মাদারীপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে বাঁ পায়ে গুলিবিদ্ধ হন কলেজছাত্র দীপঙ্কর বালা (২৬)। পরদিন থেকে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। সেখানে কয়েকবার অস্ত্রোপচার হয়েছে। এখন উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে বিদেশে নেওয়া প্রয়োজন।

সে অনুযায়ী তুরস্কে যাওয়ার সব ব্যবস্থাও হয়েছে। তবে তিনি দেশটিতে যেতে পারছেন না। গত সোমবার ফ্লাইট থাকলেও তাঁকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে থেকে ফিরে আসতে হয়েছে। বুধবার ঢামেকের বার্ন ইউনিটের ৬১৭ নম্বর ওয়ার্ডে দীপঙ্করের সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, তিন মাস ধরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে নানাভাবে আশ্বাসের পর ২৭ জানুয়ারি তুরস্কে যাওয়ার জন্য তাঁকে বিমানের টিকিট দেওয়া হয়। তা ছিল ইকোনমি ক্লাসের টিকিট। তাঁকে বসানো অবস্থায় দীর্ঘ ফ্লাইটে নেওয়া সম্ভব নয়। এ কারণে বিমানবন্দর থেকে ফেরত পাঠানো হয়। আবার কবে টিকিটের ব্যবস্থা হবে, কবে বিদেশে যেতে পারবেন, সে আশায় হাসপাতালে দিন কাটছে এই কলেজছাত্রের। এদিকে যত দিন যাচ্ছে, তাঁর পায়ের অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে। গোড়ালির দিকে ছোট ছিদ্র দিয়ে অনবরত পুঁজ পড়ছে। পা নাড়াতে পারছেন না সহজে। 

মাদারীপুর সরকারি কলেজের গণিত বিভাগের স্নাতক শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী দীপঙ্কর। রাজৈর উপজেলার আমগ্রাম ইউনিয়নের উত্তর পাখুল্লা গ্রামে পরেশ চন্দ্র বালা ও বিনা রানী বালা দম্পতির তিন ছেলের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। 

দীপঙ্কর বলেন, ‘গত ১৯ জুলাই মাদারীপুর সদরে আন্দোলন চলাকালে পুলিশের শটগানের গুলি আমার বাঁ পায়ে লাগে। এতে পায়ের একপাশের মাংস উড়ে যায়। হাঁটুর নিচ থেকে গোড়ালি পর্যন্ত তিন জায়গায় হাড় ভেঙে গিয়েছিল। এ পর্যন্ত আমার পায়ে অন্তত ছয়টি অস্ত্রোপচার হয়েছে। পায়ে রড লাগানো রয়েছে। এখানকার চিকিৎসকরা যথাসাধ্য চিকিৎসা দিয়েছেন। এখন উন্নত চিকিৎসার জন্য দ্রুত বিদেশে যেতে হবে।’

তিন মাস ধরে বিদেশ পাঠানোর কথা বলে ঘুরাতে থাকেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের লোকজন। অবশেষে তুরস্কে নেওয়ার ব্যবস্থা হয়। টিকিট কাটা হয় ইকোনমি ক্লাসের। বিমানবন্দরে যাওয়ার পর তুর্কি এয়ারলাইন্সের কর্মকর্তারা দীপঙ্করের অবস্থা দেখে জানান, ইকোনমি ক্লাসের সিটে তাঁকে বসিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। কারণ পা নিচু করলেই অনবরত রক্ত পড়ছিল। এ কারণে তারা কোনো ধরনের ঝুঁকি নিতে চাননি। শুইয়ে ছাড়া নেওয়া সম্ভব নয়। তাই বিমানবন্দর থেকে ফেরত পাঠানো হয়।

দীপঙ্কর বলেন, ‘বিদেশে পাঠানোর জন্য মন্ত্রণালয় থেকে লোকজন এসে আমাকে কয়েকবার দেখে যান। তখন আমার পরিবারের লোকজন তাদের বলে, আমাকে বসিয়ে বিদেশে নেওয়া সম্ভব নয়, শুইয়ে নিতে হবে। কিন্তু ইকোনমি ক্লাসের টিকিট ধরিয়ে দেওয়া হয়। তখন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়, সিটের সামনে টুল বসানো হবে। ২৭ জানুয়ারি রাত ১০টা ৫০ মিনিটে ফ্লাইট ছিল। বিমানবন্দরে যাওয়ার পর অবস্থা দেখে তুর্কি এয়ারলাইন্সের লোকজন ফিরিয়ে দিল।’

