জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের উদ্যোগে ২৭টি রাজনৈতিক দল ও জোটের ১০০ প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠকের ঘটনাটি তাৎপর্যবহ। কমিশনের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষায়, এটা সরকারের ‘দ্বিতীয় অধ্যায়ের শুরু’। অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় মাস ইতোমধ্যে পূর্ণ হয়েছে। একটা ‘লন্ডভন্ড অবস্থা’য় তাদের দায়িত্ব নিতে হয়েছিল– প্রধান উপদেষ্টার এ বক্তব্যে কোনো ভুল নেই। পরিস্থিতির প্রত্যাশিত উন্নতি হয়নি– সেটাও বলতে হবে। হাসিনা সরকার যে জায়গায় দেশটি রেখে গেছে, সেখান থেকে টেনে তোলা অবশ্য কঠিন। উল্লিখিত বৈঠকে ক্ষমতাচ্যুত শাসক ও তার সহযোগীদের দিক থেকে অব্যাহতভাবে বাধা তৈরির যে কথা প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, সেটা জনগণেরও অভিজ্ঞতা। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আর পণ্যবাজারেও তার বিরূপ অভিজ্ঞতা হচ্ছে। আছে এমনকি নিকট ভবিষ্যৎ নিয়ে দুর্ভাবনা। এর মধ্যে সরকারের দ্বিতীয় অধ্যায়ের সূত্রপাত নিয়েও জনগণের কম আগ্রহ নেই। 

হাসিনা-পরবর্তী সরকার সংস্কারের মধ্য দিয়ে নির্বাচনের দিকে এগোবে– এ বিষয়ে সবাই একমত। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ অবশ্য মাঠে নেই। এ প্রক্রিয়ায় তাদের মতামতের অপেক্ষাও কেউ করছে না। ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সংলাপ শুরুর দিন উল্টো বরং ক্ষমতাচ্যুত দলটির বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রশ্ন সামনে এসেছে। গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারীরা অবশ্য এ প্রশ্নে একমত নয়। জুলাই আন্দোলন দমনে হাসিনা সরকারের ভয়াবহ নিষ্ঠুরতার দিকটি জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদনে সামনে আসার পরও এ প্রশ্নে একমত নয় সব রাজনৈতিক দল। তবে নিষিদ্ধকরণের দাবিটি জোরদার হয়েছে। হাসিনা গংয়ের বিচারের দাবি আরও জোরদার। ভারতে আশ্রিত শেখ হাসিনাকে ফেরত চেয়ে নথি পাঠানোর কাজও এর মধ্যে সম্পন্ন। বিচারের এ প্রক্রিয়াকে সংশয়মুক্ত ও মানসম্পন্ন রাখার চ্যালেঞ্জ অবশ্য রয়েছে সামনে। সরকারের দ্বিতীয় অধ্যায়ে সংস্কারের পাশাপাশি বিচারে অগ্রগতিও সবাই দেখতে চাইবে। 

নিবন্ধটি লেখার দিন সংবাদপত্রে দেখছি জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নিহত হয়ে মর্গে পড়ে থাকা মো.

