ক্যাম্প কমান্ডার প্রত্যাহার, তুলে নেওয়ার কারণ জানা যায়নি
Published: 2nd, February 2025 GMT
কুমিল্লা সদরের পাঁচথুবী ইউনিয়ন যুবদলের আহ্বায়ক তৌহিদুল ইসলামকে কী অভিযোগে বাড়ি থেকে তুলে নেওয়া হয়েছিল, তা এখনও জানা যায়নি। স্বজনের দাবি, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন না তৌহিদ। বাবার কুলখানির জন্য চট্টগ্রামের কর্মস্থল থেকে বাড়ি এসেছিলেন। হেফাজতে যৌথ বাহিনীর নির্যাতনে তাঁর মৃত্যু হয়েছে।
তৌহিদের মৃত্যু ঘিরে এলাকাসহ সারাদেশে তোলপাড় ও প্রতিবাদের ঝড় বইছে। বিএনপি-জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও মানবাধিকার সংগঠন নিন্দা জানিয়ে সুষ্ঠু তদন্ত এবং দায়ীদের কঠোর শাস্তি দাবি করেছে। সরকার এরই মধ্যে দ্রুত তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট সেনাক্যাম্পের কমান্ডার প্রত্যাহার করার তথ্য জানিয়েছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)।
২০১৬ সালের ২০ মার্চ কুমিল্লা সেনানিবাসের ভেতরে জঙ্গল থেকে সোহাগী জাহান তনুর লাশ উদ্ধার করা হয়। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ইতিহাস বিভাগের এ ছাত্রীর মৃত্যুর প্রায় ৯ বছরেও মামলাটির তদন্ত শেষ হয়নি। যৌথ বাহিনীর হেফাজতে যুবদল নেতার মৃত্যুর পর নতুন করে তনুর ঘটনাও আলোচনায় এসেছে।
তৌহিদের মৃত্যুতে ক্ষোভে ফুঁসছে পাঁচথুবী ইউনিয়নের ইটাল্লা গ্রাম। দোষীদের বিচার দাবিতে গতকাল শনিবার সকালে গ্রামে ও দুপুরে কুমিল্লা প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন হয়। বিকেলে বাবার কবরের পাশে তৌহিদকে সমাহিত করা হয়। জানাজায় বিএনপির কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
কুমিল্লা প্রেস ক্লাবের সামনে সচেতন এলাকাবাসীর ব্যানারে মানববন্ধনে অংশ নেন তৌহিদের স্ত্রী ইয়াসমিন নাহার। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আমার স্বামীর কোনো অপরাধ ছিল না। সেনাবাহিনী আশ্বস্ত করেছিল, তাঁকে কিছুই করবে না। আমিও বিশ্বাস করেছিলাম। কিন্তু তারাই আমার স্বামীর পুরো শরীরে নিষ্ঠুর নির্যাতন ও বিদ্যুতের শক দিয়ে হত্যা করেছে। আমার চার সন্তানকে এতিম করা হলো কেন? আমি জড়িতদের কঠিন বিচার চাই।’
এ সময় পাশেই অ্যাম্বুলেন্সে ছিল তৌহিদের মরদেহ। সেখানে মায়ের সঙ্গে কাঁদছিল চার মেয়ে। তৌহিদের বড় মেয়ে তাসফিয়া আক্তারের বয়স ১৪ বছর। কাঁদতে কাঁদতে তাসফিয়া বলে, ‘আমার বাবা অনেক ভালো মানুষ ছিলেন। ভালো বাবাটাকে নির্যাতন করে হত্যা করা হলো। আমরা চার বোন এতিম হয়ে গেছি।’
মানববন্ধনে স্বজন ও এলাকার হাজারের বেশি মানুষ সমবেত হয়ে প্রতিবাদ জানান। সকাল ১০টার দিকে ইটাল্লা গ্রামের সড়কেও লাশবাহী গাড়ি রেখে মানববন্ধন করেন শত শত মানুষ।
ইয়াসমিন বলেন, ‘সেনাবাহিনীর পোশাক ছাড়াও বৃহস্পতিবার রাতে মুখ ঢাকা কিছু লোক সাদা পোশাকে ছিল। তারাই বলেছিল, আমার স্বামী নাকি অস্ত্র ব্যবসা করে। তুলে নেওয়ার পরদিন সকাল সাড়ে ৮টার দিকে আবারও সেনাবাহিনীর লোকজন তাঁকে (তৌহিদ) গাড়িতে রেখে আমাদের ঘরে তল্লাশি করে। তখন আমার স্বামী অর্ধচেতন ছিলেন। পরে হাসপাতালে মারা গেলে আমাদের খবর দেয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘তাঁর কোমর থেকে পায়ের তলা পর্যন্ত পেটানো হয়েছে, কালো-ফোলা জখমের চিহ্ন ছিল। পেট, বুক, পিঠ, পা, গলাসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে শুধুই নির্যাতনের চিহ্ন।’
তৌহিদের সঙ্গে প্রতিবেশী লুৎফুর রহমানকেও আটক করা হয়। মানববন্ধনে তিনি বলেন, ‘পুলিশে হস্তান্তরের আগ পর্যন্ত তৌহিদকে নির্যাতন করা হয়। তিনি দাঁড়াতেই পারছিলেন না। সকালে গোমতীতে নামিয়ে গোসল করানোর পর নামাজ পড়তে বলা হয়েছিল। আমি নামাজ পড়েছি, তৌহিদ দাঁড়াতেই পারেনি।’
কী ঘটেছিল সেই রাতে