এ পর্যন্ত চিকিৎসার জন্য ধারদেনা করে কয়েক লাখ টাকা খরচ করেছে দীপঙ্করের পরিবার। তাঁর বাবা আগে কৃষিকাজ করতেন। কয়েক বছর আগে স্ট্রোক করে আর কাজ করতে পারেন না। সংসার চলে বড় ভাই দীপক বালা ও দীপঙ্করের টিউশনির টাকায়। কিন্তু ১৯ জুলাইয়ের পর থেকে দীপঙ্কর হাসপাতালে। এ অবস্থায় তাদের পরিবারের লোকজন মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

দীপঙ্করের ছোট ভাই অনার্স পড়ুয়া দিগন্ত বালা বলেন, ‘নভেম্বর মাসে জুলাই ফাউন্ডেশনে অনুদানের জন্য আমরা আবেদন করেছিলাম। যাচাই-বাছাইয়ের পর জানুয়ারির শুরু দিকে ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে মোবাইল ব্যাংকের মাধ্যমে এক লাখ টাকা দেওয়া হয়।’

দিগন্তের অভিযোগ, বিজনেস ক্লাসের টিকিট না দিয়ে ইকোনমি ক্লাসের টিকিট দেওয়া হয়েছে। এ রকম রোগীকে বসিয়ে বিদেশ নেওয়া সম্ভব নয়। মন্ত্রণালয়ের

লোকজনকে বিষয়টি জানানো হয়। কিন্তু তারা গুরুত্ব দেননি। বিমানবন্দর থেকে ফিরে আসার পর যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও মন্ত্রণালয় থেকে কোনো সাড়া মেলেনি।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ডা.

মাহমুদুল হাসান সমকালকে বলেন, দীপঙ্করকে স্ট্রেচারে করেই তুরস্কে নেওয়া হবে। আগামী শনিবারের টিকিটের জন্য আমরা চেষ্টা করছি।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র ল কজন র জন য অবস থ

এছাড়াও পড়ুন:

ব্রহ্মপুত্রের ভাঙন ঠেকাতে গ্রামবাসী বানালেন ‘প্রাকৃতিক বাঁধ’

উজানের ঢল ও ভারী বৃষ্টিতে প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে কুড়িগ্রামের চরাঞ্চলের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। প্রবল স্রোতে ব্রহ্মপুত্র নদসহ অর্ধশতাধিক নদ-নদীর পানি বেড়ে দেখা দেয় ভাঙন। মাটির সঙ্গে ভেসে যায় বসতভিটা, ফসলি জমি, কখনো স্কুল বা মসজিদ। প্রতিবছর এই ভাঙনে নিঃস্ব হয় অসংখ্য পরিবার। সরকারি বাঁধ বা প্রকল্পের প্রতিশ্রুতি মিললেও বাস্তবে কাজের গতি নেই।

এমন অবস্থায় এবার নিজেরাই নিজেদের রক্ষার পথ খুঁজে নিয়েছেন চিলমারী উপজেলার নয়ারহাট ইউনিয়নের খেরুয়ার চরের বাসিন্দারা। সরকারি সহায়তার অপেক্ষা না করে নিজেদের টাকায় ও স্বেচ্ছাশ্রমে তাঁরা ব্রহ্মপুত্রের তীরে গড়ে তুলছেন এক ‘প্রাকৃতিক বাঁধ’।

প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে নদীতীরে লাগানো হয়েছে কলাগাছ, কাশফুল, কলমিলতা ও স্থানীয় ঘাসজাতীয় গাছের চারা। এসব গাছের বিস্তৃত শিকড় নদীতীরের মাটি আঁকড়ে ধরে রাখবে, এমন ধারণা থেকেই এই উদ্যোগ।

খেরুয়ার চরের বাসিন্দা দুলাল জোয়াদ্দার বলেন, ‘প্রতিবছর ভাঙনে ঘরবাড়ি হারাই। কেউ সাহায্য করে না। তাই ভাবলাম, গাছ লাগালেই যদি কিছুটা মাটি টিকে থাকে তাতেই লাভ।’

সম্প্রতি সরেজমিনে নয়ারহাট ইউনিয়নের খেরুয়ারচর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ব্রহ্মপুত্র নদের বুকে জেগে ওঠা বালুচরের দুই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে স্থানীয় বাসিন্দারা কাশফুলের চারা লাগাচ্ছেন। কিছু দূর পরপর কলাগাছ ও কলমিলতার চারাও লাগানো হচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের সবাই এ কাজে হাত লাগিয়েছেন। কেউ বালুচরে প্রাকৃতিক বাঁধ তৈরির কাজ করছেন, তো কেউ সেই বাঁধের জন্য কাশফুলের চারা ও কলমিলতার জোগান দিচ্ছেন। বসে নেই এলাকার নারীরাও, পুরুষের পাশাপাশি তাঁরা হাত লাগিয়েছেন পানি সরবরাহকাজে।

