নাটক গান কবিতায় উৎসবমুখর প্রচার
Published: 13th, October 2025 GMT
ক্যাম্পাসের মূল ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন প্রার্থীরা। একের পর এক শিক্ষার্থী ফটক পেরিয়ে ঢুকছেন। প্রার্থীরা তাঁদের হাতে গুঁজে দিচ্ছেন প্রচারপত্র। হাসিমুখে বলছেন, ‘আপনার মূল্যবান ভোট চাই। সমর্থন চাই।’ গতকাল রোববার সকাল ১০টায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গিয়ে এ দৃশ্য চোখে পড়ল। বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে ক্যাম্পাস এখন উৎসবমুখর।
আজ সোমবার রাত ১২টায় শেষ হচ্ছে নির্বাচনী প্রচার। তার আগে গত ১৮ দিন ক্যাম্পাসে প্রার্থীরা প্রচার চালিয়েছেন। কেউ কেউ গান গেয়ে, জামাই সেজে, ঐতিহ্যবাহী ‘গম্ভীরা’ গানের সুরে সুরে শিক্ষার্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছেন। শিক্ষার্থীরাও প্রার্থীদের এসব অভিনব পদ্ধতির প্রচারে সাড়া দিয়েছেন। প্রার্থীর সঙ্গে ছবি তুলেছেন। প্রচারণা মুঠোফোনে ধারণ করেছেন।
ক্যাম্পাসে সশরীর প্রচারের বাইরে অনলাইনেও সরব আছেন প্রার্থীরা। তাঁরা এখনো নিয়মিত ফেসবুকে ছবি ও ভিডিও আপলোড করছেন। কেউ কেউ শর্টফিল্ম বানিয়ে আলোচনায় এসেছেন। কেউ বানিয়েছেন নাটক।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বশেষ চাকসু নির্বাচন হয়েছিল ১৯৯০ সালে। দীর্ঘ ৩৫ বছর পর আবার ভোট হতে যাচ্ছে। এবার মোট ভোটার প্রায় ২৭ হাজার, যার মধ্যে ছাত্রী প্রায় সাড়ে ১১ হাজার। প্যানেল রয়েছে ১৩টি।
‘সময়ের সঙ্গে দৌড়’
দুপুর ১২টা। কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ঝুপড়ি গমগম করছিল প্রার্থী ও ভোটারের ভিড়ে। ‘বৈচিত্র্যের ঐক্য’ প্যানেলের সহসভাপতি (ভিপি) প্রার্থী ধ্রুব বড়ুয়াকে পাওয়া গেল ঝুপড়িতে। তিনি শিক্ষার্থীদের নানা প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিলেন। এক ফাঁকে ধ্রুব প্রথম আলোকে বলেন, ‘আর কিছু ঘণ্টা পর প্রচার শেষ হবে। এই শেষ মুহূর্তে সময়ের সঙ্গে দৌড়াচ্ছি। শিক্ষার্থীদের কাছে যাচ্ছি। নিজেদের প্রতিশ্রুতি তুলে ধরছি। শিক্ষার্থীরাও আগ্রহী হয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছেন। সব মিলিয়ে উৎসবমুখর পরিবেশ।’
কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদে ছাত্রীকল্যাণ সম্পাদক পদে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থী উম্মুল আখয়ার। ‘সার্বভৌম শিক্ষার্থী ঐক্য’ প্যানেল থেকে নির্বাচন করছেন এই শিক্ষার্থী। প্রচারপত্র দিতে এলে কথায় কথায় তিনি জানালেন, নিজস্বতা বজায় রেখে তিনি প্রচার চালাচ্ছেন। ভোটারদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাচ্ছেন। ভোটে অংশ নেওয়া তাঁর কাছে অন্য রকম অভিজ্ঞতা এনে দিচ্ছে।
