তবে কি নিউইয়র্ক টাইমস মেয়রপ্রার্থী জোহরানের পেছনে লেগেছে
Published: 9th, July 2025 GMT
সম্প্রতি নিউইয়র্ক টাইমসে একটি সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে পাঠকদের তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে—এবং তার যথেষ্ট কারণও আছে।
প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘কলেজে ভর্তির আবেদনপত্রে মামদানি নিজেকে এশীয় এবং আফ্রিকান আমেরিকান দেখিয়েছিলেন’
কেন নিউইয়র্ক টাইমসের ওই প্রতিবেদন তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে, তার কয়েকটি কারণ তুলে ধরেছেন মার্গারেট সুলিভান। তিনি দ্য গার্ডিয়ান ইউএসের একজন কলাম লেখক। তিনি গণমাধ্যম, রাজনীতি ও সংস্কৃতি নিয়ে কলাম লেখেন।
মার্গারেট সুলিভান তাঁর কলামে লিখেছেন, প্রতিবেদনটি নিউইয়র্ক সিটির মেয়র পদপ্রার্থী জোহরান মামদানিকে নিয়ে করা। ডেমোক্র্যাটদের প্রাথমিক বাছাইয়ে (প্রাইমারি ইলেকশন) তাঁর চকমপ্রদ জয় জাতীয় পর্যায়ে নজর কেড়েছে।
জোহরানকে নিয়ে ডানপন্থী সংবাদমাধ্যমগুলোর দাবি, মামদানি কলাম্বিয়ার অ্যাফারমেটিভ অ্যাকশনভিত্তিক ভর্তি নীতির সুবিধা নিতে নিজের জাতিগত পরিচয় নিয়ে মিথ্যা বলেছিলেন।ভারতীয় বংশোদ্ভূত মামদানির জন্ম উগান্ডায়। নিউইয়র্ক টাইমসের ওই প্রতিবেদনের মূল বক্তব্য ছিল, নিউইয়র্কে হাইস্কুলের শেষ ধাপে মামদানি কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদন করার সময় জাতিগত পরিচয়সম্পর্কিত একাধিক ঘরে টিক দিয়েছিলেন।
আপনি বলতে পারেন, এতে সমস্যা কোথায়? কেন এ বিষয়টি নিয়ে রিপোর্টই–বা করতে হবে? দারুণ প্রশ্ন।
জোহরান মামদানিকে নিয়ে এ ধরনের একটি প্রতিবেদন করা এবং সেটি প্রকাশের সিদ্ধান্ত কম করে বললেও বোকার মতো একটি কাজ হয়েছে বলা যায়মার্গারেট সুলিভান, দ্য গার্ডিয়ান ইউএসের কলাম লেখকসংবাদটির প্রকৃত গুরুত্ব থাকুক বা না থাকুক, এটি অবধারিতভাবে মামদানির একজন প্রতিদ্বন্দ্বীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তিনি হলেন, নিউইয়র্ক সিটির বর্তমান মেয়র এরিক অ্যাডামস। এবার অ্যাডামস একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মেয়র নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।
অ্যাডামস একজন কৃষ্ণাঙ্গ। তিনি বলেছেন, জোহরান মামদানি কৃষ্ণাঙ্গ না হয়েও আফ্রিকান–আমেরিকান পরিচয়কে পুঁজি করে ফায়দা তোলার চেষ্টা করেছেন। এটা তাঁর কাছে গভীর অপমানজনক মনে হয়েছে।
আর ফক্স নিউজে একাধিক টক শোতে উপস্থাপকেরা নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনের উল্লেখ করে জোহরানকে তুলাধোনা করেছেন।
যেমন, ফক্স অ্যান্ড ফ্রেন্ডস অনুষ্ঠানের উপস্থাপক চার্লি হার্ট জোহরানকে একজন ‘বর্ণবাদী’ বলে উল্লেখ করেন। তিনি দাবি করেন, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ যা কিছুতে বিশ্বাস করে, তার সবকিছুকেই ঘৃণা করেন মামদানি।
নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন প্রকাশের আগেও ডানপন্থী টেলিভিশন নেটওয়ার্ক ফক্স নিউজ জোহরানকে ধুয়ে দিয়ে সংবাদ পরিবেশন করেছে। জোহরান একজন মুসলিম ও সমাজতান্ত্রিক।
