সরকারের ‘দ্বিতীয় অধ্যায়ে’ কাজ অনেক
Published: 16th, February 2025 GMT
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের উদ্যোগে ২৭টি রাজনৈতিক দল ও জোটের ১০০ প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠকের ঘটনাটি তাৎপর্যবহ। কমিশনের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষায়, এটা সরকারের ‘দ্বিতীয় অধ্যায়ের শুরু’। অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় মাস ইতোমধ্যে পূর্ণ হয়েছে। একটা ‘লন্ডভন্ড অবস্থা’য় তাদের দায়িত্ব নিতে হয়েছিল– প্রধান উপদেষ্টার এ বক্তব্যে কোনো ভুল নেই। পরিস্থিতির প্রত্যাশিত উন্নতি হয়নি– সেটাও বলতে হবে। হাসিনা সরকার যে জায়গায় দেশটি রেখে গেছে, সেখান থেকে টেনে তোলা অবশ্য কঠিন। উল্লিখিত বৈঠকে ক্ষমতাচ্যুত শাসক ও তার সহযোগীদের দিক থেকে অব্যাহতভাবে বাধা তৈরির যে কথা প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, সেটা জনগণেরও অভিজ্ঞতা। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আর পণ্যবাজারেও তার বিরূপ অভিজ্ঞতা হচ্ছে। আছে এমনকি নিকট ভবিষ্যৎ নিয়ে দুর্ভাবনা। এর মধ্যে সরকারের দ্বিতীয় অধ্যায়ের সূত্রপাত নিয়েও জনগণের কম আগ্রহ নেই।
হাসিনা-পরবর্তী সরকার সংস্কারের মধ্য দিয়ে নির্বাচনের দিকে এগোবে– এ বিষয়ে সবাই একমত। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ অবশ্য মাঠে নেই। এ প্রক্রিয়ায় তাদের মতামতের অপেক্ষাও কেউ করছে না। ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সংলাপ শুরুর দিন উল্টো বরং ক্ষমতাচ্যুত দলটির বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রশ্ন সামনে এসেছে। গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারীরা অবশ্য এ প্রশ্নে একমত নয়। জুলাই আন্দোলন দমনে হাসিনা সরকারের ভয়াবহ নিষ্ঠুরতার দিকটি জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদনে সামনে আসার পরও এ প্রশ্নে একমত নয় সব রাজনৈতিক দল। তবে নিষিদ্ধকরণের দাবিটি জোরদার হয়েছে। হাসিনা গংয়ের বিচারের দাবি আরও জোরদার। ভারতে আশ্রিত শেখ হাসিনাকে ফেরত চেয়ে নথি পাঠানোর কাজও এর মধ্যে সম্পন্ন। বিচারের এ প্রক্রিয়াকে সংশয়মুক্ত ও মানসম্পন্ন রাখার চ্যালেঞ্জ অবশ্য রয়েছে সামনে। সরকারের দ্বিতীয় অধ্যায়ে সংস্কারের পাশাপাশি বিচারে অগ্রগতিও সবাই দেখতে চাইবে।
নিবন্ধটি লেখার দিন সংবাদপত্রে দেখছি জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নিহত হয়ে মর্গে পড়ে থাকা মো.
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম অধ্যায়ে ন্যায্য-অন্যায্য দাবিতে রাজপথ দখল করে ‘আন্দোলন’ রচনার চেষ্টা অব্যাহত জনদুর্ভোগের কারণ হয়েছে। শিক্ষাঙ্গনেও মবের তৎপরতা কম দেখা যায়নি। ইউনূস সরকার যেন এসেছে প্রাথমিকভাবে এসব দাবি-দাওয়া মেটাতে! সরকারও এ ক্ষেত্রে তার করণীয় স্পষ্ট করতে পারেনি– বললে ভুল হবে না। ইউনূস সরকারের মেয়াদ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকাতেও চারদিক থেকে চাপ সৃষ্টির চেষ্টা বেড়েছে। মবের কাছে আত্মসমর্পণেও এই প্রবণতা ছড়িয়ে পড়েছে, বলতে হবে। সরকার তার দ্বিতীয় অধ্যায়ে এটা কি নিরুৎসাহিত করবে না?
