ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের সামনে বুক চিতিয়ে হাতে হাত রাখা সাহসী কয়েকজন তরুণ-তরুণীর মিছিল নিয়ে গড়া রাজু স্মৃতি ভাস্কর্য কিংবা ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ভাস্কর্যের ভাস্কর শ্যামল চৌধুরীর কথা আপনাদের মনে আছে?
আমাদের দেশের সমকালীন ভাস্করদের মধ্যে বিশেষ করে বাস্তবানুগ ভাস্কর্যে তিনি শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছেন তাঁর পরিশ্রমী সৃজন দিয়ে। আমাদের দুর্ভাগ্য, কভিড মহামারিকালে সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতরভাবে আহত হয়ে এই সৃজনী ক্ষমতাধর ভাস্কর তাঁর কর্মসক্ষমতা হারিয়েছেন! অতি সম্প্রতি তাঁর আগের কিছু ভাস্কর্য এবং অঙ্কন দেখার বিরল একটা সুযোগ হয়েছিল দর্শকদের।
‘অবয়বের প্রতিধ্বনি’ শিরোনামে বাংলাদেশের কৃতী এই ভাস্করের একক ভাস্কর্য ও অঙ্কন প্রদর্শনীর ঘরোয়া আয়োজন হয়েছিল। শ্যামলীতে অ্যাম্ব্রোসিয়া নামের অ্যাপার্টমেন্ট ভবনে তাঁর থাকার জায়গার ঠিক পাশেই ভাস্করের বড় কন্যার আবাসনের কক্ষগুলো সেজে উঠেছিল তাঁর ভাস্কর্য ও অঙ্কনে। শ্যামল চৌধুরীর ছোট কন্যা শিল্পী রূপকল্পা চৌধুরীর কিউরেটিংয়ে ১০ থেকে ১৪ জানুয়ারি পর্যন্ত পাঁচ দিনের এই আয়োজন চলেছে। ভাস্করের সৃজনকর্মের ভক্ত এবং তাঁর সমসাময়িক অগ্রজ-অনুজ শিল্পী, সংস্কৃতিসেবী, এমনকি শিক্ষকরাও হাজির হয়ে দেখে এসেছেন ভাস্কর শ্যামল ও তাঁর কাজগুলো। আমি দেখছি আর মনে করছি গত শতকের পুরো আশির দশকের স্মৃতি! আমরা পড়েছি চারুকলায়, থেকেছি ঢাকা নিউমার্কেটের পেছনের শাহনেওয়াজ ভবনে। ছাত্রাবাসের নিচতলায় ৩ নম্বর কক্ষে থাকতেন শ্যামল চৌধুরী। এই কক্ষে আরও থাকতেন তাঁর সহপাঠী প্রয়াত ভাস্কর মৃনাল হক ও আমার সহপাঠী অশোক কর্মকার। একই কক্ষে পরে বসবাস করেছেন শিল্পী ধ্রুব এষ। সেই সূত্রে ৩ নম্বর রুম ছিল আমাদের সৃজন, আলাপ আর আড্ডার একটা উপযুক্ত স্থান।
ছেলেবেলা থেকেই ভাস্কর শ্যামল চৌধুরীর ছবি আঁকার ঝোঁক ছিল। এলাকার উন্নত সাংস্কৃতিক পরিবেশে তিনি সংগীতচর্চাও করেছেন। তাঁর কাছে শুনেছি নিজ এলাকার এক উচ্চাঙ্গসংগীত প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে তিনি দ্বিতীয় স্থান লাভ করেছিলেন, প্রথম হয়েছিলেন বরেণ্য সংগীতশিল্পী মিতালী মুখার্জি! ছাত্রজীবনে তিনি বিপ্লবী কমিউনিস্ট নেতা মণি সিংহকে সঙ্গ দিয়েছেন ও তাঁর দেখভালের দায়িত্ব পালন করেছেন।
১৯৬১ সালে নেত্রকোনায় তাঁর জন্ম। স্থানীয় স্কুল থেকে ১৯৭৭ সালে এসএসসি পাস করে ঢাকায় এসে চারুকলায় ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এবং ভর্তি হন।
শিক্ষার্থী জীবনেই শ্যামল চৌধুরীর ড্রয়িংয়ের হাত ছিল ভালো। তাঁর সহপাঠীদের মধ্যে চারুকলার অধ্যাপক শিশির ভট্টাচার্য, জার্মানপ্রবাসী শিল্পী মুর্শিদা আরজু আল্পনা, যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী শিল্পী মাসুদুল হাসান গামাসহ অনেকের অঙ্কনদক্ষতা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। তাদের মধ্যে একজন আরেকজনকে ছাড়িয়ে যাওয়ার তুমুল প্রতিযোগিতা দেখেছি। তাদের অনেকের সঙ্গে আমিও আউটডোরে স্কেচ ও জলরঙের কাজ করতে গেছি আর সবিস্ময়ে লক্ষ্য করেছি– কাজের প্রতি নিষ্ঠা ও ঐকান্তিকতায় অর্জিত দক্ষতায় তারা কত সহজে একের পর এক ছবি এঁকে শেষ করছেন!
