বাংলার জনজীবনের প্রকৃত রূপ-বৈচিত্র্য খুঁজতে আমাদের ফিরতে হবে পল্লিতে। যেখানে প্রকৃতির রূপ-রস-গন্ধমাখা সরলতা ও সরসতায় ঐশ্বর্যমণ্ডিত মাটিঘেঁষা মানুষের জীবনচক্র। প্রতিদিনের টুকরো টুকরো যাপিত জীবনচিত্র, লোকজ বিশ্বাস, টানাপোড়েন ও প্রথা– সব মিলিয়েই পাওয়া যাবে বাঙালির আত্মপরিচয়ের ভাষাচিত্র। শৈল্পিক সৌন্দর্যে রাঙিয়ে শব্দে শব্দে সেই চিত্র এঁকেছেন আশির দশকের ধীমান কবি ও কথাসাহিত্যিক কাজল শাহনেওয়াজ তাঁর সাম্প্রতিক গদ্যগ্রন্থ ‘দিঘলী’তে।
ষাট ও সত্তরের দশকের গ্রামীণ জনজীবনের আখ্যান গল্পচ্ছলে লিখেছেন তিনি। প্রচ্ছদপটে লেখা, বায়োপিক। মানে আত্মজীবনীমূলক চলচ্চিত্র। যে চিত্র চোখের সামনে চলমান, তা-ই মূলত চলচ্চিত্র। সেই অর্থে ‘দিঘলী’ ভাষায় নির্মিত চলচ্চিত্র। ‘দিঘলী’ পড়তে পড়তে পাঠক চোখের সামনে দেখতে পাবেন কতগুলো চরিত্র চলাফেরা করছে, কথা বলছে। সেসব চরিত্রকে আবর্তিত করে ঘটে যাচ্ছে নানা ঘটনা। সেসব ঘটনা মোটেও লেখকের কল্পনাপ্রসূত নয়। সেসব ঘটনা বাস্তব; লেখকের অভিজ্ঞতার নিপুণ কারুকাজ।
আত্মজীবনী বলা হলেও ‘দিঘলী’কে আমরা উপন্যাসও বলতে পারি। এখানে প্রধান চরিত্র কাজল। মায়ের পেটে থাকার সময় কী কী ঘটে চলেছে, সেই কাহিনি থেকেই মূলত আখ্যান আরম্ভ। এর পর আমরা জানতে পারি কাজলের পূর্বপুরুষের পরিচয়। দাদা-দাদি, নানা-নানি, চাচা-মামা, বাবা-মা– প্রত্যেকেই একেকজন চরিত্র। সেসব চরিত্রের সন্নিবেশে ঘটতে থাকে নানা ঘটনা। একদিকে পদ্মার ভাঙন, অন্যদিকে ইংরেজ সৈন্যদের হাতে সর্বস্বান্ত হয়ে দাদার পরিবার ধুঁকে ধুঁকে দিন কাটাতে থাকে। কেবল ব্যক্তিবিশেষ নয়, সেই সময়ের আরও মানুষের জীবনে এ রকম ঘটনার সমাবেশ ছিল। নিকটাত্মীয়দের জীবনচিত্রের ভেতর দিয়েই কাজল মূলত ওই সময়ের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর লৌকিক ইতিহাস রচনা করেছেন।
‘দিঘলী’ ফরিদপুর জেলার একটি অঞ্চল। এ অঞ্চলেই কেটেছে কাজল শাহনেওয়াজের শৈশব। আজকের ফরিদপুরের যে চালচিত্র, তার সঙ্গে ষাট কিংবা সত্তরের দশকের ফরিদপুরের কোনোই সাদৃশ্য নেই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেছে এ অঞ্চলের মানুষের জীবনধারা। আসলে দিঘলী পুরো বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়েই এই আখ্যানে সেই সময়ের চিহ্নের ছাপ রেখে গেছে। বিষণ্ন শৈশবের খেলার সাথিদের কথা কাজল অকপটে লিখে গেছেন। লিখেছেন স্কুলজীবনের কথা। এসব কিছুই আসলে ষাট ও সত্তরের দশকের জনজীবনের আখ্যান। সেই সময়ের মানুষের জীবনে নদীর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। নদীকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য ও জীবন নির্বাহের ইতিহাস ধরা আছে ‘দিঘলী’তে।
কাজলের বাবা ছিলেন সরকারি পশু চিকিৎসক। ফরিদপুরের নানা অঞ্চলে তিনি বদলি হতেন। সঙ্গে নিয়ে যেতে হতো পরিবারকে। বিচিত্র চরিত্রের মানুষের সঙ্গে চেনাজানা হতে শুরু করে কিশোর কাজলের। যৌনতার প্রথম ধারণা কীভাবে পান, সে অভিজ্ঞতা তিনি গল্পচ্ছলে চিত্তাকর্ষক ভাষায় পাঠককে জানিয়েছেন। ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু জমিদারদের অন্দরমহলের জৌলুসহীন জীবনচিত্র থেকে শুরু করে সমাজের নানা শ্রেণির মানুষের জীবনাচার ও প্রথা-অনুষ্ঠানের হৃদয়গ্রাহী বর্ণনা ‘দিঘলী’র পাতায় পাতায়। নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে কাজল মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তুলে ধরেছেন পাঠকের সামনে। তিনি যেন দর্শক; চোখের সামনে ঘটে যেতে দেখছেন নানা ঘটনা।
পাকিস্তানি আর্মির ভয়ে মানুষ পালাচ্ছে। জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে ঘরবাড়ি, বাজার। হামলা হচ্ছে থানায়। এর পর স্বাধীনতার পর দেশবাসী বঙ্গবন্ধুকে তাদের পরিত্রাতা হিসেবে মান্য করতে শুরু করল। কিন্তু কয়েক বছর যেতেই আওয়ামী লীগের ফেরেব্বাজি খোলাসা হয়ে পড়ল জনতার সামনে। সবার মান্য পশু চিকিৎসক বাবাকে হেনস্তা হতে হলো ছাত্রলীগের ক্যাডারদের হাতে।
‘দিঘলী’ যে কেবল বিশেষ একটি সময়ের জনজীবনের আখ্যান, তা কিন্তু নয়। বরং এই আখ্যান বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে কাজল সেই সময়ের কিছু ইতিহাসও এই সময়ের পাঠকের কাছে উপস্থিত করেছেন। বিভিন্ন অঞ্চলের নামকরণ ও উৎপত্তির ইতিহাস পাঠক জানতে পারবেন। অতীতের কথা হলেও কাজলের গল্প লেখার ভাষাভঙ্গি এমনই যে, পাঠক যেন এইমাত্র সব ঘটনা চোখের সামনে ঘটতে দেখছেন। ভাষার জাদুকরী কুশলতায় পাঠকের মনেও থাকে না– যে গল্প তিনি পড়ছেন সেসব কাহিনি ঘটে গেছে পাঁচ-ছয় দশক আগে।
কাজলের ভাষার জাদুতে মোহগ্রস্ত পাঠকের কাছে প্রতিটি চরিত্র খুবই পরিচিত মনে হতে থাকবে, যেন কত দিনের আপনজন তারা! শিল্প-নৈপুণ্যের এই কৃতিত্ব কাজল এর আগেও তাঁর কথাসাহিত্যে দেখিয়েছেন। তবে এই প্রথম তিনি স্মৃতির ঝাঁপি খুলে একে একে বের করে আনলেন তাঁর শৈশব ও কৈশোরের স্মৃতিকাতর চরিত্রগুলোকে। আগের কথাসাহিত্যের চরিত্র থেকে এসব চরিত্রের পার্থক্য হচ্ছে, এরা প্রত্যেকেই বিশেষ একটি সময় ও সমাজের প্রতিনিধি। আখ্যান ছাড়াও যাদের রয়েছে ঐতিহাসিক গুরুত্ব।
দিঘলী ।। কাজল শাহনেওয়াজ ।। গদ্য ।। প্রকাশক: বৈভব ।। প্রচ্ছদ: মনজুরুল আহসান ওলী ও বেনজামিন রিয়াজী ।। পৃষ্ঠা: ২৫২ ।। মূল্য: ৭২০ টাকা
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: বইম ল ম ন ষ র জ বন চ খ র স মন স ই সময় র র দশক র জ বন র
এছাড়াও পড়ুন:
সত্য মিথ্যা যাচাই না করে শেয়ার করবেন না, মেসেজটা তৃণমূলে ছড়িয়ে দিন: সিইসি
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেছেন, 'আমাদের একটা অভ্যাস হয়ে গেছে একটা নেতিবাচক সংবাদ দেখলেই যাচাই-বাছাই না করে শেয়ার করে দেওয়া হয়। অত্যন্ত ভিত্তিহীন সংবাদও আমরা শেয়ার করে দেই।'
সিইসি বলেন, 'দয়া করে সত্য মিথ্যা যাচাই না করে শেয়ার করবেন না। এই মেসেজটা তৃণমূলে ছড়িয়ে দিন। তথ্যটা যেন আগে যাচাই করে তারপরে শেয়ার করেন।'
আজ সোমবার রাজধানীর ভাটারায় আনসার গার্ড ব্যাটালিয়নে (এজিবি) এক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে এসব কথা বলেন সিইসি। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় ভুয়া সংবাদের প্রচার ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপপ্রয়োগ রোধে করণীয় সম্পর্কে তিনি এসব কথা বলেন।
থানা আনসার কোম্পানি/প্লাটুন সদস্যদের আনসার মৌলিক প্রশিক্ষণের (৪র্থ ধাপ) সমাপনী উপলক্ষে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সিইসি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোনো সংবাদ দেখা মাত্রই নাগরিকদের যাচাইবাছাই করতে আহ্বান জানান সিইসি। নিশ্চিত হওয়ার আগে শেয়ার না করতে বলেন তিনি।
জাতীয় নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে আনসার ভিডিপির ভূমিকাকে মূল শক্তি বলে উল্লেখ করেন সিইসি। তিনি বলেন, 'এনারাই অধিক সংখ্যায় নিয়োজিত থাকেন। এবং আমাদের হিসেব করতে গেলে প্রথম এদেরকেই হিসেব করতে হয় যে, কতজন আনসার ভিডিপি সদস্য আমরা মোতায়েন করতে পারব। মূল কাজটা আঞ্জাম (সম্পাদন) দিতে হয় কিন্তু আনসার এবং ভিডিপির সদস্যদের।'
অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবদুল মোতালেব সাজ্জাদ মাহমুদ। নির্বাচনকালীন জনগণের নিরাপত্তা, ভোট কেন্দ্রের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখা এবং সুষ্ঠুভাবে ভোট গ্রহণে আনসার বাহিনী সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিয়ে কাজ করছে বলে জানান তিনি। নির্বাচনে দেশজুড়ে প্রায় ৬ লাখ আনসার ও ভিডিপি সদস্য দায়িত্বপালন করবেন বলেন মহাপরিচালক।
অনুষ্ঠানে মহড়ায় ঢাকা মহানগর আনসারের চারটি জোনের অধীন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ৩২০ জন আনসার ও ভিডিপি সদস্য অংশ নেন। আনসার গার্ড ব্যাটালিয়নের সদস্যরা টহল, দায়িত্ব বণ্টন ও জরুরি প্রতিক্রিয়া অনুশীলনে অংশ নেন।
মহড়ায় ভোটকেন্দ্রে নির্বাচনী সরঞ্জামাদি নিরাপদে পৌঁছে দেওয়া, ভোটারদের শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে ভোট প্রদানে সহায়তা, জাল ভোট প্রতিরোধ, প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা এবং সেনা, বিজিবি, র্যাব ও পুলিশের সঙ্গে দ্রুত সমন্বয়ের প্রস্তুতি নেওয়া হয়।
অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বিভিন্ন জোনের অধিনায়ক এবং প্রশিক্ষণ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।