Samakal:
2025-05-01@13:16:12 GMT

আত্মপরিচয়ের ভাষাচিত্র

Published: 13th, February 2025 GMT

আত্মপরিচয়ের ভাষাচিত্র

বাংলার জনজীবনের প্রকৃত রূপ-বৈচিত্র্য খুঁজতে আমাদের ফিরতে হবে পল্লিতে। যেখানে প্রকৃতির রূপ-রস-গন্ধমাখা সরলতা ও সরসতায় ঐশ্বর্যমণ্ডিত মাটিঘেঁষা মানুষের জীবনচক্র। প্রতিদিনের টুকরো টুকরো যাপিত জীবনচিত্র, লোকজ বিশ্বাস, টানাপোড়েন ও প্রথা– সব মিলিয়েই পাওয়া যাবে বাঙালির আত্মপরিচয়ের ভাষাচিত্র। শৈল্পিক সৌন্দর্যে রাঙিয়ে শব্দে শব্দে সেই চিত্র এঁকেছেন আশির দশকের ধীমান কবি ও কথাসাহিত্যিক কাজল শাহনেওয়াজ তাঁর সাম্প্রতিক গদ্যগ্রন্থ ‘দিঘলী’তে। 

ষাট ও সত্তরের দশকের গ্রামীণ জনজীবনের আখ্যান গল্পচ্ছলে লিখেছেন তিনি। প্রচ্ছদপটে লেখা, বায়োপিক। মানে আত্মজীবনীমূলক চলচ্চিত্র। যে চিত্র চোখের সামনে চলমান, তা-ই মূলত চলচ্চিত্র। সেই অর্থে ‘দিঘলী’ ভাষায় নির্মিত চলচ্চিত্র। ‘দিঘলী’ পড়তে পড়তে পাঠক চোখের সামনে দেখতে পাবেন কতগুলো চরিত্র চলাফেরা করছে, কথা বলছে। সেসব চরিত্রকে আবর্তিত করে ঘটে যাচ্ছে নানা ঘটনা। সেসব ঘটনা মোটেও লেখকের কল্পনাপ্রসূত নয়। সেসব ঘটনা বাস্তব; লেখকের অভিজ্ঞতার নিপুণ কারুকাজ।

আত্মজীবনী বলা হলেও ‘দিঘলী’কে আমরা উপন্যাসও বলতে পারি। এখানে প্রধান চরিত্র কাজল। মায়ের পেটে থাকার সময় কী কী ঘটে চলেছে, সেই কাহিনি থেকেই মূলত আখ্যান আরম্ভ। এর পর আমরা জানতে পারি কাজলের পূর্বপুরুষের পরিচয়। দাদা-দাদি, নানা-নানি, চাচা-মামা, বাবা-মা– প্রত্যেকেই একেকজন চরিত্র। সেসব চরিত্রের সন্নিবেশে ঘটতে থাকে নানা ঘটনা। একদিকে পদ্মার ভাঙন, অন্যদিকে ইংরেজ সৈন্যদের হাতে সর্বস্বান্ত হয়ে দাদার পরিবার ধুঁকে ধুঁকে দিন কাটাতে থাকে। কেবল ব্যক্তিবিশেষ নয়, সেই সময়ের আরও মানুষের জীবনে এ রকম ঘটনার সমাবেশ ছিল। নিকটাত্মীয়দের জীবনচিত্রের ভেতর দিয়েই কাজল মূলত ওই সময়ের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর লৌকিক ইতিহাস রচনা করেছেন।

‘দিঘলী’ ফরিদপুর জেলার একটি অঞ্চল। এ অঞ্চলেই কেটেছে কাজল শাহনেওয়াজের শৈশব। আজকের ফরিদপুরের যে চালচিত্র, তার সঙ্গে ষাট কিংবা সত্তরের দশকের ফরিদপুরের কোনোই সাদৃশ্য নেই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেছে এ অঞ্চলের মানুষের জীবনধারা। আসলে দিঘলী পুরো বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়েই এই আখ্যানে সেই সময়ের চিহ্নের ছাপ রেখে গেছে। বিষণ্ন শৈশবের খেলার সাথিদের কথা কাজল অকপটে লিখে গেছেন। লিখেছেন স্কুলজীবনের কথা। এসব কিছুই আসলে ষাট ও সত্তরের দশকের জনজীবনের আখ্যান। সেই সময়ের মানুষের জীবনে নদীর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। নদীকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য ও জীবন নির্বাহের ইতিহাস ধরা আছে ‘দিঘলী’তে।

কাজলের বাবা ছিলেন সরকারি পশু চিকিৎসক। ফরিদপুরের নানা অঞ্চলে তিনি বদলি হতেন। সঙ্গে নিয়ে যেতে হতো পরিবারকে। বিচিত্র চরিত্রের মানুষের সঙ্গে চেনাজানা হতে শুরু করে কিশোর কাজলের। যৌনতার প্রথম ধারণা কীভাবে পান, সে অভিজ্ঞতা তিনি গল্পচ্ছলে চিত্তাকর্ষক ভাষায় পাঠককে জানিয়েছেন। ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু জমিদারদের অন্দরমহলের জৌলুসহীন জীবনচিত্র থেকে শুরু করে সমাজের নানা শ্রেণির মানুষের জীবনাচার ও প্রথা-অনুষ্ঠানের হৃদয়গ্রাহী বর্ণনা ‘দিঘলী’র পাতায় পাতায়। নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে কাজল মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তুলে ধরেছেন পাঠকের সামনে। তিনি যেন দর্শক; চোখের সামনে ঘটে যেতে দেখছেন নানা ঘটনা।

পাকিস্তানি আর্মির ভয়ে মানুষ পালাচ্ছে। জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে ঘরবাড়ি, বাজার। হামলা হচ্ছে থানায়। এর পর স্বাধীনতার পর দেশবাসী বঙ্গবন্ধুকে তাদের পরিত্রাতা হিসেবে মান্য করতে শুরু করল। কিন্তু কয়েক বছর যেতেই আওয়ামী লীগের ফেরেব্বাজি খোলাসা হয়ে পড়ল জনতার সামনে। সবার মান্য পশু চিকিৎসক বাবাকে হেনস্তা হতে হলো ছাত্রলীগের ক্যাডারদের হাতে।

‘দিঘলী’ যে কেবল বিশেষ একটি সময়ের জনজীবনের আখ্যান, তা কিন্তু নয়। বরং এই আখ্যান বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে কাজল সেই সময়ের কিছু ইতিহাসও এই সময়ের পাঠকের কাছে উপস্থিত করেছেন। বিভিন্ন অঞ্চলের নামকরণ ও উৎপত্তির ইতিহাস পাঠক জানতে পারবেন। অতীতের কথা হলেও কাজলের গল্প লেখার ভাষাভঙ্গি এমনই যে, পাঠক যেন এইমাত্র সব ঘটনা চোখের সামনে ঘটতে দেখছেন। ভাষার জাদুকরী কুশলতায় পাঠকের মনেও থাকে না– যে গল্প তিনি পড়ছেন সেসব কাহিনি ঘটে গেছে পাঁচ-ছয় দশক আগে।

কাজলের ভাষার জাদুতে মোহগ্রস্ত পাঠকের কাছে প্রতিটি চরিত্র খুবই পরিচিত মনে হতে থাকবে, যেন কত দিনের আপনজন তারা! শিল্প-নৈপুণ্যের এই কৃতিত্ব কাজল এর আগেও তাঁর কথাসাহিত্যে দেখিয়েছেন। তবে এই প্রথম তিনি স্মৃতির ঝাঁপি খুলে একে একে বের করে আনলেন তাঁর শৈশব ও কৈশোরের স্মৃতিকাতর চরিত্রগুলোকে। আগের কথাসাহিত্যের চরিত্র থেকে এসব চরিত্রের পার্থক্য হচ্ছে, এরা প্রত্যেকেই বিশেষ একটি সময় ও সমাজের প্রতিনিধি। আখ্যান ছাড়াও যাদের রয়েছে ঐতিহাসিক গুরুত্ব।

দিঘলী ।। কাজল শাহনেওয়াজ ।। গদ্য ।। প্রকাশক: বৈভব ।। প্রচ্ছদ: মনজুরুল আহসান ওলী ও বেনজামিন রিয়াজী ।। পৃষ্ঠা: ২৫২ ।। মূল্য: ৭২০ টাকা

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: বইম ল ম ন ষ র জ বন চ খ র স মন স ই সময় র র দশক র জ বন র

এছাড়াও পড়ুন:

ছবিতে শিল্পকলা একাডেমির দুই দিনের নৃত্যানুষ্ঠান

আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সংগীত, নৃত্য ও আবৃত্তি বিভাগের আয়োজনে শেষ হলো দুই দিনব্যাপী নৃত্যের অনুষ্ঠান। গতকাল ৩০ এপ্রিল বিকেল পাঁচটায় জাতীয় নাট্যশালায় সমাপনী দিনের আয়োজন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
অনুষ্ঠানের শুরুতে ‘সেমি ক্ল্যাসিক্যাল’ নৃত্য পরিবেশন করে নৃত্যদল ‘নৃত্যায়ন’, নৃত্য পরিচালনায় ছিলেন মনিরা পারভীন। নৃত্যদল ‘কল্পতরু’ পরিবেশন করে সমবেত নৃত্য ‘অঞ্জলি লহ মোর’, নৃত্য পরিচালনা করেছেন সম্রাট দত্ত ও নির্দেশনা দিয়েছেন লুবনা মরিয়ম। অমিত চৌধুরীর পরিচালনায় সমবেত নৃত্য ‘বিপুল তরঙ্গ, নিখিল’ পরিবেশন করে কায়া আশ্রম। বাংলাদেশ লোক সাংস্কৃতিক সংসদ ‘লোক আঙ্গিকে নৃত্য’ পরিবেশন করে, নৃত্য পরিচালনায় ছিলেন মো. ইমদাদুল হক।

ওয়ার্দা রিহাবের পরিচালনায় সমবেত নৃত্য ‘ইন্সট্রুমেন্টাল’ পরিবেশন করে নৃত্যদল ‘ধৃতি নর্তনালয়’। কত্থক নৃত্য সম্প্রদায় পরিবেশন করে ‘কত্থক (তারানা)’, নৃত্য পরিচালনায় ছিলেন সাজু আহমেদ এবং পুষ্পাঞ্জলি নৃত্যকলা কেন্দ্র পরিবেশন করে ‘দাঁড়ালে দুয়ারে মোর’, নৃত্য পরিচালনা করেছেন কস্তুরী মুখার্জী। লিখন রায়ের পরিচালনায় সমবেত নৃত্য ‘বাংলাদেশের ঢোল’ পরিবেশন করে নৃত্যদল ‘নৃত্যকথা’।

ধ্রুপদি নৃত্যালয় পরিবেশন করে ‘কত্থক আঙ্গিকে নৃত্য’, নৃত্য পরিচালনা করেছেন স্নাতা শাহরিন। সমবেত নৃত্য ‘ও পৃথিবী এবার এসে’ পরিবেশন করে নৃত্যদল ‘নৃত্যাক্ষ’, নৃত্য পরিচালনায় ছিলেন সালমা বেগম মুন্নি। সোহেল রহমানের পরিচালনায় শিখর কালচারাল অর্গানাইজেশন পরিবেশন করে সমবেত নৃত্য ‘চাঁদ উঠেছে ঐ’।  

গোলাম মোস্তফা ববির পরিচালনায় নৃত্যসংগঠন ‘নৃত্যবৃত্তি’ পরিবেশন করে ‘ভরতনাট্যম (বর্ণম)’ এবং নৃত্যদল ‘নাচঘর’ পরিবেশন করে সমবেত নৃত্য ‘গান গাই আমার মনরে বুঝাই’, নৃত্য পরিচালনায় ছিলেন আইরিন পারভীন। জিনিয়া জ্যোৎস্নার পরিচালনায় জিনিয়া নৃত্যকলা একাডেমি পরিবেশন করে ‘লোক আঙ্গিকে নৃত্য’। আকৃতি একাডেমি পরিবেশন করে সমবেত নৃত্য ‘আয় বৃষ্টি ঝেপে’, নৃত্য পরিচালনা করেছেন শহীদুল ইসলাম বাবু।

তামান্না রহমানের পরিচালনায় নৃত্যম নৃত্যশীলন কেন্দ্র পরিবেশন করে ‘সেমি ক্ল্যাসিক্যাল নৃত্য’ এবং ‘বন্ধু বিনে প্রাণ বাঁচে না’ গানের সঙ্গে সমবেত নৃত্য পরিবেশন করে নৃত্যদল ‘আরাধনা’, নৃত্য পরিচালনায় ছিলেন প্রিয়াংকা সাহা। ‘কত্থক (তারানা, তাল-ত্রিতাল)’ পরিবেশন করে পরম্পরা নৃত্যালয়, নৃত্য পরিচালনা করেছেন মো. মাসুম হোসাইন।

মৈত্রী সরকারের পরিচালনায় সমবেত নৃত্য ‘নাচে শ্যাম রাই’ পরিবেশন করে নৃত্যসংগঠন ‘স্বপ্ন বিকাশ কলাকেন্দ্র’ এবং নৃত্যসংগঠন ‘পরশমণি কলা কেন্দ্র’ পরিবেশন করে সমবেত নৃত্য ‘মাঠের সবুজ থেকে’, নৃত্য পরিচালনায় ছিলেন আমিরুল ইসলাম।

সমবেত নৃত্য ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে’ পরিবেশন করে নৃত্যসংগঠন ‘নৃত্যছন্দ’, নৃত্য পরিচালনা করেছেন বেনজির সালাম। ঝংকার ললিতকলা একাডেমি পরিবেশন করে সমবেত নৃত্য ‘ওর মোর নাইওর না যাইমু’, নৃত্য পরিচালনায় ছিলেন ফাতেমা কাশেম। আনিসুর ইসলাম হিরোর পরিচালনায় ‘দারুণ অগ্নিবাণে’ গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করে সৃষ্টি কালচারাল সেন্টার।

নৃত্যদল ‘স্পন্দন’ পরিবেশন করে সমবেত নৃত্য ‘দাও হেলানী দিয়ে’, নৃত্য পরিচালনা করেছেন অনিক বোস। ‘এই দেশ আমার’ গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করে নৃত্যকল্প পারফর্মিং আর্টস। হেনা হোসেনের পরিচালনায় ‘ফাগুনের মোহনায়’ গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করে নৃত্যদল ‘অভিনয়া’।

অনির্বাণ একাডেমি পরিবেশন করে সমবেত নৃত্য ‘মিলন হবে কত দিনে’, নৃত্য পরিচালনায় ছিলেন জামান পারভেজ। নূরে আলম চন্দনের পরিচালনায় বকুল নৃত্যালয়ের নৃত্যশিল্পীবৃন্দ পরিবেশন করে সমবেত নৃত্য ‘বাজেরে বাজে ঢোল আর ঢাক’।  
জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনের মধ্য দিয়ে শেষ হয় দুই দিনব্যাপী নৃত্যের অনুষ্ঠানমালা।

সম্পর্কিত নিবন্ধ