতীতে এই কৌশল খুব কমই সফল হয়েছে। একমাত্র ব্যতিক্রম হতে পারে হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরাল্লাহর মৃত্যু পরবর্তী সময়ে পরিস্থিতি, সেটাও ছিল লেবাননের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।

ইরানের ক্ষেত্রে বরং এই হত্যাকাণ্ড সরকারবিরোধী বহু নাগরিককেও সরকারের পাশে দাঁড়াতে বাধ্য করেছে। আইআরজিসি নেতাদের হত্যার পর এমন মানুষরাও, যারা এই সংগঠনকে ঘৃণা করেন, দেশের বিরুদ্ধে বিদেশি হামলা দেখে আইআরজিসির পক্ষেই অবস্থান নিয়েছেন। ইরানিরা পুরো বিষয়টিকে ‘শুধু সরকারের নয়, বরং গোটা জাতির ওপর হামলা’ হিসেবে দেখেছে।

শাসনব্যবস্থার প্রতীকী কিছু স্থাপনায় বোমা ফেলে ইসরায়েল পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করেছে। উদাহরণস্বরূপ, কুখ্যাত এভিন কারাগারে বোমা হামলা চালিয়ে ইসরায়েল বলেছিল, এটি নাকি রাজনৈতিক বন্দিদের পাশে দাঁড়ানোর এক প্রয়াস। বাস্তবে এতে বন্দিদের অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে এবং বহু বন্দিকে অজানা স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

তেহরানে তথাকথিত ‘ইসরায়েল ডুমসডে ক্লক’ (যেটি ইসরায়েল ধ্বংসের কাউন্টডাউন ঘড়ি হিসেবে পরিচিত) গুঁড়িয়ে দেওয়া ছিল নিছকই হাস্যকর। একইভাবে, ইরানের রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যম আইআরআইবি’তে হামলার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ইসরায়েল বলেছিল, তারা ‘রাষ্ট্রীয় প্রোপাগান্ডা বন্ধ করতে’ চেয়েছে। কিন্তু এতে বরং ইরান ইসরায়েলি টিভি চ্যানেলগুলোকে পাল্টা হামলার হুমকি দেওয়ার যুক্তি পেয়ে গেছে।

তাহলে অন্তত আন্তর্জাতিক সমর্থন কি আদায় করতে পেরেছে ইসরায়েল? গাজা ইস্যুকে আড়াল করে তারা কি ‘ন্যায়ের লড়াইকারী’ হিসেবে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছে? এর সম্ভাবনা খুবই কম।
এটা সত্য যে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে। এর ফলে আন্তর্জাতিক আইনের বহু বিধান লঙ্ঘিত হয়েছে। তবে বোমারু বিমানগুলো হামলার পরপরই ফিরে গেছে– যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে জড়ায়নি।

এরপরও ট্রাম্প বারবার বলেছেন, তিনি ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি চুক্তি চান– যাতে ইসরায়েলও অংশ নিতে পারে। এ থেকে বোঝা যায়, তিনি ইসরায়েলকে সহায়তা করেছেন মূলত নিজের এবং উপসাগরীয় মিত্রদের স্বার্থে।

জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রেদরিখ মের্জসহ কিছু নেতা এই হামলার পক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন ঠিকই; কিন্তু ইসরায়েলের দাবির কঠোরতা– যেমন, ‘ইরান এক বিন্দুও ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে পারবে না’– সে ধরনের অবস্থান কেউ নেয়নি।

বিশ্ব আবার ফিরে গেছে পুরোনো অবস্থানে– ‘ইরানের পরমাণু অস্ত্র থাকা চলবে না’, আর এই অবস্থান ইরান আগেই মেনে নিয়েছিল।

মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে এখনও ইরানকে ‘বৈধ অংশীদার’ হিসেবেই দেখা হচ্ছে। এটি ইসরায়েলের কৌশলগত ব্যর্থতা, আর ইরানের কূটনৈতিক সাফল্য।