ভারতীয় বংশোদ্ভূত মামদানির জন্ম উগান্ডায়। নিউইয়র্ক টাইমসের ওই প্রতিবেদনের মূল বক্তব্য ছিল, নিউইয়র্ক সিটির একজন হাইস্কুল শিক্ষার্থী হিসেবে মামদানি কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদন করার সময় জাতিগত পরিচয়সম্পর্কিত একাধিক ঘরে টিক দিয়েছিলেন।প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জোহরানকে একজন কমিউনিস্ট বলেছেন এবং তাঁকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিতাড়ন করা উচিত বলে মন্তব্য করেছেন।
অন্যান্য ডানপন্থী সংবাদমাধ্যমও নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনটি লুফে নিয়েছে। তারা মামদানির জাতিসংক্রান্ত তথ্য দেওয়াকে ডিইআই কেলেঙ্কারির উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করেছে। ডিইআই হলো বৈচিত্র্য, সাম্যতা ও অন্তর্ভুক্তি নীতি।
জোহরানকে নিয়ে ডানপন্থী সংবাদমাধ্যমগুলো দাবি করে, কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিবাচক পদক্ষেপমূলক ভর্তি নীতির (অ্যাফারমেটিভ অ্যাকশন) সুযোগ নিতেই মামদানি নিজের জাতিগত পরিচয় নিয়ে মিথ্যা বলেছিলেন। মামদানি কিন্তু শেষতক কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হননি, যে কারণে তাঁকে নিয়ে করা ওই সংবাদটি আরও ফালতু হয়ে গেছে।
নিউইয়র্ক টাইমসের মুদ্রিত সংস্করণে এ খবরের শিরোনাম করা হয়, ‘কলেজে ভর্তির আবেদনপত্র ঘিরে সমালোচনার মুখোমুখি মামদানি’।
অধিকাংশ কলেজে ভর্তির আবেদনপত্রে ভারতীয় বংশোদ্ভূত উগান্ডার নাগরিকদের জন্য আলাদা কোনো ঘর থাকে না, তাই আমার পারিবারিক পটভূমি পূর্ণরূপে তুলে ধরার চেষ্টা হিসেবে আমি একাধিক ঘরে টিক দিয়েছিলামজোহরান মামদানি, নিউইয়র্ক সিটির মেয়র প্রার্থীজোহরান তাঁর ব্যাখ্যায় বলেছেন, তিনি তাঁর জটিল পারিবারিক পটভূমি বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর বাবা একজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত উগান্ডার নাগরিক এবং মা ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকান। জোহরানের জন্ম উগান্ডায়, শৈশবে নিউইয়র্ক সিটিতে চলে আসার আগে স্বল্প সময় তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় বসবাস করেছেন।
নিউইয়র্ক টাইমসকে তিনি বলেন, ‘অধিকাংশ কলেজে ভর্তির আবেদনপত্রে ভারতীয় বংশোদ্ভূত উগান্ডার নাগরিকদের জন্য আলাদা কোনো ঘর থাকে না, তাই আমার পারিবারিক পটভূমি পুরোটা তুলে ধরার চেষ্টা হিসেবে আমি একাধিক ঘরে টিক দিয়েছিলাম।’
সুলিভান লেখেন, জোহরান মামদানিকে নিয়ে এ ধরনের একটি প্রতিবেদন করা এবং সেটি প্রকাশের সিদ্ধান্ত কম করে বললেও বোকার মতো কাজ হয়েছে বলা যায়।
টাইমসের মতামত বিভাগ তাদের মতপ্রকাশের অধিকার রাখে, যতই তা ভুল পথে পরিচালিত হোক না কেন। কিন্তু সরাসরি সংবাদ প্রতিবেদনে কোনো প্রার্থীর পক্ষে বা বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া ঠিক না। সংবাদ প্রতিবেদন দলনিরপেক্ষ হওয়া উচিত। কোনো প্রার্থীকে উৎসাহ দেওয়া বা কাউকে খোঁড়া করে দেওয়া সংবাদের কাজ নয়।এর একটি কারণ, কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যভান্ডারে (ডেটাবেজে) বড় ধরনের হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে নিউইয়র্ক টাইমসের হাতে এ তথ্য এসেছে। এক মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে পত্রিকাটির কাছে এ তথ্য আসে। নিউইয়র্ক টাইমস তাদের প্রতিবেদনে তথ্যসূত্র গোপন রেখেছে।
