‘রাজনীতি করা মেয়ে’ মানেই ‘স্বাধীনচেতা’—এমন ভাবনা কেন
Published: 27th, July 2025 GMT
যেখানে বাংলাদেশের নারীরা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গবেষণা, প্রযুক্তি, এমনকি প্রতিরক্ষা খাতেও অদম্য গতিতে এগিয়ে চলেছেন, সেখানে রাজনীতির মঞ্চে তাঁদের পদচারণ এতটা দুর্লভ কেন? প্রশ্নটি সহজ হলেও এর উত্তর জটিল ও বহুস্তরবিশিষ্ট।
বাংলাদেশে একটি কথার প্রচলন আছে—‘রাজনীতি মেয়েদের জন্য নয়।’ এটি নিছক কোনো আপ্তবাক্য নয়, বরং একটি প্রাতিষ্ঠানিক বাস্তবতা, যা বহু নারী প্রতিদিনের অভিজ্ঞতায় টের পান। দেশের রাজনীতির পরিসর এখনো পরিবারকেন্দ্রিক ও পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত।
রাজনীতিতে সক্রিয় বেশির ভাগ নারী নেত্রীই কোনো প্রভাবশালী পুরুষ সদস্যের আত্মীয় বা রাজনৈতিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছেন। সাধারণ নারীর জন্য এই অঙ্গনে প্রবেশের পথ প্রায় রুদ্ধই বলা চলে।
বাংলাদেশের অধিকাংশ পরিবারে রাজনীতিকে নারীদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ, অশোভন ও অগ্রহণযোগ্য পেশা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মেয়েদের বাইরে কাজ করার ক্ষেত্র এখনো সীমিত; সেখানে রাজনীতির মতো সংঘাতপূর্ণ অঙ্গনে প্রবেশকে পরিবার থেকে নিরুৎসাহিত করা হয়। সহিংসতা, কালোটাকা, অস্ত্র, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও ভয়ভীতির বাস্তবতা—এসবই নারীদের জন্য অনিবার্য ঝুঁকি তৈরি করে এবং পারিবারিক অশান্তির কারণ হতে পারে।
রাজনৈতিক দলগুলো নারীর ক্ষমতায়নের কথা বললেও বাস্তবে অনেক সময়েই তাঁদের প্রতীকী ভূমিকায় আবদ্ধ রাখা হয়। কোনো মিছিল বা সমাবেশে নারী সদস্যদের সামনের সারিতে দাঁড় করানো হয় এ ধারণা থেকে যে পুলিশ তাঁদের ওপর সহিংসতা চালাতে দ্বিধা করবে। কিন্তু নীতিনির্ধারণী বা কৌশলগত আলোচনায় তাঁদের উপস্থিতি প্রায় অনুপস্থিত।
রাজনীতি কেবল পুরুষের জন্য নয়; সমাজ পরিবর্তন, আইন প্রণয়ন ও দৃষ্টিভঙ্গির রূপান্তরে নারীর অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব অপরিহার্য। নারী যদি পরিবার ও সমাজ গড়তে পারেন, তবে রাষ্ট্র পরিচালনায় তাঁর সমান অধিকার থাকা উচিত।একই সমাজে যেখানে নারী ঘর সামলান, সন্তান লালন–পালন করেন এবং পরিবার গঠনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন, সেই সমাজের রাজনৈতিক কাঠামোয় নারীর মতামত ও নেতৃত্বকে উপেক্ষা করা নিঃসন্দেহে পরিহাসজনক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, যেটি দেশের রাজনীতির আঁতুড়ঘর হিসেবে পরিচিত, সেখানকার ছাত্রীদের মধ্যেই রাজনীতির প্রতি অনাগ্রহ স্পষ্ট। এর পেছনে রয়েছে ক্যাম্পাস সংস্কৃতি ও দৃষ্টিভঙ্গির সংকট। ‘রাজনীতি করা মেয়ে’কে আজও কটু দৃষ্টিতে দেখা হয়। তাঁকে বলা হয় ‘অত্যন্ত স্বাধীনচেতা’, ‘অভদ্র’ কিংবা ‘নিয়ন্ত্রণের বাইরে’। ছাত্ররাজনীতির সহিংস, পেশিশক্তিনির্ভর পরিবেশ মেয়েদের নেতৃত্বের পথ থেকে দূরে ঠেলে দেয়।
