দুপুরের রোদ খানিকটা পড়ে এসেছে। ক্লান্ত চোখে পিচঢালা পথ বেয়ে হেঁটে চলেছেন এক ব্যক্তি। পরনে লাল শার্ট আর লুঙ্গি। কাঁধে লোহার আঁচড়া। আঁচড়ার লম্বাটে বাঁশের হাতলের এক মাথায় লাল রঙের একটা কাপড়ের ব্যাগ। অন্য মাথায় বাঁশ-প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি ত্রিকোণাকৃতির বিশেষ ধরনের ঝুড়ি।

ওই ব্যক্তির নাম সাদ্দাম হোসেন। পেশায় স্বর্ণডুবুরি। পুকুর-জলাশয়ে কারও সোনা-রুপা হারিয়ে গেলে উদ্ধার করে দেন। বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলার কাটাখালী এলাকায় যে বেদেবহরটি আছে, সেই বহরের একজন সাদ্দাম। স্ত্রী ও তিন সন্তানকে বহরে নিয়ে এসেছেন। বাকি পাঁচ সন্তান গ্রামের বাড়িতে।

মাঘের শেষ দিন খুলনার রূপসা উপজেলার জাবুসা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এলাকায় সাদ্দামের সঙ্গে দেখা হয়। সঙ্গে থাকা জিনিসপত্র পাশে রেখে গাছের গায়ে হেলান দিয়ে একটুখানি জিরিয়ে নিচ্ছিলেন।

আলাপে আলাপে জানা গেল, সোনা খোঁজা ডুবুরি অধিকাংশই যাযাবর, বেদে সম্প্রদায়ের মানুষ। তবে এখন তাঁরা পুরোপুরি যাযাবরের জীবন পার করেন না। সাদ্দাম হোসেনদের স্থায়ী ঠিকানা মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলার খড়িয়া গ্রাম। ওই গ্রামে বেদে সম্প্রদায়ের পাশাপাশি অন্য সম্প্রদায়ের মানুষও বসবাস করেন। বছরের একটা নির্দিষ্ট সময় তাঁরা গ্রামেই থাকেন। বাকিটা সময় বাগেরহাটের কাটাখালী, মংলা, পিরোজপুর বা বরিশালের কোনো বেদেবহরের সঙ্গী হন। তাঁদের ভাষায় এটা ‘সফর’। সফরে দশটা পরিবার বের হলে তাঁদের জন্য একজন নেতা থাকেন। তাঁকে ‘বুঝনেদার’ বলা হয়। তিনি যেখানে বলেন, বহরের অন্যরা সেখানেই অস্থায়ী বসতি গাড়েন। দুই যুগের বেশি সময় ধরে তাঁরা প্রতিবছর কাটাখালীর এই ডেরায় আসেন। থাকেন পলিথিনে ছাওয়া অস্থায়ী মাচাংয়ে।

সাদ্দাম হোসেনের বয়স এখন ৩৬ বছর। মোট বয়সের অর্ধেক সময় ধরে সোনা খোঁজার কাজ করছেন। এর আগে শুধুই গ্রামে হেঁটে হেঁটে ফেরি করতেন। এখন এক দিন কড়ি, মালা, মাদুলি, চুড়ি, ফিতা, আলতা নিয়ে বের হন। অন্যদিন বের হন সোনা–রুপার খোঁজে। এই রুটিন কাজের পাশাপাশি গ্রামের বিদ্যুতের খুঁটির গায়ে গায়ে তাঁরা সোনা খোঁজার জন্য ফোন নম্বর লিখে দিয়ে আসেন। কারও কল পেলে চলে যান সোনা খুঁজতে।