একই প্যানেলের ভিপি প্রার্থী তাওসিফ মুত্তাকী চৌধুরীকেও ব্যস্ত পাওয়া গেল। বিজ্ঞান অনুষদের নিচে প্রচার চালিয়ে কেবল ঝুপড়িতে এসেছিলেন তিনি। পরে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা একটি আধুনিক ক্যাম্পাস গড়তে চান। এ প্রতিশ্রুতি সবাইকে দিচ্ছেন।
নির্বাচন এলে ভোটারদের কদর বাড়ে—এ কথা সবার মুখে মুখে। নাট্যকলা বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী বিশ্বনাথ ভৌমিকও সেদিকে ইঙ্গিত করে বললেন, পরিবেশ এখন পর্যন্ত উৎসবমুখর। দীর্ঘদিন পর নির্বাচন হচ্ছে। তাই শিক্ষার্থীরাও উচ্ছ্বসিত।
ভিন্নধারার প্রচারণা
প্রচারে নতুনত্ব চোখে পড়েছে। কেউ মাইক ছাড়াই কবিতা আবৃত্তি করে শিক্ষার্থীদের টানছেন, কেউ পোস্টারের বদলে হাতে এঁকে তৈরি করেছেন পোস্টকার্ড। আবার টাকার ওপর ছবি ছাপিয়েও প্রচার করছিলেন এক প্রার্থী। আবদুল্লাহ আল সাকিফ রহমান দুই টাকার একটি নোট হাতে ধরিয়ে দিয়ে প্রচার করছিলেন। কাছে গিয়ে দেখা গেল, এটি নকল টাকা। নোটের ওপর তাঁর ছবি আঁকা। আর লেখা—আইন ও মানবাধিকার সম্পাদক পদপ্রার্থী। চাহিবামাত্র ইহার প্রার্থীকে ভোট প্রদান করবেন। আরেক পাশে জাতীয় পাখি দোয়েলের পাশে এই প্রার্থীর ব্যালট নম্বর লেখা। সাকিফ প্রথম আলোকে বলেন, একটু ব্যতিক্রমভাবে শিক্ষার্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছেন তিনি। সাড়াও পাচ্ছেন।
কাটা পাহাড়ে ‘চার্লি চ্যাপলিনের’ অবয়ব ধারণ করে দাঁড়িয়ে ছিলেন মো.
এবারের প্রচারে বড় অংশজুড়ে দেখা গেছে নারী শিক্ষার্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা। প্রতিটি প্যানেল নারী শিক্ষার্থীদের জন্য ইশতেহারে বিভিন্ন দফা যুক্ত করেছে। এসব দফা সামনে এনে প্রচার চালাচ্ছে তারা।
১০ মিনিটে ৪০ ভোট
নির্বাচনে এবার একজন ভোটার ৪০টি পদে ভোট দেবেন। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের ২৬টি ও হল সংসদের ১৪টি পদে ভোট দিতে সময় নির্ধারণ করা হয়েছে সর্বোচ্চ ১০ মিনিট। ফলে একজন শিক্ষার্থীকে গড়ে প্রতি ২০ সেকেন্ডে একটি করে ভোট দিতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জানিয়েছে, সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ভোট গ্রহণ করা হবে। পাঁচটি অনুষদ ভবনে ভোটকেন্দ্র থাকবে ১৫টি ও বুথ থাকবে ৭০০টি। নির্বাচন পরিচালনা কমিটি বলছে, সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে ভোটকেন্দ্রের ভিড় ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থে।
নির্বাচন পরিচালনা কমিটি বলছে, একজন শিক্ষার্থীকে পাঁচটি ব্যালট পেপার দেওয়া হবে। এর মধ্যে চারটিতে থাকবে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের প্রার্থীদের নাম ও ব্যালট নম্বর। অন্য একটিতে থাকবে হল সংসদের প্রার্থীদের নাম ও ব্যালট নম্বর। এতে ভোটাররা দ্রুত বুঝতে পারবেন কোন ব্যালটে কোন পদ রয়েছে। ভোট গণনা হবে অপটিক্যাল মার্ক রিডার বা ওএমআর পদ্ধতিতে।