হাসানের লাশ দাফনের খবর। যাত্রাবাড়ীতে পুলিশের গুলিতে নিহত হয় এই দোকান কর্মচারী। অভাবের কারণে পড়াশোনায় এগোতে না পারা ১৯ বছরের এ তরুণ কিছু অর্থ গ্রামের বাড়িতেও পাঠাত। অন্যান্য ক্ষেত্র থেকে উঠে আসা ব্যক্তিদের পাশাপাশি নিতান্ত গরিব ঘরের এই ছেলেরাও হাসিনা সরকারের পতনে নেমে এসেছিল রাস্তায়। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম কর্তব্য ছিল গণঅভ্যুত্থানের এসব শহীদ ও আহতদের খোঁজ যথাযথভাবে নিয়ে প্রয়োজনীয় সব কিছু করা। সে ক্ষেত্রেও হতাশাজনক খবর কিন্তু কম মিলছে না। সরকার অবশ্য তার ‘সীমাবদ্ধতা’র কথা স্বীকার করে উদ্যোগ জোরদার করছে। ইউনূস সরকারের দ্বিতীয় অধ্যায়ে এ কাজে দৃশ্যমান অগ্রগতিও কাম্য। বিশেষত অর্থাভাবে কারও সুচিকিৎসা যেন ব্যাহত না হয়। কার্যকরভাবে সহায়তা জোগাতে শহীদ ও আহতদের তালিকা তৈরির কাজও যেন দ্রুত এগোয়। চলতি বাজেট থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ বেঁচে যাবে বলেই ধারণা। বেসরকারি, এমনকি বিদেশি উৎস থেকেও ওই রকম কাজে অর্থ সহায়তার ঘাটতি হওয়ার কথা নয়। 

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম অধ্যায়ে ন্যায্য-অন্যায্য দাবিতে রাজপথ দখল করে ‘আন্দোলন’ রচনার চেষ্টা অব্যাহত জনদুর্ভোগের কারণ হয়েছে। শিক্ষাঙ্গনেও মবের তৎপরতা কম দেখা যায়নি। ইউনূস সরকার যেন এসেছে প্রাথমিকভাবে এসব দাবি-দাওয়া মেটাতে! সরকারও এ ক্ষেত্রে তার করণীয় স্পষ্ট করতে পারেনি– বললে ভুল হবে না। ইউনূস সরকারের মেয়াদ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকাতেও চারদিক থেকে চাপ সৃষ্টির চেষ্টা বেড়েছে। মবের কাছে আত্মসমর্পণেও এই প্রবণতা ছড়িয়ে পড়েছে, বলতে হবে। সরকার তার দ্বিতীয় অধ্যায়ে এটা কি নিরুৎসাহিত করবে না?
রাজপথ দখলকারীদের প্রতি হালে পুলিশি কঠোরতা অবশ্য দেখা যাচ্ছে। শিল্প শ্রমিকদের ‘অরাজকতা’ ঠেকাতেও সরকার এক পর্যায়ে কঠোর হয়। বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে কঠোরতা দেখানোর নীতি অবশ্য সমর্থনযোগ্য নয়। এতে সরকারের ‘শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গি’ নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে বাজেটও দিতে হবে সরকারকে। তখন তার নীতিগত অবস্থান সামনে আসবে নতুন করে। সংস্কারের পাশাপাশি বিতর্ক এড়াতে এ লক্ষ্যেও অংশীজনের সঙ্গে মতবিনিময় বাড়াতে হবে সরকারকে। 

কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হয়ে যাবে রমজান। এ অবস্থায় শবেবরাত থেকেই কিছু জরুরি পণ্যের বাজার অস্থির হতে শুরু করেছে। রমজানে বরাবরই কিছু ‘অস্বাভাবিক প্রবণতা’ দেখা যায়, যার শিকার ভোক্তাসাধারণ। তারা কিন্তু এবার আশা করে আছে, তেমন কিছু ঘটবে না। অন্তর্বর্তী সরকারকে এ অবস্থায় সময়োচিত সব পদক্ষেপ নিতে হবে। তারা অবশ্য আগেই জরুরি কিছু পণ্যের কর-শুল্ক ব্যাপকভাবে কমিয়েছেন। আমদানি পরিস্থিতিও সন্তোষজনক। দেশে উৎপাদন খাত স্বাভাবিকভাবে কাজ করছে কিনা– সে প্রশ্ন অবশ্য রয়েছে। ‘সাপ্লাই চেইন’ ঠিক রাখা এবং এ ক্ষেত্রে চাঁদাবাজি ঠেকানোও কর্তব্য। বড় ব্যবসায়ীদের সংঘবদ্ধ চাপ যে এখনও আছে– সেটা কিন্তু স্পষ্ট সয়াবিন তেলের কৃত্রিম সংকটে। হাসিনার শাসনামলে যে ব্যবসায়ীরা রাষ্ট্রের বিশেষ আনুকূল্য পেয়ে জাঁকিয়ে বসেছিল, তাদের বিষয়ে নিরপেক্ষভাবে ব্যবস্থা গ্রহণের ধারাও কি জোরদার হবে ‘দ্বিতীয় অধ্যায়ে’? ব্যাংক ও আর্থিক খাত সংস্কারে বাংলাদেশ ব্যাংকের পদক্ষেপ অবশ্য নজর কাড়ছে। সরকারের পরবর্তী অধ্যায়ে বিশেষত মূল্যস্ফীতিতে এর সুফল দেখতে চাইবে মানুষ। 

