শক্তিশালী আমেরিকা রেখে যাচ্ছি, বিদায়বেলায় বাইডেন
Published: 14th, January 2025 GMT
বিদায়বেলায় নিজের প্রশাসনের বৈদেশিক নীতির পক্ষে জোরালো বক্তব্য দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তিনি বলেছেন, ‘এ চার বছরে আমরা সংকটের মুখোমুখি হয়েছি, আমাদের পরীক্ষা দিতে হয়েছে। আমি মনে করি, আমরা যে অবস্থায় পরীক্ষা শুরু করেছিলাম, তার চেয়ে শক্তিশালী রূপে বের হয়ে এসেছি।’
গতকাল সোমবার মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক ভাষণে বাইডেন এসব কথা বলেন। ২০ জানুয়ারি নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর আগে পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে এটিই ছিল বাইডেনের শেষ ভাষণ।
ভাষণে বাইডেন বলেন, ‘আমরা একটি বাঁকবদলের মুখে দাঁড়িয়ে আছি। শীতলযুদ্ধ–পরবর্তী যুগের অবসান হয়েছে। একটি নতুন যুগের সূচনা হয়েছে। সামনের মাস ও বছরগুলোতে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ আসবে। তবু এটা স্পষ্ট, আমার প্রশাসন পরবর্তী প্রশাসনকে খুব শক্তিশালী অবস্থানে রেখে যাচ্ছে।’
বাইডেন নিজ প্রশাসনের প্রশংসা করলেও সমালোচকেরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর প্রশাসনকে খুব কমই নম্বর দিয়েছেন, বিশেষ করে গাজা যুদ্ধে ইসরায়েলকে অন্ধভাবে সমর্থন দিয়ে যাওয়া নিয়ে।
বাইডেন বলেন, তিনি যখন হোয়াইট হাউসে প্রবেশ করেছিলেন, সেই সময়ের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্র এখন বেশি শক্তিশালী এবং শত্রুরা এখন বেশি দুর্বল। তিনি দাবি করেন, ‘আমরা এমন এক আমেরিকাকে রেখে যাচ্ছি, যার বেশি বন্ধু ও শক্তিশালী জোট রয়েছে। শত্রুরা আরও দুর্বল হয়েছে এবং বেশি চাপে রয়েছে। এমন এক আমেরিকা রেখে যাচ্ছি, যা আবার নেতৃত্ব দিচ্ছে, দেশগুলোকে (মিত্রদের) একত্র করছে, এজেন্ডা ঠিক করছে এবং নিজস্ব পরিকল্পনা ও লক্ষ্যের পেছনে অন্যদের জড়ো করছে।’
ট্রাম্প এবারের নির্বাচনী প্রচারের সময় বাইডেনের পররাষ্ট্রনীতির কড়া সমালোচনা করেছিলেন। ট্রাম্পের অভিযোগ ছিল, ইউক্রেন ও মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ দিয়ে ডেমোক্র্যাটরা বিদেশে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান দ্রুত দুর্বল করছেন।
কিন্তু সোমবার বাইডেন ভিন্ন কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, তাঁর নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি খাত, অর্থনীতি ও চীনের বিপরীতে মার্কিন কৌশলগত অবস্থান শক্তিশালী হয়েছে।
রাশিয়া আক্রমণ করার পর ইউক্রেনের জন্য ন্যাটোর সমর্থন জোগাড় করতে তাঁর প্রশাসন যে ভূমিকা রেখেছে, সেটিরও প্রশংসা করেছেন বাইডেন। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে আক্রমণ শুরু করে রাশিয়া।
আফগানিস্তানে যুদ্ধ রেখে যাচ্ছি না২০২১ সালে আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহার নিয়ে যে চরম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, তার পক্ষেও সাফাই গেয়েছেন বাইডেন।
বাইডেন নয়, বরং ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার নিয়ে তালেবানের সঙ্গে একটি চুক্তিতে উপনীত হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। তবে চূড়ান্ত সেনা প্রত্যাহারের সময় ক্ষমতায় ছিলেন বাইডেন।
বাইডেন বলেন, ‘আমি যখন দায়িত্ব গ্রহণ করি, আমার সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমি কয়েক হাজার সেনাসদস্যকে আফগানিস্তানে রাখার কোনো কারণ দেখিনি।’ বাইডেন আরও বলেন, তিনিই কয়েক দশকের মধ্যে প্রথম প্রেসিডেন্ট, যিনি উত্তরসূরির জন্য কোনো যুদ্ধ রেখে যাচ্ছেন না আফগানিস্তানে।