তৌহিদের ভাই সাদেকুর রহমান বলেন, ২৬ জানুয়ারি বাবা মারা যান। বৃহস্পতিবার ছিল কুলখানি। সেদিন রাত আড়াইটার দিকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা বাড়িতে আসেন। তাদের সঙ্গে সাদা পোশাকে পাঁচ যুবক ছিলেন। বাড়িতে প্রবেশ করেই তারা অস্ত্র খোঁজার কথা বলে তৌহিদকে আটক করেন। এর পর সবার কাছ থেকে মোবাইল ফোন কেড়ে নেন। ঘরে ব্যাপক তল্লাশি চালান। বারবার বলতে শোনা যায়, অস্ত্র-গুলি কই? আমার ভাই কোনো দিন অস্ত্র ধরেও দেখেনি। তাঁর সঙ্গে এলাকার কারও রাজনৈতিক বিরোধ ছিল না। তবে গ্রামের একটি পরিবারের সঙ্গে জমি নিয়ে বিরোধ ছিল। তারাই হয়তো মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে এ কাজ করিয়ে থাকতে পারে, যা তদন্ত করলে বের হবে।
গত বৃহস্পতিবার গভীর রাতে পাঁচথুবী ইউনিয়নের ইটাল্লা গ্রামের মৃত মোখলেছুর রহমানের ছেলে তৌহিদকে বাড়ি থেকে তুলে নেয় যৌথ বাহিনী। তিনি যুবদলের রাজনীতির পাশাপাশি চট্টগ্রামে একটি বেসরকারি শিপিং কোম্পানিতে চাকরি করতেন।
কুমিল্লার কোতোয়ালি থানার ওসি মহিনুল ইসলাম জানান, এ ঘটনায় থানায় জিডি হয়েছে, তদন্ত চলছে। তবে মৃতের পরিবার অভিযোগ করেনি। তৌহিদের বিরুদ্ধে ২০১৮ সালে বিশেষ ক্ষমতা আইনে একটি মামলা ছিল বলে জানান তিনি।
কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মোহাম্মদ সাইফুল মালিক বলেন, সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে তৌহিদকে পুলিশের কাছে হস্তান্তরের সময় তিনি অচেতন ছিলেন। হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
দ্রুত তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে সরকার
যুবদল নেতার মৃত্যুর ঘটনা দ্রুত তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে সরকার। গতকাল প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, ড.
এতে আরও বলা হয়, দেশে এ ধরনের অপরাধের বিচারিক প্রক্রিয়া সংস্কারের লক্ষ্যে সরকার ইতোমধ্যে একাধিক কমিশন করেছে। এসব কমিশনের বেশির ভাগই তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদ, অপরাধ ব্যবস্থাপনা এবং বিচারিক প্রক্রিয়ায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের সব সুযোগ নির্মূল করতে সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে গঠনমূলক সংলাপ করবে।
ক্যাম্প কমান্ডার প্রত্যাহার, তদন্তে কমিটি: আইএসপিআর
আইএসপিআর গতকাল এক বিবৃতিতে বলেছে, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে বৃহস্পতিবার রাত ৩টার দিকে যৌথ বাহিনীর অভিযানে কুমিল্লার আদর্শ সদর উপজেলা থেকে তৌহিদুল ইসলামকে আটক করা হয়। শুক্রবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান তিনি। এই অনাকাঙ্ক্ষিত ও দুঃখজনক ঘটনা তদন্তে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ওই সেনাক্যাম্পের কমান্ডারকে তাৎক্ষণিকভাবে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এ ছাড়া মৃত্যুর সঠিক কারণ উদ্ঘাটনে একটি উচ্চপদস্থ তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। তদন্তে দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সেনা আইন অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
রাজনৈতিক দল ও মানবাধিকার সংগঠনের প্রতিবাদ
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিবৃতিতে বলেন, জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর সমর্থন পাওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে এমন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড দুর্ভাগ্যজনক। ফেরিফায়েড ফেসবুক পেজে জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান লেখেন, পরিবর্তিত বাংলাদেশে এটি মোটেই কাম্য নয়। এমন ঘটনা কেউ দেখতে চায় না। ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিকে অবশ্যই জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত।
