বগুড়ায় বিষাক্ত মদপানে অসুস্থ পাঁচজনেরই মৃত্যু
Published: 14th, October 2025 GMT
বগুড়ার শাজাহানপুরে বিষাক্ত মদপানে অসুস্থ ব্যক্তিদের মধ্যে আরও একজন মারা গেছেন। গতকাল সোমবার সকালে বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। এই নিয়ে মদপানের ঘটনায় অসুস্থ পাঁচজনের মধ্যে সবাই মারা গেলেন।
নতুন করে মারা যাওয়া ব্যক্তির নাম রঞ্জু মিয়া (৩০) । তিনি পেশায় আনসারের সদস্য ছিলেন। ২ অক্টোবর রাতে মদ পানে অসুস্থ হওয়ার পর তিনি শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ছিলেন।
এ বিষয়ে শাজাহানপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বলেন, শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রঞ্জু মিয়া মারা গেছেন। এ নিয়ে ওই মদপানের ঘটনায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল পাঁচজনে।
থানা–পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ২ অক্টোবর রাতে শাজাহানপুর উপজেলার বেজোড়া মধ্যপাড়ার মিজানুর রহমান, নাছিদুল, আবদুল্লাহেল কাফি, রঞ্জু মিয়া ও আবদুল মানিক একসঙ্গে মদ পান করে অসুস্থ হয়ে পড়েন। ওই রাতেই তাঁদের বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। ৭ অক্টোবর সন্ধ্যায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান মিজানুর রহমান ওরফে লিটন (৫৫)।
আরও পড়ুনবগুড়ায় বিষাক্ত মদ্যপানে আরও তিনজনের মৃত্যু১০ অক্টোবর ২০২৫গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে শুক্রবার বিকেল সাড়ে চারটা পর্যন্ত শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আরও তিনজন মারা যান। এর মধ্যে বৃহস্পতিবার রাতে নাছিদুল ইসলাম (২৭), শুক্রবার দুপুর ১২টার দিকে আবদুল মানিক (৩০) ও বিকেল সাড়ে চারটার দিকে আব্দুল্লাহেল কাফি (৩০) মারা যান। নাছিদুলের বাড়ি উপজেলার খোট্টাপাড়া ইউনিয়নের সোনারপাড়া গ্রামে। আবদুল মানিক ও কাফির বাড়ি একই ইউনিয়নের পূর্বপাড়ায়।
আরও পড়ুনবগুড়ায় বিষাক্ত মদ্যপানে অসুস্থ একজনের মৃত্যু, চারজন চিকিৎসাধীন০৮ অক্টোবর ২০২৫.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব ষ ক ত মদ আবদ ল মদপ ন
এছাড়াও পড়ুন:
চাকরি নেই, প্রেম ভেঙে যাচ্ছে; তরুণেরা কী করবে
‘জানো মা, হিয়ার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে,
পাত্র স্কুলমাস্টার। পাগলি মেয়েটা বলতে পারেনি
বেকার ছেলেটাকে ভালোবাসে।’
(বেকার ছেলের চিঠি, বিশ্বজিৎ হালদার)
রাত ১০টা। একটি ছোট্ট কফিশপের কোণে বসে আছে আয়ান ও নীলা (ছদ্মনাম)। কিছুটা উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় চলছে দুজনের মধ্যে।
নীলা চেঁচিয়ে বলল, ‘তুমি শুধু বলো, এভাবে আর কতদিন চলবে? আমার মা–বাবা পাত্র ঠিক করেছেন। চাকরি করে, ভালো বেতন।’
আয়ানের গলা শুকনা, চোখে ক্লান্তি। সে বলছিল, ‘আমি চেষ্টা করছি নীলা, কিন্তু চাকরি পাচ্ছি না।’
