জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের উদ্যোগে ২৭টি রাজনৈতিক দল ও জোটের ১০০ প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠকের ঘটনাটি তাৎপর্যবহ। কমিশনের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষায়, এটা সরকারের ‘দ্বিতীয় অধ্যায়ের শুরু’। অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় মাস ইতোমধ্যে পূর্ণ হয়েছে। একটা ‘লন্ডভন্ড অবস্থা’য় তাদের দায়িত্ব নিতে হয়েছিল– প্রধান উপদেষ্টার এ বক্তব্যে কোনো ভুল নেই। পরিস্থিতির প্রত্যাশিত উন্নতি হয়নি– সেটাও বলতে হবে। হাসিনা সরকার যে জায়গায় দেশটি রেখে গেছে, সেখান থেকে টেনে তোলা অবশ্য কঠিন। উল্লিখিত বৈঠকে ক্ষমতাচ্যুত শাসক ও তার সহযোগীদের দিক থেকে অব্যাহতভাবে বাধা তৈরির যে কথা প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, সেটা জনগণেরও অভিজ্ঞতা। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আর পণ্যবাজারেও তার বিরূপ অভিজ্ঞতা হচ্ছে। আছে এমনকি নিকট ভবিষ্যৎ নিয়ে দুর্ভাবনা। এর মধ্যে সরকারের দ্বিতীয় অধ্যায়ের সূত্রপাত নিয়েও জনগণের কম আগ্রহ নেই। 

হাসিনা-পরবর্তী সরকার সংস্কারের মধ্য দিয়ে নির্বাচনের দিকে এগোবে– এ বিষয়ে সবাই একমত। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ অবশ্য মাঠে নেই। এ প্রক্রিয়ায় তাদের মতামতের অপেক্ষাও কেউ করছে না। ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সংলাপ শুরুর দিন উল্টো বরং ক্ষমতাচ্যুত দলটির বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রশ্ন সামনে এসেছে। গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারীরা অবশ্য এ প্রশ্নে একমত নয়। জুলাই আন্দোলন দমনে হাসিনা সরকারের ভয়াবহ নিষ্ঠুরতার দিকটি জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদনে সামনে আসার পরও এ প্রশ্নে একমত নয় সব রাজনৈতিক দল। তবে নিষিদ্ধকরণের দাবিটি জোরদার হয়েছে। হাসিনা গংয়ের বিচারের দাবি আরও জোরদার। ভারতে আশ্রিত শেখ হাসিনাকে ফেরত চেয়ে নথি পাঠানোর কাজও এর মধ্যে সম্পন্ন। বিচারের এ প্রক্রিয়াকে সংশয়মুক্ত ও মানসম্পন্ন রাখার চ্যালেঞ্জ অবশ্য রয়েছে সামনে। সরকারের দ্বিতীয় অধ্যায়ে সংস্কারের পাশাপাশি বিচারে অগ্রগতিও সবাই দেখতে চাইবে। 

নিবন্ধটি লেখার দিন সংবাদপত্রে দেখছি জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নিহত হয়ে মর্গে পড়ে থাকা মো.

হাসানের লাশ দাফনের খবর। যাত্রাবাড়ীতে পুলিশের গুলিতে নিহত হয় এই দোকান কর্মচারী। অভাবের কারণে পড়াশোনায় এগোতে না পারা ১৯ বছরের এ তরুণ কিছু অর্থ গ্রামের বাড়িতেও পাঠাত। অন্যান্য ক্ষেত্র থেকে উঠে আসা ব্যক্তিদের পাশাপাশি নিতান্ত গরিব ঘরের এই ছেলেরাও হাসিনা সরকারের পতনে নেমে এসেছিল রাস্তায়। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম কর্তব্য ছিল গণঅভ্যুত্থানের এসব শহীদ ও আহতদের খোঁজ যথাযথভাবে নিয়ে প্রয়োজনীয় সব কিছু করা। সে ক্ষেত্রেও হতাশাজনক খবর কিন্তু কম মিলছে না। সরকার অবশ্য তার ‘সীমাবদ্ধতা’র কথা স্বীকার করে উদ্যোগ জোরদার করছে। ইউনূস সরকারের দ্বিতীয় অধ্যায়ে এ কাজে দৃশ্যমান অগ্রগতিও কাম্য। বিশেষত অর্থাভাবে কারও সুচিকিৎসা যেন ব্যাহত না হয়। কার্যকরভাবে সহায়তা জোগাতে শহীদ ও আহতদের তালিকা তৈরির কাজও যেন দ্রুত এগোয়। চলতি বাজেট থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ বেঁচে যাবে বলেই ধারণা। বেসরকারি, এমনকি বিদেশি উৎস থেকেও ওই রকম কাজে অর্থ সহায়তার ঘাটতি হওয়ার কথা নয়। 

