বাইসাইকেলের সামনে বসানো ছোট্ট ঝুড়ি। তার ভেতরে বিচিত্র বই। আর হাতলে ঝোলানো ব্যাগটি সব সময় ভরা গাছের চারায়। এভাবে নিজের দুই চাকার যান সাজিয়ে গ্রামগঞ্জে ছোটেন মাহমুদুল ইসলাম। হঠাৎ কোথাও থেমে চারা উপহার দেন। শিশু-কিশোরদের পড়ার জন্য ধার দেন বই। কখনও খোলা আকাশের নিচে বসান গল্প পাঠের আসর। শিশু-কিশোররা মুগ্ধ হয়ে তাঁর সেই গল্প শোনে।
গাছ ও শিশুদের বিকাশে কাজ করে যাওয়া এই উদ্যমী যুবক রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেয়েছেন। পরিবেশ সংরক্ষণ ও দূষণ নিয়ন্ত্রণে অবদান রাখায় ব্যক্তি পর্যায়ে মাহমুদুলকে ‘জাতীয় পরিবেশ পদক ২০২৪’ দিয়েছে সরকার। বুধবার রাজধানীর বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে তাঁর হাতে পুরস্কার তুলে দেন পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার আজিজনগর গ্রামে মাহমুদুলের বাড়ি। তাঁর ডাকনাম মামুন। তিনি রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। গাছের সঙ্গে মাহমুদুলের সখ্য শৈশব থেকে। তখন তাঁর প্রিয় কাজ ছিল বাড়ির আঙিনায় ও ফাঁকা জায়গায় গাছ লাগানো। পাশাপাশি পাখিদের খাবার খাইয়ে আনন্দ পেতেন তিনি। এভাবেই তাঁর যাত্রা শুরু। সে সময় অনেকেই মাহমুদুলকে ‘পাগল’ বলতেন। তবে এসব কথা তিনি গায়ে মাখেননি, কাজ করে গেছেন নিজের মতো।
প্রকৃতি ও পরিবেশ সংরক্ষণে মাহমুদুলের কার্যক্রম আরও বেড়ে যায় যুগ আগে, ২০১৩ সালে। তখন রংপুরের কারমাইকেল কলেজে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক তিনি। মা-বাবার পাঠানো টাকা থেকে কিছুটা বাঁচিয়ে রাখতেন। প্রতিবার ছুটিতে বাড়ি যাওয়ার সময় রংপুর থেকে নানান জাতের ফলদ ও বনজ গাছের চারা নিয়ে যেতেন। রোপণ করতেন বাড়ির আশপাশে। ২০১৬ সালে স্নাতকোত্তর শেষ করে বাড়ি ফিরে আসেন মাহমুদুল। বাড়িয়ে দেন গাছ ও বই বিতরণ। চাকরির জন্য না ছুটে স্কুলপড়ুয়া দরিদ্র শিশুদের বাড়িতে প্রতি সন্ধ্যায় গিয়ে বিনামূল্যে পড়ান, যার নাম দিয়েছিলেন ‘সন্ধ্যা রাতের পাঠশালা’। এক সময় এলাকার মানুষের পাঠাভ্যাস গড়ে তুলতে নিজ বাড়িতে গড়ে তোলেন ‘প্রকৃতির পাঠাগার’, যেখানে আছে কয়েক হাজার বই।
মাহমুদুল শুধু বই আর গাছ বিতরণে থেমে নেই। তিনি কখনও পরিষ্কার করেন সড়কে জমে থাকা পানি, ঝোপঝাড়– যেন দুর্ঘটনা না ঘটে। চলার পথে পড়ে থাকা প্লাস্টিকের ব্যাগ কুড়িয়ে নেন। এসব কাজের ভিডিও মাঝেমধ্যে ফেসবুকে আপলোড করেন, যার প্রশংসা পান প্রতিনিয়ত। এবার পেলেন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। তাঁর এই প্রাপ্তিতে খুশি এলাকাবাসীসহ সবাই। নুসরাত জাহান নামে একজন ফেসবুকে লিখেছেন, ‘যোগ্য মানুষের হাতে পরিবেশ পদক দেখে খুশি লাগছে। আপনার মতো পাগল মানুষ আমাদের দরকার ভাই।’
মাহমুদুলের আদর্শ মা মাহামুদা বেগম। পুরস্কার পেয়ে সে কথা জানাতে ভোলেননি। গতকাল পুরস্কারপ্রাপ্তির প্রতিক্রিয়ায় ফেসবুকে একটি ছবি পোস্ট করেন তিনি। ছবিতে দেখা যায়, মাহমুদুল পরিবেশ উপদেষ্টা ও মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে। ক্যাপশনে তিনি লিখেছেন, ‘আমার কাজের আদর্শ জাতীয় মঞ্চে। কাজে কথায় ইবাদতে দোয়া জানাই, ধর্ম-বর্ণ, মতভেদের সবাই সুস্থ থাকুন। কাজের জীবন গড়ে তুলুন। পরের জন্য বাঁচুন।’
তেঁতুলিয়ার ইউএনও আফরোজ শাহীন খসরু বলেন, মাহমুদুলের পদকপ্রাপ্তিতে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অভিবাদন জানাচ্ছি। তাঁর কাজে উজ্জীবিত হয়ে তরুণরা স্বেচ্ছাসেবায় উৎসাহ পাবে।
.উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
নারায়ণগঞ্জে চাইল্ড ল্যাবরেটরি স্কুলের বার্ষিক পুরস্কার ও সনদ বিতরণ
নারায়ণগঞ্জে চাইল্ড ল্যাবরেটরি স্কুলের বার্ষিক পুরস্কার ও সনদ বিতরণ অনুষ্ঠান উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে। অনুষ্ঠানটি ছিল শিক্ষার্থীদের সাফল্য উদযাপন ও তাদের অনুপ্রেরণা জাগানোর এক উজ্জ্বল আয়োজন।
বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়া হয় বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অর্জিত পুরস্কার ও সনদপত্র। শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক ও কর্মচারীদের মাঝে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ৩১৪ টি পুরস্কার দেয়া হয়।
