চবিতে অভ্যুত্থানের মেয়েরা যেভাবে ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ ও বহিষ্কৃত
Published: 18th, February 2025 GMT
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে সামনের সারিতে ছিলেন যেসব মেয়ে, একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে তাঁদের দেওয়া হলো ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ তকমা। পাশাপাশি কঠোর শাস্তির মাধ্যমে তাঁদের ভবিষ্যৎ জীবনকে যেভাবে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে, তা আসলে আসলে কতটা ন্যায্য, সেই প্রশ্নও উঠেছে।
পুরো ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে নাগরিকদের মধ্যে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। অভ্যুত্থানের পর দায়িত্ব পাওয়া প্রশাসনকে দুষছেন সবাই।
অভিযোগ উঠেছে, নিজেদের ক্ষমতাচর্চার সুবিধার্থে প্রশাসনে দায়িত্ব পাওয়া কতিপয় শিক্ষক একদল শিক্ষার্থী ও ক্যাম্পাসভিত্তিক কিছু সাংবাদিককেও নিজেদের দলে ভিড়িয়েছেন। শিক্ষার্থীদের অনেকে মনে করছেন, ক্যাম্পাসে একটি অবরুদ্ধ পরিবেশ তৈরির সংঘবদ্ধ প্রয়াস চলছে। যার ফলস্বরূপ ছাত্রীদের নিয়ে এমন ঘটনা ঘটল।
জানা যাচ্ছে, ‘জননেত্রী শেখ হাসিনা হল’ এর সামনে বিগত প্রশাসনের আমলে নৌকার আদলে একটি বসার স্থান তৈরি করা হয়। তিনটা হলের ছাত্রীদের সময় কাটানোর কমন স্পেস ছিল এটি।
গত ৪ ফেব্রুয়ারি দুপুরে ছাত্রদের একটি দল ওই স্থাপনা ভাঙতে যায়। তাদের দাবি, পতিত আওয়ামী লীগের কোনো চিহ্ন ক্যাম্পাসে রাখা যাবে না। কিন্তু হলের ছাত্রীদের দাবি ছিল, এসব ভাঙলে প্রশাসনই ভাঙুক এবং ওই স্থানে বিকল্প বসার জায়গা বানিয়ে দিক।
পরদিন ৫ আগস্ট প্রায় মধ্যরাতে একদল ছাত্র স্থাপনাটি আবার ভাঙতে যান। তখন ছাত্রীদের সঙ্গে তাঁদের বাগ্বিতণ্ডা ও হাতাহাতি হয়। এ সময় ছাত্রীদের বিশ্রী ভাষায় গালিগালাজ করেন ও নানা তকমা দেন ভাঙচুরকারীরা।
ছাত্রীরা সে সময় প্রক্টরিয়াল টিমকে বারবার ফোন করেও ঘটনাস্থলে পাননি। একপর্যায়ে মেয়েরা হল থেকে বের হয়ে ভিসির বাসভবনের দিকে যান প্রতিবাদ জানাতে। প্রক্টরিয়াল টিমের সদস্যরা সেখানে হাজির হলে ছাত্রীদের সঙ্গে তাঁদের তর্কাতর্কি হয়।
ছাত্রীদের অভিযোগ প্রক্টরিয়াল টিমের একজন শিক্ষক বিক্ষুব্ধ ছাত্রীদের গালিগালাজ করেন। ছাত্রীদের ‘ফ্যাসিবাদের দালাল’, ‘হাসিনার লোক’ এসব ট্যাগ বা তকমাও দেন। এমন উত্তেজনাকর ও হাতাহাতির পরিস্থিতিতে ওই শিক্ষকের গায়ে হাত তোলেন এক ছাত্রী। এতে ছাত্রীদের ওপর নেমে আসে কঠোর শাস্তির খড়্গ। সনদ বাতিলের সুপারিশসহ ১ জনকে আজীবন ও ৯ জনকে দুই বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়। যদিও অভিযুক্তদের মধ্যে কেউ কেউ তখন ঘটনাস্থলে উপস্থিতও ছিলেন না।