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম অধ্যায়ে ন্যায্য-অন্যায্য দাবিতে রাজপথ দখল করে ‘আন্দোলন’ রচনার চেষ্টা অব্যাহত জনদুর্ভোগের কারণ হয়েছে। শিক্ষাঙ্গনেও মবের তৎপরতা কম দেখা যায়নি। ইউনূস সরকার যেন এসেছে প্রাথমিকভাবে এসব দাবি-দাওয়া মেটাতে! সরকারও এ ক্ষেত্রে তার করণীয় স্পষ্ট করতে পারেনি– বললে ভুল হবে না। ইউনূস সরকারের মেয়াদ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকাতেও চারদিক থেকে চাপ সৃষ্টির চেষ্টা বেড়েছে। মবের কাছে আত্মসমর্পণেও এই প্রবণতা ছড়িয়ে পড়েছে, বলতে হবে। সরকার তার দ্বিতীয় অধ্যায়ে এটা কি নিরুৎসাহিত করবে না?
রাজপথ দখলকারীদের প্রতি হালে পুলিশি কঠোরতা অবশ্য দেখা যাচ্ছে। শিল্প শ্রমিকদের ‘অরাজকতা’ ঠেকাতেও সরকার এক পর্যায়ে কঠোর হয়। বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে কঠোরতা দেখানোর নীতি অবশ্য সমর্থনযোগ্য নয়। এতে সরকারের ‘শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গি’ নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে বাজেটও দিতে হবে সরকারকে। তখন তার নীতিগত অবস্থান সামনে আসবে নতুন করে। সংস্কারের পাশাপাশি বিতর্ক এড়াতে এ লক্ষ্যেও অংশীজনের সঙ্গে মতবিনিময় বাড়াতে হবে সরকারকে। 

কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হয়ে যাবে রমজান। এ অবস্থায় শবেবরাত থেকেই কিছু জরুরি পণ্যের বাজার অস্থির হতে শুরু করেছে। রমজানে বরাবরই কিছু ‘অস্বাভাবিক প্রবণতা’ দেখা যায়, যার শিকার ভোক্তাসাধারণ। তারা কিন্তু এবার আশা করে আছে, তেমন কিছু ঘটবে না। অন্তর্বর্তী সরকারকে এ অবস্থায় সময়োচিত সব পদক্ষেপ নিতে হবে। তারা অবশ্য আগেই জরুরি কিছু পণ্যের কর-শুল্ক ব্যাপকভাবে কমিয়েছেন। আমদানি পরিস্থিতিও সন্তোষজনক। দেশে উৎপাদন খাত স্বাভাবিকভাবে কাজ করছে কিনা– সে প্রশ্ন অবশ্য রয়েছে। ‘সাপ্লাই চেইন’ ঠিক রাখা এবং এ ক্ষেত্রে চাঁদাবাজি ঠেকানোও কর্তব্য। বড় ব্যবসায়ীদের সংঘবদ্ধ চাপ যে এখনও আছে– সেটা কিন্তু স্পষ্ট সয়াবিন তেলের কৃত্রিম সংকটে। হাসিনার শাসনামলে যে ব্যবসায়ীরা রাষ্ট্রের বিশেষ আনুকূল্য পেয়ে জাঁকিয়ে বসেছিল, তাদের বিষয়ে নিরপেক্ষভাবে ব্যবস্থা গ্রহণের ধারাও কি জোরদার হবে ‘দ্বিতীয় অধ্যায়ে’? ব্যাংক ও আর্থিক খাত সংস্কারে বাংলাদেশ ব্যাংকের পদক্ষেপ অবশ্য নজর কাড়ছে। সরকারের পরবর্তী অধ্যায়ে বিশেষত মূল্যস্ফীতিতে এর সুফল দেখতে চাইবে মানুষ। 

ফেব্রুয়ারির মধ্যে গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দানকারী ছাত্রদের উদ্যোগে নতুন রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশের কথা। সরকারের এক তরুণ উপদেষ্টা এ প্রক্রিয়ায় যোগ দিতে অচিরেই পদত্যাগ করবেন বলে খবর রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ‘কিংস পার্টি’ গঠনের অভিযোগ কিন্তু এড়ানো যায়নি। এ অবস্থায় অধিকতর অভিযোগ এড়াতে সরকারে থাকা সব ছাত্রনেতারই একযোগে পদত্যাগ করে দল গঠনে নামা উচিত। নইলে অন্তর্বর্তী সরকারের ‘রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা’ নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপনের সুযোগ আরও বাড়বে। গণঅভ্যুত্থানকারী দলগুলোর মধ্যে অন্তত সরকারের পক্ষপাতহীন ভাবমূর্তি বজায় রাখা প্রয়োজন। নইলে উল্টো অভিযোগ উঠতে পারে– ক্ষমতাচ্যুত শাসকদের বিরুদ্ধে মাঠে থাকা দলগুলোর মধ্যে ‘অনৈক্য’ বাড়াচ্ছে সরকার নিজেই! কোনো কোনো ঘটনা ও বক্তব্যে এমন অভিযোগ উঠতেও শুরু করেছে। 
কীভাবে, কতদিনে, কতখানি সংস্কার করা হবে– সেটা নিশ্চিত হওয়া এ অবস্থায় জরুরি বৈ কি। মূল ছয়টি সংস্কার কমিশনের সুপারিশ নিয়ে এ লক্ষ্যে অচিরেই কাজ শুরু করবে ঐকমত্য কমিশন। সংস্কারের সব উদ্যোগই অবশ্য দরকারি, তবে সব সংস্কার এই মুহূর্তে জরুরি নয়। ‘জরুরি সংস্কার’ প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলো সহজে একমত হতেও পারবে না। এই ক্ষেত্রে সরকার অবশ্য পূর্ববর্তী ঘোষণায় অটল– ঐকমত্য না হলে সংস্কার নয়। নির্বাচনের সর্বোচ্চ সময়সীমাও ইতোমধ্যে ঘোষিত। অবশ্য বিতর্ক তৈরি হয়েছে– জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন হবে কিনা। এর ‘বাস্তবতা’ একেবারেই যে নেই, তা নয়। তবে একটি রাজনৈতিক সরকার অর্জনের চেয়ে কোনো কিছুই বেশি জরুরি নয়। এমন নির্বাচনের মাধ্যমে সেটি আসতে হবে, যা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ অনুপস্থিত। ড. ইউনূস নিজেও এটা বারবার বলছেন। চলতি বছরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের প্রত্যাশাও জোরদার তাঁর বক্তব্যে। এর মধ্যে রুটিন কাজগুলো সম্পাদনের পাশাপাশি যতখানি সম্ভব জরুরি সংস্কার সারা যায়, ততই মঙ্গল। সংস্কারের পথে রাষ্ট্র মেরামতের কাজ তো নির্বাচিত সরকারের আমলেও অব্যাহত রাখতে হবে।

হাসান মামুন: সাংবাদিক, কলামিস্ট

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র জন ত গণঅভ য ত থ ন ক ষমত চ য ত সরক র র প এ অবস থ ঐকমত য ইউন স অবশ য

এছাড়াও পড়ুন:

গণঅভ্যুত্থানের তরুণ নেতৃত্ব ও রাজনীতিতে প্রাণপ্রবাহ

বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদের অসীম সাহস ও অকুতোভয় নেতৃত্বে চব্বিশের জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদের দুর্গ ভেঙে পড়ে। রাজনীতিতে সুদীর্ঘকালের অনিয়ম, গোষ্ঠীবাজি ও দুর্নীতির দোর্দণ্ড প্রতাপের বিরুদ্ধে পরিবর্তনের সুতীব্র আকাঙ্ক্ষায় সরকার পতনের চূড়ান্ত আন্দোলনে লাখ লাখ মানুষের প্রতিবাদমুখর মিছিলের প্রথম সারিতে ছিলেন তরুণ নেতাকর্মী। এরই ধারাবাহিকতায় অন্তর্বর্তী সরকারে তরুণদের অংশগ্রহণ ও রাজনীতিতে তাদের দলের আত্মপ্রকাশ। সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল, তরুণরা যে বড় সুযোগ ও দায়িত্ব পেয়েছেন, তার সযত্ন মূল্য তারা দেবেন। 

গণঅভ্যুত্থানের মাত্র ৯ মাস দূরত্বে দাঁড়িয়ে আমরা দেখতে পাচ্ছি, তরুণ নেতৃত্বের অনেকে তৃণমূলকে ভুলে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হোটেল বা সচিবালয়ে বেশি আগ্রহী। সবচেয়ে উদ্বেগজনক, মাত্র ক’মাস আগে সরকারের দুর্নীতি ও জবাবদিহিহীনতার বিরুদ্ধে রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেওয়া তারুণ্যের একটি অংশের বিরুদ্ধেই বিপুল দুর্নীতিতে জড়ানোর অভিযোগ উঠছে। 
গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী তরুণদের রাজনৈতিক দল এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব গাজী সালাউদ্দীন তানভীরের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ খাত থেকে ৪০০ কোটি টাকা দুর্নীতি করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে সচিবালয়ে পদায়ন, বদলি, নিয়োগ ইত্যাদিতে তদবির ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। তিনি পাজেরো গাড়িতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, নিজের এলাকায় বিপুল অর্থ ব্যয়ে পোস্টার, বিলবোর্ড বানিয়ে জনগণকে ঈদের শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। নানা অভিযোগের ভিত্তিতে তাঁর দলীয় পদ সম্প্রতি স্থগিত করা হয়। 

রোববার রাতে একুশে টিভির ‘ফ্যাক্ট চেক’ অনুষ্ঠানে সব অভিযোগ অস্বীকার করে তানভীর বলেছেন, তাঁকে এক শুভাকাঙ্ক্ষী পাজেরো গাড়ি দিয়েছেন। এলাকায় প্রচারণার কাজে তিনি ‘মাত্র ১৫-১৬ লাখ টাকা’ খরচ করেছেন। ২০১৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয় উত্তীর্ণ তিনি এত টাকা কোথা থেকে পেলেন– প্রশ্নের উত্তরে তানভীর বলেন, তিনি চাকরি ও ব্যবসা করেন।
আরেক ছাত্রনেতা সারজিস আলমও তাঁর এলাকায় দুই শতাধিক গাড়ির বহর নিয়ে শোভাযাত্রা করে বিপুলভাবে সমালোচিত হয়ে বলে বসেন, এসব তাঁর দাদার সম্পত্তি! অথচ ২০১৮ সাল থেকে সামাজিক মাধ্যমে তাঁর সাধারণ জীবনযাপনের ছাপ স্পষ্ট। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতি করবার পেছনে যে কারণ সারজিস দেখিয়েছেন, তাও যুক্তিসংগত নয়। তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগের আমলে হলে সিট পেতে হলে প্রত্যেক ছাত্রকে ছাত্রলীগের মিছিলে যেতে হতো। তিনি তাই ছাত্রলীগের মিছিলে গিয়েছেন। অথচ ছাত্রলীগে যুক্ত না হয়ে নানা অত্যাচার-অপমান সহ্য করেও হলে থাকার অজস্র উদাহরণ আছে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সারজিসের আবেগমথিত উত্তাল বক্তৃতাও কি হলে থাকবার জন্য?