তিন বছর হলো দুজনের পরিচয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিবেট ক্লাবে প্রেম, হাত ধরাধরি করে কফি খাওয়া, একসঙ্গে চাকরি খোঁজার স্বপ্ন—সবই ছিল গল্পের মতো।
কিন্তু গল্প থেমে গেল, যখন আয়ান একটার পর একটা ইন্টারভিউ দিয়ে ফিরে এল শূন্য হাতে।
আয়ান স্নাতক শেষ করেছে দুই বছর আগে। যে রকম চাকরি চেয়েছিল, তেমনটা মেলেনি। এখন সে হারাতে বসেছে প্রিয় মানুষটাকেও চাকরির অভাবে।
অবশ্য এ গল্প শুধু আয়ান আর নীলার নয়।
এটা বাংলাদেশের হাজারো তরুণ–তরুণীর গল্প। চাকরি নেই, আর প্রেম ভেঙে যাচ্ছে—এই কথাটা আজকের এই পোস্ট মডার্ন সমাজের তরুণ জীবনের নির্মম বাস্তবতা।
বলা চলে এই প্রজন্মের প্রেম এখন আর সিনেমার মতো নয়; এটা এক অর্থনৈতিক সংগ্রামের গল্প, যেখানে চাকরির বিজ্ঞপ্তিও ভয়ের উৎস।
অর্থাৎ চাকরির বিজ্ঞপ্তি মানে শুধু আহ্বান নয়, তা অনেক তরুণের কাছে আতঙ্কও। কারণ, প্রতিযোগিতা, ব্যয় আর অনিশ্চয়তা তাঁদের সম্পর্কেও চাপ ফেলছে।
আরও পড়ুনউচ্চশিক্ষায় বেকারত্ব যখন নারী নির্যাতনের কারণ০২ অক্টোবর ২০২৫২.জুলাইয়ের ছাত্র–জনতার আন্দোলনের (২০২৪) ভিত্তি ছিল সরকারি চাকরিতে কোটাপ্রথা তুলে দেওয়া। উচ্চ আদালতের রায়ে সেটি হয়েছে, কিন্তু তাতে মেধাবী তরুণদের চাকরির সুযোগ কতটা বেড়েছে, তার নির্ভরযোগ্য উত্তর কারও কাছে নেই।
আর তরুণেরা নিজেদের যোগ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে কতটা প্রচেষ্টা নিচ্ছেন, সেটিও একটি প্রশ্ন। কারণ, যোগ্য প্রার্থীর সংকট আছেই।
এরপর চাকরিতে ঢোকার বয়সসীমা ৩৫ করার দাবিও এখনো পূরণ হয়নি। বিশ্বের বহু দেশে যেখানে ৪০ বছর বয়সেও চাকরিতে ঢোকার সুযোগ আছে, সেখানে বাংলাদেশে বয়স যেন এক অদৃশ্য প্রাচীর।
একজন তরুণ স্নাতক শেষ করে কিছু বছর প্রাইভেট জব করে বেশ অভিজ্ঞ হয়ে সরকারি চাকরিতে ঢুকলে তেমন অসুবিধা দেখি না।
আমাদের দেশে চাকরির আবেদন করতে গেলেও খরচ কম নয়। বিশেষ করে সরকারি চাকরিতে। একজন বেকারের জন্য চাকরির আবেদন ফি, যাতায়াত, থাকা–খাওয়ার খরচই হয়ে ওঠে মানসিক ও আর্থিক বোঝা।
আর আবেদনপত্রের সঙ্গে কত কিছু যে তারা প্রত্যাশা করে, তার কোনো শেষ নেই! প্রতিটি আবেদন যেন এক যুদ্ধ, যার ফলাফল পুরোপুরি অনিশ্চিত।
আরও পড়ুনবেকারত্ব মোচনে পথনকশা চাই০৭ জানুয়ারি ২০২৫৩.দেশে উচ্চশিক্ষিত তরুণদের মধ্যে বেকারত্ব সবচেয়ে বেশি—এই তথ্য কোনো পরিসংখ্যানের অপেক্ষা রাখে না। প্রতি ১০০ জন বেকারের মধ্যে ২৮ জনই উচ্চশিক্ষিত।
গবেষণা বলছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা শিক্ষার্থীর বড় অংশই চাকরির বাজারে পিছিয়ে।
সরকারি টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে এসব তথ্য এসেছে; কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, বেকারত্ব শুধু জাতীয় নয়, সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণদের জন্য সমান যন্ত্রণা।