চার স্তরের নিরাপত্তা
নির্বাচন ঘিরে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। গতকাল বেলা সাড়ে তিনটায় প্রশাসনিক ভবনে সিনেট কক্ষে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় এ তথ্য জানান উপাচার্য অধ্যাপক মুহাম্মদ ইয়াহইয়া আখতার। তিনি বলেন, ‘আমরা শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় সব দাবি অগ্রাধিকার তালিকায় রেখেছি। চার স্তরের নিরাপত্তা থাকলেও আমাদের আসল শক্তি ৩০ হাজার শিক্ষার্থী। তাদের প্রতি আমাদের পূর্ণ আস্থা রয়েছে।’
সভায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মনির উদ্দিন বলেন, ব্যালট পেপার ও স্বচ্ছ ব্যালটবাক্স প্রস্তুত করা হয়েছে। ভোটারদের সুবিধার্থে পর্যাপ্ত সময় বরাদ্দ রাখা হয়েছে। গোপন কক্ষগুলো সিসিটিভির আওতায় থাকবে ও বিদ্যুৎ চলে গেলেও ফুটেজ সংরক্ষিত থাকবে। প্রতি কেন্দ্রে দুটি করে মেডিকেল টিম থাকবে। ১৪ অক্টোবর থেকে পরিচয়পত্র ছাড়া কেউ ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে পারবেন না, ভোটের দিনও কেবল পরিচয়পত্র নিয়েই ভোটকেন্দ্রে যেতে পারবেন। শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের চাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে শাটল ট্রেনের সূচি বাড়ানো হয়েছে, পাশাপাশি অতিরিক্ত বাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক হোসেন শহীদ সরওয়ার্দী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৪টি প্রবেশপথের মধ্যে ৭টি বন্ধ থাকবে নির্বাচনের দিন। শিক্ষার্থীরা পরিচয়পত্র দেখিয়ে প্রবেশ করতে পারবেন। তবে বহিরাগতদের প্রবেশ ঠেকাতে ২৪টি পয়েন্টে নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
চাকরি নেই, প্রেম ভেঙে যাচ্ছে; তরুণেরা কী করবে
‘জানো মা, হিয়ার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে,
পাত্র স্কুলমাস্টার। পাগলি মেয়েটা বলতে পারেনি
বেকার ছেলেটাকে ভালোবাসে।’
(বেকার ছেলের চিঠি, বিশ্বজিৎ হালদার)
রাত ১০টা। একটি ছোট্ট কফিশপের কোণে বসে আছে আয়ান ও নীলা (ছদ্মনাম)। কিছুটা উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় চলছে দুজনের মধ্যে।
নীলা চেঁচিয়ে বলল, ‘তুমি শুধু বলো, এভাবে আর কতদিন চলবে? আমার মা–বাবা পাত্র ঠিক করেছেন। চাকরি করে, ভালো বেতন।’
আয়ানের গলা শুকনা, চোখে ক্লান্তি। সে বলছিল, ‘আমি চেষ্টা করছি নীলা, কিন্তু চাকরি পাচ্ছি না।’
তিন বছর হলো দুজনের পরিচয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিবেট ক্লাবে প্রেম, হাত ধরাধরি করে কফি খাওয়া, একসঙ্গে চাকরি খোঁজার স্বপ্ন—সবই ছিল গল্পের মতো।