যুদ্ধাপরাধী স্লোগানবাইডেন ভাষণে গাজায় ইসরায়েলের আগ্রাসন নিয়ে যা বলেছেন, সেখানকার পরিস্থিতি তার চেয়েও গুরুতর ও উদ্বেগজনক। তিনি যখন ভাষণ দিতে আসছিলেন, তখন বাইরে বিক্ষোভকারীরা ‘যুদ্ধাপরাধী’ বলে স্লোগান দিচ্ছিলেন।
সমালোচকদের অভিযোগ, (গাজা যুদ্ধ শুরুর পর) ইসরায়েলকে ওয়াশিংটনের সামরিক সহায়তা দিয়ে যাওয়া বিদেশের মাটিতে নৃশংসতাকে সমর্থন দেওয়ার শামিল।
২০২৩ সালের অক্টোবরে গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ইসরায়েলের হামলায় এখন পর্যন্ত ৪৬ হাজার ৫৮৪ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, গাজায় ইসরায়েল যা করছে, সেটা গণহত্যার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
গাজা যুদ্ধের প্রথম বছর যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে প্রায় ১ হাজার ৭৯০ কোটি ডলার সহায়তা দিয়েছে এবং এখনো তহবিল দিয়ে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাইডেন গাজা যুদ্ধে ইসরায়েলকে যেভাবে নিরবচ্ছিন্ন সমর্থন ও সহায়তা করে গেছেন, সেটা তাঁর ভাবমূর্তিতে স্থায়ী দাগ ফেলেছে।
ভাষণে বাইডেন তাঁর গাজায় যুদ্ধবিরতি পরিকল্পনা নিয়েও কথা বলেন। গত বছর জুনে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ওই পরিকল্পনা অনুমোদন পায়। কিন্তু এখনো কোনো যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়নি।
আরও পড়ুনশেষ ২ মাসে কী করবেন বাইডেন১২ নভেম্বর ২০২৪বাইডেন বলেন, ‘কয়েক মাস আগে আমার দেওয়া একটি প্রস্তাব এখন চুক্তিতে পরিণত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। অবশেষে তা বাস্তবায়িত হতে চলেছে।’ তিনি এ বিষয়ে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির সঙ্গে সম্প্রতি কথা বলেছেন বলেও জানান। বাইডেন আরও বলেন, শিগগিরই তিনি মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসির সঙ্গেও এ বিষয়ে কথা বলবেন।
বাইডেন বলেন, ‘অনেক বছর ধরে সরকারি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমি শিখেছি, কখনো, কোনো অবস্থায় আশাহত হতে নেই।’
গাজা পরিস্থিতি নিয়ে বাইডেন বলেন, ‘অনেক নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, অনেক সম্প্রদায় ধ্বংস হয়ে গেছে। ফিলিস্তিনি জনগণের শান্তি প্রাপ্য।’ এদিন চীন, রাশিয়াসহ অন্যান্য দেশ নিয়েও কথা বলেন তিনি।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত প্রতিরোধ চলবে: হামাস
স্বাধীন ও সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না হওয়ার প্রতিরোধ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে হামাস। গত মঙ্গলবার জাতিসংঘের সদর দপ্তর থেকে দেওয়া এক ঘোষণাপত্রের অস্ত্র ত্যাগের আহ্বানের জবাবে সংগঠনটি এই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।
বৃহস্পতিবার হামাসের সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, দখলদারির অবসান এবং জেরুজালেমকে রাজধানী করে একটি স্বাধীন ও সম্পূর্ণ সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত প্রতিরোধ থামবে না তারা।
মঙ্গলবার জাতিসংঘের সদর দপ্তর থেকে দেওয়া ঘোষণায় বলা হয়েছিল, ‘গাজায় যুদ্ধ বন্ধে হামাসকে (এই উপত্যকায়) তার শাসনের অবশ্যই অবসান ঘটাতে হবে এবং আন্তর্জাতিক অংশগ্রহণ ও সমর্থনের মাধ্যমে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে অস্ত্র সমর্পণ করতে হবে। সার্বভৌম ও স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যের সঙ্গে এটি সংগতিপূর্ণ।’
সৌদি আরব, কাতার, ফ্রান্স ও মিসরসহ ১৭টি দেশ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আরব লিগ ঘোষণাপত্রটি সমর্থন করেছে। এটি ‘দ্য নিউইয়র্ক’ ঘোষণাপত্র হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
