সমাজ ও রাজনীতি ব্যবসার অনন্য পাঠ
Published: 10th, February 2025 GMT
সমাজ এক মহাগ্রন্থ। যেখানে প্রত্যেক মানুষ, প্রতিটি ঘটনা একেকটি গল্প। গল্পকার ও গবেষক নূরুননবী শান্ত সমাজ-গ্রন্থের নিবিষ্ট, তীক্ষ্ণ পাঠক। নিবিড় পর্যবেক্ষক হিসেবে তিনি সমাজের অন্তর্নিহিত ও মনস্তাত্ত্বিক ভাঁজ উন্মোচন করেন। অন্তর্দৃষ্টির বলে তিনি হয়ে ওঠেন সমাজ, সংস্কৃতি ও মানুষের জটিল সূত্রের আবিষ্কারক।
নূরুননবী শান্ত নিছক গল্প ফাঁদেন না; বরং তাঁর সামাজিক অভিজ্ঞতা, উপলব্ধি ও বিশ্লেষণ দিয়ে আখ্যান ও চরিত্র নির্মাণ করেন। তাঁর সৃষ্টির ভেতর দিয়ে সমাজের অন্তর্লীন সত্য মূর্ত ও বিমূর্ত– দুই রূপেই প্রকাশ হয়। সুতরাং, আমাদের তাঁর প্রতি বিশেষ মনোযোগী হতে হয়। কারণ, তিনি গল্প লেখার নাম করে সময়ের প্রতিচ্ছবি, সমাজের দ্বন্দ্ব, মানবিক টানাপোড়েন আর জীবনের বহুমাত্রা আমাদের সামনে হাজির করেন।
এই কথাশিল্পীর অনন্যসাধারণ ভাষাভঙ্গি সাহিত্য পাঠকের নব-অনুভবের উৎস হয়ে ওঠে। দুঃখের প্রসঙ্গে তাঁর উপস্থাপন গভীর, অথচ আবেগহীন। এক চমৎকার কৌশলে স্বর ও ভঙিমায় এমন সূক্ষ্ণ প্যাঁচ কষেন যে, দুঃখ যেন মনের ওপর ভারী হয়ে চেপে না বসতে পেরে নিঃশব্দে গড়িয়ে পড়ে যায়। তাঁর ভাষার ধরন এমনই– অতি সরল, অথচ মায়াবী ও আকর্ষণীয়। মনে হয়, যেন শতাব্দীপ্রাচীন পুঁথির আবহ ভেসে আসছে তাঁর কণ্ঠ থেকে– গম্ভীর, মৃদু, মোহনীয়।
‘খিদমতুল মউত’ নূরুননবী শান্তর নতুন গল্পগ্রন্থ। ৯টি গল্পে সাজানো বইটির শুরুতেই ‘অপ্রেমের গল্প’; যেখানে বর্তমান রাজনৈতিক অপক্ষমতা আর নৈরাজ্যের দৌরাত্ম্যের ঘেরাটোপে অস্থির চরিত্রগুলোকে দেখা যায়। প্রতিবাদের স্বরবীজ অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে ক্ষমতার অপকৌশল, জিম্মিদশা চেপে ধরে স্বরতন্ত্র। গল্পে এক স্কুলশিক্ষার্থীকে শিকার হতে দেখি রাজনৈতিক আধিপত্যবাদের; যেখানে সামাজিক অপক্ষমতার সামনে বিদ্যালয় প্রশাসনকে দাঁড়াতে হয় হাতজোড় করা, কাঁধভাঙা ভঙিতে। প্রেমও আটকা পড়ে রাজনৈতিক অপকৌশলের জালে। মানুষ পালিয়েও বাঁচতে পারে না। মরতেও যে পারে, তা নয়। অদৃশ্য পাগলাগারদের ভেতরে বসে সুন্দর মৃত্যুর স্বপ্ন দেখে।
দ্বিতীয় গল্প ‘কেউ না’। ‘কেউ’ হয়ে ওঠার সাধনাই যেন জীবন। পাশের মানুষটির কেউ একজন হওয়া, সমাজের কেউ হওয়া কিংবা বিশ্বসংসারের কেউ হয়ে ওঠার প্রাণান্ত প্রচেষ্টার অংশ হিসেবেই মানুষ প্রাণ বহন করে। নিজেকে ছড়িয়ে দিতে চায় বিশ্বপ্রাণে। কিন্তু ‘কেউ’ হয়ে উঠতে না পারার আক্ষেপে বিরুদ্ধ, নিয়মবাদী, নিয়ন্ত্রক, দাহ্য সমাজে মানুষ ‘কেউ না’ হয়ে বেঁচে থাকে কিনা, তা সে নিজেও জানে না। এ গল্পে সামাজিক জাতিগত ও শ্রেণি বিভাজনের চিত্রটি খেয়াল করি। মুচির ছেলে ‘বয়রক’, যে স্কুলে গিয়েই টের পায় সমাজ তাকে নেবে না। সে উপলব্ধি করে, ‘আমি কেউ না’।
