ঋণখেলাপি মামলার জালে জাহাজভাঙা শিল্পের মালিক
Published: 18th, January 2025 GMT
সীতাকুণ্ডে জাহাজভাঙা শিল্পে একের পর এক মালিক ঋণখেলাপির তালিকায় নাম উঠাচ্ছেন । গত এক দশকে অর্ধশতাধিক মালিক ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ না করায় মামলার আসামি হয়েছেন। একাধিক মালিক অর্থঋণ আদালতে ব্যাংকের দায়ের হওয়া মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে জেলহাজতে আছেন। অনেকে রয়েছেন আত্মগোপনে। আবার এ শিল্পে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীরা ব্যবসার পরিধি বাড়িয়ে তাদের ইয়ার্ডকে গ্রিন শিপইয়ার্ডে রূপান্তর করেছেন। নিয়মিত স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি করে কাটিং অব্যাহত রাখছেন। তবে ৫ আগস্টের পর ১০টির বেশি জাহাজভাঙা কারখানায় লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। বর্তমানে ওই জাহাজভাঙা কারখানাগুলোর কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। লুটপাটের ঘটনার পর দ্রুত পদক্ষেপ না নেওয়ায় আক্রান্ত কারখানাগুলো সচল হচ্ছে না। এতে এসব কারখানার মালিকরাও ঋণখেলাপি হতে পারেন বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তবে জাহাজভাঙা কারখানার মালিকরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দাবি করেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকার জাহাজভাঙা কারখানাকে শিল্পের মর্যাদা দিলেও পরিকল্পিত শিল্প গড়ে তুলতে সহযোগিতা করেনি। ফলে এই শিল্প থেকে প্রতি বছর দেড় থেকে দুই হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করা হলেও এই শিল্প ছিল অবহেলিত।
জাহাজভাঙা কারখানায় অফিস সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সীতাকুণ্ডের বিভিন্ন ইয়ার্ডে ৯ লাখ ৫৯ হাজার ৭৬৯ মেট্রিক টন ওজনের ১৬৩টি স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি করা হলেও চলতি বছরে নানা জটিলতায় অর্ধেকও আমদানি হয়নি।
গত ১৩ জানুয়ারি আত্মগোপনে থাকা রুবাইয়া ভেজিটেবল অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের এমডি ও শিপব্রেকার্স শিল্পপতি হারুন অর রশিদকে ঢাকা থেকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। গত সোমবার দুটি চেকের মামলায় চট্টগ্রামের অতিরিক্ত মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সরকার হাসান শাহরিয়ারের আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
এর আগে দুটি চেকের মামলার পরোয়ানামূলে পুলিশ হারুন অর রশিদকে আদালতে উপস্থিত করা হয়। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে তা আত্মসাতের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে রয়েছে একাধিক মামলা। ওই মামলাগুলোয় আসামি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান তার স্ত্রী আনজুমান আরা বেগম ও পরিচালক ছেলে হাসনাইন হারুন। তাদের বিরুদ্ধেও রয়েছে একাধিক মামলা।
একইভাবে অর্থঋণ আদালতে মামলা সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে আছেন তানিয়া শিপব্রেকার্সের মালিক আবুল কালাম হাবিবসহ একাধিক শিপব্রেকার্স। ঋণখেলাপি মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামি হয়ে আত্মগোপনে রয়েছে ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন কুসুম, দিদারুল আলম, সিরাজদ্দৌলাসহ একাধিক জাহাজভাঙা কারখানার মালিক। তবে গিয়াস উদ্দিনের ভাইয়ের দাবি, তাকে অপরহণ করা হয়েছে। তার সন্ধান এখনও মেলেনি। কুসুমের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান নিলামে বেচাবিক্রিও হয়েছে।
জানা গেছে, নব্বইয়ের দশকে দেড় শতাধিক শিপব্রেকিং কারখান ছিল চাঙ্গা। বিদেশ থেকে আনা স্ক্র্যাপ জাহাজগুলোয় লাখো শ্রমিক কাটিংয়ের কাজ করতেন। স্ক্র্যাপ জাহাজের আউটফিটিং মালামালগুলো ক্রয় করতে ভিড় করতেন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা ব্যবসায়ীরা। কিন্তু গত এক দশকে দেশে অর্থনীতির মন্দাভাবে এ ব্যবসায় নেমে আসে ধস। বর্তমানে ছোট-বড় ১৫ থেকে ২০টি শিপইয়ার্ডে কার্যক্রম চালু রয়েছে। জাহাজভাঙা কারখানা কমে আসায় বেকার হয়েছেন হাজার হাজার শ্রমিক।
চট্টগ্রাম আদালতের বেঞ্চ সহকারী মো.
