হৃদরোগ হৃদয়ঘটিত কোনো রোগ নয়। তবে দেশে হৃদরোগী দেখলে অনেকের হৃদয় আনন্দে নেচে ওঠাও হয়তো অস্বাভাবিক নয়। কারণ, কারও হৃদরোগ মানেই অন্য কারও জন্য অর্থের খেলা। যে কারণে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পক্ষে অনেক সময় হৃদরোগের চিকিৎসা দূরের বিষয়, রোগ নির্ণয়ের খরচ জোগানোও সহজ নয়। এনজিওগ্রাম থেকে রিং পরানো কিংবা সার্জারি– হৃদরোগ চিকিৎসার পরতে পরতে প্রয়োজন হয় অর্থের। হৃদরোগের চিকিৎসা যখন বড় বাণিজ্যের বিষয়, তখন সিন্ডিকেট গড়ে ওঠাই স্বাভাবিক।
সোমবার সমকালের শেষ পাতায় প্রকাশ হয়: ‘রমরমা হার্টের চিকিৎসাপণ্যের অবৈধ কারবার।’ প্রতিবেদনে কেবল সিন্ডিকেটের কথাই উঠে আসেনি, বরং হৃদরোগের নিম্নমানের চিকিৎসা সরঞ্জাম চোরাচালান চক্রেরও সন্ধান দেওয়া হয়েছে। ভারত থেকে চোরাই পথে পণ্য আনছে চক্রটি। অন্যদিকে দাম কমের কারণে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালও সেগুলো ব্যবহার করছে। অথচ স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়ে তাদের খবর নেই। সরকারও যে বড় অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে, তাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
নিম্নমানের হৃদরোগের চিকিৎসা সরঞ্জামের বাজার যেভাবে বাড়ছে, সেটি নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। হৃদযন্ত্রের মতো শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে এ ধরনের সরঞ্জাম সুস্থতার পরিবর্তে অসুস্থতা দিতে পারে। সে জন্য স্বাস্থ্য প্রশাসনের নজর জরুরি। একই সঙ্গে হৃদরোগের চিকিৎসায় যেভাবে রোগীকে বড় খরচের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়, তাও ভাবা দরকার।
ভুক্তভোগীর অভিজ্ঞতা থেকেই দেখেছি, হৃদযন্ত্রে সামান্য সমস্যা পেলেই কোনো কোনো চিকিৎসক এনজিওগ্রাম করতে বলেন। বেসরকারি হাসপাতালে এ পরীক্ষায় ন্যূনতম ১৫ হাজার টাকা গুনতে হয়। সরকারি হাসপাতালে কিছুটা কম হলেও অন্যান্য ভোগান্তি বলার অপেক্ষা রাখে না। অথচ অনেক সময় সাধারণ ‘ব্লক’ দেখিয়ে রোগীকে রিং পরানো বা সার্জারিতে অনেকটা বাধ্য করা হয়। মৃদু মাত্রার হৃদরোগী কিন্তু খাদ্যাভ্যাস ও জীবন প্রণালি পরিবর্তন করেও সুস্থ থাকতে পারেন। কিন্তু বাস্তবে খরচের পথটাই যেন বিকল্পহীন। ব্যতিক্রমধর্মী চিকিৎসক ও চিকিৎসাকেন্দ্র নিশ্চয় রয়েছে।
সমকালের প্রতিবেদনে যথার্থ অর্থেই তুলে ধরা হয়েছে, ‘রমরমা হার্টের চিকিৎসা’। সমকালের অনুসন্ধানে নিম্নমানের সরঞ্জাম চোরাচালান চক্রের দু’জনের পরিচয় এসেছে। এর সঙ্গে নিশ্চয় আরও অনেকে জড়িত। তারা স্টেন্ট, হৃদরোগ চিকিৎসায় ব্যবহৃত বেলুন, গাইডওয়্যার, ক্যাথেটার, ভাল্ভ, অক্সিজেনেটরসহ নানা সরঞ্জাম অবৈধভাবে আমদানি করছে।
আমাদের স্বাস্থ্য খাত নিয়ে অভিযোগের অন্ত নেই। এখানে নানামুখী সংকট ও শক্তিশালী বিভিন্ন সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে, যার সঙ্গে কোনো কোনো চিকিৎসকও যুক্ত। সরকারি হাসপাতালের অব্যবস্থাপনা কিংবা বেসরকারি হাসপাতালের পাহাড়সম চিকিৎসা ব্যয় তো অনেক বড় বিষয়। সাধারণ ওষুধ নিয়ে যে ধরনের বাণিজ্য দেখা যায়, ওষুধ কোম্পানিগুলো চিকিৎসক ‘ম্যানেজ’ করতে যে ব্যয় করেন বলে অভিযোগ, তা হতাশাজনকই বটে।
সরকার অন্যান্য খাতের মতো স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে এ কমিশন সিন্ডিকেট নিশ্চিহ্ন করাসহ জনমুখী সুপারিশ করবে বলে প্রত্যাশা। এর বাইরে চিকিৎসকদেরও দরদি হওয়া জরুরি।
এমন অনেক চিকিৎসক আমাদের সামনে উদাহরণ ও প্রেরণা হয়ে আছেন। সেই সংখ্যা বাড়াতে না পারলে কেবল সংস্কার দিয়ে স্বাস্থ্য খাত ঠিক করা কঠিন। বিশেষত হৃদরোগের চিকিৎসা হৃদয় দিয়েই করা উচিত। অযথা খরচের হাত থেকে রোগীকে বাঁচালেও সিন্ডিকেট বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণে আসতে পারে। হৃদরোগীদের উচ্চ রক্তচাপ ঝুঁকিপূর্ণ। এর চিকিৎসাও যদি লাগামহীন খরচের পথে ধাবিত হয়, অর্থের চিন্তায় রোগীর রক্তচাপ আরও উচ্চ হতে পারে বৈ কি।
মাহফুজুর রহমান মানিক: জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, সমকাল
mahfuz.