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের পাঠানো বিবৃতিতে যৌথ বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার নিশ্চিত, সেনাবাহিনীর ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা রদ করে ব্যারাকে ফেরত এবং ধর্ম-জাতি-লিঙ্গ নির্বিশেষে সব নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানানো হয়।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) সিনিয়র সমন্বয়কারী আবু আহমেদ ফয়জুল কবিরের সই করা সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আটক ব্যক্তির সুরক্ষা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
গুম ও হত্যাকাণ্ডের শিকার পরিবারদের সংগঠন মায়ের ডাকের সংগঠক সানজিদা তুলির পাঠানো বিবৃতিতে দাবি করা হয়, যৌথ বাহিনীর অভিযানে হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনতে হবে; ডিজিএফআই-র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে লুকিয়ে থাকা অপরাধীদের শনাক্ত করে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে; যৌথ বাহিনীর নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের এই সংস্কৃতি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করতে হবে।
জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল সম্পাদক ফয়জুল হাকিম বিবৃতিতে যুবদল নেতার মৃত্যুর ঘটনাকে বিচারবহির্ভূত হত্যা উল্লেখ করে নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন। বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বিবৃতিতে বলেছেন, কোনো অবস্থায় এ ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড অনুমোদনযোগ্য নয়।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন ত ক কম ন ড র র রহম ন ল ইসল ম সরক র র ব যবস অপর ধ র ঘটন য বদল তদন ত
এছাড়াও পড়ুন:
সিদ্ধিরগঞ্জে বিএনপি নেতার মুক্তির দাবিতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল
সিদ্ধিরগঞ্জে বিএনপি নেতা নীলফমারী জেলা বিএনপি’র সাবেক সভাপতি, নীলফমারী-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য জনাব ইঞ্জিনিয়ার শাহরিন ইসলাম চৌধুরী তুহিন এর মুক্তি ও মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সোমবার (৩০ এপ্রিল) সাড়ে ৫ টার দিকে আদমজী চাষাড়া সড়কে ইপিজেড এর সামনে নারায়ণগঞ্জে বসবাসরত রংপুর বিভাগীয় বিএনপি সমর্থক গোস্ঠীর উদ্যোগে এই মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।
এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সদস্য অকিল উদ্দিন ভূঁইয়া, রংপুর বিভাগ তরুণ দলের সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম, সিদ্ধিরগঞ্জ থানা বিএনপির ক্রিয়া ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক এস, এম খোরশেদ আলম, নারায়ণগঞ্জ জেলা তরুণ দলের সাধারণ সম্পাদক মাজারুল ইসলাম, সিদ্ধিরগঞ্জ থানা তাঁতী দলের সদস্য সচিব আরিফ মুন্সী, ৮ নং ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কামাল হোসেন ভূঁইয়া, নীলফামারী জেলা তাঁতী দলের সদস্য মোঃ খোকা, লালমনিরহাট জেলা তাঁতি দলের সদস্য আশরাফ আহমেদ খান, রংপুর জেলা ছাত্রদলের সাবেক সদস্য নিতাই সরকার ,সঞ্চালনায় জাহাঙ্গীর হোসেন সাধারণ সম্পাদক নারায়ণগঞ্জ জেলা জাসাস, ও এলাকাবাসী।
তারা সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন কদমতলী হইতে বিক্ষোভ মিছিল পরিচালনা শুরু করেন এবং আদমজী ইপিজেড এর সামনে অবস্থান করেন।
এসময় মানববন্ধনে নারায়ণগঞ্জে বসবাসরত রংপুর বিভাগীয় বিএনপি সমর্থক গোস্ঠী নেতারা বলেন, এই দায়েরকৃত মিথ্যা মামলার জামিন আবেদন না মঞ্জুর করে জেল হাজতে প্রেরন করে।
আমরা অন্তবর্তী সরকারের কাছে এই মামলা সঠিক তদন্তের মাধ্যমে নীলফমারী জেলা বিএনপি’র সাবেক সভাপতি, নীলফমারী-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য জনাব ইঞ্জিনিয়ার শাহরিন ইসলাম চৌধুরী তুহিন এর মুক্তির দাবি জানাই।
বক্তারা আরো বলেন, এটি একটি ষড়যন্ত্র মূলক মামলা তাকে মিথ্যা আসামী বানিয়ে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়। আমরা চাই দ্রুত যেন তার মুক্তি দেওয়া হয়।