অভিযুক্ত ছাত্রীদের দাবি, বাদানুবাদ, গালিগালাজ ও হাতাহাতির মধ্যে প্রক্টরিয়াল টিমের সদস্য ছিলেন, ছাত্রীরা বুঝতেও পারেননি। এমন পরিস্থিতিতে একজন শিক্ষকের গায়ে হাত ওঠার অনাকাঙ্ক্ষিত ভুলটি তাঁদের একজনের দ্বারা ঘটে গেছে। তিনি যে শিক্ষক, তা পরবর্তী সময়ে জানতে পেরে ওই ছাত্রী চরম ভীত হয়ে পড়েন এবং অনুশোচনায় পড়েন। হল কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ওই শিক্ষকের কাছে ক্ষমা চাওয়ার ইচ্ছাও প্রকাশ করেন। কিন্তু হল কর্তৃপক্ষের কয়েকজন শিক্ষক এ ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেননি।
অভিযুক্ত কয়েকজন ছাত্রী, প্রতিবাদী ছাত্রসমাজ, সংবাদমাধ্যম ও সেই রাতের বিভিন্ন ভিডিওর সূত্রে বিষয়গুলো এভাবে জানা যাচ্ছে।
শাস্তি পাওয়াদের একজন, বিশ্ববিদ্যালয়ের জুলাই অভ্যুত্থানের একজন সমন্বয়ক সুমাইয়া শিকদারের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, নৌকার আদলের স্থাপনাটি সরাতে ও হলের নাম পরিবর্তন করতে হল কর্তৃপক্ষকে কয়েকবার মৌখিকভাবে ও দুইবার লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। আমরা চেয়েছিলাম, ফ্যাসিবাদের এই প্রতীক প্রশাসনই ভাঙুক। কিন্তু সেটি তারা করেনি। উল্টো ‘মবকে’ প্রশ্রয় দিয়েছে।
এ ঘটনায় কিছু প্রশ্ন উঠেছে, যেমন যেখানে রাত ৯টায় ছাত্রী হল বন্ধ হয়ে যায়, একদল ছাত্র কীভাবে প্রায় মধ্যরাতে সেখানে ঢুকতে পারলেন? স্থাপনাটি ভাঙতে বাধা দিয়ে ছাত্রীরা যদি ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ হয়ে যান, তা হলে পালিয়ে যাওয়া স্বৈরশাসকের নামে এত দিন হলটি রেখে দেওয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে কী তকমা দেওয়া যায়?
যেখানে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠান থেকে পতিত সরকারপ্রধানের পরিবারের নামে সব স্থাপনার নামকরণ বদলে ফেলা হয়েছে, সেখানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেকগুলো স্থাপনা তাদের নামে এখনো কী করে থাকে? মেয়েদের বারবার মৌখিক ও লিখিত আবেদন সত্ত্বেও নৌকার আদলে সেই স্থাপনা কেন সরানো হলো না?
ছাত্রীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁরা ক্যাম্পাসের সাংবাদিকদেরও অপদস্থ করেছেন সেই রাতে। সাংবাদিকদের ভিডিও করতে বাধা দেওয়া হয়। ছাত্রীরা বলছেন, তাঁরা যে সাংবাদিক ছিলেন, সেটি বোঝার উপায় ছিল না। কারণ, তাঁদের গলায় কোনো আইডি কার্ড ছিল না। তা ছাড়া সাংবাদিকদেরও কেউ কেউ মেয়েদের অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করছিলেন। আর ওই রাতে রুম থেকে দ্রুত নেমে আসায় মেয়েদের অনেকে রাতের পোশাকে বা অপ্রস্তুত পোশাকে ছিলেন, সে জন্য মানা করার পরও মোবাইলে ভিডিও করছিলেন কেউ কেউ।
এ ঘটনায় ছাত্রীদের কোনো কারণ দর্শানোর নোটিশও দেওয়া হয়নি, এমনকি প্রায় এক সপ্তাহ হয়ে গেলেও শাস্তির বিষয়টি চিঠি দিয়ে জানানো হয়নি। ছাত্রীদের অন্যায্য শাস্তি দেওয়ার প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া ছাত্ররা। তাঁদের উদ্দেশে একজন সহকারী প্রক্টর ফেসবুকে লেখেন, ‘বিপ্লবীরা কি হানি ট্র্যাপে।’ তার মানে দাঁড়ায় ছাত্রীরা হানি ট্র্যাপে ফেলে তাঁদের পক্ষে প্রতিবাদী ছাত্রদের কথা বলতে বাধ্য করেছেন!