বেঞ্চ সহকারী আরও বলেন, ‘হারুন অর রশিদের বিরুদ্ধে অনেক মামলা রয়েছে। এরমধ্যে কয়েকটি মামলায় তার সাজা হয়েছে। অনেক মামলা বিচারাধীন রয়েছে। আমাদের কোর্টে দুটি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। আমাদের কোর্টে থাকা চেকের মামলা দুটি গত মে মাসে নগরীর বাদামতলী এলাকার আলম স্টিল করপোরেশনের পক্ষ থেকে দায়ের করা হয়।’
আদালত সূত্র জানায়, হারুন অর রশিদের বিরুদ্ধে সব মিলিয়ে খেলাপিসহ নানা অভিযোগে ৪৫টির মতো মামলা রয়েছে। এর মধ্যে ৩০টির মতো মামলায় তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে। ১৩টি ব্যাংক থেকে হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। চট্টগ্রামের অর্থঋণ আদালতেও তার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা বিচারাধীন।
আদালত সূত্র জানায়, গত ১২ জানুয়ারি ঢাকার মতিঝিল থানা পুলিশ হারুন অর রশিদকে গ্রেপ্তার করে। পরে নগরীর ডবলমুরিং ও হালিশহর থানা
পুলিশের কাছে তাকে হস্তান্তর করা হয়। মতিঝিলের দিলকুশা এলাকায় আত্মগোপনে ছিলেন তিনি। এর আগেও ২০১৯ সালে হারুন অর রশিদকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে জামিনে গিয়ে পলাতক হয়ে পড়ে। রুবাইয়া ভেজিটেবল অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ছাড়ড়াও হারুন অর রশিদের প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে–এইচ স্টিল রি–রোলিং মিলস লিমিটেড, ন্যাশনাল আয়রন অ্যান্ড স্টিল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, রুবাইয়া প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, চিটাগাং ইস্পাত লিমিটেড ও আমানত স্টিল লিমিটেড। ডবলমুরিং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী রফিক আহমেদ বলেন, মতিঝিল থানা পুলিশ হারুন অর রশিদকে আমাদের কাছে হস্তান্তর করেছে।
তবে এর আগে হারুন-উর রশিদ সমকালকে বলেছিলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা, শিপইয়ার্ড ব্যবসায় মন্দা ও করোনার কারণে ব্যবসায় ব্যাপক লোকসান দিয়েছেন তিনি। কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর ভুলের কারণেও তাঁর ক্ষতি হয়েছে। রুবাইয়া ভেজিটেবলেই প্রায় ৪০০ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। তবে করোনার আগে সাউথইস্ট ব্যাংকের ৭০ কোটি টাকা ও জনতা ব্যাংকের ৭৩ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতপশিল করেছেন। কিন্তু করোনার কারণে আবারও খেলাপি হয়ে গেছেন তিনি।
সীতাকুণ্ডের কদমরসুল এলাকায় রুবাইয়া ভেজিটেবল অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ তালাবদ্ধ প্রায় দশ বছর ধরে। মাঝে কিছুদিন খুললেও দারোয়ান ছাড়া কারখানায় কেউ নেই। এটিই ব্যবসায়ী হারুনের ঋণ নেওয়ার প্রধান প্রতিষ্ঠান। আশির দশকে জাহাজভাঙা শিল্পের মাধ্যমে তাঁর ব্যবসায় উত্থান। ২০০২ সালে তিনি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে গড়ে তোলেন ভোজ্যতেল পরিশোধনাগার রুবাইয়া ভেজিটেবল অয়েল। প্রতিষ্ঠার পর কয়েক বছর ব্যবসা ভালো হলেও পরে ক্রমশ লোকসান দিতে থাকে রুবাইয়া ভেজিটেবল। ২০১৪ সালের শেষ দিকে এ কারখানা বন্ধ করে দেন তিনি।
সাউথইস্ট ব্যাংকের পাহাড়তলী শাখার ১৪২ কোটি ৮৭ লাখ ৩২ হাজার টাকা ঋণখেলাপির অভিযোগে করা একটি মামলায় রুবাইয়া ভেজিটেবল অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. হারুন-উর রশিদ, চেয়ারম্যান আনজুমান আরা বেগম ও পরিচালক হাসনাইন হারুনকে ২০২১ সালে ৫ মাসের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। এছাড়া দেওয়ানি আটকাদেশ কার্যকর করার জন্য অর্থঋণ আইনের ৩৫ ধারা অনুযায়ী তাঁদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। চট্টগ্রামের অর্থঋণ আদালত এ আদেশ দেন। ২০২১ সালের ২৫ অক্টোবর এনসিসি ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখার পৃথক আরেকটি মামলায় মা-বাবা ও ছেলের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত। ২৫ কোটি ১৮ লাখ ৭৬ হাজার টাকা ঋণখেলাপির মামলায় অর্থঋণ আদালত এ আদেশ দেন। ২০১৪ সালে দায়ের হওয়া চেক প্রতারণার দুটি মামলায়ও সাজাপ্রাপ্ত হন হারুন-উর রশিদ। আদালত একটি মামলায় তাঁকে এক বছর কারাদণ্ড ও ৫ কোটি টাকা জরিমানা করেন। অন্য মামলায় আদালত তাঁকে এক বছর কারাদণ্ড ও ৪ কোটি ৪৩ লাখ টাকা জরিমানা করেন।
