প্রতি বছর নভেম্বর-ডিসেম্বরে পেঁয়াজের দাম কেন বাড়ে
Published: 10th, November 2025 GMT
রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে পেঁয়াজের দাম এখন কেজিপ্রতি ১১০ থেকে ১২০ টাকা। এক মাসে আগেও ৭০ থেকে ৭৫ টাকায় পেঁয়াজ বিক্রি হতো। প্রতিবছরই অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে পেঁয়াজের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। অক্টোবরে দাম বাড়তে শুরু করে এবং নভেম্বর ও ডিসেম্বরে এক কেজি পেঁয়াজের দাম ১০০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। আবার প্রতিবছরই ভারত থেকে আমদানি করে দাম কমাতে হয়। এভাবেই চলছে বছরের পর বছর।
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি) সম্প্রতি স্থানীয় বাজারে পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধিতে সরবরাহ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেছে। সেখানেও এই চিত্র ওঠে এসেছে। ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদন অনুসারে, গত ৩ বছরে নভেম্বরে গড় দাম ছিল যথাক্রমে ২০২৩ সালে ১১৫ টাকা, ২০২৪ সালে ১৩০ টাকা ও চলতি বছরের নভেম্বর মাসে ১০৫ টাকা।
কেন দাম বাড়েঅক্টোবর-ডিসেম্বরে পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধির বেশ কিছু কারণ আছে। প্রথমত, উৎপাদন থেকে ভোক্তা পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য; দ্বিতীয়ত, পেঁয়াজ সংরক্ষণের অভাব; তৃতীয়ত, মৌসুমের শেষ পর্যায়; চতুর্থত, বৃষ্টিতে পেঁয়াজের ক্ষতি।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারের পেঁয়াজ বিক্রেতা আবদুল হালিম প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবছরই অক্টোবরের পর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বাজারে পেঁয়াজের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। মৌসুমের শেষ পর্যায়ে কৃষকের হাতেও পর্যাপ্ত পেঁয়াজ থাকে না। তাই দাম বাড়ে।
পেঁয়াজ সংরক্ষণের অভাবপেঁয়াজ সংরক্ষণের মৌসুম হলো জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত। সরকারি সংরক্ষণাগার না থাকায় কৃষকেরা নিজেরাই পেঁয়াজ সংরক্ষণ করে থাকেন। পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধির কারণ হিসেবে সরকারিভাবে সংরক্ষণের অভাবকে চিহ্নিত করেছে ট্যারিফ কমিশন। ট্যারিফ কমিশন বলেছে, বিভিন্ন সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে পেঁয়াজ সংরক্ষণাগার স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও বর্তমানে সরকারিভাবে পেঁয়াজ সংরক্ষণের হিমাগার নেই। কৃষক নিজের বাড়িতেই পেঁয়াজ সংরক্ষণ করেন।
মৌসুমের শেষ পর্যায়নভেম্বর ও ডিসেম্বর হলো পেঁয়াজের মৌসুমের শেষ পর্যায়। এই সময়ে কৃষকের ঘরে মজুত কম থাকে। সে কারণেও পেঁয়াজের দাম বেড়ে যায়। ডিসেম্বরের দ্বিতীয়ার্ধে মুড়িকাটা পেঁয়াজ (আগাম পেঁয়াজ) বাজারে আসতে শুরু করবে; তখন পেঁয়াজের দাম কমবে।