বৃহস্পতিবার আলাদা এক বিবৃতিতে প্রতি শুক্রবার, শনিবার ও রোববার বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও তাদের মিত্র দেশগুলোর দূতাবাসের বাইরে বিক্ষোভ করার আহ্বান জানিয়েছে হামাস। ইসরায়েলের আগ্রাসন বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত তা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানিয়েছে তারা।
অনাহারে মৃত্যু ১৫৪গাজায় কর্মরত চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, উপত্যকাটিতে অনাহারে আরও দুই শিশু এবং এক তরুণ মারা গেছে। এ নিয়ে সেখানে অনাহারে মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ১৫৪ জনে। তাদের মধ্যে শিশু ৮৯টি।
গাজায় প্রায় ২১ লাখ মানুষের বসবাস। উপত্যকাটিতে গত মার্চ থেকে নতুন করে অবরোধ শুরু করে ইসরায়েল। ফলে সেখানে ত্রাণবাহী কোনো ট্রাক প্রবেশ করতে পারছিল না। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে সম্প্রতি কিছুদিন ধরে গাজায় সীমিত পরিমাণে ত্রাণ প্রবেশ করতে দিচ্ছে ইসরায়েল। এই ত্রাণ প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত নগণ্য।
ত্রাণ নিতে প্রাণহানি ১৩৭৩জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় জানিয়েছে, গাজায় গত মে মাস থেকে এখন পর্যন্ত ত্রাণ আনতে গিয়ে মোট ১ হাজার ৩৭৩ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে ৮৫৯ জন মারা গেছেন বিতর্কিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের (জিএইচএফ) ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে। গত মে মাসের শেষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থাটি ইসরায়েলি সেনাদের সহায়তায় গাজার কয়েকটি স্থানে ত্রাণ দিচ্ছে।
বাকি ৫১৪ জন মারা গেছেন ত্রাণবাহী ট্রাকের আশপাশে। তাঁরা ত্রাণের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। অধিকাংশই ইসরায়েলের সেনাদের গুলিতে নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয়।
আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুক্রবার সকালে গাজায় অন্তত আরও ৪২ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ত্রাণ আনতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন ১৫ জন। এই নিয়ে প্রায় ২২ মাসের সংঘাতে গাজায় ইসরায়েলি সেনাদের হামলা নিহত হয়েছেন অন্তত ৬০ হাজার ৩৩২ জন।
গাজায় স্টিভ উইটকফশুক্রবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ গাজা সফর করেছেন। তিনি উপত্যকাটির রাফা এলাকায় জিএইচএফের একটি ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রও ঘুরে দেখেন। এ সময় ইসরায়েলে নিয়োজিত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মাইক হুকাবি তাঁর সঙ্গে ছিলেন। তাঁরা পাঁচ ঘণ্টার বেশি গাজায় ছিলেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে উইটকফ নিজেই এই কথা জানিয়েছেন। আগের দিন তিনি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। উইটকফ বলেছেন, ‘মাঠের পরিস্থিতি বুঝতে ও তথ্য সংগ্রহ করতে আমরা গাজায় গিয়েছিলাম। গাজার মানবিক পরিস্থিতির একটি স্পষ্ট ধারণা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে পৌঁছে দেওয়াই আমার উদ্দেশ্য, যাতে করে গাজাবাসীর জন্য খাদ্য ও চিকিৎসা সহায়তা পৌঁছাতে পরিকল্পনা প্রণয়নে সহায়তা করা যায়।’
গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য-বিষয়ক বিশেষ দূত ও আবাসন খাতের সাবেক আইনজীবী উইটকফের আন্তর্জাতিক নীতি ও মানবিক সহায়তা-সংক্রান্ত কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তা সত্ত্বেও তিনি মধ্যপ্রাচ্যের সংকট সমাধানের চেষ্টার পাশাপাশি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধেও কূটনীতি চালাচ্ছেন। এরই মধ্যে তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছেন।