গত ২১ নভেম্বর নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সঙ্গে দেশের সংবাদপত্রগুলোর সম্পাদক ও সিনিয়র সাংবাদিকদের মতবিনিময় সভার অভিজ্ঞতা দিয়ে শুরু করা যাক। সমকালের প্রকাশক ও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের সঙ্গে আমিও ওই সভায় যোগ দিয়েছিলাম। সেখানে একটি টেকসই নির্বাচন ব্যবস্থা গড়ে তোলার উপায় নিয়ে অনেক প্রস্তাবই এসেছিল। এক পর্যায়ে প্রশ্ন ওঠে– বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? যত ভালো সুপারিশই আসুক, দিন শেষে সেগুলো জাতীয় সংসদে পাস হতে হবে, যার এখতিয়ার শুধুই রাজনৈতিক দলের। কিন্তু এ বিষয়ে অভিজ্ঞতা খুব ভালো না। বিশেষ করে নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সরকারগুলোর অঙ্গীকার ভাঙার দুঃখজনক প্রসঙ্গও আলোচনায় আসে। ২০০৭-০৮ সালে ‘ওয়ান ইলেভেন’ সরকারের ব্যর্থ চেষ্টার কথাও স্মরণ করা হয়। 

এবার যেন এত পরিশ্রম বৃথা না যায়, তাই বলা হলো, সবার আগে রাজনৈতিক দলের সংস্কার জরুরি। আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণে ইচ্ছুক রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য এমন কিছু শর্ত রাখতে হবে যেন সংসদে সংস্কার প্রস্তাবগুলোর চূড়ান্ত অনুমোদনে কোনো দল বাধা হয়ে না দাঁড়ায়। কিন্তু সেই শর্তগুলো কী হতে পারে, তা কেউ বলতে পারলেন না। শেষে কমিশনপ্রধান ও অন্য সদস্যরা বললেন, দায়িত্বটা সংবাদমাধ্যমকেই নিতে হবে। তারা যদি সংস্কার প্রস্তাবগুলোর ব্যাপক প্রচার দেয়, তাহলে এগুলোর পক্ষে জনমত প্রবল হবে। তখন সংসদও এগুলো এড়াতে পারবে না।

আমার ধারণা, একই প্রশ্ন অন্যান্য সংস্কার কমিশনকেও ভাবায়; খোদ সরকারও এ নিয়ে চিন্তিত। সে কারণেই গত বিজয় দিবসে প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’ গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন। কমিশনের নেতৃত্বে আছেন প্রধান উপদেষ্টা নিজে; সদস্য থাকবেন প্রথম ধাপে গঠিত ছয় কমিশনের প্রধানরা। ওই ভাষণে যেমনটা বলা হয়েছে, এ কমিশনের কাজ হবে রাজনৈতিক দলসহ সব পক্ষের সঙ্গে মতবিনিময় করা; যেসব বিষয়ে ঐকমত্য স্থাপিত হবে সেগুলো চিহ্নিত করার পাশাপাশি বাস্তবায়নের সুপারিশ করা।

তাতেও কি দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন বিষয়ে আশাবাদী হওয়া যায়? অতি আশাবাদীরাও উত্তরে খুব আস্থার সঙ্গে হ্যাঁ বলতে পারবেন না। ১৯৯০ ও ২০০৭-০৮ পরবর্তী তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা আগেই বলেছি। সাম্প্রতিক কিছু ঘটনাও ভরসা জোগায় না। 

জনপ্রশাসন সংস্কার-বিষয়ক কমিশনপ্রধান সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বললেন, তারা প্রশাসনের নীতনির্ধারণী পর্যায়ে সব ক্যাডারের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে চান। এ জন্য উপসচিব পদে প্রশাসন ক্যাডারের বাইরের কর্মকর্তাদের জন্য বিদ্যমান ২৫ শতাংশ কোটা বাড়িয়ে ৫০ শতাংশ করার সুপারিশ দেবেন। অমনি বিদ্যমান প্রশাসনিক ব্যবস্থার মূল অংশীজন বা সুবিধাভোগী প্রশাসন ক্যাডারের চাকরিরত ও অবসরপ্রাপ্ত সদস্যরা রীতিমতো রে রে করে তেড়ে এলেন। এমনকি কমিশনপ্রধান তাদের স্বগোত্রীয় হওয়ার পরও তাঁর আশু অপসারণ চাইলেন তারা। 

৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর আমলারা নিজেদের ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী’ বলে গলা ফাটালেও, বাস্তবে বরাবরই সরকারের আদেশ-নির্দেশ মেনে এসেছেন– নির্বাচিত বা অনির্বাচিত যা-ই হোক। এখনও তারা তা করতে বাধ্য। কিন্তু সেই আমলারাও যখন মৌরসি পাট্টা হারানোর ভয়ে গোটা সংস্কার প্রক্রিয়াকেই ভন্ডুল করতে উদ্যত, তখন দলীয় সরকার নির্বাচিত হওয়ার পর সব জবাবদিহির ঊর্ধ্বে চলে যাওয়ার বিদ্যমান সুবিধা কেন যেচে বিসর্জন দেবে?

