বোতলজাত ভোজ্যতেলের আমদানি বেশি হলেও বাজারে সংকট, পাচারের আশঙ্কা
Published: 10th, February 2025 GMT
আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম কমছে। ভোজ্যতেল পরিশোধনকরী দেশীয় কারখানাগুলোর মালিকেরাও সরকারকে জানিয়েছেন, অন্যান্যবারের তুলনায় এ বছর আমদানি পরিস্থিতি ভালো। তারপরও বোতলজাত ভোজ্যতেলের সংকট চলছে। কিন্তু কেন তা হচ্ছে, সেটি তাঁরা জানেন না। এদিকে পরিশোধন কারখানার মালিকেরা অন্য পণ্য কেনার শর্তে ভোজ্যতেল বিক্রি করছেন তা–ও সত্য।
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি) কার্যালয়ে গতকাল রোববার অনুষ্ঠিত ভোজ্যতেলের সরবরাহ পরিস্থিতি পর্যালোচনাবিষয়ক এক বৈঠকে এসব তথ্য উঠে আসে। এ নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। তাতে ভাসা ভাসা কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও যথাযথ কোনো সমাধান হয়নি। ফলে ভোজ্যতেল নিয়ে মূল সংকট থেকেই যাচ্ছে।
বিটিটিসির চেয়ারম্যান মইনুল খানের সভাপতিত্বে বৈঠকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আবদুর রহিম খান ছিলেন আমন্ত্রিত অতিথি। দেশের শীর্ষ ভোজ্যতেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধিরা এতে অংশ নেন।
বৈঠক শেষে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বিটিটিসি জানায়, বাজারে ভোজ্যতেলের কোনো ঘাটতি নেই। যেটি হয়েছে তা কৃত্রিম সংকট এবং প্রকৃত তথ্যের ঘাটতি থেকে তা সৃষ্ট। কাস্টমসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ভোজ্যতেলের আমদানি প্রায় ৩৫ শতাংশ বেড়েছে। ঋণপত্রও (এলসি) বেড়েছে একই হারে। শুধু তা–ই নয়, বিশ্ববাজারেও এখন পণ্যটির মূল্য স্থিতিশীল।
বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় ভোজ্যতেলের উৎপাদন ও বিপণনের সব পর্যায়ে বাজার তদারকির দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। কিন্তু ‘প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা’ সুনির্দিষ্ট করে বলা হয়নি।
কেউ কেউ অন্যান্য পণ্য কেনার শর্তে ভোজ্যতেল বাজারজাত করছে, এমন তথ্য উঠে আসে বৈঠকে। এ ব্যাপারে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, উৎপাদক বা কোনো পর্যায়ে এ ধরনের শর্তযুক্ত বিক্রি বা বাজারজাত করা প্রচলিত আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এ ধরনের কোনো অভিযোগ প্রমাণিত হলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
ভোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অনেক দিন ধরেই ভোজ্যতেল নিয়ে সমস্যা চলছে। কিন্তু বাজার তদারকিতে তা ধরা পড়ে না। পড়লেও সেটি চেপে যাওয়া হয়। ছদ্মবেশে বা ক্রেতা সেজে বাজারে ঢুকলেই এর প্রমাণ পাওয়া যাবে। যারা এটি করছে, তারা সরকারের বাজার তদারকি ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে ধরাছোঁয়ার বাইরে অর্থাৎ আইনানুগ ব্যবস্থার বাইরেই থেকে যাচ্ছে।
নতুন একটি বিষয় উঠে আসে বৈঠকে, আর সেটি হচ্ছে ভোজ্যতেল পাচার বা এর অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্য। প্রতিবেশী দেশে মূল্য বেশি হওয়ায় অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্য হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে ব্যবসায়ীদের। অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্য হচ্ছে কি না, সীমান্তসংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন ও সংস্থাগুলোকে তা খতিয়ে দেখতে এবং তা প্রতিরোধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
বৈঠকে আরও বলা হয়েছে, নিজেদের পরিবেশকদের কাছে সরবরাহ করা ভোজ্যতেল ভোক্তারা সব সময় নির্ধারিত দামে কিনতে পারছেন কি না, তা ভোজ্যতেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোই তদারক করবে।
