ট্রেনের নিচে প্রাণ দিলেন ছেলে, ঋণের বোঝায় দিশেহারা মা
Published: 26th, September 2025 GMT
ঋণের ফাঁদ থেকে কোনোভাবেই বের হতে পারছিলেন না মিঠুন দাস (২৮)। ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধির চাকরি আর সিসি ক্যামেরা বসানোর ব্যবসা থেকে যা আয় হতো, তার প্রায় সবটুকুই চলে যেত শুধু সুদের টাকা মেটাতে। চরম মানসিক চাপের মধ্যে বাসে যাত্রাকালে তার কাছে থাকা ব্যাগ থেকে চুরি হয় কোম্পানির প্রায় তিন লাখ টাকা। সেই আঘাত সহ্য করতে পারেননি মিঠুন।
গত মঙ্গলবার (২৩ সেপ্টেম্বর) ফেসবুকে লাইভে দুঃখের কথাগুলো বলে রাতে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে চলন্ত ট্রেনের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়েন মিঠুন। এভাবেই অবসান ঘটে তার জীবনের।
আরো পড়ুন:
গোসলে নেমে কুমার নদে প্রাণ গেল দাদি ও ২ নাতির
টিকটক ভিডিও করতে গিয়ে ট্রেনের ধাক্কায় যুবকের মৃত্যু
মিঠুনের জীবনের অবসান হলেও তিনি রেখে গেছেন প্রায় পাঁচ লাখ টাকার ঋণের বোঝা। তার সংসারে এখন উপার্জন করার কেউ নেই। একমাত্র সন্তান হারিয়ে শোকে ভেঙে পড়া মিঠুনের মা শ্রীমতি রানী দিশেহারা হয়ে পড়েছেন—ঋণ শোধ করবেন কীভাবে, সেই দুশ্চিন্তায়।
মিঠুনের বাড়ি রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার বনকিশোর গ্রামে। বাবা প্রেমানন্দ দাস পেশায় ভ্যানচালক ছিলেন, বর্তমানে অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী। ১৪ মাস আগে নাটোরের মেয়ে বিউটি দাসকে বিয়ে করেছিলেন মিঠুন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি থাকতেন কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার গৌরিপুর এলাকায়। সেখানেই সিসি ক্যামেরা বসানোর ব্যবসা করতেন। তিন মাস আগে যোগ দেন একটি ওষুধ কোম্পানিতে, বেতন ছিল ১০ হাজার টাকা।
মারা যাওয়ার আগে ফেসবুক লাইভে মিঠুন বলেন, “কোনদিন ভাবিই নাই এ সিদ্ধান্ত নিব। এর আগে সিদ্ধান্তটা নিলে ক্ষতিটা হইত না। আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। ডিসেম্বর মাস থেকে বিপদ পিছু ছাড়ছে না। কোম্পানির তিন লাখ টাকার মতো হারাই ফেলছি। জানি, আমার পরিবারটাকে দেখার কেউ নাই। কিন্তু এই মুখ নিয়ে মা-বাবাকে কীভাবে জানাব?”
একটু থেমে তিনি আরো বলেন, “আমি চলে যাইতেছি। যারা আমার কাছ থেকে টাকা পান, ক্ষমা করে দিয়েন আমাকে। আমি আমার নিজের চোখে পরিবারটাকে শেষ হতে দেখতে পারি না। সরকারের কাছে একটাই আবেদন—পরিবারটাকে ঋণমুক্ত কইরেন, পরিবারটাকে বাঁচায়ে রাইখেন। মা-বাবা ক্ষমা করে দিও। বিউটিকে একটা ভাল ছেলে দেইখে বিয়ে করাইও।”
রাজশাহী শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে বনকিশোর গ্রামে বৃহস্পতিবার (২৫ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় গেলে দেখা যায়, বাড়ির আঙিনায় বসে আছেন মিঠুনের মা শ্রীমতি রানী। তাকে ঘিরে প্রতিবেশী নারীরা। শোকে কাতর রানী জানান, মঙ্গলবার দুপুরে ছেলে ফোন করে শুধু জিজ্ঞেস করেছিল—‘মা, ভালো আছো?’ এরপর আর কোনো কথা বলেননি। রাতেই ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যার খবর আসে। বুধবার রাত ১টার দিকে লাশ আসে। রাতেই বাড়ির পাশের বড়াল নদের তীরে দাফন করা হয়।