এর আগেও নারীদের নিয়ে একাধিকবার অশালীন বক্তব্য দিয়েছেন তিনি। এভাবে যৌন হয়রানিমূলক বক্তব্য দেওয়া কোনো ব্যক্তি কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হন? প্রক্টরিয়াল টিমে এমন সদস্য থাকাই তো নারীদের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। ক্যাম্পাসভিত্তিক কিছু সাংবাদিককেও দেখা যায়, বাজে ভাষায় মেয়েদের চরিত্রহানি করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়টি কি কখনো নারীবান্ধব হতে পারবে না?
ঘটনাকেন্দ্রিক নানা প্রশ্নই বলছে, ছাত্রীদের দেওয়া এ শাস্তি সুবিবেচনাপ্রসূত হয়নি। গণহারে ৯ জনকে দুই বছর বহিষ্কারাদেশ ছাড়াও মাস্টার্সের চূড়ান্ত পরীক্ষা দিয়ে দেওয়া এক শিক্ষার্থীর অনার্সের অর্জিত সনদ কেড়ে নেওয়া কোনোভাবেই যৌক্তিক হতে পারে না।
বিশৃঙ্খলা ও নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের শাস্তি দিয়ে থাকে। সেটির মূল্য উদ্দেশ্যই হচ্ছে অভিযুক্ত শিক্ষার্থীকে সংশোধন করা। ঘটনা বিবেচনায় গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রে প্রচলিত আইনের আশ্রয়ও নিতে পারে চাইলে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সেটি না করে ছাত্রীদের শিক্ষাজীবন ধ্বংসের যে সিদ্ধান্ত নিল তারা, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠাটাই স্বাভাবিক।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এমন সিদ্ধান্তে প্রতিষ্ঠানটিরই অনেক শিক্ষকও কঠোর সমালোচনা করেছেন। তাদের মধ্যে একজন সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মাইদুল ইসলাম।
পতিত সরকারের আমলে নির্যাতিত এ শিক্ষক এক ফেসবুক পোস্টে বলেন, ‘যাদেরকে বহিষ্কার করা হয়েছে তাঁদের অনেকেই জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের সম্মুখসারির যোদ্ধা। প্রশাসনকে বলি আপনারা যে চেয়ারে বসে শিক্ষার্থীদের বহিষ্কার করার ক্ষমতা দেখাচ্ছেন তা এই শিক্ষার্থীদের তাজা রক্ত মারিয়ে পেয়েছেন, বেশিদিন হয় নাই, রাস্তায় শহীদদের রক্তের দাগও এখনো মুছে যায় নি। শিক্ষকদের কার কী ভূমিকা ছিল তা নাইবা বললাম। কিন্তু জানি তো। খুনি হাসিনাও ক্ষমতার দম্ভে অন্ধ হয়ে গিয়েছিল মনে রাখবেন। টিকতে পারেনি কিন্তু।’
ছাত্রীদের বহিষ্কারের এ ঘটনায় প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন দেশের ১৫৪ জন নাগরিকও। যাদের মধ্যে রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ, আইনজীবী, লেখক, গবেষক, কবি, সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকর্মী, আন্দোলনকর্মীসহ অনেকে।
এসব বিশিষ্ট নাগরিক বলেছেন, মধ্যরাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হলের সামনে একদল ছাত্রের ভাঙচুরের ঘটনায় প্রশাসন নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। এরপর অস্পষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে, যথাযথ তদন্ত না করে এবং কোনো রকম আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়েই একযোগে এসব শিক্ষার্থীকে বহিষ্কারাদেশ দেওয়া হয়েছে।
