রাষ্ট্র নয়, বেসরকারি খাত হবে উন্নয়নের চালিকা শক্তি: ডেভিড এঙ্গারম্যান
Published: 8th, October 2025 GMT
বিভিন্ন দাতা রাষ্ট্রের সহায়তায় সরকারিভাবে উন্নয়নকাজের যুগ এখন প্রায় শেষ হয়ে গেছে। এর পরিবর্তে একটি নতুন উন্নয়ন অর্থায়নের যুগ তৈরি হচ্ছে, যেখানে উন্নয়নের জন্য দান বা সহায়তা হিসেবে নয়, বরং ঋণ হিসেবে অর্থ আসবে বা নেওয়া হবে। আর রাষ্ট্র নয়, বেসরকারি খাত হবে উন্নয়নের চালিকা শক্তি।
আজ বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের অধ্যাপক মুজাফফর আহমেদ চৌধুরী মিলনায়তনে আয়োজিত এক সেমিনারে এ কথা বলেন যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক ইতিহাসের অধ্যাপক ডেভিড সি এঙ্গারম্যান। সেমিনারে প্রধান আলোচক ছিলেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ ও বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি যৌথ উদ্যোগে ‘আন্তর্জাতিক উন্নয়ন: অতীত, বর্তমান ও সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক এ সেমিনারের আয়োজন করে। সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির আহ্বায়ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ।
সেমিনারে ডেভিড সি এঙ্গারম্যান বলেন, প্রচলিত দাতা অর্থায়নের মাধ্যমে উন্নয়ন যুগ এখন সমাপ্তির পথে। এটি প্রায় ৭০ বছর স্থায়ী ছিল; ১৯৫৫ থেকে ২০২৫ পর্যন্ত, যা শীতল যুদ্ধের চেয়ে দীর্ঘ। ফলে উন্নয়নকে প্রাপক ও দাতা নয়, বরং ঋণগ্রহীতা ও ঋণদাতা সম্পর্কের ভিত্তিতে ভাবা উচিত। এত দিন বিশ্বব্যাংকসহ আঞ্চলিক বিভিন্ন সংস্থাগুলো ব্যাংকঋণ দিয়ে আসছিল। এখন সেই ভূমিকা নিচ্ছে বেসরকারি খাত। বিশেষ করে চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’–এর মতো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে।
তবে ‘উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষা’ টিকে থাকবে, এমন উল্লেখ করে ডেভিড এঙ্গারম্যান বলেন, ‘এই আকাঙ্ক্ষা শুধু পশ্চিমা ব্যাংক বা সংস্থার মধ্যে নয়, বরং গ্লোবাল সাউথ বা উন্নয়নশীল দেশগুলোর নিজেদের ভেতরও তৈরি হয়েছে। এখন আমরা এমন এক বিশ্বে বাস করছি, যেখানে প্রধান শক্তি হলো বেসরকারি বাজার ও বেসরকারি অর্থায়ন। ফলে অর্থায়নের জন্য উন্নয়নশীল দেশের নিজেদের বেসরকারি কোম্পানি, সাহায্য সংস্থা (এনজিও) ও সামাজিক ব্যবসার গুরুত্ব বাড়ছে।
দুর্নীতি উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে
অনুষ্ঠানে ডেভিড এঙ্গারম্যান বলেন, ‘দুর্নীতি উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে, এই মন্তব্যের সঙ্গে আমি একমত। বড় সরকারি চুক্তি ও ক্রয়প্রক্রিয়া সরকারের অভ্যন্তরে দুর্নীতির সহজ সুযোগ তৈরি করে। বেসরকারি খাতও যে সব সময় নিখুঁতভাবে অর্থের ব্যবস্থাপনা করে, বিষয়টি এমন নয়। আমার ধারণা, এই নতুন ও অধিকতর বেসরকারিকেন্দ্রিক উন্নয়নব্যবস্থায়ও দুর্নীতি সম্পূর্ণ বিলীন হবে না।’
প্রযুক্তিগত পরিবর্তন মানব উন্নয়নে যেমন অগ্রগতি আনতে পারে, তেমনি তা মানব উন্নয়নের ক্ষতিও করতে পারে বলে মনে করেন ডেভিড সি এঙ্গারম্যান। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দেশে দেশে কিংবা দেশের অভ্যন্তরে মানুষের ভেতর বৈষম্য বাড়ানোর বড় একটি ঝুঁকি তৈরি করছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য সেগুলো জাতীয়করণ করা হয়। এ প্রসঙ্গে ডেভিড সি এঙ্গারম্যান বলেন, জাতীয়করণ একটি জটিল ও কঠিন বিষয়। স্বাধীনতার পর পূর্ব পাকিস্তানের বহু প্রতিষ্ঠান ও কারখানা পশ্চিম পাকিস্তানি মালিকেরা ফেলে রেখে গিয়েছিলেন। সেগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য রাষ্ট্রই তখন একমাত্র প্রতিষ্ঠান হয়ে দাঁড়ায়। এটি কোনো আদর্শগত (সমাজতান্ত্রিক) বিষয় ছিল না। তবে শেষ পর্যন্ত দুর্নীতি ও অদক্ষ লোকের কারণে রাষ্ট্র–পরিচালিত এসব প্রতিষ্ঠান সফলতা পায়নি।