পরিবার সূত্রে জানা গেছে, আগে শুধু সিসি ক্যামেরা বসানোর কাজ করতেন মিঠুন। আগাম টাকা নিয়ে অর্ডার দেওয়া ক্যামেরা কিনে লাগিয়ে দিতেন। গত ডিসেম্বরে এক বন্ধুকে দেড় লাখ টাকা দিয়েছিলেন ক্যামেরা কেনার জন্য। কিন্তু ওই বন্ধু টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়। পরে ধারদেনা করে ক্যামেরা কিনে দিতে গিয়ে বিপাকে পড়েন। ভুল সংযোগ দেওয়ায় সব ক্যামেরা পুড়ে যায়, আবার জরিমানার টাকা গুনতে হয়। এক কাজেই ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় সাড়ে তিন লাখ টাকা।
এরপর দাউদকান্দির তিনটি এনজিও থেকে ১ লাখ ১০ হাজার টাকা ঋণ নেন। মায়ের ননদও ২ লাখ টাকা ধার দেন। আরেকটি সংস্থা থেকে ৪০ হাজার টাকা, ব্যবসার জন্য সুদে আরও ৫০ হাজার টাকা নেন মিঠুন। রাজশাহীতে স্বর্ণকারের দোকানে গয়না বন্ধক রেখে মা রানীও ছেলেকে দেন ৫০ হাজার টাকা। এই টাকার সুদ ছিল মাসে হাজারে ১০০ টাকা, অর্থাৎ মাসিক ১০ হাজার টাকা।
ঋণের কিস্তি মেটাতে না পেরে মিঠুন যোগ দেন ওষুধ কোম্পানিতে। কিন্তু সেখানকার কালেকশন করা টাকা চুরি হয়ে গেলে ভেঙে পড়েন তিনি।
মিঠুনের মা শ্রীমতি রানী বলেন, “আমার আর কোনো ছেইলে নাই। ওর বাপ আগে ভ্যান চালাইত, এখন অসুস্থ হয়ে শুইয়া আছে। মাথার ওপর এতগুলো ঋণ। আমার বাকি দিনডা চালাইবে কে?”
স্ত্রী বিউটি দাস নির্বাক বসেছিলেন। শুধু বললেন, “মঙ্গলবার শেষবার সে ফোনে বলল, চট্টগ্রামে আছে, কাজে ব্যস্ত। পরে কথা বলবে। আর কথা হলো না।”
ঢাকা/কেয়া/মাসুদ
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ঋণ পর ব র
এছাড়াও পড়ুন:
৪১ বছর ধরে হেঁটে হেঁটে পত্রিকা বিলি করেন গাইবান্ধার রহিম
গাইবান্ধার পত্রিকা বিক্রেতা আবদুর রহিম। বাড়ি পলাশবাড়ী পৌরসভার নুনিয়াগাড়ি এলাকায়। বয়স ৭১ বছর। এই বয়সেও তিনি ঘুমভাঙা চোখে একনজর পত্রিকার শিরোনাম দেখে নেন। পত্রিকা গুছিয়ে বগলে চেপে ছুটে চলেন পাঠকের কাছে। ‘ভাই, আজকে গরম খবর আছে’ বলেই পাঠকের হাতে এগিয়ে দেন পত্রিকা।
এক পাঠক থেকে আরেক পাঠকের কাছে যান আবদুর রহিম। পত্রিকা বিলি করেন সকাল ৬টা থেকে টানা ৭ ঘণ্টা। বিকেল ৫টা থেকে ৪ ঘণ্টা বিলি করা পত্রিকার টাকা সংগ্রহ করেন। ১১ ঘণ্টার বেশির ভাগ সময় হেঁটে পত্রিকা বিলি ও টাকা সংগ্রহ করেন। দূরের পাঠকের কাছে যান বাইসাইকেলে। প্রতিদিন গড়ে ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার হেঁটে বিলি করেন পত্রিকা। এভাবেই দীর্ঘ ৪১ বছর ধরে গাইবান্ধায় পত্রিকা বিলির কাজ করছেন তিনি।
আবদুর রহিম বলেন, ‘সকাল ৬টা থেকে পত্রিকা বিলির কাজ শুরু করি। বেলা ১টার দিকে শেষ হয়। উপজেলা সদরে হেঁটে বিলি করি। তবে সদর থেকে ৬-৭ কিলোমিটার দূরে জুনদহ, কালীতলা, ঢোলভাঙ্গা, হোসেনপুর এলাকায় সাইকেলে যাই। এসব জায়গায় সাইকেল রেখে হেঁটে পত্রিকা বিলি করি। দুপুরে বাড়িতে বিশ্রাম নিই। এরপর পত্রিকা বিক্রির টাকা তোলা শুরু করি। টাকা তুলতে বিকেল ৫টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সময় লাগে। সব মিলিয়ে প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার হাঁটাহাঁটি হয়ে যায়। এ রকম ব্যস্ততায় কীভাবে ৪১ বছর কেটে গেল, টেরই পেলাম না! তবে পত্রিকা বিলি করে আনন্দ পাই। অনেক পাঠক আমাকে ভালোবাসেন, খোঁজখবর নেন।’