কিন্তু গল্প থেমে গেল, যখন আয়ান একটার পর একটা ইন্টারভিউ দিয়ে ফিরে এল শূন্য হাতে।
আয়ান স্নাতক শেষ করেছে দুই বছর আগে। যে রকম চাকরি চেয়েছিল, তেমনটা মেলেনি। এখন সে হারাতে বসেছে প্রিয় মানুষটাকেও চাকরির অভাবে।
অবশ্য এ গল্প শুধু আয়ান আর নীলার নয়।
এটা বাংলাদেশের হাজারো তরুণ–তরুণীর গল্প। চাকরি নেই, আর প্রেম ভেঙে যাচ্ছে—এই কথাটা আজকের এই পোস্ট মডার্ন সমাজের তরুণ জীবনের নির্মম বাস্তবতা।
বলা চলে এই প্রজন্মের প্রেম এখন আর সিনেমার মতো নয়; এটা এক অর্থনৈতিক সংগ্রামের গল্প, যেখানে চাকরির বিজ্ঞপ্তিও ভয়ের উৎস।
অর্থাৎ চাকরির বিজ্ঞপ্তি মানে শুধু আহ্বান নয়, তা অনেক তরুণের কাছে আতঙ্কও। কারণ, প্রতিযোগিতা, ব্যয় আর অনিশ্চয়তা তাঁদের সম্পর্কেও চাপ ফেলছে।
আরও পড়ুনউচ্চশিক্ষায় বেকারত্ব যখন নারী নির্যাতনের কারণ০২ অক্টোবর ২০২৫২.জুলাইয়ের ছাত্র–জনতার আন্দোলনের (২০২৪) ভিত্তি ছিল সরকারি চাকরিতে কোটাপ্রথা তুলে দেওয়া। উচ্চ আদালতের রায়ে সেটি হয়েছে, কিন্তু তাতে মেধাবী তরুণদের চাকরির সুযোগ কতটা বেড়েছে, তার নির্ভরযোগ্য উত্তর কারও কাছে নেই।
আর তরুণেরা নিজেদের যোগ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে কতটা প্রচেষ্টা নিচ্ছেন, সেটিও একটি প্রশ্ন। কারণ, যোগ্য প্রার্থীর সংকট আছেই।
এরপর চাকরিতে ঢোকার বয়সসীমা ৩৫ করার দাবিও এখনো পূরণ হয়নি। বিশ্বের বহু দেশে যেখানে ৪০ বছর বয়সেও চাকরিতে ঢোকার সুযোগ আছে, সেখানে বাংলাদেশে বয়স যেন এক অদৃশ্য প্রাচীর।
একজন তরুণ স্নাতক শেষ করে কিছু বছর প্রাইভেট জব করে বেশ অভিজ্ঞ হয়ে সরকারি চাকরিতে ঢুকলে তেমন অসুবিধা দেখি না।
আমাদের দেশে চাকরির আবেদন করতে গেলেও খরচ কম নয়। বিশেষ করে সরকারি চাকরিতে। একজন বেকারের জন্য চাকরির আবেদন ফি, যাতায়াত, থাকা–খাওয়ার খরচই হয়ে ওঠে মানসিক ও আর্থিক বোঝা।
আর আবেদনপত্রের সঙ্গে কত কিছু যে তারা প্রত্যাশা করে, তার কোনো শেষ নেই! প্রতিটি আবেদন যেন এক যুদ্ধ, যার ফলাফল পুরোপুরি অনিশ্চিত।
আরও পড়ুনবেকারত্ব মোচনে পথনকশা চাই০৭ জানুয়ারি ২০২৫৩.দেশে উচ্চশিক্ষিত তরুণদের মধ্যে বেকারত্ব সবচেয়ে বেশি—এই তথ্য কোনো পরিসংখ্যানের অপেক্ষা রাখে না। প্রতি ১০০ জন বেকারের মধ্যে ২৮ জনই উচ্চশিক্ষিত।
গবেষণা বলছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা শিক্ষার্থীর বড় অংশই চাকরির বাজারে পিছিয়ে।
সরকারি টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে এসব তথ্য এসেছে; কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, বেকারত্ব শুধু জাতীয় নয়, সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণদের জন্য সমান যন্ত্রণা।