আমরা শিক্ষকদের কাছে শিখতাম যতটুকু, প্রায়োগিক ক্ষেত্রে তারও বেশি শিখেছি অগ্রজ শিল্পশিক্ষার্থীদের কাছ থেকে।
শিল্পী শিশির ভট্টাচার্য ও শ্যামল চৌধুরী আমাকে মাঝেমধ্যে ড্রয়িং দেখাতেন। বিশেষ করে হিউম্যান ফিগারের অ্যানাটমি বিশ্লেষণের সূত্র যা শিখেছি, সেটি তাদের হাত ধরেই। তখন থেকেই দেখেছি অঙ্কনে শিল্পী শ্যামল চৌধুরীর বিশেষ ঝোঁক ও পারদর্শিতা। এই অঙ্কনদক্ষতাকে ত্রিমাত্রিক রূপে ফুটিয়ে তোলার প্রবল ইচ্ছেয় তিনি চারুকলার ভাস্কর্য বিভাগে ভর্তি হন। এরপর ভাস্কর হিসেবে তাঁর উত্থানপর্বের ক্রমবিকাশ।
শ্যামলের আরেকটি ভূমিকা পালনের খবর অনেকে জানেন না। ছাত্রজীবনে তিনি বিপ্লবী কমিউনিস্ট নেতা মণি সিংহকে সঙ্গ দিয়েছেন ও তাঁর দেখভালের দায়িত্ব পালন করেছেন।
চারুকলার শিক্ষার্থীদের আঁকা ও গড়া নির্বাচিত শিল্পকর্ম নিয়ে বার্ষিক চিত্র প্রদর্শনী হয়। তাতে নানা মাধ্যমে ভালো কাজের জন্য পুরস্কার প্রদানের রেওয়াজ রয়েছে। আশির দশকে দেখেছি শ্যামল চৌধুরী ভাস্কর্য বিভাগে শ্রেণি পুরস্কার থেকে শুরু করে ভাস্কর্য মাধ্যমে সেরা পুরস্কার পেয়েছেন। ১৯৮৩ সালে তিনি চারুকলার স্নাতক পরীক্ষা দিয়ে প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অর্জন করেন এবং স্নাতকোত্তর পর্বে পাঠ নিয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সমাপ্ত করে পুরোদস্তুর পেশাদার ভাস্কর হিসেবে আবির্ভূত হন। একে একে গড়ে তোলেন বৃহৎ আঙ্গিকের বহিরাঙ্গন ভাস্কর্য। ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে তাঁর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ভাস্কর্য আরেকটি অসামান্য সৃষ্টি।
১৯৯২ সালে টিএসসি-সংলগ্ন এলাকায় ছাত্র ইউনিয়ন নেতাকর্মীর সন্ত্রাসবিরোধী মিছিলে থাকা ছাত্রনেতা মঈন আহমেদ রাজু অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন। ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্বে ছাত্র-শিক্ষকসহ সবার আর্থিক অংশগ্রহণে অকুতোভয় রাজুর স্মরণে শিল্পী ও ভাস্কর শ্যামল চৌধুরী টিএসসি সড়কদ্বীপে রাজু স্মৃতি ভাস্কর্য গড়ে তোলেন। v
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র ভ স কর ভ স কর য চ র কল র কর ছ ন
এছাড়াও পড়ুন:
অতি ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস, পাহাড়ে ভূমিধসের শঙ্কা
আজ শ্রাবণের ১৬ তারিখ। প্রকৃতির নিয়মে এ মাসে বৃষ্টি বেশি ঝরে। আজও ঢাকার আকাশ মেঘলা। বুধবার রাত থেকে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। কখনও ঝুম বৃষ্টি কখনও গুঁড়ি গুঁড়ি। তবে সক্রিয় মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে উপকূলীয় ও পাহাড়ি এলাকায় অতি ভারী বৃষ্টি হতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। রয়েছে ভূমিধসের ঝুঁকি।
বৃহস্পতিবার (৩১ জুলাই) ভারী বৃষ্টিপাতের সতর্কবার্তায় বলা হয়েছে, আগামী ২৪ ঘণ্টায় খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন স্থানে ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টির আশঙ্কা করা হচ্ছে। ফলে চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও কক্সবাজারের পাহাড়ি এলাকায় কোথাও কোথাও ভূমিধসের ঝুঁকি রয়েছে।
আবহাওয়া পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, অতিভারী বৃষ্টির কারণে খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম মহানগরীর কিছু এলাকায় সাময়িক জলাবদ্ধতা দেখা দিতে পারে। নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়াসহ বাস, রিকশা ও সাধারণ চলাচলে বিঘ্ন ঘটতে পারে।
বঙ্গোপসাগরে উত্তাল থাকায় চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরসমূহকে তিন নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। নদী ও সমুদ্রবন্দর এলাকায় অবস্থানরত নৌযানগুলোকে সাবধানতার সঙ্গে চলাচলের নির্দেশ দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। সারা দেশে আজ দিনের তাপমাত্রা সামান্য কমতে পারে, রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকবে।
শুক্রবার ঢাকা, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায়, এবং রংপুর, রাজশাহী, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের অনেক জায়গায় হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টি হতে পারে। কোথাও কোথাও ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণের সম্ভাবনা রয়েছে। দিন ও রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকবে।
শনিবারও সারা দেশে বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকবে। বিশেষ করে ঢাকা, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগে অধিকাংশ এলাকায় এবং অন্যান্য বিভাগে অনেক জায়গায় দমকা হাওয়াসহ বৃষ্টি হতে পারে। সারা দেশে দিনের ও রাতের তাপমাত্রা সামান্য কমতে পারে।
রবিবার রংপুর, রাজশাহী, ঢাকা, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় এবং খুলনা ও বরিশাল বিভাগে অনেক জায়গায় বৃষ্টি হতে পারে। কোথাও কোথাও হতে পারে অতি ভারী বৃষ্টিপাত।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের বর্ধিত পূর্বাভাস অনুযায়ী, আগামী পাঁচ দিন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের প্রবণতা অব্যাহত থাকতে পারে।
গত ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ বৃষ্টি হয়েছে কক্সবাজার ৬৮ মিলিমিটার। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল সৈয়দপুরে ৩৬ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গতকাল ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
ঢাকা/ইভা