ফেব্রুয়ারির মধ্যে গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দানকারী ছাত্রদের উদ্যোগে নতুন রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশের কথা। সরকারের এক তরুণ উপদেষ্টা এ প্রক্রিয়ায় যোগ দিতে অচিরেই পদত্যাগ করবেন বলে খবর রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ‘কিংস পার্টি’ গঠনের অভিযোগ কিন্তু এড়ানো যায়নি। এ অবস্থায় অধিকতর অভিযোগ এড়াতে সরকারে থাকা সব ছাত্রনেতারই একযোগে পদত্যাগ করে দল গঠনে নামা উচিত। নইলে অন্তর্বর্তী সরকারের ‘রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা’ নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপনের সুযোগ আরও বাড়বে। গণঅভ্যুত্থানকারী দলগুলোর মধ্যে অন্তত সরকারের পক্ষপাতহীন ভাবমূর্তি বজায় রাখা প্রয়োজন। নইলে উল্টো অভিযোগ উঠতে পারে– ক্ষমতাচ্যুত শাসকদের বিরুদ্ধে মাঠে থাকা দলগুলোর মধ্যে ‘অনৈক্য’ বাড়াচ্ছে সরকার নিজেই! কোনো কোনো ঘটনা ও বক্তব্যে এমন অভিযোগ উঠতেও শুরু করেছে। 
কীভাবে, কতদিনে, কতখানি সংস্কার করা হবে– সেটা নিশ্চিত হওয়া এ অবস্থায় জরুরি বৈ কি। মূল ছয়টি সংস্কার কমিশনের সুপারিশ নিয়ে এ লক্ষ্যে অচিরেই কাজ শুরু করবে ঐকমত্য কমিশন। সংস্কারের সব উদ্যোগই অবশ্য দরকারি, তবে সব সংস্কার এই মুহূর্তে জরুরি নয়। ‘জরুরি সংস্কার’ প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলো সহজে একমত হতেও পারবে না। এই ক্ষেত্রে সরকার অবশ্য পূর্ববর্তী ঘোষণায় অটল– ঐকমত্য না হলে সংস্কার নয়। নির্বাচনের সর্বোচ্চ সময়সীমাও ইতোমধ্যে ঘোষিত। অবশ্য বিতর্ক তৈরি হয়েছে– জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন হবে কিনা। এর ‘বাস্তবতা’ একেবারেই যে নেই, তা নয়। তবে একটি রাজনৈতিক সরকার অর্জনের চেয়ে কোনো কিছুই বেশি জরুরি নয়। এমন নির্বাচনের মাধ্যমে সেটি আসতে হবে, যা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ অনুপস্থিত। ড. ইউনূস নিজেও এটা বারবার বলছেন। চলতি বছরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের প্রত্যাশাও জোরদার তাঁর বক্তব্যে। এর মধ্যে রুটিন কাজগুলো সম্পাদনের পাশাপাশি যতখানি সম্ভব জরুরি সংস্কার সারা যায়, ততই মঙ্গল। সংস্কারের পথে রাষ্ট্র মেরামতের কাজ তো নির্বাচিত সরকারের আমলেও অব্যাহত রাখতে হবে।