রাজপথ দখলকারীদের প্রতি হালে পুলিশি কঠোরতা অবশ্য দেখা যাচ্ছে। শিল্প শ্রমিকদের ‘অরাজকতা’ ঠেকাতেও সরকার এক পর্যায়ে কঠোর হয়। বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে কঠোরতা দেখানোর নীতি অবশ্য সমর্থনযোগ্য নয়। এতে সরকারের ‘শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গি’ নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে বাজেটও দিতে হবে সরকারকে। তখন তার নীতিগত অবস্থান সামনে আসবে নতুন করে। সংস্কারের পাশাপাশি বিতর্ক এড়াতে এ লক্ষ্যেও অংশীজনের সঙ্গে মতবিনিময় বাড়াতে হবে সরকারকে।
কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হয়ে যাবে রমজান। এ অবস্থায় শবেবরাত থেকেই কিছু জরুরি পণ্যের বাজার অস্থির হতে শুরু করেছে। রমজানে বরাবরই কিছু ‘অস্বাভাবিক প্রবণতা’ দেখা যায়, যার শিকার ভোক্তাসাধারণ। তারা কিন্তু এবার আশা করে আছে, তেমন কিছু ঘটবে না। অন্তর্বর্তী সরকারকে এ অবস্থায় সময়োচিত সব পদক্ষেপ নিতে হবে। তারা অবশ্য আগেই জরুরি কিছু পণ্যের কর-শুল্ক ব্যাপকভাবে কমিয়েছেন। আমদানি পরিস্থিতিও সন্তোষজনক। দেশে উৎপাদন খাত স্বাভাবিকভাবে কাজ করছে কিনা– সে প্রশ্ন অবশ্য রয়েছে। ‘সাপ্লাই চেইন’ ঠিক রাখা এবং এ ক্ষেত্রে চাঁদাবাজি ঠেকানোও কর্তব্য। বড় ব্যবসায়ীদের সংঘবদ্ধ চাপ যে এখনও আছে– সেটা কিন্তু স্পষ্ট সয়াবিন তেলের কৃত্রিম সংকটে। হাসিনার শাসনামলে যে ব্যবসায়ীরা রাষ্ট্রের বিশেষ আনুকূল্য পেয়ে জাঁকিয়ে বসেছিল, তাদের বিষয়ে নিরপেক্ষভাবে ব্যবস্থা গ্রহণের ধারাও কি জোরদার হবে ‘দ্বিতীয় অধ্যায়ে’? ব্যাংক ও আর্থিক খাত সংস্কারে বাংলাদেশ ব্যাংকের পদক্ষেপ অবশ্য নজর কাড়ছে। সরকারের পরবর্তী অধ্যায়ে বিশেষত মূল্যস্ফীতিতে এর সুফল দেখতে চাইবে মানুষ।
ফেব্রুয়ারির মধ্যে গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দানকারী ছাত্রদের উদ্যোগে নতুন রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশের কথা। সরকারের এক তরুণ উপদেষ্টা এ প্রক্রিয়ায় যোগ দিতে অচিরেই পদত্যাগ করবেন বলে খবর রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ‘কিংস পার্টি’ গঠনের অভিযোগ কিন্তু এড়ানো যায়নি। এ অবস্থায় অধিকতর অভিযোগ এড়াতে সরকারে থাকা সব ছাত্রনেতারই একযোগে পদত্যাগ করে দল গঠনে নামা উচিত। নইলে অন্তর্বর্তী সরকারের ‘রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা’ নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপনের সুযোগ আরও বাড়বে। গণঅভ্যুত্থানকারী দলগুলোর মধ্যে অন্তত সরকারের পক্ষপাতহীন ভাবমূর্তি বজায় রাখা প্রয়োজন। নইলে উল্টো অভিযোগ উঠতে পারে– ক্ষমতাচ্যুত শাসকদের বিরুদ্ধে মাঠে থাকা দলগুলোর মধ্যে ‘অনৈক্য’ বাড়াচ্ছে সরকার নিজেই! কোনো কোনো ঘটনা ও বক্তব্যে এমন অভিযোগ উঠতেও শুরু করেছে।
কীভাবে, কতদিনে, কতখানি সংস্কার করা হবে– সেটা নিশ্চিত হওয়া এ অবস্থায় জরুরি বৈ কি। মূল ছয়টি সংস্কার কমিশনের সুপারিশ নিয়ে এ লক্ষ্যে অচিরেই কাজ শুরু করবে ঐকমত্য কমিশন। সংস্কারের সব উদ্যোগই অবশ্য দরকারি, তবে সব সংস্কার এই মুহূর্তে জরুরি নয়। ‘জরুরি সংস্কার’ প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলো সহজে একমত হতেও পারবে না। এই ক্ষেত্রে সরকার অবশ্য পূর্ববর্তী ঘোষণায় অটল– ঐকমত্য না হলে সংস্কার নয়। নির্বাচনের সর্বোচ্চ সময়সীমাও ইতোমধ্যে ঘোষিত। অবশ্য বিতর্ক তৈরি হয়েছে– জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন হবে কিনা। এর ‘বাস্তবতা’ একেবারেই যে নেই, তা নয়। তবে একটি রাজনৈতিক সরকার অর্জনের চেয়ে কোনো কিছুই বেশি জরুরি নয়। এমন নির্বাচনের মাধ্যমে সেটি আসতে হবে, যা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ অনুপস্থিত। ড. ইউনূস নিজেও এটা বারবার বলছেন। চলতি বছরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের প্রত্যাশাও জোরদার তাঁর বক্তব্যে। এর মধ্যে রুটিন কাজগুলো সম্পাদনের পাশাপাশি যতখানি সম্ভব জরুরি সংস্কার সারা যায়, ততই মঙ্গল। সংস্কারের পথে রাষ্ট্র মেরামতের কাজ তো নির্বাচিত সরকারের আমলেও অব্যাহত রাখতে হবে।
হাসান মামুন: সাংবাদিক, কলামিস্ট