এছাড়া, ছাত্রনেতাদের গাড়িবিলাসের জবাব কী? আজ মার্সিডিজ, কাল পাজেরো, পরশু আরও বড় কোনো ব্র্যান্ড। কীভাবে এসব গাড়িতে চড়েন? টেলিভিশন টকশোতে এই প্রশ্নের উত্তরে ছাত্রনেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেছিলেন, একেক দিন একেক বড় ভাই একেক গাড়ি ব্যবহার করতে দেন! আরেক ছাত্রনেতা হান্নান মাসুদও বলেছেন, জামায়াতসংশ্লিষ্ট এক বড় ভাই তাঁকে বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহারের জন্য দিয়েছেন!

এমনও জানা যায়, পাঁচতারকা হোটেলে রীতিমতো স্যুট নিয়ে দিনের পর দিন থাকতে শুরু করেছেন কোনো কোনো ছাত্রনেতা। 
সমকাল জানাচ্ছে, ‘২২ এপ্রিল যুব ও ক্রীড়া এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার এপিএস মোয়াজ্জেম হোসেনকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এর আগে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগমের পিও (ছাত্র উপদেষ্টা) তুহিন ফারাবিকে অব্যাহতি দেওয়া হয়’ (২৫.০৪.২৫)। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী ছিলেন এই দুই এপিএস-পিও।

২.
স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার পিতা বিল্লাল হোসেন কুমিল্লার মুরাদনগরের আকবপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। আসিফ যে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে, সেই মন্ত্রণালয়ের কাজের জন্য তাঁর পিতার ঠিকাদারি লাইসেন্সের খবর ছড়ালে সমালোচনা শুরু হয়। সেই প্রেক্ষিতে আসিফ ফেসবুকে পোস্ট লিখে বাবার ভুলের জন্য ক্ষমা চান। 
পুত্র স্বয়ং মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে, পিতা এক স্কুলের প্রধান  শিক্ষক– দু’বছর আছে অবসর গ্রহণের; এই অবস্থায় সেই মন্ত্রণালয়ের অধীনে ঠিকাদারি লাইসেন্স নেওয়ার আগ্রহের পেছনের কারণ সন্ধানে ত্রিকালদর্শী হতে হয় না নিশ্চয়ই। এখানে স্বার্থের সংঘাতই শুধু নয়, পরিমিতিবোধের অভাবও প্রকট।   

৩.
পরিমিতিবোধের অভাব তরুণ নেতৃবৃন্দের কারও কারও মধ্যে যেমন, এনসিপির কার্যক্রমের মধ্যেও তা দেখা যাচ্ছে। জাঁকজমকের সঙ্গে পার্টির অভিষেক অনুষ্ঠান কিংবা পাঁচতারকা হোটেলে অনুষ্ঠানের চেয়ে তৃণমূলের হাটবাজার-গঞ্জই হওয়া উচিত এনসিপির মূল গন্তব্য। ওখানেই বাংলাদেশের প্রাণ, বাংলাদেশের কেন্দ্র। 

