খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ক্ষুধার্ত উৎকোচ চক্র
Published: 18th, February 2025 GMT
খাদ্য অধিদপ্তরে চাউল, আটা ও ময়দাকলের মালিকদের তালিকাভুক্তি লইয়া ব্যাপক অনিয়ম চলিতেছে বলিয়া মঙ্গলবার সমকাল এক উদ্বেগজনক সংবাদ দিয়াছে। সেই সংবাদে বলা হয়, খাদ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা মিলিয়া উৎকোচ চক্র গড়িয়া তুলিয়াছেন, যাহাদের ‘খুশি’ করিতে না পারিলে যোগ্য কলমালিকগণ তালিকাভুক্ত হইতে পারেন না। এমনকি তালিকাভুক্ত কলমালিকের অনুমোদনপত্রও বাতিল হইয়া যায়। ফলে একদিকে সরকারি তালিকার বাহিরে থাকিয়া যাইতেছেন অনেক প্রকৃত কলমালিক, অপরদিকে অস্তিত্বহীন বা নামকাওয়াস্তে কার্যক্রম পরিচালনাকারীরা সরকারি খাতায় নাম লিখাইতে পারিতেছেন। বিষয়টা উদ্বেগজনক। কারণ ইহার ফলে দেশে খাদ্য মজুতের সঠিক চিত্র দুরূহ হইয়া যায়, যাহার নেতিবাচক প্রভাব বহুবিধ। প্রথমত, সময়মতো চাউল বা গমের ন্যায় প্রধান খাদ্যপণ্য আমদানির সিদ্ধান্ত গ্রহণ কঠিন হইয়া পড়ে। দ্বিতীয়ত, এই সকল পণ্যের বাজার চক্রের নিয়ন্ত্রণে চলিয়া যায়। আন্তরিক হইলেও সরকারের পক্ষে বাজার নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব হইয়া পড়ে। মোদ্দা কথা, খাদ্য মন্ত্রণালয়ে বিরাজমান দুর্নীতির চক্র ভাঙিতে না পারিলে সমূহ সংকটের ঝুঁকি রহিয়াছে। ক্ষুধার্ত উৎকোচ চক্রকে অবিলম্বে যথাবিহিত প্রাপ্য বুঝাইয়া দেওয়া তাই কর্তব্য।
বিদ্যমান ত্রুটিপূর্ণ বাজার ব্যবস্থায় বিশেষত ধান ও চাউল সাধারণত মিল মালিকগণই সংগ্রহ করেন, যাহাদের নিকট হইতে সরকার তাহার প্রয়োজন অনুসারে উক্ত পণ্যসমূহ ক্রয় করিয়া থাকে। সরাসরি কৃষকের নিকট হইতে এই সকল পণ্য ক্রয়ের নিয়ম থাকিলেও ত্রুটিপূর্ণ সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়ার কারণে নিয়মটি কদাচিৎ পালিত হয়।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, খাদ্য অধিদপ্তরের তালিকাভুক্তির জন্য জেলা খাদ্য কর্মকর্তার মাধ্যমে আবেদনের নিয়ম থাকিলেও তাহা মান্য হয় না বলিলেই চলে। অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে সরাসরি খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বা সচিব বরাবর আবেদন করিয়া তালিকাভুক্তির ঘটনা কম নহে। শুধু উহাই নহে, এমনকি মোড়ককৃত আটা-ময়দা বিক্রয়ের জন্যও মিলগুলিকে বিভিন্ন প্রক্রিয়া অনুসরণ করিয়া সরকারি অনুমোদন লইবার নিয়ম রহিয়াছে। কিন্তু খাদ্য অধিদপ্তরের কোনো প্রকার সুপারিশ ব্যতিরেকেই বেশ কয়েকটা আটা-ময়দাকলকে অনুমোদন দিয়াছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। সত্য, খাদ্য অধিদপ্তর ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের মিলারদের তালিকাভুক্তি বিষয়ে আলোচ্য কারসাজি দীর্ঘদিন যাবৎ চলমান। গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকার বিদায় গ্রহণের পর যেই সরকার ক্ষমতাসীন, উহারই এই কারসাজির অবসান ঘটাইবার দায়িত্ব ছিল। এমনকি, এই ক্ষেত্রে ঘুরিয়া ফিরিয়া এই চক্রের সদস্যরূপে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবের একান্ত সচিব, খাদ্য অধিদপ্তরের পরিচালক, অনুমোদন প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত খাদ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব, সচিবের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা গোলাম রব্বানীর নাম আসিলেও অদ্যাবধি উহাদের কেশাগ্রও স্পর্শ করা হয় নাই। অভিযোগ রহিয়াছে, বিবিধ প্রকার বদলি বাণিজ্যও এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সম্পন্ন হইয়া থাকে। যেই সরিষা দিয়া কারসাজির ভূত বিতাড়নের কথা, সেই সরিষার অভ্যন্তরেই ভূতের বসবাস কিনা, আমরা জানি না। তবে তাহা যে সমগ্র জাতির মধ্যেই হতাশা সৃষ্টি করিবে, ইহা হলফ করিয়া বলা যায়। এমতাবস্থায় কোনো উন্নতিকামী জাতির জন্যই ইহা শুভ হইতে পারে না।
ধান ও গম শুধু আমাদের প্রধান খাদ্য শস্যই নহে, সামগ্রিক উন্নয়নের প্রধান শর্ত রাজনৈতিক-সামাজিক স্থিতিশীলতাও যে কোনো অর্থে জনগণের সকল অংশের নিকট এই সকল পণ্য সুলভ হইবার উপর নির্ভরশীল। অতএব বাজারে ধান ও গমের সরবরাহে ন্যূনতম ঘাটতি সৃষ্টি করিতে পারে এমন যেই কোনো বিষয়ে সরকারের সতর্ক থাকা জরুরি। পূর্বেই বলা হইয়াছে, প্রকৃত চাউল ও আটাকল মালিকদের সুরক্ষা ব্যতীত সরকারের পক্ষে এহেন পরিস্থিতি সামলানো এক প্রকার অসম্ভব। তাই খাদ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর দুর্নীতিমুক্ত করিয়া প্রকৃত কলমালিকদের সহিত সরকারের সম্পর্ক গড়িয়া তোলা জরুরি।
.উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
বিদেশে গিয়েও সুদিন ফেরেনি, কলা চাষে এল সাফল্য
দীর্ঘদিনের পরিত্যক্ত এক একর জমি এখন সবুজে আচ্ছাদিত। সেখানে দেড় বছর আগে রোপণ করা হয় ৩২০টি কলা গাছ। সঠিক পরিচর্যা পেয়ে গাছগুলো সুস্থ ও সবল হয়ে বেড়ে উঠেছে। সারি সারি কলাগাছে ঝুলছে কলার ছড়া। মেহের সাগর জাতের এই কলা চাষে সুদিন ফিরেছে বিদেশ ফেরত আবু সিদ্দিকের।
আবু সিদ্দিক (৫৫) চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার বাসিন্দা। স্ত্রী ও পাঁচ সন্তানের পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তিনি। ২০১৭ সালে জীবিকার তাগিদে সৌদি আরবে পাড়ি জমান। সেখানে শারীরিক অসুস্থতার কারণে অধিকাংশ সময় বেকার থেকেছেন। তাই প্রবাসে গিয়েও সচ্ছলতার মুখ দেখেননি। ২০২৪ সালে দেশে ফিরে আসেন সিদ্দিক। স্থানীয় বাজারগুলোতে সারা বছর চাহিদা থাকায় কলা চাষের উদ্যোগ নেন, তবে তাঁর নিজের কোনো জমি নেই।