অর্থনীতি সমিতির অন্তর্বর্তী কমিটির সদস্যসচিব মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিনের সঞ্চালনায় সেমিনারে আরও বক্তব্য দেন ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপের (ইআরজি) নির্বাহী পরিচালক সাজ্জাদ জহির, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারপারসন মাসুদা ইয়াসমীন, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক কাজী ইকবাল প্রমুখ।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
আপসের কপ৩০ চুক্তি থেকে বাদ পড়ল জীবাশ্ম জ্বালানির প্রসঙ্গ
জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন কপ৩০-তে বহু কাঠখড় পুড়িয়ে সর্বসম্মতিক্রমে একটি চুক্তি হয়েছে। এতে বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাব মোকাবিলায় দরিদ্র দেশগুলোর জন্য অর্থ সহায়তা বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। তবে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির মূল চালিকা শক্তি জীবাশ্ম জ্বালানি নিয়ে সরাসরি কোনো কিছু বলা হয়নি। তা ছাড়া চুক্তিটি বাধ্যতামূলক নয়, বরং স্বেচ্ছাভিত্তিক। অর্থাৎ সম্মত কোনো দেশ চাইলে চুক্তিতে থেকে বের হয়ে যেতে পারবে।
দ্য গার্ডিয়ান জানায়, কপ৩০-এর নির্ধারিত সময়ে চুক্তি করা সম্ভব না হওয়ায় আলোচনা বর্ধিত সময়ে গড়ায়। টানা ১২ ঘণ্টার নিবিড় দর-কষাকষির পর শনিবার সকালে চুক্তির ঘোষণা আসে। চুক্তিতে ১৯৪টি দেশ ও স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল সম্মত হয়েছে। এবারের সম্মেলনের আয়োজক দেশ ব্রাজিলের বেলেম শহরের স্থানীয় সময় বেলা ১টা ৩৫ মিনিটে চুক্তির আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়।
ব্রাজিলের আশা, চুক্তি হওয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় ভবিষ্যতে বৈশ্বিক পর্যায়ে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করা সম্ভব হবে। কিন্তু এবারের সম্মেলনে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধি না পাঠায়, ব্রাজিলের এই আশাবাদ নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
এবারের চুক্তি অনেককে হতাশ করেছে উল্লেখ করে জাতিসংঘের জলবায়ু সেক্রেটারিয়েটের (ইউএনএফসিসিসি) নির্বাহী সেক্রেটারি সাইমন স্টিয়েল বলেন, দায় স্বীকারে অস্বীকৃতি এবং নানা বিষয়ে বিভক্ত একটি বছরে অংশগ্রহণকারী দেশের প্রতিনিধিরা শেষ পর্যন্ত একমত হতে পেরেছেন, এটাই প্রশংসনীয়।
সাইমন স্টিয়েলের ভাষায়, ‘আমি বলছি না আমরা জলবায়ু লড়াইয়ে জিতছি। তবে আমরা এখনো নিঃসন্দেহে সম্ভাবনা জিইয়ে রেখেছি। আমরা প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছি।’
১০ নভেম্বর থেকে আমাজন নদীর মুখের কাছের বেলেম শহরে শুরু হওয়া কপ৩০-এর মূল লক্ষ্য ছিল গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ রোধ এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে সৃষ্ট ক্ষতি মোকাবিলায় জাতিসংঘের বিদ্যমান কাঠামোকে শক্তিশালী করা। প্রতিটি কপের শেষে সর্বসম্মতিক্রমে একটি আশা জাগানিয়া ঘোষণা আসবে, এমটি আশা করে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সংকট থাকা উন্নয়নশীল দেশগুলো। কিন্তু বিগত কয়েক বছরের মতো এবারও সম্মেলনের শেষ দিন গত শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত চুক্তির বিষয়ে সম্মত হওয়া যায়নি। তখন আলোচনা বর্ধিত সময়ে গড়ায়।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভুক্তভোগী ৮০টির বেশি দেশ ও অঞ্চল এবারে চুক্তিতে জ্বালানি তেল, কয়লা ও গ্যাসের মতো জীবাশ্ম জ্বালানি নিয়ে স্পষ্ট রূপরেখা চেয়েছিল। যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এই দাবির পক্ষে ছিল। কিন্তু সৌদি আরব ও রাশিয়ার মতো শীর্ষ জীবাশ্ম জ্বালানি উত্তোলন ও রপ্তানিকারক দেশগুলো সম্মেলনের শুরু থেকে এই দাবির বিরোধিতা করে আসছিল। শেষ মুহূর্তে এটা নিয়ে অচলাবস্থা তৈরি হয়।