তাঁরা এ বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার, ঘটনার পুনঃতদন্ত এবং অপেশাদার আচরণের জন্য প্রক্টরিয়াল টিমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। দুজন প্রক্টরের অশালীন বক্তব্য ও ফেসবুকে নারী শিক্ষার্থীদের জঘন্য ভাষায় আক্রমণের তীব্র নিন্দাও জানিয়েছেন তাঁরা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এ ঘটনায় ক্যাম্পাসটিতে একাধিক বিক্ষোভ ও মানববন্ধন হয়েছে, ঢাকায়ও প্রতিবাদ–মিছিল হয়েছে। এসব প্রতিবাদ, মানবন্ধন, বিক্ষোভ, বিবৃতির পর এখন দেখার অপেক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের অন্যায্য সিন্ধান্ত নিয়ে কী পদক্ষেপ নেয়।
রাফসান গালিব প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী। ই–মেইল: [email protected]
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: এ ঘটন য় র একজন র জন য কর ছ ন দ র অন র অন ক
এছাড়াও পড়ুন:
মহানবী (সা.)–এর ইন্তেকালের পরে শাসন নিয়ে যা ঘটেছে
মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সিরাত বা জীবনী শুধু ইসলামের ইতিহাসের একটি অধ্যায় নয়, বরং এটি একটি স্বতন্ত্র জ্ঞানশাখা, যার কেন্দ্রে রয়েছেন তিনি এবং তাঁর যুগের ঘটনাবলি, মূল্যবোধ, নীতি, মুজিজা এবং সম্পর্ক।
নবীজির সিরাত প্রতিষ্ঠিত কোরআন, হাদিস এবং সাহাবিদের জীবনাচরণের আলোকে। তবে এই জীবনী নিয়ে বিভিন্ন সময়ে ভ্রান্ত ব্যাখ্যা এবং তথ্য বিকৃতির ঘটনা ঘটেছে, যা ইসলামের প্রকৃত চিত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
প্রামাণিক উৎসমহানবী (সা.)–এর জীবন সম্পর্কে অধ্যয়নের সবচেয়ে প্রামাণিক উৎস হলো কোরআন মাজিদ। কোরআনে তাঁর জীবনের বিভিন্ন পর্যায়, তাঁর রিসালাত, হিজরত, যুদ্ধ এবং তাঁর মানবিক গুণাবলি সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, সুরা মুহাম্মদে তাঁর নাম উল্লেখ করা হয়েছে (আয়াত: ২)।
সুরা আলে ইমরানেও এসেছে (আয়াত: ১৪৪), সুরা আহজাবে তাঁকে ‘খাতামুন নাবিয়্যিন’ বা নবীদের সিলমোহর (মানে শেষ নবী) বলা হয়ে (আয়াত: ৪০) এবং সুরা ফাতহে তাঁকে বলা হয়েছে ‘আল্লাহর রাসুল’ (আয়াত: ২৯)।
মহানবীর সিরাত নিয়ে কিছু ব্যাখ্যা ও রচনা ঐতিহাসিক সত্য থেকে বিচ্যুত হয়েছে, যা ইসলামের প্রকৃত চিত্রকে বিকৃত করেছে। এই বিকৃতিগুলো ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় হয়েছে, কখনো অতিরঞ্জিত বর্ণনা বা ভুল ব্যাখ্যার মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে।এ ছাড়া চরিত্র, কাজ, অবস্থান সম্পর্কে বহু আয়াত আছে কোরআনে।
হাদিস গ্রন্থগুলোও সিরাতের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। ইমাম মালিকের মুয়াত্তা, সহিহ বুখারি, সহিহ মুসলিম, সুনানে আবু দাউদ, সুনানে ইবনে মাজা, সুনানে তিরমিজি এবং সুনানে নাসাইতে তাঁর বাণী, কাজ ও সম্মতির বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে এবং সিরাতের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়েছে।
এই গ্রন্থগুলোর সনদ (বর্ণনা পরম্পরা ও বিষয়বস্তু যাচাইয়ের জন্য মুহাদ্দিসগণ কঠোর মানদণ্ড প্রয়োগ করেছেন, যা ‘জার্হ ও তাদিল’ নামে পরিচিত।