এখন বাজারে হালি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে। গতকাল শনিবার পাবনায় এক মণ হালি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৩ হাজার ৭০০ থেকে ৪ হাজার টাকায়। ডিসেম্বরের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত পেঁয়াজের মৌসুম। এপ্রিল মাস থেকে পেঁয়াজ সংরক্ষণ শুরু হয়।
মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যকৃষকের কাছ থেকে বাজারে আসা পর্যন্ত পেঁয়াজের একাধিকবার হাত বদল হয়। প্রতি ধাপে মুনাফা করেন মধ্যস্বত্বভোগীরা। প্রতিটি ধাপেই মধ্যস্বত্বভোগীরা তাঁদের নির্ধারিত মুনাফায় পেঁয়াজ বিক্রি করে থাকেন। মধ্যস্বত্বভোগীদের অতি মুনাফার কারণেও মৌসুমে পেঁয়াজের দাম বাড়ে।
বৃষ্টিতে পেঁয়াজ নষ্টপেঁয়াজ উৎপাদন হয়, এমন জেলা যেমন পাবনা, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, মেহেরপুরসহ একাধিক জেলায় গত দুই সপ্তাহে বৃষ্টি হয়েছে। ফলে বিপুল পরিমাণ আগাম পেঁয়াজ নষ্ট হয়েছে। এটাও বাজারে পেঁয়াজে মূল্যবৃদ্ধির কারণ বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
এ বছর কোন মাসে কত দামচলতি বছরের জানুয়ারি থেকে পেঁয়াজের দাম বেড়েই চলেছে। তবে নভেম্বরে ১ কেজি পেঁয়াজের দাম ১০০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদন অনুসারে, গত জানুয়ারিতে এক কেজি পেঁয়াজের গড় দাম ছিল ৬৫ টাকা। পরের মাসে তা ৫২ টাকায় নেমে আসে। মার্চ মাসে পেঁয়াজের দাম আরও কিছুটা কমে ৪২ টাকা হয়। এপ্রিল মাসে হয় ৪৮ টাকা। মূলত ওই চার মাস হলো পেঁয়াজের মৌসুম। এরপরের ৩ মাস পেঁয়াজের দাম ৫৫ থেকে ৬০ টাকার মধ্যেই ছিল। আগস্টে অবশ্য হঠাৎ পেঁয়াজের দাম ৮০ টাকায় ওঠে। পরের দুই মাস কেজিপ্রতি পেঁয়াজের দাম ৭৫ টাকায় স্থির থাকে। চলতি নভেম্বরে কেজিপ্রতি পেঁয়াজের দাম ৪০ শতাংশ বেড়ে ১০৫ টাকা হয়।
পেঁয়াজ আমদানি কি সমাধানপ্রতিবছর পেঁয়াজের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেলে আমদানির অনুমতি দেয় সরকার। এবারও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। ইতিমধ্যে ট্যারিফ কমিশন পেঁয়াজ আমদানির সুপারিশ করে বাণিজ্যসচিব ও কৃষিসচিবকে চিঠি দিয়েছে।
বাংলাদেশের পেঁয়াজ আমদানির প্রধান উৎস দেশ ভারত। পেঁয়াজের মোট আমদানির ৯৯ শতাংশই ভারত থেকে করা হয়। এ ছাড়া তুরস্ক, পাকিস্তান, মিয়ানমার, চীন ও মিসর থেকেও পেঁয়াজ আমদানি করা হয়। গত অর্থবছরে মোট ৪ লাখ ৮৩ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানি হয়। বর্তমানে পেঁয়াজের ওপর মোট ১০ শতাংশ শুল্ক কর আছে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশে ৪৪ লাখ ৪৮ হাজার টন পেঁয়াজ উৎপাদন। তবে সংরক্ষণ সমস্যাসহ নানা কারণে পেঁয়াজ নষ্ট হয়। তাই গত অর্থবছরে ৩৩ লাখ টনের মতো পেঁয়াজ বাজারে এসেছে।
ট্যারিফ কমিশন প্রতিবছর নভেম্বর-ডিসেম্বর সময়ে স্থানীয় বাজারে পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধি ঠেকাতে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য ঠেকানোর ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে। এ ছাড়া বছরজুড়ে পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য সরকারি পর্যায়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছে তারা।
ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান মইনুল খান প্রথম আলোকে বলেন, পেঁয়াজের উচ্চ দামের সুবিধা কৃষক পাচ্ছেন না। মধ্যস্বত্বভোগীরা এই সুযোগ নিচ্ছেন। তাই পেঁয়াজ আমদানির সুযোগ দিলে বাজারে মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব কমে যাবে। ভোক্তারা যৌক্তিক মূল্যে পেঁয়াজ কিনতে পারবেন।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ম স ম র শ ষ পর য য় য় জ আমদ ন ড স ম বর আমদ ন র সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
হঠাৎ বেড়েছে পেঁয়াজের দাম, কারণ কী
চট্টগ্রামের বাজারে হঠাৎ বেড়েছে পেঁয়াজের দাম। গত অক্টোবর মাসজুড়ে খুচরা পর্যায়ে ৮০ থেকে ৯০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছিল পেঁয়াজ। তবে চলতি নভেম্বর মাসের শুরুতেই প্রায় ২৫ থেকে ৩০ টাকা বেড়েছে দাম। আমদানি না থাকা ও দেশি পেঁয়াজের মৌসুম শেষ হওয়ায় দাম বেড়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ বছর পেঁয়াজের আমদানি খুব বেশি হয়নি। দেশি পেঁয়াজের ওপর বাজার নির্ভর ছিল। অক্টোবর পর্যন্ত বাজারে দেশি পেঁয়াজের সরবরাহ থাকলেও এখন তা কমে গেছে। ফলে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে। আগামী ডিসেম্বর মাসে বাজারে আগাম পেঁয়াজ আসা শুরু হতে পারে। তখন দাম কমবে। নভেম্বরে দাম ঊর্ধ্বমুখী থাকতে পারে।
চট্টগ্রামের বাজারে পেঁয়াজ সরবরাহ হয় দেশে ভোগ্যপণ্যের বৃহৎ আড়ত খাতুনগঞ্জ থেকে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খাতুনগঞ্জের আড়তগুলোতে আকার ও মানভেদে দেশি পেঁয়াজ ৯২ থেকে ১০০ টাকার দরে বিক্রি হয়েছে। এক মাস আগেও দাম ছিল ৭০ থেকে ৭৫ টাকার মধ্যে। বাজারে এই মুহূর্তে আমদানি পেঁয়াজ নেই বললেই চলে।
খাতুনগঞ্জের হামিদুল্লাহ মিঞা মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইদ্রিস বলেন, বাজারে কোনো আমদানি পেঁয়াজ নেই। দেশি পেঁয়াজ দিয়েই বাজার চলছে। দাম এ মাসে কিছুটা বেশি থাকতে পারে। আমদানির অনুমতি দিলে হয়তো কিছুটা কমবে। নাহয় কয়েক মাসে আগাম পেঁয়াজ এসে যাবে বাজারে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত অর্থবছরে জেলায় পেঁয়াজ আবাদ হয়েছে ৯১ হেক্টর জমিতে। আর উৎপাদন ছিল ৬৭১ টন। চলতি অর্থবছরে আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ১০২ হেক্টর এবং উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৭৯২ টন। অর্থাৎ আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এ বছর চট্টগ্রামের পেঁয়াজও এখানকার বাজারে চাহিদা পূরণ করবে।আমদানি কমেছে ৯৫ ভাগ
চট্টগ্রামের বাজার মূলত আমদানি পেঁয়াজনির্ভর। দেশে প্রতিবছর যে পেঁয়াজ আমদানি হয় তাঁর অধিকাংশ ভারত থেকে আসে। দেশের বিভিন্ন স্থলবন্দর দিয়ে আসা ভারতীয় পেঁয়াজের চাহিদা চট্টগ্রামে তুলনামূলক বেশি। পাশাপাশি পাকিস্তানি, চীনা ও মিসরের পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে।