স্থানীয় ইউপি সদস্য সানোয়ার হোসেন বলেন, আগেও সীমিত পরিসরে গাছ লাগানো হয়েছিল, কিন্তু এবার মানুষ অনেক বেশি সংগঠিত হয়েছে। তাই ব্যাপক পরিসরে লাগানো হচ্ছে। ‘মানুষ নিজেরাই টাকাপয়সা দিয়েছে, দল বেঁধে গাছ লাগিয়েছে। আমরা পাশে আছি’, বলেন তিনি।

ভাঙনের তীব্রতা বাড়ছে

নয়ারহাট ইউনিয়ন পরিষদের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরেই বজরা দিয়ারখাতা, দক্ষিণ খাউরিয়ার চর ও ফেইচকা এলাকায় অন্তত ২০০ পরিবারের ঘরবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। শতাধিক পরিবার বসতবাড়ি হারিয়ে অন্যের জায়গায় আশ্রয় নিয়েছেন। ভাঙনের ঝুঁকিতে ইউনিয়নের একমাত্র আশ্রয়ণ প্রকল্প, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও স্থানীয় বাজার।

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয়ের তথ্যানুযায়ী, এ বছর নদীভাঙনে জেলার ১ হাজার ৫০০ পরিবার তাদের বসতি হারিয়েছে। এ ছাড়া গত ছয় বছরে ১৬ হাজার পরিবার নদীভাঙনের শিকার হয়েছে এবং ১৫৩ হেক্টর কৃষিজমি বিলীন হয়েছে।

কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাকিবুল হাসান বলেন, ব্রহ্মপুত্রের গভীরতা ও প্রবল স্রোতের কারণে এ ধরনের উদ্যোগ দীর্ঘ মেয়াদে কার্যকর না–ও হতে পারে। তবে স্থানীয়দের সচেতনতা ও অংশগ্রহণ ইতিবাচক। এভাবে প্রাকৃতিক বাঁধ তৈরি হলে ভাঙনের ঝুঁকি কমে আসবে। জেলার প্রতিটি চরে বর্ষার পানি নেমে যাওয়ার পর এভাবে বাঁধ দিলে ভূমিক্ষয় ও ভাঙনের ঝুঁকি কমবে।

জলবায়ুর প্রভাব ও অভিযোজন

বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উত্তরাঞ্চলের নদীগুলোর চরাঞ্চলে নদীভাঙন বেড়েছে। শুষ্ক মৌসুমে পানি কমে গিয়ে নদীতীর দুর্বল হয়, আর বর্ষায় প্রবল স্রোতে দ্রুত ক্ষয় ঘটে।

জেলা জলবায়ুকর্মী মার্জিয়া মেধা বলেন, চরাঞ্চলের এই উদ্যোগকে ছোট করে দেখা ঠিক হবে না। কলা, কাশফুল ও কলমি—সবই এমন উদ্ভিদ, যেগুলোর শিকড় মাটি ধরে রাখে। এটি একধরনের সবুজ বর্ম, যা ভাঙন রোধে প্রাকৃতিক প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তিনি আরও বলেন, এটি আসলে কমিউনিটিভিত্তিক জলবায়ু অভিযোজনের উদাহরণ। সরকার যদি বৈজ্ঞানিক পরামর্শ, উপযুক্ত প্রজাতির গাছ ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সহায়তা দেয়, তবে এটি ব্রহ্মপুত্র তীর রক্ষার একটি টেকসই মডেল হয়ে উঠবে।

নদীগবেষক ও রিভারাইন পিপলের পরিচালক তুহিন ওয়াদুদ প্রথম আলোকে বলেন, ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙন রোধে বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনা করে মানুষের জমি ও বসতভিটা রক্ষার দায়িত্ব সরকারের গ্রহণ করা উচিত ছিল। কিন্তু রাষ্ট্র সেখানে ব্যর্থ হয়েছে। স্থানীয় মানুষ নিজেদের বাঁচানোর তাগিদে কখনো বাঁশ-কাঠ দিয়ে, আবার কখনো কাশফুলের চারা দিয়ে প্রতিরোধব্যবস্থা করেছে। তিনি আরও বলেন, নদীতে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ অনেক সময় জীব ও পরিবেশের ওপর প্রভাব ফেলে, জলবায়ু সংকট তৈরি হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। সেদিক বিবেচনায় স্থানীয় মানুষের এই প্রাকৃতিক বাঁধ ব্রহ্মপুত্র নদের তীর রক্ষার একটি টেকসই মডেল হয়ে উঠতে পারে।

চিলমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সবুজ কুমার বসাক বলেন, ‘স্থানীয়দের প্রাকৃতিক বাঁধ নির্মাণ একটি প্রশংসনীয় প্রচেষ্টা। এ বছর বন্যায় নদীভাঙনের পর সেখানে স্থায়ী বাঁধের জন্য আমরা পানি উন্নয়ন বোর্ডকে চিঠি দিয়েছি। এ ছাড়া স্থানীয়দের কাজকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য আমরা তাদের পাশে রয়েছি।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