এ ছাড়া ইবনে ইসহাকের সিরাতু রাসুলিল্লাহ সিরাতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থগুলোর একটি, ইবনে হিশাম, যার একটি সংক্ষিপ্ত সংস্করণ প্রকাশ করেছেন এবং আস-সুহাইলি তা নিয়ে আর-রওদুল উনুফ নামে একটি ব্যাখ্যা রচনা করেছেন।
এ ছাড়া ইবনে শিহাব জুহরি ও মুসা ইবনে উকবার মাগাজি মহানবী (সা.) রাসুলুল্লাহর নির্ভরযোগ্য জীবনীগ্রন্থ। কাজি ইয়াজের আশ-শিফা বি তা’রিফ হুকুকিল মুস্তফা তাঁর গুণাবলি ও অধিকারের ওপর বিশদ আলোচনা করেছে, যা পূর্ব ও পশ্চিমের পণ্ডিতদের কাছে ব্যাপকভাবে সমাদৃত।
আরও পড়ুনমহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর জীবনী রচনার হাজার বছর১১ নভেম্বর ২০২০ভ্রান্ত ব্যাখ্যা ও তথ্য বিকৃতিমহানবীর সিরাত নিয়ে কিছু ব্যাখ্যা ও রচনা ঐতিহাসিক সত্য থেকে বিচ্যুত হয়েছে, যা ইসলামের প্রকৃত চিত্রকে বিকৃত করেছে। এই বিকৃতিগুলো ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় হয়েছে, কখনো অতিরঞ্জিত বর্ণনা বা ভুল ব্যাখ্যার মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে।
মহানবীর মৃত্যুর পূর্বে তাঁর অসুস্থতার লক্ষণ প্রকাশ পায় হজ্জাতুল বিদা বা বিদায় হজের সময়। তিনি আরাফাতে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আমার কাছ থেকে তোমাদের হজের রীতি গ্রহণ করো। কারণ, এ বছরের পর আমি হয়তো আর হজ করতে পারব না।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১,২৯৭)
সুরা নাসর অবতীর্ণ হলে তিনি বলেন, ‘এটি আমার মৃত্যুর ঘোষণা।’ (ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৫/২০৮, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৯৮৮)
আমি এখনো খায়বারে খাওয়া বিষাক্ত খাবারের যন্ত্রণা অনুভব করছি, এখন এর সময় এসেছে যে আমার শিরা ছিঁড়ে যাবে।সহিহ বুখারি, হাদিস: ৪৪২৮রাসুল (সা.) মসজিদে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আল্লাহ তাঁর একজন বান্দাকে দুনিয়া ও আল্লাহর নৈকট্যের মধ্যে পছন্দ করতে বলেছেন, আর সেই বান্দা আল্লাহর নৈকট্য পছন্দ করেছেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,৫০৪)
তাঁর অসুস্থতার সময় তিনি আয়েশা (রা.)-এর ঘরে থাকতে পছন্দ করেন। আয়েশা বলেন, ‘তিনি জান্নাতুল বাকি (কবরস্থান) থেকে ফিরে এসে আমাকে মাথাব্যথায় কাতর দেখে বললেন, “বরং আমি বলি, হায় আমার মাথা”!’ (মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক, সিরাতু রাসুলিল্লাহ, পৃ. ৬৭৮, দারুল মা’রিফা, বৈরুত, ১৯৭৮)
তিনি তীব্র জ্বরে ভুগছিলেন এবং বলেন, ‘আমি এখনো খায়বারে খাওয়া বিষাক্ত খাবারের যন্ত্রণা অনুভব করছি, এখন এর সময় এসেছে যে আমার শ ছিঁড়ে যাবে’ (সহিহ আল-বুখারি, হাদিস: ৪৪২৮)। তিনি নির্দেশ দেন সাতটি মশকের পানি তাঁর ওপর ঢালার জন্য, যা তাঁর জ্বর কমাতে সাহায্য করে। (ইবনে হিশাম, সিরাতুন নবী, ২/৬৪২, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৮)
১১ হিজরির ১২ রবিউল আউয়াল, সোমবার (৭ জুন, ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দ) তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি আয়েশা (রা.)–এর ঘর থেকে মসজিদে উঁকি দিয়ে মুসল্লিদের দিকে তাকিয়ে হাসেন এবং বলেন, ‘হে আল্লাহ, আমাকে মৃত্যুর যন্ত্রণায় সাহায্য করো।’ (আবু বকর আল-বাইহাকি, দালাইলুন নুবুওয়া, ৭/২৪৪, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৮৫)