আরও পড়ুনজোহরানকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রে ইসলামবিদ্বেষ ছড়াচ্ছেন উগ্রবাদীরা০১ জুলাই ২০২৫কিন্তু পরে জানা গেছে, ওই সূত্র হলেন জর্ডান লাসকার। গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন অনুযায়ী, তিনি একজন সুপরিচিত এবং ব্যাপক সমালোচিত জাতিগত বিশুদ্ধতাবাদী বা শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী।
প্রখ্যাত সাংবাদিক ও গণমাধ্যম উদ্যোক্তা সোলেদাদ ও’ব্রায়েন নিউইয়র্ক টাইমসে জোহরানকে নিয়ে করা ওই প্রতিবেদনকে ‘একটি রসিকতা’ বলে আখ্যা দিয়েছেন।
তিনি বলেন, জোহরান মামদানির ওপর এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা টাইমসের জন্য ‘চরম লজ্জাজনক একটি ঘটনা’।
সোলেদাদ নিজেও মিশ্র জাতিগত পারিবারিক পটভূমি থেকে এসেছেন এবং নিজেকে কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে পরিচয় দেন।
এ ঘটনা একটি বড় বিষয় তুলে ধরেছে। সেটি হলো, জোহরান মামদানির প্রার্থিতা নিয়ে টাইমসের প্রকাশ্য বিরূপ মনোভাব।
মামদানির ওপর টাইমসের এই প্রতিবেদন প্রকাশ সম্পূর্ণ লজ্জাজনক একটি ঘটনাসোলেদাদ ও’ব্রায়েন, সাংবাদিক ও গণমাধ্যম উদ্যোক্তাপত্রিকাটির মতামত বিভাগ দেখলে এ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ প্রায় নেই। যদিও টাইমস এখন মেয়র পদে আর আনুষ্ঠানিক সমর্থন ঘোষণা করে না। তবে পত্রিকাটি একটি সম্পাদকীয়তে ভোটারদের আহ্বান জানিয়েছিল, তাঁরা যেন মামদানিকে তাদের বাছাইয়ে একেবারে স্থানই না দেয়। কারণ, মামদানি অত্যন্ত অযোগ্য প্রার্থী।
টাইমসের মতামত বিভাগ তাদের মতপ্রকাশের অধিকার রাখে, যতই তা ভুল পথে পরিচালিত হোক না কেন। কিন্তু সরাসরি সংবাদ প্রতিবেদনে কোনো প্রার্থীর পক্ষে বা বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া ঠিক না।
সংবাদ প্রতিবেদন দলনিরপেক্ষ হওয়া উচিত। কোনো প্রার্থীকে উৎসাহ দেওয়া বা কাউকে খোঁড়া করে দেওয়া সংবাদের কাজ নয়।
বাস্তব সংবাদের বেলায় অনেক ক্ষেত্রেই তা একেবারে মানা হয় না।
এই সাজানো কেলেঙ্কারি এবং পূর্ব সম্পাদকীয় মিলিয়ে টাইমস মামদানির বিরুদ্ধে যেন একটি ধর্মযুদ্ধে নেমেছে, এমনই মনে হচ্ছে। আর কোনো আদর্শিক ব্যাখ্যাই এটা ঢেকে রাখতে পারবে না।
আরও পড়ুননিউইয়র্কের কৃষ্ণাঙ্গ ও শ্রমজীবী ভোটারদের কাছে কতটা গ্রহণযোগ্য জোহরান মামদানি০৪ জুলাই ২০২৫.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ন উইয়র ক ট ইমস র প র ব র ক পটভ ম ন উইয়র ক স ট র য ক তর ষ ট র ন ম মদ ন ক ট ইমস র প কল ম ব য় ম মদ ন র জ ত গত প প রক শ র ড নপন থ কর ছ ন
এছাড়াও পড়ুন:
যে বন্ধন জুলাইয়ের...
চিত্রগ্রাহক শহিদুল আলম ভাইয়ের সঙ্গে বছর সাতেক আগে আমার ছেলের একবার দেখা হয়েছিল। তিনি তখন তাঁর ফোল্ডিং সাইকেলটা চালিয়ে ধানমন্ডি দিয়ে যাচ্ছিলেন। আমার ছেলে তার নানির সঙ্গে রিকশায় বসে। হুডের ফাঁক দিয়ে মুখ বাড়িয়ে অবাক হয়ে ও সাইকেলটা দেখছিল। শহিদুল ভাই ওকে কিছুটা অবাক করে দিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘সাইকেল চালাতে পারো?’