পরিশোধন কোম্পানিগুলো যা বলেছেবিটিটিসি জানায়, সিটি গ্রুপের প্রতিনিধি (উপদেষ্টা) অমিতাভ চক্রবর্তী বৈঠকে জানান, তাঁরা গত জানুয়ারিতে মোট ৫০ হাজার ৭০০ টন ভোজ্যতেল সরবরাহ করেছেন। এর মধ্যে ২২ হাজার ২৪২ টন বোতলজাত। এর আগের মাস ডিসেম্বরে তাঁরা ১৪ হাজার ২৬২ টন বোতলজাত ভোজ্যতেল সরবরাহ করেছিলেন।
এ ছাড়া মেঘনা গ্রুপের প্রতিনিধি জি এম তসলিম শাহরিয়ার জানান, জানুয়ারিতে তাঁরা মোট ৪৭ হাজার ৬৬৮ হাজার টন সরবরাহ করেন। এর মধ্যে ১৫ হাজার টন বোতলজাত। আগের মাসের ২৫ হাজার টনের মধ্যে ১২ হাজার টন ছিল বোতলজাত।
টি কে গ্রুপের পরিচালক শফিউল আতাহার তসলিম জানান, জানুয়ারিতে তাঁরা ১১ হাজার ৮১০ টন বোতলজাত সয়াবিন তেল সরবরাহ করেন, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ৯ হাজার ৫০০ টন।
অন্যান্য উৎপাদনকারীরাও জানান, তাঁরাও আগের মাসগুলোর তুলনায় সম্প্রতি বেশি তেল সরবরাহ করেছেন। ব্যবসায়ীরা জানান, রমজান উপলক্ষে এখন পাইপলাইনে প্রায় দেড় লাখ টন ভোজ্যতেল ভর্তি জাহাজ চট্টগ্রামের বন্দরে নোঙর করার অপেক্ষায় আছে। এই তেল শিগগিরই সরবরাহব্যবস্থায় যুক্ত হবে।
ব্যবসায়ীরা আরও জানান, মাঠপর্যায়ে কেউ অতিরিক্ত মজুত করে থাকতে পারেন। আবার কেউ কেউ অধিক লাভের আশায় বোতল কেটে খোলা তেলে পরিণত করে তা বিক্রি করতে পারেন।
বিটিটিসির তথ্য অনুযায়ী দেশে ভোজ্যতেলের বার্ষিক চাহিদা ২৩ থেকে ২৪ লাখ টন। তবে রমজানের চাহিদা বেশি, ১ লাখ ৮০ হাজার থেকে ৩ লাখ টন।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ত ভ জ যত ল র হ জ র টন ব যবস থ
এছাড়াও পড়ুন:
৭৭ মেট্রিক টন চাল তুলে নিয়েছেন ডিলার, উপকারভোগীরা জানেন ‘বরাদ্দ হয়নি’
মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলায় গত জুলাই মাসে ট্রেডিং করপোরেশন বাংলাদেশের (টিসিবি) উপকারভোগীদের জন্য ৭৭ দশমিক ৮ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ করা হয়েছিল। প্রক্রিয়া অনুযায়ী উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে এ চাল খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির (ওএমএস) একজন ডিলার (পরিবেশক) তুলেও নেন। তবে ওই মাসে টিসিবির অন্য পণ্য পেলেও চাল পাননি বলে অভিযোগ করেছেন উপকারভোগীরা।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, মহম্মদপুরের ৮ ইউনিয়নে টিসিবির উপকারভোগী কার্ডধারী আছেন ১৫ হাজার ৫৬৭ জন। এসব উপকারভোগী নিজেদের কার্ড দেখিয়ে প্রতি মাসে একবার ইউনিয়নের টিসিবির নিয়োগ করা ডিলারের কাছ থেকে বাজারের চেয়ে কম মূল্যে তেল, চিনি, ডাল ও চাল কিনতে পারেন। গত জুলাইয়ে ডিলারদের কাছ থেকে তেল, চিনি ও ডালের একটি প্যাকেজ কিনতে পেরেছেন তাঁরা। ওই মাসে চালের বরাদ্দ আসেনি বলে জানানো হয় কার্ডধারীদের।
মহম্মদপুর উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থেকে পাওয়া নথিতে দেখা গেছে, গত ৩০ জুলাই উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. মজনুর রহমান স্বাক্ষরিত দুইটি বিলি আদেশে (ডিও) উপজেলার হোসেনিয়া কান্তা ঋতু নামে একজন ওএমএস ডিলারের অনুকূলে ৭৭ দশমিক ৮৩৫ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়। ওই দিনই মহম্মদপুর ও বিনোদপুর খাদ্যগুদাম থেকে এ চাল তুলেও নেওয়া হয়।
সেখানে ৩০ টাকা কেজিতে চাল পাওয়া যায়। বাজার থেকে ওই চাল কিনতে কেজিতে প্রায় ৫০ টাকা লাগে। জুলাই মাসে চাল না পাওয়ায় কিছুটা কষ্টই হইছে।শরিফা, টিসিবির কার্ডধারী, রাজাপুর ইউনিয়নটিসিবি ও উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন টিসিবি উপকারভোগীদের চাল ছাড়া অন্য পণ্য সরাসরি তাঁদের নিয়োগ করা ডিলারদের কাছে সরবরাহ করে। চালের বরাদ্দ দেওয়া হয় খাদ্য বিভাগ থেকে। এ অনুযায়ী উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থেকে প্রথমে খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে নিয়োগ করা ওএমএস বা খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ডিলারদের অনুকূলে ২৬ টাকা কেজি দরে চাল বরাদ্দ দেয়। সেই চাল ওই ডিলারদের কাছ থেকে ২৮ টাকা কেজি দরে নেন টিসিবির ডিলাররা। এরপর তাঁরা ৩০ টাকা কেজি দরে ওই চাল উপকারভোগীদের কাছে বিক্রি করেন।
উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের পারুল নামে টিসিবির এক উপকারভোগী ১ সেপ্টেম্বর জানান, আগস্ট মাসে চাল, ডাল, তেল ও চিনির প্যাকেজ পেলেও জুলাই মাসে তাঁদের চাল ছাড়া অন্য তিন ধরনের পণ্যের প্যাকেজ দেওয়া হয়েছিল। জুলাই মাসে তাঁদের জানানো হয় চাল বরাদ্দ হয়নি।
বিষয়টি জানতে উপজেলার ৮ ইউনিয়নে টিসিবির নিয়োগ করা ৮ জন ডিলারের সঙ্গে কথা বলেছেন এই প্রতিবেদক। তাঁদের মধ্যে মহম্মদপুর সদর, নহাটা, পলাশবাড়ীয়া, বালিদিয়া, রাজাপুর ও বাবুখালী ইউনিয়নের ডিলার জানিয়েছেন, জুলাই মাসে তাঁদেরকে চাল দেওয়া হয়নি। নহাটা ও রাজাপুর ইউনিয়নের ডিলার মিলন ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী মিলন ঘোষ ৪ সেপ্টেম্বর বলেন, ‘জুলাই মাসে আমাদের বলা হইছিল চাল বরাদ্দ নেই। এ কারণে চাল ছাড়া অন্য পণ্যগুলো বিক্রি করেছি। তবে অ্যাপে দেখাইছিল চাল। কিন্তু আমরা পাইনি।’
হোসনিয়া কান্তা উপজেলার বিনোদপুর এলাকার ওএমএস ডিলার। গত ২৫ জুলাই লটারির মাধ্যমে তিনিসহ তিনজন উপজেলায় ওএমএস ডিলার হিসেবে নিয়োগ পানঅবশ্য বিনোদপুর ও দীঘা ইউনিয়নের দুই ডিলার দাবি করেছেন তাঁরা অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে চালও কার্ডধারীদের কাছে বিক্রি করেছেন। তবে দুই ইউনিয়নের অন্তত ১০ জন উপকারভোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে তাঁরা কেউই চাল পাননি। এর মধ্যে বিনোদপুর বাজারের একজন ফল ব্যাবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘জুলাই মাসে ডিলার জানাইছিল চাল ফুরায় গেছে।’
হোসনিয়া কান্তা উপজেলার বিনোদপুর এলাকার ওএমএস ডিলার। গত ২৫ জুলাই লটারির মাধ্যমে তিনিসহ তিনজন উপজেলায় ওএমএস ডিলার হিসেবে নিয়োগ পান বলে খাদ্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে। এ বিষয়ে জানতে হোসেনিয়া কান্তার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও পাওয়া যায়নি। উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থেকে সরবরাহ করা তাঁর মুঠোফোনে সোমবার যোগাযোগ করা হলে একজন ধরে জানান, ওই নম্বর হোসেনিয়া কান্তা ঋতু নামে কেউ ব্যবহার করেন না।
জানতে চাইলে টিসিবির ঝিনাইদহ ক্যাম্প অফিসের উপপরিচালক আকরাম হোসেন সোমবার (১৫ সেপ্টেম্বর) মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘টিসিবির চাল খাদ্য বিভাগ থেকে সরবরাহ করা হয়। আর বিতরণ কার্যক্রম তদারকির জন্য প্রতিটি উপজেলায় নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে একটি কমিটি রয়েছে। যেখানে প্রতি ইউনিয়নে একজন ট্যাগ অফিসার আছেন, যিনি এগুলো তদারকি করেন।’
জেলার কয়েকজন চাল ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২৬ টাকা কেজি দরে কেনা এসব চাল বাজারে প্রায় ৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। উপকারভোগীদের কাছে তা ৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করার কথা। এ হিসাবে উপকারভোগীদের ফাঁকি দিয়ে এ চাল বাজারে বিক্রি করতে পারলে কেজিতে ২২ থেকে ২৪ টাকা লাভ হয়।
চাল না পাওয়ার বিষয়ে কেউ কোনো অভিযোগ করেননি বলে জানিয়েছেন মহম্মদপুরের ইউএনও শাহীনুর আক্তার। সোমবার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘চাল দেওয়া হয়নি এখন পর্যন্ত এমন অভিযোগ কেউ দেয়নি। খাদ্য অফিস থেকে আমি যত দূর জানতে পেরেছি তাতে সবকিছু দেওয়া হয়ে গেছে। বরাদ্দ থাকলে তা আটকে রাখার সুযোগ নেই। তারপরও কোনো অভিযোগ থাকলে খতিয়ে দেখব।’
হঠাৎ এক মাসে চাল না পাওয়ায় বিপাকে পড়েন উপকারভোগীরা। রাজাপুর ইউনিয়নের শরিফা নামের টিসিবি কার্ডধারী এক নারী বলেন, ‘সেখানে ৩০ টাকা কেজিতে চাল পাওয়া যায়। বাজার থেকে ওই চাল কিনতে কেজিতে প্রায় ৫০ টাকা লাগে। জুলাই মাসে চাল না পাওয়ায় কিছুটা কষ্টই হইছে।’