হাসান মামুন: সাংবাদিক, কলামিস্ট

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র জন ত গণঅভ য ত থ ন ক ষমত চ য ত সরক র র প এ অবস থ ঐকমত য ইউন স অবশ য

এছাড়াও পড়ুন:

জুলাই সনদ নিয়ে জট খুলুন, সময় কিন্তু চলে যাচ্ছে

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ১ ঘণ্টা ৪০ মিনিট কথা বলে দুই দেশের উদ্বেগজনক বাণিজ্য বিরোধের মীমাংসা করতে পারলেও আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর বিজ্ঞ নেতারা দীর্ঘ আলোচনা করে ঠিক করতে পারছেন না কীভাবে নির্বাচন ও সংস্কার কাজটি করা যাবে।

অনেক আলোচনা ও বিতর্কের পর ১৭ অক্টোবর বৃষ্টিস্নাত বিকেলে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় বেশ ঘটা করে ২৫টি দল জুলাই সনদে সই করেছিল; চারটি বামপন্থী দল রাষ্ট্রের মূলনীতি পরিবর্তন করার প্রতিবাদে সনদে সই দেয়নি, তাতে অবাক হইনি। কিন্তু ছাত্রনেতৃত্ব থেকে গড়ে ওঠা জাতীয় নাগরিক পার্টি, যারা জুলাই সনদের দাবিটি প্রথম তুলেছিল, তাদের সই না দেওয়াটা অস্বাভাবিক ঠেকেছে। এটা নিয়ে তারা যে দর–কষাকষি করছে, তার পেছনে কি নীতিগত অবস্থান, না ভোটের হিসাব–নিকাশ মুখ্য ছিল, সেই প্রশ্নও উঠেছে।

এদিকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সরকারের কাছে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আইনি ভিত্তি দেওয়ার লক্ষ্যে যে সুপারিশমালা সরকারের কাছে পেশ করেছে, তা নিয়ে রাজনীতির মাঠ বেশ গরম। বিএনপিসহ বেশ কিছু দল একে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ ও তামাশা বলেও অভিহিত করেছে। আবার কেউ কেউ স্বাগতও জানিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পরবিরোধী অবস্থান নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন করেছেন, জুলাই সনদ ও আইনি ভিত্তি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত না হতে পারলে নির্বাচন হবে কীভাবে?

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তিনটি বলয় তৈরি হয়েছে। একটি বলয় হলো বিএনপি ও তাদের সমর্থক-অনুসারী দল। আরেকটি হলো জামায়াতে ইসলামী ও এর অনুসারী দল। তৃতীয়টি হলো জাতীয় নাগরিক পার্টি। আবার কোনো কোনো দল দুই নৌকায় পা দিয়ে রেখেছে। যেখানে গিয়ে ভোটের মাঠে সুবিধা করা যাবে, শেষ পর্যন্ত তাদের সঙ্গে যাবে।

মাঠে সক্রিয় থাকা ৩০টি রাজনৈতিক দলকে নিয়েই সরকার তথা জাতীয় ঐকমত্য কমিশন দীর্ঘ আট মাস ধরে আলোচনা করে ৮৪টি বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে। এর মধ্যে ৪৮টি বিষয় যেহেতু সংবিধানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, সেহেতু এগুলোর আইনি ভিত্তি তৈরির জন্য জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে কিছু সুপারিশ করা হয়েছে, যা নিয়ে আবার মতভেদ দেখা দিয়েছে। যদিও সনদ তৈরির সময় বলা হয়েছিল, তারা আইনি ভিত্তির সুপারিশ করবে না। কিন্তু অসমাপ্ত সনদ করতে গিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন আরও জট পাকিয়ে ফেলেছে।