দীর্ঘ সময় পত্রিকা বিলি করতে সমস্যা হয় কি না, তা জানতে চাইলে আবদুর রহিম বলেন, ‘আমার কোনো অসুখবিসুখ নেই। যত দিন শরীর ভালো থাকবে, তত দিন এই কাজ চালিয়ে যাব।’
ব্যবসার শুরুরহিমের পৈতৃক বাড়ি রংপুর শহরের আরাজি গুলাল বুদাই এলাকায়। সেখানে তাঁর বাবার ৩ শতাংশ জমিতে বসতভিটা ছিল। এ ছাড়া কোনো সম্পদ ছিল না। বাবা আবেদ আলী অনেক আগেই মারা গেছেন। তিন ভাই ও চার বোনের মধ্যে সবার বড় তিনি। লেখাপড়া করেছেন তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত। ছোটবেলা থেকেই কৃষিকাজ করতেন। ১৯৭৫ সালে বিয়ে করেন একই এলাকায়। তাঁর ছয় মেয়ে ও এক ছেলে। দারিদ্র্যের কারণে সংসার চালানো একসময় কঠিন হয়ে পড়ে।
রহিমের খালাতো ভাই রংপুর শহরে পত্রিকা বিলি করতেন। তাঁর পরামর্শে ১৯৮৪ সাল থেকে রংপুরে স্থানীয় পত্রিকা দিয়ে আবদুর রহিমের এই ব্যবসার যাত্রা শুরু। এরপর তিনি বাসে ফেরি করে বিক্রি করতে থাকেন পত্রিকা। প্রতিদিন রংপুর থেকে বাসে উঠে পলাশবাড়ী পর্যন্ত আসেন। এভাবে তিন বছর কেটে যায়। এরপর পলাশবাড়ীর স্থানীয় এক সাংবাদিকের বাড়িতে থেকে পত্রিকা বিক্রি শুরু করেন। ছয় মাস থাকেন সেখানে। এরপর জমানো ও ঋণের টাকায় নুনিয়াগাড়ি এলাকায় সোয়া ৮ শতাংশ জমি কিনে টিনশেড ঘর বানান। বাড়ি থেকে ব্যবসা করতে থাকেন। পলাশবাড়ী চারমাথা এলাকায় বসে ঢাকা, রংপুর ও বগুড়া থেকে প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকা সংগ্রহ করে পলাশবাড়ী উপজেলা সদরে বিক্রি করতে থাকেন।
হকার থেকে এজেন্টকয়েক বছর পর আবদুর রহিম নিজের নামে বেশ কিছু পত্রিকার এজেন্সি নেন। পত্রিকার চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় একা সামলাতে পারছিলেন না। তাই চারজন লোক নিয়োগ করেন। তাঁরা এখনো রহিমের কাছে কমিশনে পত্রিকা নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। ব্যবসা শুরুর সময় প্রতিদিন ২০০ থেকে ২৫০ কপি পত্রিকা বিলি করতেন। মাসিক আয় ছিল ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা। কয়েক বছর পর পাঠকের চাহিদা বেড়ে যায়। সে সময় মাসিক আয় হতো ২২ থেকে ২৫ হাজার টাকা। বর্তমানে ছাপা পত্রিকার পাঠক কমে গেছে। এখন প্রতিদিন ১৫০ থেকে ১৬০ কপি পত্রিকা বিলি করছেন। বর্তমানে তাঁর মাসিক আয় গড়ে ১৬ থেকে ১৭ হাজার টাকা।
আবদুর রহিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘পত্রিকার ব্যবসা করে রংপুর থেকে এসে পলাশবাড়ীতে বাড়ি করতে পেরেছি, মেয়েদের বিয়ে দিয়েছি। সততার সঙ্গে চলছি। এতেই আমি সন্তুষ্ট।’
পলাশবাড়ী মহিলা ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ আবু সুফিয়ান সরকার বলেন, ‘আবদুর রহিমকে বহু বছর ধরেই পত্রিকা বিক্রি করতে দেখছি। তাঁকে দেখে মনে হয় না ৭১ বছর বয়স হয়েছে। তাঁর মধ্যে ক্লান্তি দেখা যায় না। দিন-রাত পরিশ্রম করেন। কখনো তাঁকে মিথ্যা বলতে শুনিনি। এলাকার মানুষ তাঁকে ভালোবাসেন।’