চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে আগে প্রতি মাসে অন্তত একটি নাটক হলেও মঞ্চায়িত হতো। শীত-বসন্তসহ বিভিন্ন উৎসব মৌসুমে হতো নাট্য উৎসবসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কার্যক্রম। গত মে মাসেও পাঁচটি ও জুনে এখানে চারটি নাটক মঞ্চায়িত হয়েছে। গত ৫ আগস্ট ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর যেন ভিন্ন চিত্র দেখা যাচ্ছে। নাটক মঞ্চায়ন যেমন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কমেছে, তেমনি কমেছে অন্যান্য সাংস্কৃতিক কার্যক্রমও। আগস্ট-পরবর্তী সময়ে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত শিল্পকলা একাডেমিতে মঞ্চায়িত হয়েছে মাত্র চারটি নাটক। এর মধ্যে সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও ডিসেম্বর মাসে কোনো নাটকই মঞ্চায়িত হয়নি।

জেলা শিল্পকলা একাডেমি সূত্র বলছে, গত বছরের অক্টোবর পর্যন্ত সেখানে সংগীত, নৃত্য, নাটক মিলে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়েছে প্রায় ৪৫টি। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ৫টি, ফেব্রুয়ারিতে ৪টি, মার্চে একটি, এপ্রিলে ২টি, মে মাসে ১০টি, জুনে ৬টি, জুলাই ও আগস্টে ৩টি, সেপ্টেম্বরে ৫টি ও অক্টোবরে ৮টি সংগীত, নৃত্য ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়েছে। নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে হয়েছে ১২টি সংগীত, নৃত্য ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ফেব্রুয়ারিতে তিনটি চিত্র প্রদর্শনী আয়োজন করেছিল প্রিয়প্রাঙ্গণ, শিল্পী শুভাশীষ ও চট্টগ্রাম আর্ট স্কুল। মার্চ মাসে স্কেচ গ্যালারি ও শিল্পী রিগানের চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন হয়। গত অক্টোবরে ইসলামী ছাত্রশিবির সেখানে আয়োজন করে আলোকচিত্র প্রদর্শনী। নভেম্বর মাসে দুটি ও ডিসেম্বর মাসে তিনটি চিত্র প্রদর্শনী হয়েছে। 

অভিন্ন চিত্র দেখা যাচ্ছে চট্টগ্রাম থিয়েটার ইনস্টিটিউটেও। আগস্ট-পূর্ববর্তী ছয় মাসে সেখানে ১৫টি নাটক মঞ্চায়িত হলেও পরের ছয় মাসে হয়েছে মাত্র ৪টি। উচ্চাঙ্গ, রবীন্দ্র, নজরুল এবং লালনভিত্তিক বিভিন্ন সংগীতের অনুষ্ঠান নিয়মিতই হতো থিয়েটার ইনস্টিটিউটে। ৫ আগস্টের পরে সেই চিত্র একেবারে বিপরীত। চট্টগ্রামের উল্লেখযোগ্য নাট্যদল তীর্যক, নান্দিকার, মঞ্চমুকুট, কথক নাট্য সম্প্রদায়, অনন্য, অরিন্দমসহ সক্রিয় সংগঠনগুলোকে গত পাঁচ মাসে নাটক মঞ্চায়ন করতে দেখা যায়নি থিয়েটার ইনস্টিটিউটে।

থিয়েটার ইনস্টিটিউটে ক্ল্যাসিক্যাল, উচ্চাঙ্গ সংগীত, রবীন্দ্র ও নজরুল এবং লালনভিত্তিক বিভিন্ন সংগীতের অনুষ্ঠানও আয়োজিত হয়ে থাকে। গত বছরের প্রথম তিন মাসে সেখানে পাঁচটি সংগীতানুষ্ঠান হয়েছে। অন্যদিকে এপ্রিল, মে ও জুন মাসে হয়েছে প্রায় ২০টি সংগীতানুষ্ঠান।

রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে জুলাই, আগস্ট মাসে কোনো সংগীতানুষ্ঠান হয়নি। সেপ্টেম্বরে একটি, অক্টোবরে তিনটি, নভেম্বরে তিনটি ও ডিসেম্বরে পাঁচটি সংগীতভিত্তিক অনুষ্ঠান হয়েছে। 

অক্টোবরের রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে অনুষ্ঠান 
আয়োজিত হলেও, লালনভিত্তিক কোনো অনুষ্ঠান হয়নি। সাধারণত অক্টোবর, নভেম্বর ও  ডিসেম্বরে এখানে লালনভিত্তিক সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন হয়ে থাকে।
শুধু নগরী নয়; চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) এক বছরের অনুষ্ঠান তালিকা পর্যালোচনা  করেও পাওয়া গেছে এমন চিত্র। মঞ্চ নাটক,  নৃত্য ও সংগীতের মতো অনুষ্ঠানের সংখ্যা  সেখানেও কমে গেছে। বেড়েছে সভা-সেমিনার। আবার বিশ্ববিদ্যালয় ও নগরীতে এতদিন যারা নিয়মিত অনুষ্ঠান করেছে তাদের উপস্থিতিও এখন কমে এসেছে। 
জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাংস্কৃতিক কর্মকর্তা মোসলেম উদ্দিন বলেন, ‘বছরের এই সময়ে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো যে পরিমাণ সক্রিয় থাকত, এ বছর তার ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে। নিয়মিত যারা অনুষ্ঠান করত তাদের অনেকে এখন নিষ্ক্রিয়। দেশের সার্বিক পরিস্থিতির কারণে তাদের সক্রিয় হতে হয়তো সময় লাগছে।’

থিয়েটার ইনস্টিটিউটের শৈল্পিক পরিচালক আহমেদ ইকবাল হায়দার বলেন, ‘রাজনৈতিক অস্থিরতার একটা প্রভাব আছে সর্বত্র। আমার উপলদ্ধি বলছে, করোনা-পরবর্তী সময় থেকেই নাটক মঞ্চায়নের সংখ্যা কমেছে। নতুনদের মধ্যে আমরা আগ্রহ তৈরি করতে পারছি না ঠিকভাবে। এটির নানা কারণও রয়েছে।’ রাজনৈতিক পরিস্থিতি যত স্থিতিশীল হবে সংস্কৃতির অঙ্গন তত মুখর হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

বেড়েছে আবৃত্তি ও সভা-সেমিনার
থিয়েটার ইনস্টিটিউটের অনুষ্ঠানের তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে আবৃত্তি অনুষ্ঠানের আয়োজন বেড়েছে। এই দুই মাসে তিনটি করে আবৃত্তি অনুষ্ঠান হয়েছে। এছাড়া জানুয়ারি মাসে দুটি, ফেব্রুয়ারি ও সেপ্টেম্বর মাসে একটি করে আবৃত্তি অনুষ্ঠান হয়। সাধারণত শীত মৌসুমে নানা সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের জন্য শিল্পকলা একাডেমি, থিয়েটার ইনস্টিটিউটের হলগুলো সভা-সেমিনারের জন্য পাওয়া কঠিন হতো। সাংস্কৃতিক কার্যক্রম কমে যাওয়ায় সেখানে সভা-সেমিনারের সংখ্যা বেড়েছে।

আগে মাসে সাধারণত পাঁচ থেকে ছয়টি আলোচনা সভা হতো থিয়েটার ইনস্টিটিউটে। অক্টোবর থেকে এখানে সাত থেকে দশটি আলোচনা সভা হয়েছে প্রতি মাসে। 

সরব হওয়ার প্রহর গুনছে চবির সাংস্কৃতিক অঙ্গন
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে হঠাৎ করে অধিকাংশ সাংস্কৃতিক সংগঠন যেন থেকেও নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, আবৃত্তি মঞ্চ, অঙ্গন, উত্তরায়ণ সাহিত্য-সংস্কৃতি পরিষদ, বারোমাসি, লোকজ সাংস্কৃতিক সংগঠন, রঁদেভু শিল্পীগোষ্ঠী, আবৃত্তি সংসদ, ভিন্নষড়জসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন রয়েছে। এসব সংগঠনের মধ্যে পাঁচটি জোট গঠন করলেও বাকিগুলো আলাদাভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করে। সংগঠনগুলোর কার্যক্রম নিয়ে তাদের নেতারা বলেছেন, অতীতে সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় যেভাবে সরব ছিল, তা গত দশ বছরে কমে গেছে। আগস্টের পর আরও কমেছে কার্যক্রম। বিশ্বদ্যালয়ের স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক দল বারোমাসির প্রতিনিধি সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমরা কিছুটা ভিন্নধর্মী সাংস্কৃতিক আয়োজন নিয়ে সরব আছি। প্রশাসনের সহায়তা পেলে আরও সরব হবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।’

উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক পার্থপ্রতিম মহাজন বলেন, ‘সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর মধ্যেও বিভাজন আছে। আমাদের পরস্পরকে আরও একত্র হতে হবে। পাঁচ আগস্টের আগেও আমরা অনেক বাধা মোকাবিলা করেছি; এখনও করতে হচ্ছে। আমাদের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া কম থাকার কারণে কিছু সংগঠন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।’ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে সহযোগিতা পেলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক অঙ্গন আরও সরব হয়ে উঠতে পারবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: স ক ত ক স গঠন ন ষ ঠ ন হয় ছ শ ল পকল এক ড ম আগস ট বছর র

এছাড়াও পড়ুন:

যে পরিকল্পনায় এগোচ্ছে ছাত্রসংগঠনগুলো, প্রার্থী হিসেবে আলোচনায় যাঁরা

গণ-অভ্যুত্থানের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন হতে যাচ্ছে। ছয় বছর আগে সর্বশেষ ডাকসু নির্বাচনে বেশির ভাগ পদে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের (বর্তমানে নিষিদ্ধ) প্যানেল থেকে জয় পেলেও সহসভাপতির (ভিপি) পদে জয়ী হয়েছিলেন কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা নুরুল হক নূর।

সেই কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকেই গত বছর বাংলাদেশে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হয়। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে পতন ঘটে আওয়ামী লীগের প্রায় ১৬ বছরের শাসনের। এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের একটি অংশ এখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তাঁরা বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের নেতৃত্বে আছেন। তাই নতুন এই বাস্তবতায় ডাকসু নির্বাচনে কোন কোন ছাত্রসংগঠনের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পারে এবং কারা সম্ভাব্য প্রার্থী, তা নিয়ে ক্যাম্পাসের রাজনীতিসচেতন শিক্ষার্থীদের কৌতূহল রয়েছে।

গতকাল মঙ্গলবার এ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, আগামী ১৯ আগস্ট পর্যন্ত মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া যাবে। প্রার্থীদের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হবে ২৫ আগস্ট। আর ভোট গ্রহণ হবে ৯ সেপ্টেম্বর।

থাকছে না বয়সের বাধা

সর্বশেষ ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০১৯ সালে। ২৮ বছর পর অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনে প্রার্থীর সর্বোচ্চ বয়স ছিল ৩০ বছর। তবে আসন্ন ডাকসু নির্বাচনে প্রার্থীর সর্বোচ্চ বয়সসীমা তুলে দেওয়া হয়েছে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণকালীন শিক্ষার্থী হলেই নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া যাবে।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তমতে, এবারের নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না সান্ধ্যকালীন কোর্সের শিক্ষার্থীরা। ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে ভোটার ও প্রার্থী হতে হলে শিক্ষার্থীকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণকালীন শিক্ষার্থী হতে হবে, যিনি ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে স্নাতক প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়ে স্নাতক, স্নাতকোত্তর বা এমফিলে অধ্যয়নরত এবং কোনো আবাসিক হলে অবস্থানরত বা সংযুক্ত।

এ ছাড়া সান্ধ্যকালীন কোর্সের পাশাপাশি পেশাদার বা এক্সিকিউটিভ মাস্টার্স, ডিপ্লোমা, সার্টিফিকেট ও ভাষা কোর্সে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরাও ভোটার বা প্রার্থী হওয়ার যোগ্য হবেন না। একইভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ও সংযুক্ত কলেজ বা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না।

তা ছাড়া ছাত্রত্ব না থাকলে ডাকসু নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা। আইনি জটিলতা এড়াতে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে ডাকসু নির্বাচন আয়োজনে গঠিত নির্বাচন কমিশন।

এবারের ডাকসু নির্বাচন সামনে রেখে ছাত্রসংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে গুরুত্বপূর্ণ একটি দাবি ছিল হলের বাইরে ভোটকেন্দ্র করা। সেই দাবি মেনে ডাকসু নির্বাচনে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোর বাইরে ভোটকেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়েছে।

কেন্দ্রগুলো হলো: এক. কার্জন হল কেন্দ্র (পরীক্ষার হল); ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌ হল, অমর একুশে হল ও ফজলুল হক হলের শিক্ষার্থীরা এখানে ভোট দেবেন। দুই. শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্র; জগন্নাথ হল, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল ও সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের শিক্ষার্থীরা এখানে ভোট দেবেন। তিন. ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি); রোকেয়া হল, শামসুন নাহার হল ও কবি সুফিয়া কামাল হলের শিক্ষার্থীরা এখানে ভোট দেবেন। চার. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাব কেন্দ্র; বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হল ও শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের শিক্ষার্থীরা এখানে ভোট দেবেন। পাঁচ. সিনেট ভবন কেন্দ্র (অ্যালামনাই ফ্লোর, সেমিনার কক্ষ, ডাইনিংরুম); স্যার এ এফ রহমান হল, হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল ও বিজয় একাত্তর হলের শিক্ষার্থীরা এখানে ভোট দেবেন। ছয়. উদয়ন স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্র; সূর্যসেন হল, মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল, শেখ মুজিবুর রহমান হল ও কবি জসীমউদ্‌দীন হলের শিক্ষার্থীরা এখানে ভোট দেবেন।