চব্বিশের জুলাই অমন করে জীবনে না এলে, তাঁর সঙ্গে আমার বা আমার পরিবারের কোনো সদস্যের এর চেয়ে বেশি আলাপ হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না বললেই চলে। কিন্তু চব্বিশের অবিস্মরণীয় আষাঢ় আমাকে এবং আমার স্ত্রী সাবন্তীকে নিয়ে গিয়েছিল শহিদুল ভাই আর রেহনুমা আপার বইয়ে ঠাসা বসার ঘরটাতে। সঙ্গে ক্যামেরাবন্দী বিদ্রোহের আগুন, মনে লড়াইয়ের দৃপ্ত প্রত্যয়।
সাবন্তী বরাবরই মৃদুভাষী। উচ্চকণ্ঠ হওয়া তার স্বভাববিরুদ্ধ। কিন্তু সেবার বর্ষার অবিশ্রান্ত বর্ষণও তার মনের আগুনকে নেভাতে পারেনি। সে–ও তো একজন মা! এত সন্তানের রক্তস্রোত মায়েদের ঘরে থাকতে দেয়নি। তাই সেদিন যখন শাহবাগে বন্ধু তাজনূভার সঙ্গে সাবন্তী গিয়ে হাজির হয়েছিল পুলিশের বাধা ডিঙিয়ে প্রতিবাদে শামিল হতে, নিয়তির লিখনে তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন সামিনা লুৎফা। মঞ্চে ‘খনা’ চরিত্রে তাঁর অনবদ্য অভিনয়ের গল্প এর আগে অনেক শুনেছি। কিন্তু তাঁকে চিনে ওঠার সুযোগ জীবনে জুলাই না এলে হতো কি?
এরই মধ্যে ঝড়ের পাখির মতো বাসায় এসে হাজির হলো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম ছাত্রনেতা মাসুদ রানা। ঢাকায় তিন–চারবার বাসা পাল্টানো তত দিনে হয়ে গেছে তার। কিন্তু গ্রেপ্তার হয়ে গেলে মুখ থুবড়ে পড়তে পারে গোটা রাজশাহীর আন্দোলন। জুলাই না এলে মাসুদের কোনো দিন আমাদের পরিবারের সদস্য হয়ে ওঠা হতো না। কিন্তু আজ তো মনে হয় ও চিরকাল আমাদেরই একজন।
আরও পড়ুনজুলাই গণ–অভ্যুত্থান: স্বপ্নগুলো বুকপকেটে লুকিয়ে ফেলেছি০৩ জুলাই ২০২৫জুলাইয়ে অনেক পুরোনো মানুষকে নতুন করে চিনেছি। অনেকের সঙ্গে হৃদয়ের বন্ধন, গন্তব্যের মিল স্পষ্টতর হয়েছে। এমনকি বিজয়ের পরেও বহু অচেনা সহযোদ্ধাকে চেনার সুযোগ হয়েছে, যারা একই মোক্ষ লাভের জন্য লড়াই করেছেন অভ্যুত্থানের দিনগুলোতে, এখনো হেঁটে চলেছেন সেই পথে।
বরিশালে গিয়ে দেখা হয়েছে ছাত্রনেতা সুজয়ের সঙ্গে। মাসুদেরও সুজয়ের সঙ্গে দেখা সেই প্রথম। অথচ জুলাইয়ে তাদের মধ্যে কথা হয়েছে ফোনে, চরম হতাশার মুহূর্তে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টায়। আমার সঙ্গে অন্যদের ছবি তোলার আগ্রহ দেখে সুজয় মজা করে বলেছে, ‘জুলাইয়ের পর দুই জিনিসের দাম বেড়েছে, এক তেলের আর দুই আপনার!’ হাসি-আড্ডা আর তপ্ত বিতর্কে মনে হয়নি এই যোগাযোগটা মাত্র কয়েক দিনের। জন্মান্তরের বন্ধন যেন!