জুলাই সনদের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে আসতে না পারলে নির্বাচনের অনিশ্চয়তা কাটবে না। সরকার বলছে, তারা ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন করতে বদ্ধপরিকর। কিন্তু প্রতিযোগী রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজি করাতে না পারলে কীভাবে সেই নির্বাচন হবে? প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস নির্বাচন সামনে রেখে বড় আক্রমণের আশঙ্কার কথা বলেছেন। সেই আশঙ্কা মোকাবিলার দায়িত্ব তো সরকারকেই নিতে হবে। 

যেসব বিষয়ে রাজনৈতিক পক্ষগুলোর মধ্যে মতবিরোধ তীব্র, তার একটি হলো গণভোটের তারিখ। জামায়াতে ইসলামী ও তাদের অনুসারীরা বলছে, নভেম্বরেই গণভোট হতে হবে। অন্যদিকে বিএনপি ও তাদের অনুসারীদের দাবি, সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোট হতে পারবে না। তাঁরা মনে করেন, আগে গণভোটের দাবি তোলা নির্বাচনকে পিছিয়ে দেওয়ার দুরভিসন্ধি ছাড়া কিছু নয়। 

জাতীয় ঐকমত্য কমিশন অবশ্য দুই বিকল্প প্রস্তাবই সরকারের কাছে পেশ করেছে। সমস্যা হলো যিনি সরকারপ্রধান, তিনি ঐকমত্য কমিশনেরও প্রধান। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে কে কার কাছে প্রস্তাব পেশ করেছেন।

দ্বিতীয়ত, জুলাই সনদে ঐকমত্যের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলের আপত্তিগুলো লিপিবদ্ধ হলেও আইনি ভিত্তির সুপারিশে বাদ দেওয়া হয়েছে। বিএনপি ও তাদের অনুসারীদের প্রধান আপত্তি এখানেই। জুলাই সনদে বলা হয়েছে, যেসব বিষয় রাজনৈতিক দলগুলো আপত্তি জানিয়েছে, নির্বাচনে তারা জনগণের রায় পেলে সেটি বাস্তবায়ন করতে বাধ্য নয়। কিন্তু আইনি ভিত্তিতে যখন সেটি বাদ দেওয়া হয়েছে এবং সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোটের মাধ্যমে সেটি অনুমোদন করে নিলে সংসদের সার্বভৌমত্ব নষ্ট হবে।

তাদের তৃতীয় আপত্তির জায়গা হলো স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে আইনি ভিত্তি অনুমোদিত হয়ে যাওয়া। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন বলেছে, যদি ৯ মাসের মধ্যে জাতীয় সংসদ উল্লিখিত বিষয়ে আইন পাস না করে, তাহলে সেটা স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে অনুমোদিত হয়ে যাবে। ঐকমত্য কমিশনের এই আইনি ভিত্তির সঙ্গে ১৯৭০ সালে ইয়াহিয়া খান প্রণীত এলএফওর মিল খুঁজেও পেয়েছেন কোনো কোনো বিশ্লেষক।

প্রথম আলোর প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তীব্র অনৈক্যের কারণে জুলাই জাতীয় সনদ বা সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নে ‘দুরূহ চ্যালেঞ্জ’ দেখছে সরকার। তবে গণভোটসহ সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবে সরকার। এ ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার জাতীয় নির্বাচনের দিন একই সঙ্গে গণভোট করার বিষয়টিও গভীরভাবে চিন্তা করছে বলে জানা গেছে। তবে এ বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি।’ (প্রথম আলো, ৩১ অক্টোবর ২০২৫)

সিদ্ধান্তটি কবে হবে, কেমন হবে? যদি একই দিনে দুই ভোট করার পক্ষে সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে জামায়াত ও এনসিপি কি মেনে নেবে? আর যদি সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোট হয়, বিএনপি কি তা গ্রহণ করবে? যদি না করে, কী পরিস্থিতি তৈরি হবে?