নামগল্প ‘খিদমতুল মউত’। নষ্ট সমাজে সব যেখানে ব্যবসার বস্তু, এমনকি মৃত্যুর নিদানও পণ্য। এখানে একজন মানুষ, যিনি এই পচে যাওয়া সমাজের কাছ থেকে নিজেকে লুকিয়ে বাঁচতে চান, পারেন না। এমনকি স্বেচ্ছামৃত্যুর সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতাও যার নেই। শেষ পর্যন্ত নিজেকে তিনি তুলে দেন স্বেচ্ছামৃত্যুর স্টার্টআপ ‘খিদমতুল মউত’-এর হাতে।
‘খিদমতুল মউত’ আমার কাছে অনেকটা বর্তমান বাংলাদেশের হাসপাতাল বা ক্লিনিকের রূপক মনে হয়, যেখানে গেলে আপনি দুষ্টুচক্রের হাত থেকে রেহাই পাবেন না। গল্পের চরিত্রও শেষ পর্যন্ত রেহাই পান না, পালিয়ে বাঁচতে পারেন না, পড়ে যান দুষ্টুচক্রের জালে। দুর্নীতিগ্রস্ত শিক্ষাব্যবস্থা, মেকি বন্ধুত্ব, ক্ষমতালোভীদের উদ্ভট রাজনৈতিক উল্লম্ফন, সেবামূলক প্রতিষ্ঠান– সবই যেন সাজিয়ে রাখা হয়েছে মানুষের মৃত্যু নিশ্চিত করার বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে!
সব গল্প নিয়ে আলাদা করে বলার পরিসর এখানে নেই। উত্তরবঙ্গের ভাষামাধুর্য নবপ্রাণ পেয়েছে নূরুননবী শান্তর ‘খিদমতুল মউত’-এ। এ দেশের বিকলাঙ্গ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলে দিশাহীন মানুষের মৃতের মতো বেঁচে থাকার গল্পগুলো পাঠককে নতুন করে ভাবাবে।
খিদমতুল মউত ।। নূরুননবী শান্ত ।। গল্প ।। আইডিয়া প্রকাশন ।। প্রচ্ছদ: বেনামী বাউল ।। পৃষ্ঠা: ১১২ ।। মূল্য: ২০০ টাকা
মাহাবুবা লাভীন, কবি
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: বইম ল বই র জন ত ক ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
সব্যসাচী কাজী মোতাহার হোসেন বিজ্ঞান ও শিল্পের মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন
প্রথিতযশা অধ্যাপক ও পরিসংখ্যানবিদ কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন একজন সব্যসাচী মানুষ। তিনি নিজের কাজের মাধ্যমে বিজ্ঞান ও শিল্পের মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। তাঁর ঐতিহ্য শিক্ষার্থীদের ধারণ করতে হবে।
জ্ঞানতাপস কাজী মোতাহার হোসেনের ১২৮তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আজ বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) মিলনায়তনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বক্তারা এ কথাগুলো বলেন।
অনুষ্ঠানে স্মারক বক্তৃতা, বৃত্তি, পদক, পুরস্কার ও সনদ দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানের যৌথ আয়োজক কাজী মোতাহার হোসেন ফাউন্ডেশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগ এবং পরিসংখ্যান গবেষণা ও শিক্ষণ ইনস্টিটিউট।