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
মৃত্যু যেখানে রমরমা ব্যবসা হয়ে উঠছে
দক্ষিণ কোরিয়ার বন্দর নগরী বুসানের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে সারিবদ্ধ করে রাখা হয়েছে কফিন। দেশটিতে ভবিষ্যতের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া পরিচালকদের প্রশিক্ষণের জন্য এগুলো প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
দক্ষিণ কোরিয়ায় ব্যাপক জনসংখ্যাগত পরিবর্তনের ফলে মৃত্যুর ব্যবসায় ক্রমবর্ধমান সংখ্যক লোক কাজ খুঁজে পাচ্ছে। কারণ দেশটিতে জন্মহার বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে কম এবং জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকের বয়স ৫০ বা তার বেশি।
বুসান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির শিক্ষার্থীরা ঐতিহ্যবাহী কোরিয়ান অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার কাপড়ে সাবধানে একটি পুতুল জড়িয়ে, কাপড়টিকে আসল চামড়ার উপর মসৃণ করে, তারপর আলতো করে কফিনে নামিয়ে দিচ্ছিল।
অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া প্রশাসনের শিক্ষার্থী ২৭ বছর বয়সী জ্যাং জিন-ইয়ং বলেন, “আমাদের সমাজের বয়স বাড়ার সাথে সাথে, আমি ভেবেছিলাম এই ধরণের কাজের চাহিদা আরো বাড়বে।”
আরেক ছাত্র, ২৩ বছর বয়সী ইম সে-জিন তার দাদীর মৃত্যুর পর মাঠে নামার সিদ্ধান্ত নেয়।
তিনি বলেন, “তার (দাদীর) অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় আমি দেখেছি পরিচালকরা তাকে শেষ বিদায়ের জন্য কতটা সুন্দরভাবে প্রস্তুত করেছেন। আমি গভীর কৃতজ্ঞ বোধ করছি।”
দক্ষিণ কোরিয়ার মানুষ ক্রমশ একাকী জীবনযাপন করছে এবং নিঃসঙ্গ অবস্থায় মারা যাচ্ছে। এশিয়ার চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতির প্রায় ৪২ শতাংশ এখন একাকী জীবনযাপন করে।
এই পরিসংখ্যান দেশটিতে একটি নতুন পেশার আবির্ভাবকে প্রতিফলিত করছে।
উন্নত দেশগুলির মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ায় আত্মহত্যার হার সবচেয়ে বেশি। এই ‘একাকী মৃত্যু’-তে সেইসব ব্যক্তিরাও অন্তর্ভুক্ত যারা আত্মহত্যা করেছেন।
অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ব্যবসায়ের একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি কিম ডু-নিয়ন বলেন, তার ২০ বছর বয়সী ক্রমবর্ধমান সংখ্যক নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মী রয়েছে।
তিনি বলেন, “মানুষ যখন একসাথে থাকে, তখন তারা জিনিসপত্র ভাগ করে নেয়... এমনকি যদি একজন ব্যক্তি মারা যায়, সেই জিনিসপত্রগুলি থেকে যায়। কিন্তু যখন কেউ একা মারা যায়, তখন সবকিছু পরিষ্কার করতে হবে।”
তবে নিজের পেশা নিয়ে ভয়ও পান কিম।
তিনি বলেন, “আমি ভয় পাচ্ছি। আপনি যতই প্রস্তুতি নিন না কেন, একজন মৃত ব্যক্তির মুখোমুখি হওয়া ভীতিকর।”
ঢাকা/শাহেদ