সম্ভবত এরই সমাধান হিসেবে অনেকে বলছেন, জনগণ তো নির্বাচনের জন্য ‘পাগল’ হয়ে যায়নি। নির্বাচনের আগেই প্রচলিত ধারার রাজনীতিতে আমূল সংস্কার আনতে হবে। সম্প্রতি রাজধানীতে অনুষ্ঠিত ঐক্য সংস্কার ও নির্বাচন-বিষয়ক জাতীয় সংলাপে নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.

) সাখাওয়াত হোসেনও বলেছেন, এ সময়ে রাষ্ট্রের কিছু সংস্কার করতে না পারলে আর কখনোই করা যাবে না। নির্বাচনের আগে প্রচলিত ধারার রাজনীতিতে আমূল সংস্কার আনতে হবে (সমকাল অনলাইন, ২৮ ডিসেম্বর, ২০২৪)। মোদ্দাকথা, যা করার এখনই করতে হবে। ‘যা’ বোঝাতে এক মার্কিন র‍্যাপারের অ্যালবামের শিরোনাম ধার করে বেশ নাটকীয় ভঙ্গিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারাও বলেছেন, নাউ অর নেভার।

কথা হচ্ছে, অংশীজনের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে কোনো কিছু চাপিয়ে দিলে তা টেকসই হয় না– গত ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত সরকারের সব ব্যবস্থা তছনছ হওয়াই তার প্রমাণ। একই ভুল কি আবারও হবে? জনমতের দোহাই সব শাসকই দেয়। কিন্তু আসল জনমত প্রকাশ পায় সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনে। সেই নির্বাচনকে দীর্ঘ অপেক্ষায় রাখবে যে সরকার, তার কর্মকাণ্ড জনতার দরবারে ভালো মূল্যায়ন পাবে?

বিশ্বের যে দেশগুলোতে অন্তত কার্যকর গণতান্ত্রিক শাসন আছে বলে ধরে নেওয়া হয়, সেগুলোর রাজনৈতিক ইতিহাসও কিন্তু এমন ধারার সংস্কারের উদাহরণ তুলে ধরে না। দুনিয়া কাঁপানো ফরাসি বিপ্লব শুধু দেশটির জনগণকে গণতন্ত্রের স্বাদই দেয়নি; ইংল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্রসহ বহু দেশের গণতান্ত্রিক সংস্কারের মানদণ্ড স্থাপন করেছিল। ১৭৮৯ সালের সেই ফরাসি বিপ্লবই কি ফ্রান্সের জন্য শেষ কথা ছিল? বস্তুত, এর প্রায় দু’শ বছর পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির দখল থেকে ফ্রান্সকে মুক্তকারী ফরাসি সেনা কর্মকর্তা শার্ল দ্য গলের নেতৃত্বেই দেশটিতে স্থায়ী একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। যুক্তরাজ্যেও জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী হাউস অব কমন্স আজকের পর্যায়ে আসতে প্রায় হাজার বছর লেগেছে। ১২১৫ সালে বিখ্যাত ম্যাগনাকার্টা পেশের পর লর্ড, নাইট প্রভৃতি উপাধিপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের নিয়ে হাউস অব লর্ড প্রতিষ্ঠিত হলেও আমজনতার সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল না। আবার হাউস অব কমন্স চতুর্দশ শতকে প্রতিষ্ঠিত হলেও রাজার কর্তৃত্বের বাইরে আসে সপ্তদশ শতকে, যখন সেখানে বিখ্যাত বিল অব রাইটস পাস হয়। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতেও আছে গৃহযুদ্ধসহ বহু রক্তপাতের ঘটনা। তিন দেশের ক্ষেত্রেই রাজনীতির উন্নয়নে অর্থনীতিসহ সামাজিক-সাংস্কৃতিক উন্নতিরও অবদান অভাবনীয়।

অনস্বীকার্য, বারবার রক্ত ঝরানো ঘটনা কোনো উন্নতিকামী রাষ্ট্রের জন্যই কাঙ্ক্ষিত নয়। আবার রাজনীতিকে তার মতো এগোতে না দিয়ে বিশেষত অসাংবিধানিক পন্থা বেছে নিলে তা রাজনৈতিক ব্যবস্থার কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনে সহায়ক হয়– এমন প্রমাণও সমসাময়িক বিশ্বে নেই। রাজনৈতিক দলগুলো তো অন্ধ বা বধির নয়। ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের বার্তা নিশ্চয় তারা কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছে। জনগণ অতিষ্ঠ হলে অতি জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতারও পরিণতি কী হয়, তার উদাহরণ এখানেই আছে। আবার জনগণের মধ্যে তাগিদ থাকলে নতুন রাজনৈতিক দল যে জন্ম দেবে না– তাই-বা কে বলতে পারে! ফলে সামনের দিনের রাজনীতি নিয়ে অতি উচ্চাশার যেমন সুযোগ নেই, তেমনি পুরোপুরি ৫ আগস্টের আগের ধারায় ফিরে যাবে না– এমন আশাবাদও রাখা যায়।