লোহাগাড়া উপজেলা সদর থেকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক হয়ে আট কিলোমিটার দক্ষিণে চুনতি শাহ সাহেব গেট। সেখান থেকে চুনতি ইসহাক মিয়া সড়ক ধরে গেলে হাতের ডানে একটি মাঠের পর চুনতি সুফি নগর বাগানপাড়া এলাকায় আবু সিদ্দিকের কলাবাগানটি চোখে পড়ে।
আবু সিদ্দিক বলেন, খুঁজতে খুঁজতে বাড়ি থেকে আধা কিলোমিটার দূরে পরিত্যক্ত এক একর জমি চোখে পড়ে তাঁর। বছরে ছয় হাজার টাকায় ওই জমি ভাড়া নেন। কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শ নিয়ে গত বছরের জুনে শুরু করেন কলা চাষ। উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে ৪০ টাকা দরে ৩২০টি চারা সংগ্রহ করেন তিনি। এতে তাঁর খরচ হয় ১৩ হাজার টাকা। রোপণের ১০ মাস পর কলা বিক্রির উপযোগী হয়। সাত মাস আগে থেকেই তিনি কলা বিক্রি শুরু করেছেন। শ্রমিকের মজুরি, সার, কীটনাশক ও নিয়মিত সেচ বাবদ এ পর্যন্ত তাঁর খরচ হয়েছে ৮০ হাজার টাকা। প্রতিটি ছড়া গড়ে ৫০০ টাকা দরে গত ৭ মাসে আড়াই লাখ টাকার কলা বিক্রি করেছেন তিনি। এখন খরচ বাদে কলা ও গাছের চারা বিক্রি করে প্রতি মাসে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা পান সিদ্দিক।
সম্প্রতি সরেজমিন দেখা যায়, ১ একর আয়তনের জমিতে ৬ ফুট দূরত্বে রোপণ করা হয়েছে ৩২০টি মেহের সাগর জাতের কলাগাছ। একটি গাছ থেকে নতুন চারা গজিয়ে আরও চার থেকে পাঁচটি গাছ হয়েছে। প্রায় প্রতিটি আট ফুট উচ্চতার প্রাপ্তবয়স্ক গাছে ঝুলছে কলার ছড়া। একেকটি ছড়ায় রয়েছে ৮০ থেকে ১৫০টি কলা। আবু সিদ্দিক সেখানে কলাগাছের আগাছা পরিষ্কার করছিলেন।
কলা চাষে সফলতার মুখ দেখে উৎসাহিত হয়ে এক মাস আগে আধা কিলোমিটার দূরত্বে নতুন করে ২ বিঘা জমিতে আরও ৬০০টি কলাগাছ লাগিয়েছেন সিদ্দিক। তিনি বলেন, কলা চাষে প্রথমবার চারা কিনতে যে ব্যয় হয়েছিল, পরের বার তা ব্যয় হবে না। খরচ অর্ধেকে নেমে আসবে। প্রতিবছর চারা বিক্রির টাকা দিয়ে খরচ মেটানো সম্ভব হবে। এতে এক একর এই বাগান থেকে খরচ বাদে প্রতিবছর সাড়ে তিন লাখ টাকা আয় হবে তাঁর। স্থানীয় বাজারের ব্যবসায়ীরা বাগানে এসে কলা নিয়ে যান। তাই বাড়তি শ্রম ও পরিবহন খরচ দিয়ে বাজারে নিয়ে যেতে হয় না। জমি পেলে কলা চাষের পরিধি বাড়াবেন বলে জানান তিনি।
এ বিষয়ে লোহাগাড়া উপজেলা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা সরোয়ার আলম প্রথম আলোকে বলেন, কঠোর পরিশ্রমের কারণে আবু সিদ্দিক সফল হয়েছেন। তাঁকে প্রণোদনা হিসেবে সার ও অর্থসহায়তা দেওয়া হচ্ছে। লোহাগাড়ার আবহাওয়া ও মাটি কলা চাষের জন্য উপযোগী। তা ছাড়া এ অঞ্চলে কলার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।