হুমায়ুন কবির নামে এক ব্যক্তির দায়ের করা মামলায় ২০১৯ সালে একবার গ্রেপ্তার হন হারুন-উর রশিদ। আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় তাঁকে তখন গ্রেপ্তার করা হয় ঢাকার ধানমন্ডি এলাকা থেকে। তখন জামিনে বের হয়ে কিছু ব্যাংকের ঋণ পুনঃতপশিল করেন তিনি। কিন্তু ঋণের তুলনায় এটি নগণ্য হলেও কিছু ব্যাংক তাঁকে আবার ঋণ দিয়েছে। এখন নতুন পুরোনো সব ব্যাংকই আছে বেকায়দায়। এছাড়া ছেলে হাসনাইন হারুনকে চেক প্রতারণার একটি মামলায় ২০২১ সালে ১২ ডিসেম্বর গ্রেপ্তার করে হালিশহর থানা পুলিশ। পুলিশ জানিয়েছে, তাঁর বিরুদ্ধে ১১টি সাজা পরোয়ানা এবং ২৪টি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছিলো। তাছাড়া আরও ২৪টি মামলার বিচার চলছে।
বাংলাদেশ শিপব্রেকার্স এন্ড রিসাইক্লার্স এসোসিয়েশন ( বিএসবিআরএ) সভাপতি মোহাম্মদ আবু তাহের বলেন, অর্থনৈতিক মন্দার কারণে ও ডলার সংকটের কয়েকটি ইয়ার্ডে জাহাজ আমদারি কমে গেছে। পরিস্থিতি স্বভাবিক হলে পুরো দমে কাযক্রম চলবে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ঋণখ ল প গ র প ত র কর ঋণখ ল প ব যবস য় পর য় ন এক ধ ক
এছাড়াও পড়ুন:
ক্রিকেটার নাসির ও তামিমার মামলায় শুনানিতে আদালত বিব্রত
তালাক যথাযথভাবে হয়নি জেনেও তামিমা সুলতানাকে বিয়ের অভিযোগে করা মামলার শুনানিতে বিব্রত হয়ে মামলার নথি চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বরাবর পাঠিয়েছেন একই আদালতের অ্যাডিশনাল চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ওয়াহিদুজ্জামান। ঢাকার সিএমএম আদালতে আজ সোমবার এ ঘটনা ঘটে।
প্রথম আলোকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন বাদীপক্ষের আইনজীবী ইশরাত হাসান ও বিবাদীপক্ষের আইনজীবী আজিজুর রহমান।
২০২১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর উত্তরার একটি রেস্তোরাঁয় নাসির ও তামিমার বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। এরপর নতুন করে বিতর্ক ওঠে এই ক্রিকেটারকে ঘিরে। তামিমা তাঁর আগের স্বামীকে তালাক না দিয়ে নাসিরকে বিয়ে করেছেন বলে অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় তামিমা ও নাসিরের বিরুদ্ধে ২০২১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি মামলা করেন তামিমার আগের স্বামী রাকিব হাসান।
এ মামলায় নাসির ও তামিমার বিরুদ্ধে ২০২২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি অভিযোগ গঠন করেন আদালত। আর ২০২১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর দুই আসামির বিরুদ্ধে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
আজ বাদীপক্ষের আইনজীবী ইশরাত হাসান প্রথম আলোকে বলেন, তালাক যথাযথভাবে হয়নি জেনেও তামিমা সুলতানাকে বিয়ের অভিযোগে করা মামলায় আজ আসামিপক্ষের আত্মপক্ষ সমর্থনের শুনানির দিন ধার্য ছিল। তবে আসামিপক্ষের আইনজীবী এক দরখাস্ত দিয়ে আদালতকে বলেন, বিচারাধীন বিষয় নিয়ে বাদীপক্ষের আইনজীবী (তিনি) মন্তব্য করেছেন, যা আদালত অবমাননার শামিল।
আইনজীবী ইশরাত হাসান প্রথম আলোকে আরও বলেন, তিনি বিবাদীপক্ষের আইনজীবীদের বিষয়ে আদালতকে বলেছেন, বিবাদীপক্ষের আইনজীবী একসময় বাদীপক্ষের আইনজীবী হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। এটিকে পেশাগত অসদাচরণ বলে মনে করেন তিনি।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ক্রিকেটার নাসিরের আইনজীবী আজিজুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেছেন, ১৬ এপ্রিল এ মামলায় বাদীপক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়। পরে বাদীপক্ষের আইনজীবী ইশরাত হাসান গণমাধ্যমে তামিমাকে জড়িয়ে নাসিরকে নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন। মামলার বিচার নিষ্পত্তি হওয়ার আগে এ ধরনের মন্তব্য আদালত অবমাননার শামিল। আদালত অবমাননার লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি বিচারের এখতিয়ার সুপ্রিম কোর্টের। আদালত অবমাননার আবেদনটি সুপ্রিম কোর্টে পাঠিয়ে দিতে অনুরোধ জানান।
আইনজীবী আজিজুর রহমান আরও বলেন, তিনি কোনো পেশাগত অসদাচরণ করেননি। আদালত মামলার শুনানিতে বিব্রত বোধ করেন।