যে পরিকল্পনায় এগোচ্ছে ছাত্রসংগঠনগুলো

তফসিল ঘোষণার পর ছাত্রসংগঠনগুলোর নিজেদের মধ্যে প্রার্থী নিয়ে জোর আলোচনা শুরু হয়েছে। কাকে কোন পদে প্রার্থী করলে জয় ছিনিয়ে আনা যাবে, চলছে সেসব বিশ্লেষণ। তবে অধিকাংশ ছাত্রসংগঠনের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবার দলীয় প্যানেলের চেয়ে সম্মিলিত সাধারণ শিক্ষার্থী প্যানেলের কথা ভাবছে সংগঠনগুলো। নিজ সংগঠনের বাইরে স্বচ্ছ ভাবমূর্তির অনেক প্রার্থীকে তাঁরা নিজেদের প্যানেলে রাখতে চাচ্ছেন।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর হওয়া ডাকসু নির্বাচনে শিক্ষার্থীরা অভ্যুত্থানে অবদান রাখা প্রার্থীদের কিছুটা এগিয়ে রাখবেন—এমনটা মনে করছে কিছু সংগঠন। এ ছাড়া নারী শিক্ষার্থী, বিজ্ঞান অনুষদগুলোর শিক্ষার্থী, আদিবাসী, সংখ্যালঘু ও অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের ভোট প্রার্থীদের জিতে আসার জন্য বড় ভূমিকা রাখবে বলেও মনে করা হচ্ছে।

জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের প্যানেল কেমন হবে, তা দলীয় সিদ্ধান্তের আলোকেই ঠিক করা হবে বলে জানিয়েছেন সংগঠনটির নেতারা। বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ সম্মিলিত সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্যানেল করবে, এমন আলোচনা চলছে। বাম ছাত্রসংগঠনগুলোর পাশাপাশি ইসলামী ছাত্রশিবিরও পৃথকভাবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে প্যানেল দিতে পারে এমন আলোচনা হচ্ছে।

প্রার্থী হিসেবে আলোচনায় যাঁরা

ডাকসু নির্বাচনে সহসভাপতি (ভিপি), সাধারণ সম্পাদক (জিএস), সহসাধারণ সম্পাদকসহ (এজিএস) এবার মোট ২৮টি পদের বিপরীতে লড়বেন প্রার্থীরা। ছাত্রসংগঠনগুলোর দাবির মুখে এবার গবেষণা ও প্রকাশনা সম্পাদক; ক্যারিয়ার উন্নয়ন সম্পাদক; স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সম্পাদক এবং মানবাধিকার ও আইনবিষয়ক সম্পাদক নামে চারটি নতুন পদ তৈরি করা হয়েছে।

ছাত্রসংগঠনগুলোর শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা এবং জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পরিচিত কিছু মুখ সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে আলোচনায় রয়েছেন। জুলাই অভ্যুত্থানের পর গঠিত হওয়া সংগঠন গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বায়ক আবু বাকের মজুমদার, সদস্যসচিব জাহিদ আহসান ও মুখ্য সংগঠক তাহমিদ আল মুদ্দাসির চৌধুরী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক আবদুল কাদের প্রার্থী হতে পারেন। আলোচনায় রয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক মুখপাত্র উমামা ফাতেমা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সভাপতি মহিউদ্দিন মুজাহিদও।

ছাত্রদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবিদুল ইসলাম খান ও বি এম কাওসার, কবি জসীমউদ্‌দীন হল শাখা ছাত্রদলের প্রচার সম্পাদক তানভীর বারী হামিম প্রার্থী হিসেবে আলোচনায় রয়েছেন।

বাম ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি মেঘমল্লার বসু ও বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রীর জাবির আহমেদের নাম আলোচনায় রয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থানের পর ক্যাম্পাসে প্রকাশ্য রাজনীতিতে আসা ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি আবু সাদিক কায়েম ও বর্তমান সভাপতি এস এম ফরহাদ প্রার্থী হতে পারেন। এ ছাড়া ছাত্র অধিকার পরিষদের বিন ইয়ামিন মোল্লার নামও আলোচনায় রয়েছে।