তাঁর মৃত্যুর পর আবু বকর (রা.) ঘোষণা দেন, ‘যে মুহাম্মদের ইবাদত করত, সে জানুক, মুহাম্মদ মারা গেছেন। আর যে আল্লাহর ইবাদত করে, সে জানুক আল্লাহ চিরজীবী, তিনি মরেন না।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১২৪১)
আরও পড়ুননবীজি (সা.)–র কোন জীবনী পড়বেন২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫খিলাফতের প্রতিষ্ঠা: সাকিফা বনু সায়েদামহানবী (সা.)–এর মৃত্যুর পর ‘সাকিফা বনু সায়েদা’য় সাহাবিরা খিলাফত নির্বাচনের জন্য সমবেত হন। আনসাররা সাদ ইবন উবাদার নেতৃত্বে দাবি করেন যে তারা ইসলামের প্রথম দিন থেকে রাসুলকে সমর্থন করেছেন, তাই তাদের মধ্য থেকে আমির নির্বাচিত হওয়া উচিত।
আবু বকর (রা.) মুহাজিরদের পক্ষে বলেন, ‘কুরাইশরা ইসলামে প্রথম ইমান এনেছে এবং তারা আরবের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত গোত্র। আমি তোমাদের জন্য উমর বা আবু উবাইদাহর মধ্যে একজনকে প্রস্তাব করছি।’ (ইবনে হিশাম, সিরাতুন নবী, ২/৫৬, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৮)
আনসাররা প্রস্তাব করেন, ‘একজন আমির মুহাজিরদের থেকে এবং একজন আনসারদের থেকে হবে।’ তবে এই প্রস্তাব ঐক্য রক্ষার জন্য প্রত্যাখ্যাত হয়। উমর ইবনে খাত্তাব আবু বকরের হাত ধরে বায়আত করেন এবং আনসাররাও তাঁকে সমর্থন দেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,৮৩০)
আমি তোমাদের নেতা নির্বাচিত হয়েছি, কিন্তু আমি তোমাদের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট নই। যদি ভালো করি, আমাকে সাহায্য করো; আর যদি ভুল করি, আমাকে সংশোধন করো।হজরত আবু বকর (রা.)পরদিন মসজিদে সাধারণ বায়আত অনুষ্ঠিত হয়। আবু বকর (রা.) বলেন, ‘আমি তোমাদের নেতা নির্বাচিত হয়েছি, কিন্তু আমি তোমাদের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট নই। আমি যদি ভালো করি, আমাকে সাহায্য করো; আর যদি ভুল করি, আমাকে সংশোধন করো।’ (ইবনে হিশাম, সিরাতুন নবী, ২/৬৫৮, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৮)
কয়েকজন সাহাবি, যেমন আলী (রা.) এবং জুবাইর ইবন আওয়াম, ফাতিমা (রা.)-এর ঘরে মহানবীর দাফনের প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, তাই সাকিফায় উপস্থিত ছিলেন না। কেউ কেউ মনে করেন, খিলাফতের জন্য আলী (রা.) বা আব্বাস ইবন আবদুল মুত্তালিব উপযুক্ত ছিলেন।
তবে মহানবী কাউকে স্পষ্টভাবে খলিফা মনোনয়ন করেননি। তিনি বলেছিলেন, ‘আমাকে কাগজ দাও, আমি তোমাদের জন্য এমন কিছু লিখে দেব, যার পর তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না।’ কিন্তু উমর বলেন, ‘নবীজি এখন প্রবল যন্ত্রণায় ভুগছেন, (তাকে বিরক্ত করব না) আমাদের জন্য কোরআনই যথেষ্ট।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১১৪)।
রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় মহানবীর ভূমিকা‘আবু বকর (রা.) ইসলামি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন’ বলে হালা ওয়ার্দি যে দাবি করেছেন, তা ঐতিহাসিক তথ্যের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ।