এবার বর্ধিত সময়ে যে চুক্তি হয়েছে, তাতে জীবাশ্ম জ্বালানি ধীরে ধীরে কমানোর একটি রূপরেখা নিয়ে আলোচনা শুরু করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বন নিধন বন্ধ করা নিয়ে রূপরেখায় কোনো কিছু উল্লেখ করা হয়নি। এটি আয়োজক দেশ ব্রাজিল ও প্রকৃতি রক্ষায় নিবেদিত সংগঠনগুলোকে হতাশ করেছে। কারণ বন নিধন নিয়ে সচেতনতা বাড়াতেই এবারের কপ সম্মেলন বিশ্বের বৃহত্তম চিরহরিৎ বনাঞ্চল (রেইনফরেস্ট) আমাজনের নদীর মুখের বেলেম শহরে করা হয়েছিল।
বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ভবিষ্যতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা নিয়ে আরও গভীর মতভেদ তৈরি হতে পারে, যা এবারের সম্মেলনে স্পষ্ট হয়েছে।
চুক্তিতে পৌঁছাতে যে বেশ ঘাম ঝরাতে হয়েছে, তা কপ৩০-এর সভাপতি আন্দ্রে কোরেয়া দো লাগোর কথার মধ্যেও সুস্পষ্ট। তিনি বলেন, ‘আমরা জানি, আপনাদের মধ্যে অনেকে কিছু বিষয় নিয়ে আরও বড় প্রত্যাশা ছিল।’
কলম্বিয়া, পানামা এবং উরুগুয়ের মতো ব্রাজিলের প্রতিবেশী দেশগুলো দো লাগোর কিছু সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন। এসব দেশের প্রতিনিধিদের অভিযোগ, চুক্তির প্রক্রিয়া কেমন হবে, তা চূড়ান্ত করার জন্য সব প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে আলোচনা (পেলেনারি) করা দরকার ছিল। কিন্তু দো লাগো তা স্থগিত করেছেন।
তবে এক ঘণ্টা পর আলোচনা পুনরায় শুরু হয়। এতে দো লাগোর জানান, যেসব সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে তা বাতিল হওয়ার সুযোগ নেই।
কলম্বিয়ার প্রতিনিধি বলেন, জীবাশ্ম জ্বালানি পৃথিবীর উষ্ণায়নের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী। তাই তাঁর দেশ এমন কোনো চুক্তির সঙ্গে থাকতে পারে না, যা বিজ্ঞানকে উপেক্ষা করে।
জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার দ্রুত বন্ধের রূপরেখা নিয়ে স্পষ্ট ঘোষণা না থাকায় ইইউ চুক্তিতে থাকবে কিনা, তা নিয়ে আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। কিন্তু বর্ধিত সময়ে শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে রাতভর আলোচনার পর শনিবার সকালে চুক্তিতে তারা সম্মতি দেয়। তবে ইউরোপের সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের জোটটি জানিয়েছে, চুক্তিটি যেভাবে শেষ করা হয়েছে, তা নিয়ে তারা একমত নয়।
চুক্তি চূড়ান্ত হওয়ার আগে ইইউর জলবায়ু কমিশনার ওপকে হোয়েকস্ট্রা বলেন, ‘আমাদের চুক্তিটি সমর্থন করা উচিত। কারণ তা অন্ততপক্ষে সঠিক পথে রয়েছে।’
তহবিল
জীবাশ্ম জ্বালানি নিয়ে স্পষ্ট রূপরেখা না থাকলেও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য তহবিল বৃদ্ধির ঘোষণা কপ৩০ সবচেয়ে বড় অর্জন। জলবায়ু সংকটের প্রভাব মোকাবিলায় উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য আর্থিক সহায়তা ধনী দেশগুলোকে ২০৩৫ সালের মধ্যে তিনগুণ বৃদ্ধি করতে বলা হয়েছে। কিন্তু চুক্তিটি যেহেতু বাধ্যতামূলক নয়, তাই এটা কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে।
দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চুক্তি অনুযায়ী উন্নয়নশীল দেশগুলো এক বছরে ১২ হাজার কোটি ডলার পাবে। ধনী দেশগুলো জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য গত বছর ৩০ হাজার কোটি ডলার দেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেখান থেকেই এই তহবিল আসবে। তবে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর অনেকে আশা করেছিল, ৩০ হাজার কোটি ডলার থেকে নয়, বরং তাদের জন্য বাড়তি ১২ হাজার কোটি ডলারের ঘোষণা আসবে।
আরও পড়ুনজলবায়ু সম্মেলনে কাঙ্ক্ষিত ফল না আসার আশঙ্কা২ ঘণ্টা আগে