দাম এ মাসে কিছুটা বেশি থাকতে পারে। আমদানির অনুমতি দিলে হয়তো কিছুটা কমবে। নাহয় কয়েক মাসে আগাম পেঁয়াজ এসে যাবে বাজারে।মোহাম্মদ ইদ্রিস, সাধারণ সম্পাদক, খাতুনগঞ্জের হামিদুল্লাহ মিঞা মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতিতবে এ বছর চট্টগ্রামের বাজারে ‘রাজত্ব’ ছিল দেশি পেঁয়াজের। আমদানির অনুমতি বন্ধ ও পেঁয়াজের উৎপাদন ভালো হওয়ায় বাজারে আমদানি পেঁয়াজের চাহিদা ছিল না। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে (২০২৫-২৬) জুলাই থেকে অক্টোবর মাসে দেশে পেঁয়াজ এসেছে ১৩ হাজার টন। গত অর্থবছরে (২০২৪-২৫) একই সময় আমদানি ছিল ২ লাখ ৪৬ হাজার টন।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাবে, গত অর্থবছরের প্রথম চার মাসের তুলনায় এবার আমদানি কমেছে প্রায় ৯৫ শতাংশ। দেশের কৃষকদের জন্য এটি ভালো দিক বলে মনে করছেন পাইকারি আড়তদারেরা। তাঁরা বলছেন, কৃষকেরা দাম পাচ্ছেন, পাশাপাশি অন্য দেশের বাজারের ওপর আর দাম নির্ভর করছে না। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে পেঁয়াজের আবাদ ভালো হবে এবারও।
দেশের আমদানি পেঁয়াজের অধিকাংশই ভারতীয়। এ অর্থবছরেও আমদানির ৯৯ শতাংশ এসেছে ভারত থেকে। গত বছর ভারতে পেঁয়াজের দাম বাড়লে দেশে পেঁয়াজের বাজার অস্থির হয়। এরপর দেশে উৎপাদন বাড়লে আমদানি অনুমতি (আইপি) বন্ধ রাখা হয়। তবে গত এপ্রিল ও আগস্ট মাসে দাম বাড়লে আইপি দেওয়া হয়।
চট্টগ্রামে বাড়ছে উৎপাদন
বাজারে সাধারণ ডিসেম্বর মাসে আগাম পেঁয়াজ বা মুড়িকাটা পেঁয়াজ আসে। এরপর জানুয়ারিতে রাজবাড়ী ও ফরিদপুরের পেঁয়াজ বাজারে এসে যায়। সেটি সরবরাহের মধ্যেই মেহেরপুর, জামালপুরসহ অন্যান্য জেলার পেঁয়াজও বাজারে আসে। গত বছর থেকে এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে চট্টগ্রাম জেলার পেঁয়াজও। গত বছর জেলায় পেঁয়াজের আবাদ হয়েছে বেশি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত অর্থবছরে জেলায় পেঁয়াজ আবাদ হয়েছে ৯১ হেক্টর জমিতে। আর উৎপাদন ছিল ৬৭১ টন। চলতি অর্থবছরে আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ১০২ হেক্টর এবং উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৭৯২ টন। অর্থাৎ আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এ বছর চট্টগ্রামের পেঁয়াজও এখানকার বাজারে চাহিদা পূরণ করবে।
এদিকে পেঁয়াজের দাম বাড়ায় ক্রেতারা ক্ষোভ জানিয়েছেন। তাঁরা বলছেন, দাম বাড়লেও ৫ থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত ক্রেতারা মানিয়ে নেন। এক লাফে ২০ টাকার বেশি বেড়ে যাওয়া অস্বাভাবিক।
চাক্তাই শিল্প ও ব্যবসায়ী সমিতির যুগ্ম সম্পাদক আহসান খালেদ বলেন, এক মাস হয়তো দাম একটু বাড়তি। কিছু সার্বিকভাবে কৃষকেরা এবার লাভবান হয়েছেন। আমদানির খবরে বাজারে দাম কিছুটা নেমে আসে। আবহাওয়া ঠিক থাকলে সামনেই মুড়িকাটা এসে যাবে। ফেব্রুয়ারির মধ্যেই বাজারে সরবরাহ বেড়ে যাবে আবার।