শিক্ষিতদের তো আগে চাকরি পাওয়ার কথা; কিন্তু হচ্ছে এর উল্টো। গত সেপ্টেম্বরের শ্রমশক্তি জরিপ ২০২৪ অনুযায়ী, দেশে শিক্ষিত বেকারের হার সবচেয়ে বেশি।
বেকারের মধ্যে ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ স্নাতক ডিগ্রিধারী, আর ৭ দশমিক ১ শতাংশ উচ্চমাধ্যমিক পাস।
অর্থাৎ প্রতি পাঁচজন বেকারের একজনই স্নাতক বা উচ্চমাধ্যমিক সনদধারী। যাঁদের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, তাঁদের বেকারত্ব সবচেয়ে কম, মাত্র ১ দশমিক ২৫ শতাংশ।
এরাই ভালো, মাঠেঘাটে কাজ করছেন। রোজগার করে চলছেন। অন্তত বেকারত্বের খাতা থেকে নাম তো কাটতে পেরেছেন।
বেকারের সংজ্ঞা কী? আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) বলছে, সপ্তাহে এক ঘণ্টা মজুরি পেলেই কাউকে ‘বেকার’ বলা যায় না। এই মানদণ্ডে বাংলাদেশের বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ২৪ হাজার।
কিন্তু বাস্তবে সপ্তাহে এক ঘণ্টা কাজ করে কারও জীবন চলে না। মনমতো কাজ না পাওয়া প্রায় এক কোটি মানুষ ‘ছদ্মবেকার’।
উন্নত দেশে সপ্তাহে এক ঘণ্টা কাজ করলেও রাষ্ট্র বেকার ভাতা দেয়। বাংলাদেশে তার কোনো ধারণাই নেই। তরুণেরা এখানে শুধু টিকে থাকেন, ভালো থাকেন না। পরবর্তী লেখায় বেকার ভাতা নিয়ে আলোচনা করার ইচ্ছা জানিয়ে রাখলাম।
আরও পড়ুনবেকারত্ব ও মূল্যস্ফীতি কমানোর সদিচ্ছা কোথায়০৫ জুন ২০২৩৪.বাংলাদেশের সমাজে প্রেম এখনো পরিবারের অনুমোদনে বন্দী। কথাটি ১০০ শতাংশ ঠিক না হলেও বড় অংশে ঠিক।
একজন তরুণের মূল্য নির্ধারণ করা হয় তাঁর চাকরি, বেতন বা ফ্ল্যাটের আয়তনের ওপর। চাকরি না থাকলে প্রেমিকা বা তাঁর পরিবারের কাছে তাঁর কোনো মূল্য থাকে না। ‘ছেলে চাকরি করে না’—এই এক বাক্যেই শেষ হয় সম্পর্ক। সরকারি চাকরি হলে মূল্য বেশি।
রিলেশনশিপে থাকা তরুণ চাকরিহীন হলে প্রশ্ন ওঠে, ‘তোমার ফিউচার কী?’ প্রেমিকা দিনের পর দিন ভাবেন, ‘আমি কি এই অনিশ্চয়তায় ঝুঁকি নেব?’ অভিযোগ, অভিমান আর শেষে বিচ্ছেদ ঘটে।
কেউ কেউ সম্পর্ক বাঁচাতে প্রত্যাশার চেয়ে কম বেতনের চাকরি নেন নিজের স্বপ্ন ছেড়ে দিয়ে। ভাবেন, এক বছরের মধ্যে নিশ্চয়ই ভাগ্যের শিকে ছিঁড়বে। অফিসে নাম হবে, মাইনে বাড়বে। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া আশাবাদী হওয়ার মতো কিছু জোটে না।
বেকারত্ব তরুণদের সামাজিক বিচ্ছিন্নতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে—এমন তথ্যও আমাদের জানা আছে। বিভিন্ন গবেষণায় তা–ই উঠে এসেছে।
একটি লেখায় পড়ছিলাম, বেকারত্বের কারণে সম্পর্ক ভাঙার হার ৩০ শতাংশ বেশি। অর্থনৈতিক চাপ এখানে বড় ভূমিকা রাখে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনে যে প্রেম ছিল এক কাপ চা, একটুকরা সময়, এখন সেটি মোটা টাকার পাটাতনের ওপর প্রতিষ্ঠিত।