আরেকটি দিক ভুললে চলবে না– ইসরায়েল নিজ ভূখণ্ডেই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে। আকাশে শুরুতে আধিপত্য স্থাপন করলেও ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র একের পর এক ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ভেদ করে দেশের বিভিন্ন এলাকায় আঘাত হানে। সবকিছুই স্থবির হয়ে পড়ে, অনেক মানুষ নিহত হন, বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ধ্বংসযজ্ঞ চলে। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছিল, মজুত পূরণের তেমন সুযোগ ছিল না। ইসরায়েলের অর্থনীতি কার্যত থমকে যায়। এটাও ইরানের আরেকটি বড় অর্জন।
ইরান এই যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, প্রাণহানি হয়েছে শত শত মানুষের, দেশজুড়ে বিস্তৃত বোমাবর্ষণের শিকার হয়েছে। কিন্তু তবু ইসলামি প্রজাতন্ত্র ভেঙে পড়েনি।

ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র নির্ভুলভাবে আঘাত হেনেছে, আর বিশ্ব তাদের দেখেছে আক্রান্ত এক রাষ্ট্র হিসেবে, আগ্রাসী হিসেবে নয়। কাতারে অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটিতে হামলার প্রতিশোধ নেওয়ার আগে ইরান নিজেই আগাম সতর্কবার্তা দিয়ে উত্তেজনা প্রশমিত করেছে।

অবস্থা এমন হয়েছিল যে, ট্রাম্প পর্যন্ত ইসরায়েলকে হুঁশিয়ারি দেন যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন না করতে। শেষ পর্যন্ত, ইরান এই যুদ্ধ থেকে বেরিয়ে এসেছে খানিকটা আহত, কিন্তু অটুট, আত্মবিশ্বাসী এবং ভবিষ্যতের কৌশলগত সম্ভাবনা নিয়ে এগিয়ে চলার অবস্থানে।

ওরি গোল্ডবার্গ: ইসরায়েলি লেখক, রাজনৈতিক বক্তা ও মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশ্লেষক

আলজাজিরা থেকে ভাষান্তর: শাহেরীন আরাফাত

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ইসর য় ল শ সনব যবস থ র য ক তর ষ ট র ইসর য় ল র অবস থ ন র জন ত

এছাড়াও পড়ুন:

ইরানের মধ্যাঞ্চলে ইসরায়েলি হামলায় ১০ আইআরজিসি সদস্য নিহত: তাসনিম

ইরানের মধ্যাঞ্চল ইয়াজদ প্রদেশে ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ড কর্পসের (আইআরজিসি) কমপক্ষে ১০ সদস্য নিহত হয়েছেন। স্থানীয় সময় রোববার এ হামলা চালায় আইডিএফ। সংবাদ সংস্থা তাসনিমের বরাতে এ খবর প্রকাশ করেছে আল জাজিরা।

খবরে আরও বলা হয়েছে, হামলায় বহু আইআরজিসি কর্মী আহত হয়েছেন।

ইসরায়েল জানিয়েছে, ১৩ জুন আকস্মিক হামলা শুরু করার পর থেকে দুই ডজন ইরানি সামরিক কমান্ডার ও পারমাণবিক বিজ্ঞানীকে হত্যা করেছে তারা।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • হামলার পরই ইসরায়েলি গোয়েন্দারা ইরানি জেনারেলদের স্ত্রী-সন্তানসহ হত্যার হুমকি দিয়েছিলেন
  • জীবিত আছেন ইরানের কুদস ফোর্স কমান্ডার ইসমাইল কানি
  • ইরানে ইসরায়েল যেভাবে পুরোপুরি ব্যর্থ হলো
  • কুয়েত, বাহরাইন, আমিরাতের আকাশপথ আবার সচল
  • তেহরানে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে
  • এবার মার্কিন ঘাঁটিতে ইরানের হামলা
  • কারও আগ্রাসন মেনে নেবে না ইরান: খামেনি
  • ইরানের মধ্যাঞ্চলে ইসরায়েলি হামলায় ১০ আইআরজিসি সদস্য নিহত: তাসনিম