অনুষ্ঠানে ‘যুগলের বন্ধন: কাজী নজরুল ইসলাম-কাজী মোতাহার হোসেন’ শীর্ষক স্মারক বক্তৃতা দেন অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী। তিনি দুই বন্ধুর সম্পর্কের রসায়নের নানা দিক তুলে ধরেন।
প্রধান অতিথি বক্তব্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়াজ আহমেদ খান বলেন, এই অনুষ্ঠানের দুটো প্রাপ্তি আছে। প্রথমত, মানুষের অবদান ও মেধাকে স্বীকার করা হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, এই উপমহাদেশের একজন প্রথিতযশা সব্যসাচী মানুষের ঋণ স্বীকার করা হচ্ছে।
কাজী মোতাহার হোসেন যেকোনো বিবেচনায় একজন দার্শনিক বলে উল্লেখ করেন নিয়াজ আহমেদ খান। তিনি বলেন, কাজী মোতাহার হোসেন বিজ্ঞান ও শিল্পের মধ্যে মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। প্রথম সারির পরিসংখ্যানবিদ, বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা ছাড়াও তিনি অনেকগুলো সামাজিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন, প্রভাব বিস্তার করেছেন। একজন মানুষের ছোট জীবদ্দশায় এত গুণ সন্নিবেশিত করা কঠিন। কিন্তু তিনি তা করে দেখিয়েছেন।
সবাইকে নিয়ে চলা, প্রতিষ্ঠান তৈরি করা, নিজের জগতের বাইরে নানা কিছুতে হাত বাড়িয়ে দেওয়ার মতো ঐতিহ্য কাজী মোতাহার হোসেন করে গেছেন বলে উল্লেখ করেন নিয়াজ আহমেদ খান। তিনি বলেন, তাঁর সম্মানে যাঁরা আজ স্বীকৃতি পেলেন, তাঁরা এই ঐতিহ্যকে ধারণ করবেন। এটা (বিশ্ববিদ্যালয়) যে সামাজিক প্রতিষ্ঠান, সে বার্তা দেবেন। যেসব শিক্ষার্থী সম্মাননা পাচ্ছেন, তাঁদের ছোট প্রোফাইল তৈরি করে ওয়েবসাইটে তুলে দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
কাজী মোতাহার হোসেন ফাউন্ডেশনের সভাপতি অধ্যাপক আবদুল মাজেদ বলেন, কাজী মোতাহার হোসেন একজন সব্যসাচী মানুষ ছিলেন। বিজ্ঞানের এমন কোনো দিক নেই, যেখানে তাঁর পদচারণা ছিল না। তিনি দাবা খুব পছন্দ করতেন। দাবা খেলার কথা শুনলে তিনি ছুটে যেতেন। কাজী মোতাহার হোসেনকে নিয়ে তাঁর শোনা নানা গল্প তিনি স্মৃতিচারণা করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জাফর আহমেদ খান বলেন, কাজী মোতাহার হোসেন পরিসংখ্যান চর্চার পথিকৃৎ ছিলেন। বিজ্ঞান, দাবাচর্চারও পথিকৃৎ ছিলেন। এমন কোনো পুরস্কার নেই যে, তিনি পাননি। তাঁর দেখানো পথে যেন শিক্ষার্থীরা নিজেদের আলোকিত করতে পারেন।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন কাজী মোতাহার হোসেন ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক কাজী রওনাক হোসেন। এই আয়োজনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের বিভিন্ন বর্ষের সেরা শিক্ষার্থীদের বই, নগদ অর্থ ও সনদ তুলে দেওয়া হয়। এ ছাড়া কাজী মোতাহার হোসেনকে নিয়ে আয়োজিত রচনা প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়।