রাজনৈতিক দলগুলোকে জুলাই সনদের পক্ষে এনে সরকার যতটুকু বাহবা পেয়েছিল, তার বেশি সমালোচিত হয়েছে আইনি ভিত্তি দিতে গিয়ে। এখানে কোনটি ন্যায্য, কোনটি অন্যায্য; তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো তারা রাজনৈতিক দলগুলোকে একমতে আনতে ব্যর্থ হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো যেমন একে অপরকে বিশ্বাস করবে না, তেমনি তাদের বড় অংশ সরকারের প্রতিও আস্থাশীল নয়। নির্বাচনের বিষয়ে শুরু থেকে সরকারের দ্বিধাদ্বন্দ্ব রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যেমন সন্দেহ বাড়িয়েছে, তেমনি সরকারের প্রতিও একধরনের অনাস্থা সৃষ্টি করেছে।

সংস্কারের বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের যেখানে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কথা ছিল, রাজনৈতিক দলের সংস্কার, সেখানেই তারা কম গুরুত্ব দিয়েছে। তারা এই একটি বিষয়ে শক্ত অবস্থান নিলে রাষ্ট্রীয় ও রাজনীতির সংস্কারকাজ অনেকটা সহজ হতো। এখন রাজনৈতিক দলগুলো সরকারের চাপে সনদে যতই সই করুক না কেন, কাজ করবে তাদের মতো করে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সংবিধানের দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলন নিয়ে যতটা ব্যস্ত ছিল, রাজনৈতিক দলের গণতন্ত্রায়ণ নিয়ে ততটাই উদাসীন থেকেছে। 

জুলাই সনদের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে আসতে না পারলে নির্বাচনের অনিশ্চয়তা কাটবে না। সরকার বলছে, তারা ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন করতে বদ্ধপরিকর। কিন্তু প্রতিযোগী রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজি করাতে না পারলে কীভাবে সেই নির্বাচন হবে? প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস নির্বাচন সামনে রেখে বড় আক্রমণের আশঙ্কার কথা বলেছেন। সেই আশঙ্কা মোকাবিলার দায়িত্ব তো সরকারকেই নিতে হবে। 

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভাজন যত বাড়বে, আক্রমণের আশঙ্কারও তত জোরদার হবে। এই সহজ সত্যটি সরকারের নীতিনির্ধারকেরা যত দ্রুত উপলব্ধি করবেন, ততই মঙ্গল। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন করতে চাইলে অবিলম্বে সৃষ্ট জট খোলার ব্যবস্থা করুন। প্রয়োজনে আবার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসুন। সময় কিন্তু চলে যাচ্ছে।

সোহরাব হাসান, সাংবাদিক ও কবি

* মতামত লেখকের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সনদ বাস্তবায়নে দ্রুত সিদ্ধান্ত, আরপিওতে পরিবর্তন আসছে
  • তড়িঘড়ি না করে সংবিধান সংস্কারে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান
  • কিছু রাজনৈতিক দল ঐকমত্য কমিশনে গিয়ে ফাঁদে পড়েছে: জাপা মহাসচিব
  • দেশের মানুষ ১৭ বছর ধরে নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করছে: সাইফুল হক
  • ঐকমত্য কমিশন হাজির করেছে অনৈক্যের দলিল: বিএনপি নেতা জহির উদ্দিন স্বপন
  • জুলাই সনদে সই না করা অংশের দায় নেব না: মির্জা ফখরুল
  • ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশকে ‘অশ্বডিম্ব’ বললেন সিপিবি সভাপতি
  • জুলাই সনদ নিয়ে জট খুলুন, সময় কিন্তু চলে যাচ্ছে
  • রূপগঞ্জে ৩১ দফা বাস্তবায়নের লক্ষে লিফলেট বিতরণ 
  • যুদ্ধবিরতির মেয়াদ বাড়াতে সম্মত হয়েছে পাকিস্তান ও আফগানিস্তান: তুরস্ক