কে কী বলছেন

নির্বাচন আয়োজনে কালক্ষেপণের অভিযোগ ছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে। এরপরও তফসিল ঘোষণায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কিছুটা তড়িঘড়ি করেছে বলে মনে করছেন ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপন।

নাহিদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলেছিল নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত হলে এবং শিক্ষার্থী নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত চিহ্নিত ছাত্রলীগ কর্মী ও ফ্যাসিবাদের দোসর শিক্ষকদের বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার পর তফসিল ঘোষণা করা হবে। কিন্তু আমরা সেগুলোর কিছুই দেখিনি। ডাকসুর গঠনতন্ত্র সংস্কারের বিষয়েও কোনো প্রকার অগ্রগতি দেখিনি।’

শিক্ষার্থীদের সংস্কার প্রস্তাবের বেশির ভাগই উপেক্ষা করে আগের কাঠামোর মধ্যেই ডাকসু নির্বাচন আয়োজন করা হচ্ছে বলে অভিযোগ বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের। সংগঠনটির একাংশের সাধারণ সম্পাদক শিমুল কুম্ভকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে ফ্যাসিস্ট হাসিনার বিদায়ের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে ফ্যাসিবাদী কাঠামোর বিলোপের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ডাকসু সংস্কারের প্রস্তাব দেয়। অপরাপর সংগঠনগুলোও সংস্কারের দাবি জানায়। কিন্তু আমরা দেখি, শিক্ষার্থীদের সংস্কার প্রস্তাবের বেশির ভাগই উপেক্ষা করে আগের কাঠামোর মধ্যেই ডাকসু নির্বাচন আয়োজন করা হলো।’

এরপরও ডাকসু নির্বাচনকে সাধুবাদ জানিয়ে শিমুল বলেন, প্রতিবছর নিয়মতান্ত্রিকভাবে ছাত্র সংসদ নির্বাচন প্রত্যাশা করেন তাঁরা। ছাত্র ইউনিয়ন চায়, ডাকসু নির্বাচনে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান এবং চব্বিশের জুলাইয়ে যাঁরা গণহত্যার সঙ্গে যুক্ত, সেসব সংগঠন এই নির্বাচনে অংশ নিয়ে নির্বাচনকে বিতর্কিত না করুক।

ডাকসু নির্বাচন নিয়ে ইতিবাচক পদক্ষেপ শিক্ষার্থীদের মধ্যে উচ্ছ্বাস-উদ্দীপনার সঞ্চার করেছে বলে মনে করছেন গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক আবদুল কাদের। তিনি বলেন, ‘এই উচ্ছ্বাস যেন আশাহত অবস্থায় রূপ না নেয়, সে জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সচেষ্ট থাকতে হবে। কুচক্রী মহলের ডাকসু বানচালের পাঁয়তারায় প্রশাসনের মধ্যে যেন জুজুর ভয় সঞ্চারিত না হয়, সেটাই আমাদের আহ্বান থাকবে।’

ডাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছেন ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সভাপতি আবু সাদিক কায়েম। তিনি বলেন, ‘প্রতিটি ক্যাম্পাসে ছাত্র সংসদের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব নির্বাচন করা জুলাইয়ের অন্যতম আকাঙ্ক্ষা। আমাদের দাবি থাকবে, অনতিবিলম্বে প্রতিটি ক্যাম্পাসেই যেন ছাত্র সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়।’

নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের (সবার জন্য সমান সুযোগ) ওপর প্রশাসনের জোর দেওয়া উচিত বলে মনে করেন বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর সাধারণ সম্পাদক জাবির আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিপুল অর্থ এবং পেশিশক্তির ব্যবহার করে যাতে কোনো গোষ্ঠী এই নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করতে না পারে, সে ব্যাপারে তাদের ভূমিকা রাখতে হবে। আমরা বিশ্বাস করি, একটা অবাধ, সুষ্ঠু, নিরেপক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাঁদের যোগ্য নেতৃত্ব নির্বাচিত করবেন।’

আরও পড়ুনডাকসু নির্বাচন ৯ সেপ্টেম্বর১৭ ঘণ্টা আগে

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • যে পরিকল্পনায় এগোচ্ছে ছাত্রসংগঠনগুলো, প্রার্থী হিসেবে আলোচনায় যাঁরা