গত ৯ মাসে তিন ধাপে এনসিপি বর্তমান অবয়বে এসেছে; প্রথমে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, পরের ধাপে নাগরিক কমিটি, এরপর ফেব্রুয়ারির ২৬ তারিখ থেকে এনসিপি। এই পুরো সময়টিতে এনসিপি অনেক বেশি রাজধানীকেন্দ্রিক, মিডিয়ানির্ভর। ‘৩৬ জুলাই’ ক্ষমতা কাঠামোর যে দম্ভ চূর্ণ করার অবিনাশী আয়োজনে নেতৃত্ব দেন এই ছাত্রনেতারা– তার প্রত্যয় ছড়িয়ে দিতে হবে বাংলাদেশের আনাচে কানাচে। এই অভূতপূর্ব আন্দোলনের সময় এনসিপি নেতাদের কারও গাড়ি-বাড়ি বা শান-শওকত ছিল না। তারা রাস্তায় দাঁড়িয়ে তপ্ত রোদে এক বোতল পানি দু’তিনজনে ভাগ করে পান করে স্লোগান দিতেন; আজ তাদের কারও কারও কেন মনে হচ্ছে– রাজনীতি করতে চাইলে শতাধিক গাড়িবহরের শোভাযাত্রা করতে হবে, রঙিন পোস্টারে ছেয়ে দিতে হবে নিজের এলাকা? কিংবা পাঠ্যপুস্তকের কাগজের ব্যবসা করে ধনী হতে হবে? বদলি বাণিজ্যে বড়লোক হতে হবে? কিংবা জামায়াতের নেতার টাকায় প্রাডো গাড়ি চালাতে হবে? 
এসবই ঘুণে ধরা ক্লিশে রাজনীতির পরম্পরা! রাজনীতি করতে হলে প্রচুর অর্থ থাকতে হবে। টাকা দিয়ে লোক (ভোট) কিনে নিতে হবে; এই ধারণা থেকে গণঅভ্যুত্থানজয়ী তরুণরা বের হয়ে আসতে না পারলে কে পারবেন? যে ক্লিশে বড়লোকি রাজনীতি বছরের পর বছর দেশকে দমবন্ধ করে রেখেছে, এর থেকে পরিবর্তনের কাণ্ডারি গণঅভ্যুত্থানজয়ী তরুণ ছাড়া আর কে হবে? তাই দেশের তরুণ ছাত্র নেতাকর্মীকে বিলাসী জীবনের মোহ ছেড়ে যৌক্তিক প্রশ্ন ও দাবি নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। 

আত্মজিজ্ঞাসার কোনো বিকল্প নেই। নির্বাচনবিরোধী অবস্থান না নিয়েও মৌলিক সংস্কার প্রশ্নে নিজেদের অটুট অবস্থান দৃঢ় করতে হবে। বড় দল বিশেষত বিএনপি মৌলিক সংস্কারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে; এনসিপিকে এখানে সুস্পষ্ট ও যুক্তিসংগত ব্যাখ্যায় আসতে হবে– কেন এক ব্যক্তির শাসন ব্যবস্থা থেকে দেশের মানুষের মুক্তি অনিবার্য; এর পক্ষে তাদের কথা বলে যেতেই হবে। এনসিপিকে যেতে হবে তৃণমূলে, মানুষের দুয়ারে দুয়ারে। সবই হতে হবে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায়। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করলে তার ভোট সব চলে আসবে এনসিপির গোলায়– এত সরল নয় দেশের নির্বাচনী রাজনীতি। বরং আওয়ামী লীগ যে বীভৎস একনায়কতন্ত্র পরিচালনা করেছে; সেই তথ্য মনে রেখে আগামী দিনে একনায়কতান্ত্রিক শাসনকাঠামোর বিরুদ্ধে তরুণ নেতৃবৃন্দের দাবি ও স্বপ্ন জোরালোভাবে উপস্থাপন ও প্রতিষ্ঠা করাই ভবিষ্যতের বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন প্রাণপ্রবাহ আনতে পারে।

মাহবুব আজীজ: উপসম্পাদক, সমকাল; সাহিত্যিক
mahbubaziz01@gmail.com

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সংস্কারের একাল-সেকাল
  • সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনসহ ১১ বিষয়ে ইসলামী আন্দোলন ও এবি পার্টির ঐকমত্য
  • চলছে বৈঠকের রাজনীতি
  • বৈঠকে আওয়ামী লীগের বিচার ও মৌলিক সংস্কার প্রশ্নে একমত এনসিপি ও গণসংহতি আন্দোলন
  • কানাডার প্রধানমন্ত্রী কার্নিকে অভিনন্দন জানালেন ট্রাম্প
  • ঐকমত্য কমিশন দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে পারলে দ্রুত রাজনৈতিক বোঝাপড়া সম্ভব: সাইফুল হক
  • জাতীয় স্বার্থে আমরা কি একমত হতে পারি না
  • গণঅভ্যুত্থানের তরুণ নেতৃত্ব ও রাজনীতিতে প্রাণপ্রবাহ
  • গণভোটে সংস্কার চায় নুরের গণঅধিকার
  • সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীর বয়স ন্যূনতম ২৩ করার প্রস্তাব গণ অধিকার পরিষদের