অদেখা যে স্বপ্নের দেশের কথা গ্রাফিতিতে বলে গেছে আমাদের সন্তানেরা, তার নাগাল পেতে এখনো হয়তো অনেক বাকি, কিন্তু একা একা স্বপ্ন দেখার চেয়ে কয়েকজন মিলে স্বপ্ন দেখা শ্রেয়তর নয় কি?জুলাইয়ে প্রাণাধিক প্রিয় সুহৃদ যে কেবল আমি আর সাবন্তীই খুঁজে পেয়েছি তা নয়। যাঁরা কালের অমোঘ প্রবাহে জুলাইয়ের মহারণে যুক্ত হয়েছিলেন, তাঁরা সবাই এমন সব মানুষের খোঁজ পেয়েছেন, যাঁদের হাতে হাত রেখে হাসিমুখে মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়া যায়। আমাদের দৈনন্দিন ছাপোষা জীবনে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। কিন্তু সময়ের সেই সব বাঁকে এই মানুষদের খুঁজে পাওয়া যায়, যখন মহাকাল নতুন করে ইতিহাস লেখে।
আরও পড়ুনজুলাই গণ-অভ্যুত্থান: কোথায় ব্যর্থ, কোথায় সফল০১ জুলাই ২০২৫বর্ষার নবধারাজলে আবার যখন এ দেশের তপ্ত মাটি ভিজে উঠছে, তখন কেটে যাওয়া বছরটার দেনাপাওনার হিসাব মেলাতে বসেছি আমরা। ‘জুলাইয়ে কী করেছি’ রব তোলার পর এখন অনেকে নিভৃতে ‘জুলাইয়ে কী পেলাম’ তার হিসাব কষছেন। কারও কণ্ঠে হতাশার সুর, ‘কী লাভ হলো এত কিছু করে?’ আকাশছোঁয়া প্রত্যাশার অনেক কিছুই পূরণ হয়নি সত্য। বাস্তবতার নিরিখে অনেক কিছুই হয়তো হওয়ার ছিল না, আবার অনেক কিছু করার সময় হয়তো এখনো ফুরিয়ে যায়নি।
আমার খেরো খাতায় সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি এই মানুষগুলো, এই সম্পর্কগুলো। কৃতজ্ঞতায় মন ভরে ওঠে যখন চারপাশের এই মানুষগুলোকে দেখি। এই মানুষগুলো বিজয়ী। তাঁরা জানেন কেমন করে ভয়ের টুঁটি চেপে ধরতে হয়। তাঁরা জানেন কীভাবে নিজ স্বার্থের তোয়াক্কা না করে যা ঠিক তা করে যেতে হয়। দেশের প্রতিটি প্রান্তে সমমনা মানুষগুলোর এই সম্পর্ক গড়ে দিয়েছে জুলাই। এরাই নতুন বাংলাদেশের আসল কারিগর।
নতুন বাংলাদেশ এক দিনে বা এক বছরে গড়ে উঠবে না। ওঠা সম্ভবও নয়। গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রায় নির্বাচন অপরিহার্য। আগামী বছর নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশে গণতন্ত্রের নতুন একটি অধ্যায়ের সূচনা হবে। কিন্তু সে কেবল সূচনা। বহু মত, বহু পথের মানুষের জন্য একটি নিরাপদ, স্বস্তিদায়ক শান্তির দেশ গড়ার পথ অনেক দীর্ঘ। সে পথে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কেবল সরকার কিংবা রাজনৈতিক দলের ভরসায় বসে থাকলে চলবে না। ইতিবাচক সামাজিক শক্তির সংঘবদ্ধ উপস্থিতি ছাড়া এ যাত্রায় পথ হারানোর ভয় পদে পদে।
তাই জুলাইয়ের সবচেয়ে বড় উপহার, মানুষে মানুষে এই আত্মার বন্ধনকে আমাদের কাজে লাগাতেই হবে। শহীদ আবু সাঈদের প্রসারিত বাহু আজ দেশের পথে–প্রান্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। সে ডাক একতার, সে ডাক মৈত্রীর।
আবু সাঈদদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে যে প্রাণের বন্ধনে আমরা জড়িয়েছি, তার সুরভি ছড়িয়ে পড়ুক সময়ের সীমানা পেরিয়ে। অদেখা যে স্বপ্নের দেশের কথা গ্রাফিতিতে বলে গেছে আমাদের সন্তানেরা, তার নাগাল পেতে এখনো হয়তো অনেক বাকি, কিন্তু একা একা স্বপ্ন দেখার চেয়ে কয়েকজন মিলে স্বপ্ন দেখা শ্রেয়তর নয় কি?
মানজুর আল মতিন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী