Samakal:
2025-05-01@04:42:00 GMT

স্মৃতিই যখন অনুপ্রেরণা

Published: 13th, February 2025 GMT

স্মৃতিই যখন অনুপ্রেরণা

চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি খেলতে আজ রাতে আরব আমিরাতের উদ্দেশে দেশ ছাড়বে বাংলাদেশ। বুধবার অফিসিয়াল সংবাদ সম্মেলনে অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত আট জাতির এই টুর্নামেন্টের প্রস্তুতি, লক্ষ্য, সম্ভাবনা ও প্রত্যাশা নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন। তিনি জানান, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে যাচ্ছেন চ্যাম্পিয়ন হওয়াল লক্ষ্যে।

চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির প্রেরণা

শান্ত: শেষ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ভালো একটা স্মৃতি আছে; সেমিফাইনাল খেলেছি। এটা বাড়তি একটা অনুপ্রেরণা দেবে। পাশাপাশি দেশের মানুষের প্রত্যাশা ও খেলোয়াড়দের পরিবারের প্রত্যাশা আছে। আমরা যেভাবে প্রস্তুতি নিতে পেরেছি, আশা করছি ভালো কিছু করা সম্ভব হবে।

নিজের প্রস্তুতি নিয়ে

শান্ত: আমার ম্যাচ খেলতে না পারার ভেতরেও ইতিবাচক দিক ছিল। অতিরিক্ত অনুশীলন করার সুযোগ পেয়েছি। কোচরা সাহায্য করেছেন। ফিটনেস নিয়েও কাজ করতে পেরেছি। বিপিএলের সময়ে খুব ভালো প্রস্তুতি নিতে পেরেছি। আশা করছি, সব ঠিক থাকলে টুর্নামেন্টটা ভালো যাবে।

ম্যাচ প্র্যাকটিসের ঘাটতি

শান্ত: শেষ ওয়ানডে ম্যাচে ভালো একটা ইনিংস খেলেছিলাম আফগানিস্তানের বিপক্ষে। টি২০ বিষয়টি নিয়ে যেটা বললেন, ভালো অবস্থায় নেই। গত বছর রান মোটামুটি করেছি, স্ট্রাইক রেট ওই রকম আপ টু দ্য মার্ক ছিল না। তবে রান মোটামুটি ভালো করেছি। আমি বিশ্বাস করি, আমি এর চেয়েও ভালো ব্যাটার। আসলে ওই সংস্করণ নিয়ে চিন্তা করছি না। ওয়ানডে ফরম্যাট ভালো যাচ্ছে। অনেক দিন পর ম্যাচ খেলব। ম্যাচ প্রস্তুতিটা এখানে হচ্ছে। গতকাল ম্যাচ সিনারিও প্র্যাকটিস হয়েছে। আজকে হবে। সামনে একটি প্র্যাকটিস ম্যাচ আছে। আর এই সংস্করণে আমরা ছোটবেলা থেকে অনেক খেলি। সুতরাং মানিয়ে নিতে সমস্যা হবে না। 

প্রস্তুতি নিয়ে কোচের অতৃপ্তি

শান্ত: আমার মনে হয় না, কোচ এ রকম কোনো কিছু মিন করেছেন। ফরম্যাট অনুযায়ী দেখলে একটু তো ভিন্নতা আছেই। উইকেট ভালো ছিল, ব্যাটাররা ভালো প্রস্তুতি নিয়েছে। এখন ৫০-৬০ রানকে কীভাবে ১০০-১৩০ করতে পারে, এটা গুরুত্বপূর্ণ। তারই ম্যাচ সিনারি হচ্ছে। একটি প্রস্তুতি ম্যাচ আছে। ভালো উইকেটেও বেশ কিছু বোলার ভালো বল করেছে। আমার মনে হয় প্রস্তুতির দিক দিয়ে আমরা ভালো অবস্থানে আছি। আমাদের হাতে সাত দিন সময় তো আছেই। এই সাত দিনে আরও একটু গুছিয়ে নিতে পারব।

রিয়াদ-মুশফিকের রোল

শান্ত: তারা দু’জন খুবই গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়। এত বছর ধরে খেলছেন, শেষ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতেও ছিলেন। তাদের এই অভিজ্ঞতা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তবে অধিনায়ক হিসেবে কোনো একক খেলোয়াড়ের ওপর ভরসা করি না। পুরো দল নিয়ে চিন্তা। আমরা হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে খেলতে পারলে ভালো করা সম্ভব। রিয়াদ ভাই, মুশফিক ভাইয়ের কাছে চাওয়া, তারা যেন নিজেদের অভিজ্ঞতা সবাইকে দেন, তাদের ভাবনা যেন মাঠের ভেতর শেয়ার করেন।

দুবাইয়ে রান চেজ করা বা বড় টার্গেট সেট করা

শান্ত: আমি পাকিস্তানে ৩০০ প্লাস রান আশা করছি। আগে ব্যাট করলে অবশ্যই এ ধরনের স্কোর করতে হবে। ডিফেন্ড করার ক্ষেত্রেও এ রকম রান ডিফেন্ড করতে হবে। দুবাইয়ে একেক সময় একেক রকম হয়। আমার মনে হয়, ২৬০ থেকে ২৮০-এর ভেতরেই থাকবে। এভাবে সংখ্যা অনুমান করা কঠিন। তবে অতীতের স্ট্যাট.

দেখলে তাই মনে হয়। নির্দিষ্ট দিনে কী রকম রান করা দরকার বা কত রানে আটকানো দরকার– এসব অ্যানালাইসিস করব আমরা।

টুর্নামেন্টে দলীয় লক্ষ্য

শান্ত: আমরা চ্যাম্পিয়ন হওয়ার লক্ষ্যে যাচ্ছি।

বিপিএলে রিশাদের খেলা নিশ্চিত করা

শান্ত: রিশাদ খুব গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়। আমাদের দেশে রিস্ট স্পিনার বলতে রিশাদই সেরা। আমাদের হাতে ওই রকম বিকল্প নেই। সম্প্রতি ও টি২০ সংস্করণে যেভাবে খেলছে, বিপিএলেও ২-৩ ম্যাচ একাই জিতিয়েছে। খুবই ভালো বোলিং, পাশাপাশি ব্যাটিং; আর ফিল্ডিং তো আছেই। সে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একজন খেলোয়াড়। আমি খুবই খুশি যেভাবে বোলিং ও ব্যাটিং করেছে। আমি আরও বেশি কিছু আশা করেছিলাম। সে যতটুকু করেছে, আমি খুশি।

বুমরাহর না থাকা চাপ কমাবে

শান্ত: প্রতিটি দলের প্রত্যেক ক্রিকেটার সামর্থ্যবান। একেক দলে এক্স ফ্যাক্টর থাকে। সে অনেক বড় বোলার। আসলে এভাবে ব্যক্তিকেন্দ্রিক পরিকল্পনা করতে চাই না। পুরো দলের প্ল্যান থাকে, কোন বোলারকে কীভাবে হ্যান্ডেল করব বা ব্যাটারকে যেভাবে আটকাব। ওভারঅল একটি টিম প্ল্যান তো থাকেই।

চ্যাম্পিয়ন হওয়ার লক্ষ্য দলের ওপর চাপ

শান্ত: আমার কাছে বাড়তি চাপ মনে হয় না। ৮ দলই ডিজার্ভ করে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার, কোয়ালিটি টিম। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের দলের ওই সামর্থ্য আছে। আমার মনে হয় না কেউ বাড়তি চাপ অনুভব করবে। কারণ সবাই মনেপ্রাণে এটাই চাচ্ছে। সবাই বিশ্বাস করে ওই সামর্থ্য আছে। আমাদের রিজিকে আল্লাহ কী লিখে রেখেছেন, জানি না। আমরা ওইভাবে মেহনত করছি, সততার সঙ্গে কাজ করছি। প্রত্যেক খেলোয়াড় বিশ্বাস করি, আমরা ওই লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব।

সাকিব মিস করবে

শান্ত: সাকিবকে অবশ্যই মিস করব। এই প্রশ্ন কেন করলেন আমি জানি না। আমরা সবাই জানি, এই উত্তর অনেক খেলোয়াড় দিয়েছে। অবশ্যই সাকিব ভাইকে মিস করব, থাকলে ভালো হতো– এই উত্তর অনেকবার পেয়েছেন। আমার মনে হয় না এ রকম একটি টুর্নামেন্টে যাওয়ার আগে এ প্রসঙ্গে বলা যৌক্তিক হবে। তবে ওই ম্যাচে দারুণ ব্যাটিং করেছেন। দলকে জেতাতে অনেক সহায়তা করেছে।

স্কোয়াড নিয়ে খুশি

শান্ত: যে ১৫ জন স্কোয়াডে আছে, সবাইকে নিয়ে খুবই খুশি ও আত্মবিশ্বাসী। যেই খেলবে, একা হাতে ম্যাচ জেতাতে পারে, এই সামর্থ্য সবার আছে। 

মিডল অর্ডারে উইকেট না নিতে পারা

শান্ত: মিডল ওভারে উইকেট যদি নিতে পারে স্পিনাররা, দলের জন্য খুব ভালো। তাদের মধ্যে এই সামর্থ্য আছে। গত সিরিজে হয়তো হয়নি। মিডল ওভারে উইকেট নিতে পারিনি। তার মানে এই না সামনে পারব না। অতীতে অনেক ম্যাচে মিরাজ মিডল ওভারে উইকেট নিয়ে জিতিয়েছে, নাসুম, রিশাদ নিয়েছে। সামর্থ্য সবারই আছে। ওই দিনে দায়িত্বটা যে পাবে, দলের জন্য কতটুকু দিচ্ছে এটা গুরুত্বপূর্ণ। আমি বিশ্বাস করি, তারা ভালো কিছু করবে। 

বুমরাহ না থাকায় ভারত সহজ কিনা

শান্ত: একক কাউকে নিয়ে চিন্তা করছি না, তাদের পুরো দলই ভালো। শুধু ভারত নয়, পাকিস্তান ও নিউজিল্যান্ড– তিনটি দলই ভারসাম্যপূর্ণ। তিনটি দলের সঙ্গেই কষ্ট করে খেলতে হবে।

ব্যাটিং অর্ডার নিয়ে ভাবনা

শান্ত: শেষ সিরিজটি ইনজুরির কারণে আমরা দু-তিনজন খেলোয়াড় খেলতে পারিনি। এই সুযোগে জাকের আলী অনিকের অসাধারণ একটা সিরিজ গেছে। রিয়াদ ভাই ভালো করছেন। মিরাজ চারে ভালো করছে। আমরা আসলে বুঝতে পেরেছি কোন জায়গায় কাকে ফিট করা যাবে এবং কে কতটুকু ভালো অবস্থানে আছে। এই ইনজুরিটা আমাদের জন্য ভালো হয়েছে। সবাইকে দেখার সুযোগ হয়েছে। তবে আমরা জানি কে কোথায় ব্যাটিং করবে, কার কী রোল। এটা নিয়ে খুব বেশি একটা সমস্যা হবে না।

বিপিএলে ভালো উইকেটে খেলা

শান্ত: এত অল্পতে খুশি হয়েন না, মাত্র শুরু হলো। বিপিএলে খুব ভালো উইকেট ছিল। ব্যাটাররা খুব ভালোভাবে ব্যাটিং করেছে, বোলারদের কষ্ট হয়েছে। এটা শুরু। আমার মনে হয়, আরও ভালো উইকেট হওয়া সম্ভব। কীভাবে লম্বা সময় ধরে ভালো উইকেটে প্র্যাকটিস করছি, ডিপিএল, প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে। লম্বা সময় ধরে এমন উইকেট পেলে হেল্প হবে। এবার ভালো উইকেট হওয়ায় ব্যাটাররা কনফিডেন্ট আছে। বোলারদেরও কোথায় বল করতে হবে– এসব ধারণা আগের চেয়ে ভালো।

ব্যাটিং না বোলিংয়ে এগিয়ে

শান্ত: আলাদাভাবে চিন্তা করছি না। একসময় পেস বোলার ছিল না। এখন ভালো পেস বোলিং ইউনিট। রিস্ট স্পিনার ছিল না, এখন আছে। সব মিলিয়ে ব্যালান্স দল। সবাই সবার দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করলে যে কোনো দলকে যে কোনো সময় হারানো সম্ভব।

চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ২০২৫

প্রতিপক্ষ     তারিখ         ভেন্যু
বাংলাদেশ : ভারত  ২০ ফেব্রুয়ারি দুবাই
বাংলাদেশ : নিউজিল্যান্ড  ২৪ ফেব্রুয়ারি রাওয়ালপিন্ডি
বাংলাদেশ : পাকিস্তান  ২৭ ফেব্রুয়ারি  রাওয়ালপিন্ডি 
সময় বিকেল ৩টা  বাংলাদেশ সময়

বাংলাদেশ স্কোয়াড: নাজমুল হোসেন শান্ত (অধিনায়ক), মুশফিকুর রহিম, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, মেহেদী হাসান মিরাজ, সৌম্য সরকার, তাওহিদ হৃদয়, তাসকিন আহমেদ, নাহিদ রানা, জাকের আলী, তানজিদ হাসান তামিম, তানজিম হাসান, মোস্তাফিজুর রহমান, রিশাদ হোসেন, নাসুম আহমেদ ও পারভেজ হোসেন ইমন।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ব শ ব স কর আম র ম ব প এল আম দ র উইক ট স করব

এছাড়াও পড়ুন:

রাখাইনে করিডোর কি রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আশার আলো দেখাবে

রোহিঙ্গা সংকট ঘিরে নতুন আলোচনা ও বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। এর সূত্রপাত হয় সম্প্রতি মিয়ানমার সীমান্তে হিউম্যানিটারিয়ান বা মানবিক করিডর গড়ে তুলতে অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টার মন্তব্যের মাধ্যমে, যেখানে তিনি বলেন, বাংলাদেশ এ বিষয়ে একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। 

গত দুই মাসে রোহিঙ্গা সংকটকে ঘিরে ক্রমাগত নানা আলোচনা ও সমালোচনা চলমান। রোহিঙ্গা সংকটকে ঘিরে সাম্প্রতিক সময়ে প্রথম ইতিবাচক আলোচনা শুরু হয় মার্চ মাসে, যখন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বাংলাদেশ ভ্রমণ করেন এবং বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরে পবিত্র রোজার মাসে তাদের সঙ্গে ইফতার করেন।

এ সময় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তাদের মেহমান উল্লেখ করে বলেন, তিনি প্রত্যাশা করেন আগামী রোজা রোহিঙ্গারা নিজ দেশে করতে পারবেন। 

পরবর্তী সময়ে ষষ্ঠ বিমসটেক সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়ে একটি পার্শ্ব আলোচনার পর মিয়ানমারের পক্ষ থেকে বলা হয়, তারা প্রাথমিকভাবে ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে নীতিগতভাবে সম্মত।

এ নিয়েও জনসাধারণের মধ্যে একধরনের ধোঁয়াশা কাজ করে। কেননা, আরাকান আর্মিকে উপেক্ষা করে এ ধরনের মন্তব্য রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে খুব বেশি আশার আলো দেখাবে না। এর বেশ কিছুদিন পরে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা উল্লেখ করেন, সাম্প্রতিক সময়ে আরাকান আর্মি ও মিয়ানমারের সঙ্গে যে সহিংস দ্বন্দ্ব চলমান, সে প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন এখনই সম্ভব নয়। 

এই চলমান আলোচনায় নতুন বিতর্ক তৈরি হয় রাখাইনে মানবিক করিডর গড়ে তোলার আলোচনার মাধ্যমে, যদিও এরপর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বলেছেন, এ বিষয়ে জাতিসংঘ বা অন্য কারও সঙ্গে তাঁদের এখনো কোনো আলোচনা হয়নি। এমন নানামুখী আলোচনায় জনমনে বিভ্রান্তি আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাখাইনে মানবিক করিডর গড়ে তোলার প্রধান যুক্তি হলো, এতে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে মিয়ানমারে অবস্থানরত জনগোষ্ঠীর সাহায্যার্থে ত্রাণ এবং অন্যান্য প্রয়োজনের সামগ্রী পাঠানো সম্ভব হবে। 

মানবিক করিডর ও রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়ে আলোচনার আগে একটু দেখে নেওয়া যাক মানবিক করিডর বলতে আসলে কী বোঝায়। 

জাতিসংঘের ব্যাখ্যা অনুযায়ী সশস্ত্র সংঘাতপূর্ণ এলাকায় সংঘাত বা যুদ্ধ পরিস্থিতির সাময়িক বিরতির জন্য অনেক ধরনের পন্থা অবলম্বন করা হয়, তার মধ্যে একটি হলো মানবিক করিডরের প্রস্তাব।

এই মানবিক করিডরের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এমন একটি জায়গা নির্ধারণ করা হয়, যেখানে সশস্ত্র সংঘাত যেন না ঘটে। সে বিষয়ে দুই পক্ষ জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে একমত হয়। মানবিক করিডরের পরবর্তী ধাপে সেই ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের অধিবাসীদের একটি নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয় অথবা সেখানে খাদ্য, ওষুধ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সেবার ব্যবস্থা হয়। 

এ ধরনের মানবিক করিডরের উদাহরণ আমরা ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে সংঘাতপূর্ণ বিভিন্ন দেশের প্রেক্ষাপটে দেখতে পাই। এখানে সামগ্রিক কর্মকাণ্ড জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে হবে, সেটাই প্রত্যাশা করা হয়। বিভিন্ন দেশের প্রেক্ষাপট থেকে আমরা দেখতে পাই, জাতিসংঘের ত্রাণবিষয়ক প্রতিষ্ঠান রেডক্রস এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলির মধ্যে অন্যতম হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ইহুদি শিশুদের যুক্তরাজ্যে স্থানান্তর, নব্বইয়ের দশকে সারায়েভো সংকট, ২০১৮ সালে সিরিয়ার জনগোষ্ঠীকে নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করা এবং সর্বশেষ দেখতে পাই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষেত্রে।

যদি আরও রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে হয়, তাহলে তাদের দায়দায়িত্ব নিতে বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত, সেটা ভেবে দেখা জরুরি। কেননা, এখনই এক মিলিয়নের ওপর রোহিঙ্গা বিভিন্ন শরণার্থীশিবিরে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এর সঙ্গে রয়েছে তাদের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার জন্য আন্তর্জাতিক মহলের অর্থনৈতিক সাহায্য কমিয়ে দেওয়া, যা বাংলাদেশের জন্য এক বড় অর্থনৈতিক বোঝা। 

রাখাইনকে ঘিরে মানবিক করিডর গড়ে তোলার এই নীতিগত সিদ্ধান্তের প্রেক্ষাপটে গবেষক, রাজনীতিবিদ, নীতিনির্ধারক ও সাধারণ জনগণের মধ্যে বেশ কিছু প্রশ্ন, আশঙ্কা ও দ্বিধা তৈরি হয়েছে।

তবে শঙ্কার পাশাপাশি কোনো কোনো গবেষক মনে করছেন, মানবিক করিডরের প্রস্তাব মেনে নেওয়ার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলার চলমান সংলাপ আরও জোরদার হবে, যা ভবিষ্যতে এই সংকট মোকাবিলায়, বিশেষ করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। 

তবে এই ইতিবাচক প্রত্যাশা ছাপিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকে কেন্দ্র করে যে দ্বিধা রয়েছে, সেটি হলো এই মানবিক করিডরের মাধ্যমে ভবিষ্যতে কি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত হবে, নাকি আরও বিলম্বিত হবে, নাকি আরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করার সুযোগ পাবে। 

ইতিমধ্যে আমরা দেখেছি, এক লাখের ওপরে রোহিঙ্গা শরণার্থী আবারও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলা কক্সবাজারে প্রবেশ করতে বাধ্য হয়েছে। মানবিক কারণে বাংলাদেশ এই দায় যেমন এড়িয়ে যেতে পারছে না, তেমনি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ব্যবস্থাপনার ভারও বহন করতেও হিমশিম খাচ্ছে। এ অবস্থায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনসহ তাদের অন্যান্য সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে মানবিক করিডর কতটা বাস্তবসম্মত হবে, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। কেননা, কোনো বিস্তারিত দিকনির্দেশনা আমাদের সামনে নেই। 

অতীতের বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষাপট থেকে আমরা দেখতে পাই, মানবিক করিডরের অন্যতম প্রধান ব্যবহার হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ জাতিগোষ্ঠীকে সংঘাতপূর্ণ স্থান থেকে নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করা। যেখানে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশে চলমান অনুপ্রবেশ কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না, সেখানে মানবিক করিডরের মাধ্যমে আরও বৃহৎ অংশের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় নিরাপত্তার স্বার্থে স্থানান্তর করার প্রক্রিয়ায় শুরু অস্বাভাবিক নয়। 

এ প্রেক্ষাপটে যদি আরও রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে হয়, তাহলে তাদের দায়দায়িত্ব নিতে বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত, সেটা ভেবে দেখা জরুরি। কেননা, এখনই এক মিলিয়নের ওপর রোহিঙ্গা বিভিন্ন শরণার্থীশিবিরে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এর সঙ্গে রয়েছে তাদের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার জন্য আন্তর্জাতিক মহলের অর্থনৈতিক সাহায্য কমিয়ে দেওয়া, যা বাংলাদেশের জন্য এক বড় অর্থনৈতিক বোঝা। 

এর বাইরে আরেকটি চিন্তার জায়গা হলো সীমান্ত এলাকা বাংলাদেশ কতটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে, সেটি। সাম্প্রতিক ঘটনাবলি দেখলে বোঝা যায়, সীমান্ত প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের বর্তমান প্রচেষ্টা খুব যে সুখকর, সেটি বলা যাবে না।

এ ছাড়া এই অঞ্চল বিভিন্ন কারণে মাদক ব্যবসা, মানব পাচার, সহিংসতা ও অন্যান্য নিরাপত্তাঝুঁকির জন্য একটি অন্যতম হটস্পট, যা নিয়ন্ত্রণ করতে আমাদের নানাভাবে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

এমন পরিস্থিতিতে সীমান্ত এলাকার নিয়ন্ত্রণ আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয় কি না, সেটা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। মানবিক করিডরের মাধ্যমে বাংলাদেশ কীভাবে লাভবান হতে পারে, সে বিষয়েও যথাযথ পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে এবং নিজেদের স্বার্থেই আমাদের স্বচ্ছ থাকতে হবে। 

এর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোসহ অন্য অংশীজনের সঙ্গে পরামর্শ করারও বিশেষ প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কেননা, এর পরবর্তী পরিণতি ও ব্যবস্থাপনার দায়দায়িত্ব ভবিষ্যতের নির্বাচিত সরকারকেই গ্রহণ ও বহন করতে হবে। যদিও জাতিসংঘের মানবিক করিডরের প্রস্তাব বেশ পুরোনো, কিন্তু তড়িঘড়ি করে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হিতে বিপরীত হতে পারে। শরণার্থী বিষয়ে একটি টেকসই রূপরেখা এবং পরিকল্পনানীতি না থাকার কারণে সরকারকে অ্যাডহক প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে হয়, যা অনেক ক্ষেত্রেই সমস্যাজনক হয়। 

এসব বিবেচনায় নিয়ে একজন গবেষক হিসেবে আমি বিভিন্ন সময় রোহিঙ্গাবিষয়ক একটি জাতীয় রোডম্যাপ বা রূপরেখা এবং শরণার্থীবিষয়ক নীতি প্রণয়ন করার পক্ষে কথা বলে আসছি। আমাদের সে ধরনের কোনো দৃশ্যমান পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি বিগত সময়ে ছিল না। বিশেষ করে যদি প্রত্যাবাসন ব্যর্থ হয় এবং জাতিসংঘের প্রস্তাবিত মানবিক করিডর আমাদের প্রত্যাশামতো কাজ না করে, তাহলে বিকল্প কী হবে, সে বিষয়ে বিস্তারিত পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি আমাদের থাকা উচিত। সেটি না হলে রোহিঙ্গা সংকট আরও জটিল আকার ধারণ করবে এবং তাদের নিজ দেশে স্বেচ্ছায় ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন একটি ‘মিথ’ হিসেবে থেকে যাবে, যা আমাদের ও রোহিঙ্গা উভয়ের জন্যই হতাশার একটি বিষয় হবে। 

বুলবুল সিদ্দিকী সহযোগী অধ্যাপক, রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়

সম্পর্কিত নিবন্ধ