একজন তরুণ লিখেছেন, ‘অভাব লেগেই আছে, ঘরভাড়াও দিতে পারি না।’ বলার অপেক্ষা রাখে না, এই অভাব শুধু সংসারে নয়, প্রেমেও ফাটল ধরায়।
এ রকম ছেলে, তা যে যত যোগ্য হোক না কেন, কোনো মেয়ে তাঁকে পছন্দ করবে—এমন নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না।
মেয়েরা নিরাপত্তা চান, ছেলেরা স্বনির্ভরতা দেখাতে চান। তবে বেকারত্বে দুটিই শেষ।
তরুণদের প্রেম ভাঙছে শুধু অর্থের অভাবে নয়, মানসিক অনিশ্চয়তায়ও। সরকারের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। বেকারত্ব কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে। চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে হবে। সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। এসব অজানা নয় কারও; কিন্তু কার্যকর কোনো পদক্ষেপ কি চোখে পড়ছে? একদম পড়ছে না।৫.বেকারত্বের এই ফাঁদ থেকে বেরোনোর উপায় কী
প্রথমত, সমাজের মনোভাব বদলাতে হবে। চাকরি না থাকলেই কেউ ‘অযোগ্য’, এই ধারণা বদলানো জরুরি।
প্রেমিক–প্রেমিকারা একসঙ্গে লড়াই করা শিখতে পারেন, যেমন ফ্রিল্যান্সিং, স্কিল ডেভেলপমেন্ট বা ছোট উদ্যোগ। এ রকম অনেক উদাহরণ এই সমাজেই আছে। দরকার কেবল একটু ধৈর্য।
দ্বিতীয়ত, মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিতে হবে। কাউন্সেলিং, খোলামেলা কথা—এসব সম্পর্ককে শক্ত করে; কিন্তু এ ব্যাপারে মা–বাবারাও খুব অসচেতন থাকেন।
তৃতীয়ত, পরিবারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। মা–বাবারা মেয়ের বিয়ে দিতে চান ‘চাকরিজীবী’ ছেলের কাছে, বিশেষ করে সরকারি চাকরি কিংবা নিদেনপক্ষে ব্যাংকের চাকরি করে এমন কারও কাছে; কিন্তু হৃদয়ের কথা শোনার সময় যেন কারও নেই।
সমাজ যখন ভালোবাসার মানদণ্ডে অর্থ ও পেশাকে বসায়, তখন সম্পর্ক টেকে না, কেবল ক্লান্তি বাড়ে। চাকরি দরকার নিশ্চয়ই; কিন্তু হৃদয়ের দরজাও যেন তার সঙ্গে বন্ধ না হয়ে যায়।
অভিভাবকেরা যদি বিষয়টি বুঝতেন, অনেক তরুণ-তরুণী চাপমুক্ত হয়ে নিজেদের দক্ষতা বাড়ানোর প্রচেষ্টা নিতে পারতেন।
তরুণদের প্রেম ভাঙছে শুধু অর্থের অভাবে নয়, মানসিক অনিশ্চয়তায়ও। সরকারের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। বেকারত্ব কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে।
চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে হবে। সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। এসব অজানা নয় কারও; কিন্তু কার্যকর কোনো পদক্ষেপ কি চোখে পড়ছে? একদম পড়ছে না।
ভালোবাসা টিকিয়ে রাখতে চাই সহানুভূতি, বোঝাপড়া আর এমন এক সমাজ, যেখানে ‘চাকরি নেই’ মানেই ‘ভালোবাসা নেই’ নয়। তরুণ প্রাণে স্ফূর্তি আসুক।
কাজী আলিম-উজ-জামান প্রথম আলোর উপবার্তা সম্পাদক
ইমেইল: alim. zaman@prothomalo. com
(মতামত লেখকের নিজস্ব)