বেদেদের সবার পেশা আবার এক নয়। গোত্রভিত্তিক আলাদা আলাদা পেশা তাঁদের। সাদ্দাম যেমন বলছিলেন, তাঁরা সাপখেলা দেখান না। সাপের সঙ্গে তাঁদের কোনো রকমের সম্পৃক্ততা নেই। সোনা খোঁজা আর ফেরি করে কড়ি-মালা বিক্রি করাই তাঁদের পূর্বপুরুষের পেশা। নারী-পুরুষ মিলেই উপার্জন করে সংসার চালান। স্ত্রীরা গ্রামে ঘুরে ঘুরে ‘দাঁতের পোকা’ তোলেন; শিঙা ফুঁকে বিষ–ব্যথা নামান। সকালে খেয়ে স্বামী-স্ত্রী আলাদা বের হয়ে যান। বহরের পুরুষ সদস্যরা কখনো একা, কখনো দল বেঁধে বের হলেও নারীরা বের হন ছোট–বড় দলে।

‘বাংলাদেশের বেদে জনগোষ্ঠীর নৃতাত্ত্বিক পরিচয়’ বইয়ের তথ্য অনুযায়ী, পানি থেকে গয়না খুঁজে আনা সম্প্রদায়টি হচ্ছে শান্দার বেদের মধ্যে রায়েন্দা উপগোত্রের কুড়িন্দা উপ–উপগোত্রের। আর চুড়ি-ফিতা–আলতা বিক্রি করে একই উপগোত্রের নাগারচি উপ-উপগোত্রের লোকজন।

সোনা খোঁজার কথা বলতে গিয়ে সাদ্দাম বলেন, গলার মালা, নাকফুল, কানের গয়না ঘাট এলাকায় পড়লে তাঁরা তুলে দেন। মাথার ওপর দু-তিন ফুট পানি হলেও তাঁরা বের করতে পারেন। তবে সব সময় ডুব দিয়ে কাজ হয় না। যেখানে গয়নাটা পড়ছে, তার চারপাশের মাটি আঁচড়া দিয়ে টেনে টেনে কাছে আনেন তারপর ঝাঁই (বিশেষ ঝুড়ি) দিয়ে কাদা তোলেন। সেই কাদা ওই ঝাঁইয়ের মধ্যে ধোয়ার পরে সোনা যদি সত্যিই পুকুরে পড়ে থাকে, তাহলে পাওয়া যায়।

হারানো জিনিস খুঁজে পাওয়ার ক্ষেত্রে সফলতা মেলে কেমন—এমন প্রশ্নের জবাবে সাদ্দাম বলেন, ‘অন্য জায়গায় ফেলে পানিতে পড়ার কথা বললে তো আর পাব না। পানিতে শিওর হারালে শিওর পাওয়া যায়। এ কাজে আমাদের সুনাম আছে। এ জন্য মানুষ ডাকে।’

সোনা খুঁজে দিলে কেমন টাকা আসে, জানতে চাইলে সাদ্দাম হোসেন বলেন, এ বিষয়ে পার্টির সঙ্গে একটা চুক্তি হয়। ধরা যাক, এক ভরি হারিয়ে গেলে পাঁচ হাজার টাকা। না পাওয়া গেলে পরিশ্রম বাবদ হয়তো দু–তিন শ টাকা। সেটা অবশ্য খুশি-অখুশির ব্যাপার।

সোনা খোঁজার কাজে বের হলে আয়রোজগার হবেই, এটা নিশ্চিত নয়। বিষয়টি ব্যাখ্যা দিয়ে সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘সোনা খোঁজার ইনকামটা লটারি সিস্টেম। এই যেমন আজ প্রায় বিকেল পর্যন্ত কিছু হয়নি। এ জন্য লটারি বলছি। কড়ি-মালায় নিশ্চিত হবেই। প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা হবেই। তবে সোনা খোঁজায় লাভটা অন্য রকম। একটা গয়না তুলে দিলে বিশাল অঙ্কের টাকা পাচ্ছি। কড়ি-মালায় তামাম দিনে ওই ৫০০ টাকা আসবে। দুটোই আমাদের পেশা, দুটোই করতে হয়। তবে যেকোনো সময় যেকোনো কাজ করতে প্রস্তুত আমরা। কেউ যদি কামলার জন্য ডাকে, আমরা সেটাও করি।’