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন ত গণঅভ য ত থ ন ক ষমত চ য ত সরক র র প এ অবস থ ঐকমত য ইউন স অবশ য
এছাড়াও পড়ুন:
জুলাই সনদের খসড়া অসম্পূর্ণ, কিছু অংশ বিপজ্জনক: জামায়াত
জুলাই সনদের খসড়াকে অসম্পূর্ণ বলেছে জামায়াতে ইসলামী। একই সঙ্গে নির্বাচিত সরকারকে দুই বছরের মধ্যে এই সনদ বাস্তবায়নের প্রস্তাবকে বিপজ্জনক বলেছে দলটি।
আজ মঙ্গলবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় ধাপের ২১তম দিনের আলোচনার বিরতিতে জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের এ কথা বলেন।
সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ‘এটি অসম্পূর্ণ এবং কিছু অংশ বিপজ্জনক। আজকে তারা বলছে, এটা একটা নমুনামাত্র, ভুল হয়েছে। যদি সেটাই হয়, তাহলে মন্তব্যের দরকার নেই। তবে যদি সেটাই মূল কথা হয়, তাহলে একে গ্রহণ করা যাবে না।’
জামায়াত নিজস্ব একটি খসড়া সনদ তৈরি করছে এবং কমিশনে জমা দেবে বলে জানান তাহের। তিনি বলেন, ‘সংলাপে যেসব বিষয়ে একমত হচ্ছি, সেগুলো বাস্তবায়নের আইনি ভিত্তি থাকতে হবে।’ তিনি প্রস্তাব করেন দুটি পথ—১. অধ্যাদেশের মাধ্যমে একটি আইনি কাঠামো গঠন করে পরে নির্বাচিত পার্লামেন্টে তা অনুমোদন। ২. গণভোটের মাধ্যমে জনগণের চূড়ান্ত অনুমোদন নেওয়া।
সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ‘আমরা যেকোনো একটি পদ্ধতিতে এই কাঠামোকে আইনগত বৈধতা দিতে চাই।’ তিনি জানান, তাঁরা ঐকমত্যের পক্ষে কিন্তু সেটা হতে হবে কার্যকর এবং আইনি কাঠামোর মধ্যে হতে হবে। অন্যথায় দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ‘অনিশ্চয়তার দিকে’ চলে যেতে পারে বলে তাঁরা আশঙ্কা করছেন।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে চলমান সংলাপে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠনপ্রক্রিয়া নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা হয়েছে বলে জানান জামায়াতের এই নেতা। তিনি বলেন, ‘আমরা একমত হয়েছি যে আগামী জাতীয় নির্বাচন অবশ্যই কেয়ারটেকার সরকারের অধীনেই হতে হবে, এখানে প্রায় সবাই একমত, একমাত্র বিএনপি কিছু পর্যবেক্ষণ দিয়েছে।’
আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের জানান, প্রস্তাবিত কাঠামো অনুযায়ী পাঁচ সদস্যের একটি বাছাই কমিটি গঠিত হবে—প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার (বিরোধী দলের) এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধী দলের একজন প্রতিনিধি। এঁরা ১২ জন সম্ভাব্য প্রার্থীর মধ্য থেকে কেয়ারটেকার সরকারের প্রধান নির্বাচন করবেন।
যদি একমত না হন, তাহলে প্রথমে সর্বসম্মতভাবে, পরবর্তী সময়ে এক চয়েস ভোট, তারপর প্রয়োজনে র্যাংক চয়েস ভোটিং পদ্ধতির মাধ্যমে সিদ্ধান্ত হবে। এ পদ্ধতিতে ভোটার হবেন মোট সাতজন—ওপরে উল্লিখিত পাঁচ সদস্য এবং সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের একজন করে বিচারপতি।
জামায়াতের এ নায়েবে আমির বলেন, ‘বিচারপতি দুজন যুক্ত করা হয়েছে যেন এককভাবে তৃতীয় দল বা অন্য কেউ ডিসাইডিং ফ্যাক্টর না হয়ে যায়। আমরা আশা করি, বিচারপতিরা নিরপেক্ষ থাকবেন এবং হর্স ট্রেডিংয়ের আশঙ্কা কমবে।’ তিনি জানান, বিএনপির আপত্তি মূলত এই যে—যদি ঐকমত্য না হয় তাহলে বিষয়টি সংসদে পাঠানো হোক। তবে জামায়াতসহ বেশির ভাগ দল মনে করে সংসদে পাঠালে তা আর সিদ্ধান্তে পৌঁছাবে না।
আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ‘সংসদে পাঁচ-ছয়টা দল আছে, অথচ এই বডিতে ৩০টির বেশি দলের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। এখানেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি।’
আজকের আলোচনায় জামায়াতে ইসলামী ছাড়াও বিএনপি, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), গণসংহতি আন্দোলনসহ ৩০টি রাজনৈতিক দল অংশ নেয়। আলোচনায় সভাপতিত্ব করেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারের সঞ্চালনায় আরও উপস্থিত আছেন সফর রাজ হোসেন, বিচারপতি এমদাদুল হক, ড. বদিউল আলম মজুমদার, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. আইয়ুব মিয়া।