মহানবী (সা.) নিজেই ইসলামি রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন করেন। তিনি মদিনায় একটি জাতি গঠন করেন, যারা কোরআনের নির্দেশনা অনুসরণ করে ঐক্যবদ্ধ হয়। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমরা সবাই আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধরো এবং বিচ্ছিন্ন হোয়ো না।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১০৩)
তিনি মদিনা সনদ প্রণয়ন করেন, যা মুসলিম ও অমুসলিমদের মধ্যে সম্পর্ক ব্যাখ্যা করে। (ইবনে হিশাম, সিরাতুন নবী, ১/৫০১, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৮)
তিনি বিভিন্ন গোত্রের সঙ্গে চুক্তি, যুদ্ধে নেতৃত্ব এবং রাষ্ট্রদূত প্রেরণের মাধ্যমে রাষ্ট্রের কাঠামো গড়ে তোলেন। যেমন রোমের সম্রাট হেরাক্লিয়াস, পারস্যের কিসরা এবং মিসরের মুকাউকিসের কাছে পত্র প্রেরণ করেন, যা তাঁর রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রতীক। (ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৪/২৬৯, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৯৮৮)
তিনি রাষ্ট্র পরিচালনায় ন্যায়বিচার ও শুরার নীতি প্রয়োগ করেন। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘মানুষের মধ্যে ন্যায়বিচারের সঙ্গে রায় দাও।’ (সুরা সাদ, আয়াত: ২৬)
মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যদি ফাতিমা বিনতে মুহাম্মদ চুরি করত, আমি তার হাত কেটে দিতাম।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,৭৮৭)।
তিনি শুরার বাস্তবায়ন করেন, কেননা কোরআন বলেছে, ‘তাদের সঙ্গে পরামর্শ করো।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৫৯)
তিনি বলেন, ‘আমি একজন মানুষ। ধর্মীয় বিষয়ে আমার নির্দেশ গ্রহণ করো, কিন্তু পার্থিব বিষয়ে তোমরা আমার চেয়ে বেশি জানো।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,৩৬৩)
হালা ওয়ার্দির গ্রন্থের মতো অনেক গ্রন্থ বাজারে পাওয়া যায়, যা ঐতিহাসিক তথ্যের অপব্যাখ্যা করে এবং তাঁর মৃত্যু ও খিলাফত নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা প্রচার করে।শেষ কথামহানবীর ‘সিরাত’ ইসলামের ইতিহাস ও মূল্যবোধের একটি জীবন্ত দলিল। কোরআন, হাদিস এবং প্রামাণিক সিরাত গ্রন্থগুলো তাঁর জীবনের সঠিক চিত্র তুলে ধরেছে। তবে হালা ওয়ার্দির গ্রন্থের মতো অনেক গ্রন্থ বাজারে পাওয়া যায়, যা ঐতিহাসিক তথ্যের অপব্যাখ্যা করে এবং তাঁর মৃত্যু ও খিলাফত নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা প্রচার করে।
মহানবী (সা.) ইসলামি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন, যিনি ন্যায়বিচার, শুরা এবং ঐক্যের ভিত্তিতে এটি গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর মৃত্যু ও খিলাফত নির্বাচনের ঘটনাগুলো তাঁর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করেছে। এই সিরাত আমাদের শিক্ষা দেয় যে সত্য ও ন্যায়ের পথে অবিচল থাকা এবং ঐক্যের মাধ্যমে সমাজ গঠন করা সম্ভব।
সূত্র: আল-মালুম আন আল-জাদওয়াল আত-তারিখি লি-সিরাতির রাসুল
আরও পড়ুনমহানবী (সা.)–এর জন্মকালের অলৌকিক ঘটনাবলি১৯ ঘণ্টা আগে