অনেক ছাত্রী মনে করেন, রাজনীতিতে এগোতে হলে কাউকে ‘আপু’ বা ‘ভাইয়া’ বলে প্রভাবশালী সম্পর্ক গড়ে তুলতে হয়; কিন্তু তাঁরা নিজেদের পরিচয়ে উঠে আসতে চান।
নারীর রাজনীতিতে ব্যর্থতা খুব সহজেই গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়, অথচ সফলতা নিয়ে আলোচনা প্রায় হয়ই না। ‘রাজনীতিবিদ’ শব্দটি এখনো সমাজে পুরুষতান্ত্রিক ধারণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ফলে তরুণীদের মধ্যে রাজনীতিকে পেশা হিসেবে নেওয়ার আগ্রহ খুব কম।
রাজনীতি কেবল পুরুষের জন্য নয়; সমাজ পরিবর্তন, আইন প্রণয়ন ও দৃষ্টিভঙ্গির রূপান্তরে নারীর অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব অপরিহার্য। নারী যদি পরিবার ও সমাজ গড়তে পারেন, তবে রাষ্ট্র পরিচালনায় তাঁর সমান অধিকার থাকা উচিত।
প্রয়োজন একটি নিরাপদ, স্বচ্ছ, সহনশীল ও অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক পরিবেশ, যেখানে নারী কেবল অংশগ্রহণকারী নন, সিদ্ধান্তদাতার ভূমিকাতেও সমানভাবে অবদান রাখতে পারেন।
নুসরাত রুষা
শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জন ত র র র জন ত র জন ত ক পর ব র র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
আইন যেভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের হাতিয়ার
এটা অনস্বীকার্য যে মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য আইন তৈরি করা হয়, অন্যভাবে বললে মানুষের অধিকার সুরক্ষার জন্য একটি শক্তিশালী আইনি কাঠামোর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে সেই আইনই মানুষের অধিকার লঙ্ঘনের সহযোগী উপাদান বা হাতিয়ার হিসেবে কাজ করতে পারে, বিশেষত আইন যখন এমনভাবে প্রণয়ন করা হয়, যাতে অতিবিস্তৃত, অস্পষ্ট এবং অসংগতিপূর্ণ ধারা থাকে কিংবা আইনের দুর্বল এবং ‘সিলেকটিভ’ প্রয়োগ হয়; আইনকে ইচ্ছাকৃতভাবে এমনভাবে ব্যবহার করা হয়, যা নির্বিচার আটকের ন্যায্যতা দেয়, মৌলিক স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন করে এবং বৈষম্যমূলক চর্চাকে উৎসাহিত করে।
আইনকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে সেসব দেশে, যেখানে আইনের শাসন ভঙ্গুর, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সীমিত এবং গণতন্ত্রের ঘাটতি থাকে। বাংলাদেশ এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
২.
চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি নজিরবিহীন অধ্যায়, যেখানে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন ঘটে। সরকারি চাকরিতে অন্যায্য কোটাব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হলেও তৎকালীন সরকারের ব্যাপক দমন-পীড়ন এবং সহিংস আক্রমণের ফলে পরবর্তীকালে তা গণ-আন্দোলনে রূপ নেয়। গণ-অভ্যুত্থানে সমাজের সব স্তরের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে এবং একটি স্বৈরাচারী বা কর্তৃত্ববাদী শাসনের পতন হয়।
জাতিসংঘের তথ্য অনুসন্ধানী মিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ১ হাজার ৪০০ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে, যার মধ্যে আশঙ্কাজনকভাবে ১২-১৩ শতাংশ ছিল শিশু। আহত হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশের বিগত সরকার এবং নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থা বিচারবহির্ভূত হত্যা, সহিংসতা, নির্বিচার আটক ও নির্যাতনের মতো গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনে জড়িত ছিল।
আন্দোলন চলাকালীন হাজার হাজার আন্দোলনকারীকে নির্বিচার আটক করা হয়েছিল, যা বাংলাদেশের সংবিধান এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে স্বীকৃত ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার এবং আটকের ক্ষেত্রে আইনের যথাযথ প্রক্রিয়া (ডিউ প্রসেস) অনুসরণের যে বিধান, তার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গণগ্রেপ্তার অভিযানের সময় আটক হওয়া প্রায় ৮৫ শতাংশ ছিল শিক্ষার্থী এবং সাধারণ নাগরিক আর ১৫ শতাংশ বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে যুক্ত ছিল। হত্যা, নির্বিচার আটক এবং নির্যাতনের পাশাপাশি গণ-অভ্যুত্থানের সময় ইন্টারনেট বন্ধ করে মানুষের যোগাযোগের অধিকার, তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার ক্ষুণ্ন করা হয়েছে।
এসব মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে জাতীয় নিরাপত্তা, জননিরাপত্তা, আত্মরক্ষায় বলপ্রয়োগ কিংবা জনস্বার্থের মতো ‘অস্পষ্ট’ বিষয়ের কথা বলা হয়েছে এবং রাষ্ট্রযন্ত্রকে নিপীড়ন, হয়রানি ও নির্যাতনের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। এসব ক্ষেত্রে আইন সহযোগী উপাদান বা অনুঘটক হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। যেমন, কারফিউ জারি, প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার বা দেখামাত্রই গুলির নির্দেশকে ন্যায্যতা দিতে জননিরাপত্তা এবং জনস্বার্থের মতো বিষয়কে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এর মাধ্যমে মূলত আইন রাষ্ট্রের দমনমূলক কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দিতে সহায়তা করেছে, যা মানবাধিকারের মানদণ্ডের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
৩.
জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানেই নয়, বছরের পর বছর ধরে দেশের শাসনব্যবস্থায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের হাতিয়ার হিসেবে আইনকে ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন বিগত সময়ে কিছু কঠোর ও দমনমূলক আইন প্রণয়ন করেছিল, যা স্পষ্টভাবে মানবাধিকারের পরিপন্থী। এই আইনগুলো ভিন্নমত দমন, নির্যাতন এবং নিপীড়ন করে কর্তৃতবাদী শাসন টিকিয়ে রাখতে সহায়ক ছিল। বহুল আলোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) ছিল এমন একটি আইন (যা পূর্ববর্তী আইসিটি আইনের বিতর্কিত এবং দমনমূলক ৫৭ ধারার একটি পদচিহ্ন)। এ আইন বাংলাদেশে ডিজিটাল কর্তৃত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করেছিল, যার ভুক্তভোগী ছিলেন অসংখ্য রাজনৈতিক কর্মী, সাংবাদিক, শিক্ষার্থী, এমনকি সাধারণ নাগরিকও।
এই দমনমূলক ডিএসএ আইনটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল যে আইনের অপব্যবহারের প্রয়োজন ছিল না, বরং আইনটি ব্যবহার করেই অর্থাৎ আইনের মধ্যে থেকেই মানুষকে হয়রানি এবং নির্যাতন করা সম্ভব ছিল। ডিজিটাল আইনের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ছিল ভীতি এবং সেলফ-সেন্সরশিপের সংস্কৃতি তৈরি করে ভিন্নমতকে দমন করা, যা সংবিধান প্রদত্ত বাক্স্বাধীনতা, মতপ্রকাশ এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা লঙ্ঘন করে। লক্ষণীয়, নিপীড়নমূলক ডিজিটাল আইন প্রণয়নে এবং প্রয়োগে বিগত সরকার ডিজিটাল মাধ্যমে মানবাধিকার রক্ষার চেয়ে রাজনৈতিক এজেন্ডাগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়েছিল। বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে যখন ডিজিটাল মাধ্যমে মানবাধিকারের ধারণা ক্রমাগত বিকশিত হচ্ছে, বাংলাদেশে দমনমূলক ডিজিটাল আইন মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করেছে এবং বিরোধী কণ্ঠ দমন করে কর্তৃত্ববাদী শাসনকে পাকাপোক্ত করতে সহায়তা করেছে।
বিগত সরকারের আমলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন হয়ে উঠেছিল ভিন্নমত দমনের বড় অস্ত্র