শিক্ষিতদের তো আগে চাকরি পাওয়ার কথা; কিন্তু হচ্ছে এর উল্টো। গত সেপ্টেম্বরের শ্রমশক্তি জরিপ ২০২৪ অনুযায়ী, দেশে শিক্ষিত বেকারের হার সবচেয়ে বেশি।
বেকারের মধ্যে ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ স্নাতক ডিগ্রিধারী, আর ৭ দশমিক ১ শতাংশ উচ্চমাধ্যমিক পাস।
অর্থাৎ প্রতি পাঁচজন বেকারের একজনই স্নাতক বা উচ্চমাধ্যমিক সনদধারী। যাঁদের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, তাঁদের বেকারত্ব সবচেয়ে কম, মাত্র ১ দশমিক ২৫ শতাংশ।
এরাই ভালো, মাঠেঘাটে কাজ করছেন। রোজগার করে চলছেন। অন্তত বেকারত্বের খাতা থেকে নাম তো কাটতে পেরেছেন।
বেকারের সংজ্ঞা কী? আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) বলছে, সপ্তাহে এক ঘণ্টা মজুরি পেলেই কাউকে ‘বেকার’ বলা যায় না। এই মানদণ্ডে বাংলাদেশের বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ২৪ হাজার।
কিন্তু বাস্তবে সপ্তাহে এক ঘণ্টা কাজ করে কারও জীবন চলে না। মনমতো কাজ না পাওয়া প্রায় এক কোটি মানুষ ‘ছদ্মবেকার’।
উন্নত দেশে সপ্তাহে এক ঘণ্টা কাজ করলেও রাষ্ট্র বেকার ভাতা দেয়। বাংলাদেশে তার কোনো ধারণাই নেই। তরুণেরা এখানে শুধু টিকে থাকেন, ভালো থাকেন না। পরবর্তী লেখায় বেকার ভাতা নিয়ে আলোচনা করার ইচ্ছা জানিয়ে রাখলাম।
আরও পড়ুনবেকারত্ব ও মূল্যস্ফীতি কমানোর সদিচ্ছা কোথায়০৫ জুন ২০২৩৪.বাংলাদেশের সমাজে প্রেম এখনো পরিবারের অনুমোদনে বন্দী। কথাটি ১০০ শতাংশ ঠিক না হলেও বড় অংশে ঠিক।
একজন তরুণের মূল্য নির্ধারণ করা হয় তাঁর চাকরি, বেতন বা ফ্ল্যাটের আয়তনের ওপর। চাকরি না থাকলে প্রেমিকা বা তাঁর পরিবারের কাছে তাঁর কোনো মূল্য থাকে না। ‘ছেলে চাকরি করে না’—এই এক বাক্যেই শেষ হয় সম্পর্ক। সরকারি চাকরি হলে মূল্য বেশি।
রিলেশনশিপে থাকা তরুণ চাকরিহীন হলে প্রশ্ন ওঠে, ‘তোমার ফিউচার কী?’ প্রেমিকা দিনের পর দিন ভাবেন, ‘আমি কি এই অনিশ্চয়তায় ঝুঁকি নেব?’ অভিযোগ, অভিমান আর শেষে বিচ্ছেদ ঘটে।
কেউ কেউ সম্পর্ক বাঁচাতে প্রত্যাশার চেয়ে কম বেতনের চাকরি নেন নিজের স্বপ্ন ছেড়ে দিয়ে। ভাবেন, এক বছরের মধ্যে নিশ্চয়ই ভাগ্যের শিকে ছিঁড়বে। অফিসে নাম হবে, মাইনে বাড়বে। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া আশাবাদী হওয়ার মতো কিছু জোটে না।
বেকারত্ব তরুণদের সামাজিক বিচ্ছিন্নতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে—এমন তথ্যও আমাদের জানা আছে। বিভিন্ন গবেষণায় তা–ই উঠে এসেছে।
একটি লেখায় পড়ছিলাম, বেকারত্বের কারণে সম্পর্ক ভাঙার হার ৩০ শতাংশ বেশি। অর্থনৈতিক চাপ এখানে বড় ভূমিকা রাখে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনে যে প্রেম ছিল এক কাপ চা, একটুকরা সময়, এখন সেটি মোটা টাকার পাটাতনের ওপর প্রতিষ্ঠিত।
একজন তরুণ লিখেছেন, ‘অভাব লেগেই আছে, ঘরভাড়াও দিতে পারি না।’ বলার অপেক্ষা রাখে না, এই অভাব শুধু সংসারে নয়, প্রেমেও ফাটল ধরায়।
এ রকম ছেলে, তা যে যত যোগ্য হোক না কেন, কোনো মেয়ে তাঁকে পছন্দ করবে—এমন নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না।
মেয়েরা নিরাপত্তা চান, ছেলেরা স্বনির্ভরতা দেখাতে চান। তবে বেকারত্বে দুটিই শেষ।
তরুণদের প্রেম ভাঙছে শুধু অর্থের অভাবে নয়, মানসিক অনিশ্চয়তায়ও। সরকারের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। বেকারত্ব কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে। চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে হবে। সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। এসব অজানা নয় কারও; কিন্তু কার্যকর কোনো পদক্ষেপ কি চোখে পড়ছে? একদম পড়ছে না।৫.বেকারত্বের এই ফাঁদ থেকে বেরোনোর উপায় কী
প্রথমত, সমাজের মনোভাব বদলাতে হবে। চাকরি না থাকলেই কেউ ‘অযোগ্য’, এই ধারণা বদলানো জরুরি।
প্রেমিক–প্রেমিকারা একসঙ্গে লড়াই করা শিখতে পারেন, যেমন ফ্রিল্যান্সিং, স্কিল ডেভেলপমেন্ট বা ছোট উদ্যোগ। এ রকম অনেক উদাহরণ এই সমাজেই আছে। দরকার কেবল একটু ধৈর্য।
দ্বিতীয়ত, মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিতে হবে। কাউন্সেলিং, খোলামেলা কথা—এসব সম্পর্ককে শক্ত করে; কিন্তু এ ব্যাপারে মা–বাবারাও খুব অসচেতন থাকেন।
তৃতীয়ত, পরিবারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। মা–বাবারা মেয়ের বিয়ে দিতে চান ‘চাকরিজীবী’ ছেলের কাছে, বিশেষ করে সরকারি চাকরি কিংবা নিদেনপক্ষে ব্যাংকের চাকরি করে এমন কারও কাছে; কিন্তু হৃদয়ের কথা শোনার সময় যেন কারও নেই।
সমাজ যখন ভালোবাসার মানদণ্ডে অর্থ ও পেশাকে বসায়, তখন সম্পর্ক টেকে না, কেবল ক্লান্তি বাড়ে। চাকরি দরকার নিশ্চয়ই; কিন্তু হৃদয়ের দরজাও যেন তার সঙ্গে বন্ধ না হয়ে যায়।
অভিভাবকেরা যদি বিষয়টি বুঝতেন, অনেক তরুণ-তরুণী চাপমুক্ত হয়ে নিজেদের দক্ষতা বাড়ানোর প্রচেষ্টা নিতে পারতেন।
তরুণদের প্রেম ভাঙছে শুধু অর্থের অভাবে নয়, মানসিক অনিশ্চয়তায়ও। সরকারের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। বেকারত্ব কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে।
চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে হবে। সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। এসব অজানা নয় কারও; কিন্তু কার্যকর কোনো পদক্ষেপ কি চোখে পড়ছে? একদম পড়ছে না।
ভালোবাসা টিকিয়ে রাখতে চাই সহানুভূতি, বোঝাপড়া আর এমন এক সমাজ, যেখানে ‘চাকরি নেই’ মানেই ‘ভালোবাসা নেই’ নয়। তরুণ প্রাণে স্ফূর্তি আসুক।
কাজী আলিম-উজ-জামান প্রথম আলোর উপবার্তা সম্পাদক
ইমেইল: alim. zaman@prothomalo. com
(মতামত লেখকের নিজস্ব)