অনুষ্ঠানের সূচনাতেই শিক্ষার্থীদের পরিবেশনায় নাচ, গান, কবিতা আবৃত্তি ও নাটিকা দর্শকদের মুগ্ধ করে তোলে। ক্ষুদে শিল্পীদের প্রাণবন্ত পরিবেশনায় মিলনায়তনে তৈরি হয় এক মনোরম আবহ। কখনও দেশের গান, কখনও নৃত্য, আবার কখনও আবৃত্তি—প্রতিটি পর্বেই ছিল শিক্ষার্থীদের মনোমুগ্ধকর পরিবেশনা। অভিভাবকরাও মুগ্ধ হয়ে হাততালি আর উৎসাহে ভরিয়ে দেন প্রিয় সন্তানদের।
পুরো অনুষ্ঠানজুড়ে ছিল অভিভাবক, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ। কেউ ছবি তুলেছেন, কেউ সন্তানকে সাজাতে সাহায্য করেছেন, কেউবা নীরবে গর্বভরে দেখেছেন মঞ্চে তাদের প্রিয় মুখ। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন ১২২ জন শিক্ষার্থী এবং বিদ্যালয়ের সেরা শিক্ষক পুরষ্কার পান ৬ জন। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট বিল্লাল হোসেন রবিন।
সাংস্কৃতিক পরিবেশনা উপভোগ করে তিনি বলেন, “শিশুদের এই আনন্দ, আত্মবিশ্বাস আর মঞ্চে নিজেকে প্রকাশের ক্ষমতাই প্রমাণ করে—তারা কতটা সম্ভাবনাময়। শিক্ষা শুধু বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ নয়; শিল্প-সংস্কৃতি শিশুর মানসিক বিকাশের অপরিহার্য অংশ।”
অভিভাবকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, বাচ্চাকে অন্য কারো সঙ্গে তুলনা করবেন না। প্রত্যেক বাচ্চার নিজস্ব প্রতিভা ও দক্ষতা থাকে কেউ চমৎকার ছবি আঁকে, কেউ গান করে, কেউ নাচ বা কিছু তৈরি করতে পারে।
এজন্য প্রতিটি শিশুকে আলাদাভাবে বোঝা এবং উৎসাহ দেওয়াই গুরুত্বপূর্ণ। মা-বাবা বা শিক্ষকরা শুধুই গাইড বা পথপ্রদর্শক হিসেবে থাকবেন; চাপ বা শাস্তির মাধ্যমে নয়, ভালোবাসা ও সহানুভূতির মাধ্যমে শিশুদের এগোতে শেখাতে হবে।
প্রতিটি শিশুর আলাদা দক্ষতা আছে এবং তাদের সেই অনুযায়ী উৎসাহ ও নির্দেশনা দেওয়া উচিত, যাতে তারা স্বাভাবিকভাবে বড় হতে পারে এবং নিজের শক্তি ও সম্ভাবনা অনুযায়ী এগিয়ে যেতে পারে।
সাংস্কৃতিক পরিবেশনার পর শুরু হয় প্রতীক্ষিত পুরস্কার বিতরণ পর্ব। একে একে মঞ্চে উঠে আসে মেধাবী শিক্ষার্থীরা। বছরের সেরা ফলাফল, সহশিক্ষা কার্যক্রমে কৃতিত্ব ও সৃজনশীল প্রতিযোগিতায় সফল শিক্ষার্থীদের হাতে পুরস্কার ও সনদ তুলে দেন অতিথিরা। শিক্ষার্থীদের মুখে ঝলমল করছিল আনন্দের হাসি; অভিভাবকরা মোবাইল হাতে ধরে রাখছিলেন সন্তানের সাফল্যের মুহূর্তগুলো।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন চাইল্ড ল্যাবরেটরি স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মোঃ সামসুজ্জামান। তিনি বলেন,“চাইল্ড ল্যাবরেটরি স্কুল শুধুমাত্র একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, এটি আমাদের শিশুদের স্বপ্ন গড়ে তোলার এক কেন্দ্র। আমরা চাই প্রতিটি শিক্ষার্থী পড়াশোনার পাশাপাশি সৎ, দেশপ্রেমিক ও সংস্কৃতিমনা মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠুক।”
বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা বিলকিস আক্তার বৈশাখী ও কাশফিয়া মেহজাবীন ইকরার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন পরিচালক ঐক্য পরিষদ (নারায়ণগঞ্জ জেলা) সভাপতি ও টাঙ্গাইল ক্যাডেট এন্ড একাডেমিক স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান আলহাজ্ব মোঃ সাখাওয়াত হোসেন খাঁন, বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন পরিচালক ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মোঃ মজিবুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক মোঃ কাউসার আহমেদ, রাজিয়া এ্যাপালেস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলহাজ্ব মোঃ গোলাম মোস্তফা খান, ক্যালিক্স প্রি-ক্যাডেট স্কুলের পরিচালক মতিনুল ইসলাম মতিন, এবং শাহিনুর আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান শিক্ষক মোঃ আরিফ হোসেন ঢালী। সার্বিক ব্যবস্থাপনায় ছিলেন বিদ্যালয়ের ভাইস চেয়ারম্যান মাহমুদুল হাসান সোহান।