সোনা খোঁজা পেশার সোনালি সময়টা পার হয়ে গেছে বলে মনে করেন সাদ্দাম হোসেন। হতাশ কণ্ঠে সাদ্দাম হোসেন বলেন, এটা নদী, নালা, জলাশয়, পুকুরনির্ভর জীবিকা। এখন তো পুকুর, মাঠেল কম। আবার নারীরা আগের মতো পুকুরে গোসল না করে ঘরেই গোসল করেন। তাই এই ব্যবসায় আর আগের মতো জুত নেই।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: বহর র

এছাড়াও পড়ুন:

বোচাগঞ্জ থানার ওসির অপসারণ দাবিতে মানববন্ধন 

দিনাজপুরের বোচাগঞ্জ উপজেলায় মামলা নিতে অস্বীকৃতি জানানোয় এবং আসামি গ্রেপ্তারে বিলম্ব করার অভিযোগ এনে বোচাগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাসান জাহিদের অপসারণের দাবি মানববন্ধন করা হয়েছে। 

সোমবার (১৬ জুন) দুপুর ১২টায় সেতাবগঞ্জ চৌরাস্তায় মানববন্ধন শেষে ঝাড়ু মিছিল নিয়ে থানার প্রধানগেটে মিছিল করে  স্থানীয়রা। 

মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন, সন্ত্রাসী হামলায় আহত শাহরিয়ার শিশিরের বাবা সাবেক কাউন্সিলর আসাদুজ্জামান আসাদ, জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি ও সেতাবগঞ্জ পৌর বিএনপির সভাপতি নওশাদ আলী, দিনাজপুর জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক মোজাহারুল ইসলাম, বোচাগঞ্জ উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান রেদওয়ানুল কারীম রাবিদ, পৌর বিএনপির উপদেষ্টা এমওয়ালী ফ্লাড, উপজেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক রিয়াদ হাসান চৌধুরী, এমরুল রেজা, মাসুদ খাঁন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী প্রীতি আক্তার নিশি, সাবেক কাউন্সিলর মামুন প্রমুখ। 

আরো পড়ুন:

কালীগঞ্জে মাদকবিরোধী সমাবেশ 

মুন্সীগঞ্জে গুমে জড়িতদের বিচার দাবিতে মানববন্ধন 

তারা বলেন, বোচাগঞ্জের মাটিতে একের পর এক সন্ত্রসী ঘটনা ঘটছে কিন্তু বোচাগঞ্জ থানার ওসি হাসান জাহিদ সরকার সেই সন্ত্রসীদের বিরুদ্ধে মামলা নেন না। কারণ ওই সন্ত্রাসীরা হলেন তথাকথিত সমন্বয়ক ফয়লাল মোস্তাকের ক্যাডার বাহিনী। তিনি মামলার বাদীকে চিহ্নিত সন্ত্রাসীর নাম বাদ দিয়ে মামলা করতে বাধ্য করেন। তার পরও এজাহারভুক্ত আসামিদের গ্রেপ্তার করছেন না। 

তারা অবিলম্বে ওসি হাসান জাহিদের অপসারণ ও কিশোর গ্যাংয়ের সকল সদস্যদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনার জোর দাবি জানান।

এ বিষয়ে বোচাগঞ্জ থানার ওসি হাসান জাহিদ সরকার জানান, গত ৯ জুন সেতাবগঞ্জ চিনিকল উচ্চবিদ্যালয় মাঠে শাহরিয়ার শিশিরকে মারধরের ঘটনায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। সেই মামলায় আটজনকে আসামি করা হয়েছে। আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা করা হচ্ছে।  

তিনি আরো বলেন, ‘‘যারা আমার কাছে অবৈধভাবে সুবিধা নিতে পারেননি। তাদের একটি অংশ আমার বিরুদ্ধে ঝাড়ু মিছিল করছেন। আমার পদত্যাগ দাবি করছেন। আর যে মামলায় আসামি গ্রেপ্তার হওয়ার বিষয়ে মানববন্ধন করা হয়েছে। ওই মামলার আসামিরা আদালতের মাধ্যমে জামিন পেয়েছেন বলে আমি আদালত মারফত জানতে পেরেছি।’’

ঢাকা/মোসলেম/বকুল

সম্পর্কিত নিবন্ধ