সাইফুর রহমান তপন: সহকারী সম্পাদক, সমকাল

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র গণঅভ য ত থ ন ৫ আগস ট র ক ব যবস থ র র জন ত র জন য সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

বন্দরে বিএনপি নেতা তাওলাদের উপর হামলাকারীদের গ্রেপ্তারে আল্টিমেটাম

বন্দর উপজেলা বিএনপি নেতা তাওলাদ মাহমুদকে প্রকাশ্য দিবালোকে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির দোসরা হামলা চালিয়ে মারাত্মকভাবে আহত করেছে।

সে ঘটনা মামলা করা হলো এখনো বন্দর থানা পুলিশ ঘটনার সাথে জড়িত মূল হোতাদেরকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। ঘটনার সাথে জড়িত হামলাকারীদের আগামী ৭২ঘন্টার মধ্যে গ্রেপ্তারের আল্টিমেটাম দিয়েছে বন্দর উপজেলা বিএনপি।

‎শনিবার ( ১ নভেম্বর) সকালে মদনপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে বন্দর উপজেলা বিএনপির সভাপতি মাজহারুল ইসলাম হিরণ ও সাধারণ সম্পাদক হারুন অর রশিদ লিটন তাওলাদ মাহমুদের উপর নৃশংস হামলার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে আগামী ৭২ ঘন্টার মধ্যে হামলার সাথে জড়িত আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির দোসরদের গ্রেপ্তারের এই দাবি জানান।

‎সংবাদ সংবাদ সম্মেলনে তারা বলেন, ফ্যাসিস শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেল কিন্তু তার দোসরা এখনো রয়ে গেছে। মুছাপুর ইউনিয়ন তথা বন্দর উপজেলার বিএনপি’র নেতা-কর্মীরা দীর্ঘ ১৭টি বছর  আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির দোসর দ্বারা নির্যাতিত হয়েছিল। 

এখনো আওয়ামী লীগের দোষরদের দ্বারা বিএনপি নেতা কর্মীরা নির্যাতিত হবে এটা খুবই দুঃখজনক। ৫ তারিখের পরও কিন্তু তারা আত্মগোপনে ছিল। কিন্তু কতিপয় কিছু নেতা ও প্রশাসনের কারণে তারা এখনো আবারো প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

তারা আবারও নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের জন্য বিএনপি নেতাকর্মী ও নিরীহ জনগণের উপর হামলা চালাচ্ছে।

‎তারা আরও বলেন, তাওলাদ মাহমুদ উপর হামলার ঘটনায় মামলাআওয়ামী লীগে ও জাতীয় পার্টির দোসরদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এছাড়াও বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন ঘটনায় মামলাসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক মামলা রয়েছে। কিন্তু বন্দর থানা পুলিশ প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপে নিচ্ছে না। 

ফলে প্রতিনিয়ত তারা হামলা মামলা নির্যাতন সহকারে বিভিন্ন অপরাধ করে বেড়াচ্ছ । মুছাপুরের জনগণ তাদের হাত থেকে মুক্তি চায়। অবিলম্বে বিএনপি নেতা তাওলাত মাহমুদের ঘটনার সাথে জড়িত সকল আসামীদের গ্রেপ্তারের ৭২ ঘণ্টার জন্য পুলিশ প্রশাসনকে সব সময় বেঁধে দিলাম আমরা উপজেলা বিএনপি।

যদি আগামী ৭২ ঘণ্টার মাধ্যমে তাওলাদ মাহমুদের উপর হামলাকারী মূল হোতাদেরকে গ্রেফতার করা না হয় তাহলে আমরা কঠোর থেকে কঠোরতর পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবো। তার জন্য কিন্তু সকল দায়ভার পুলিশ প্রশাসনকেই নিতে হবে।
 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • জনগণের সহজে ভূমিসেবা নিশ্চিত করতে হবে: সিনিয়র সচিব
  • অবিলম্বে গণভোটের দাবি চাকসুর
  • বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে 
  • ক্ষমতার লোভে কেউ কেউ ধর্মকে ব্যবহার করছে: আব্দুস সালাম
  • উজানে বাঁধ ও জলবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে মারাত্মক সংকটে তিস্তা নদী
  • ভুল শুধরে জনগণের আস্থা ফেরানোর সুযোগ এই নির্বাচন: আইজিপি
  • ইরান পারমাণবিক স্থাপনাগুলো আরো শক্তিশালী করে পুনর্নির্মাণ করবে
  • জ্বালানি সুবিচার নিশ্চিতে সংগ্রাম, শপথ যুব সংসদের সদস্যদের
  • বন্দরে বিএনপি নেতা তাওলাদের উপর হামলাকারীদের গ্রেপ্তারে আল্টিমেটাম
  • রূপগঞ্জে ৩১ দফা বাস্তবায়নের লক্ষে লিফলেট বিতরণ