সামষ্টিক বিচারের সুখ যেন প্রলুব্ধ না করে
Published: 20th, February 2025 GMT
আমরা অস্থির সময় পার করছি। বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী জহির উদ্দিনকে নোয়াখালীতে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে ক’দিন আগে, যেভাবে প্রাণ দিতে হয়েছিল তোফাজ্জল হোসেনকে গত বছর সেপ্টেম্বরে, ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। শিক্ষককে লাঞ্ছনা করতে দ্বিধান্বিত হচ্ছে না কেউ। ভাঙচুর হচ্ছে। চলছে অগ্নিসংযোগ।
আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা প্রকট হয়ে উঠছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এমন আচরণ কি গণতন্ত্রায়নের ইঙ্গিত দেয়? নাকি আমরা বাক স্বাধীনতার নামে গণবিচার বা মব ট্রায়ালের সুযোগ নিচ্ছি? গোষ্ঠীগত আচরণের নৈতিক দায়িত্ব একজন ব্যক্তির ক্ষেত্রেই বা কতটুকু? এর উত্তর খুঁজতে গেলে গণঅসহযোগ, গণবিচার ও নৈরাজ্য বা অরাজকতার ভেতর তফাত বুঝতে হবে।
গণঅসহযোগ জনমত প্রকাশের একটি জোরালো ভাষা। ক্ষমতাসীনদের অসম কিংবা অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য এটি ব্যবহার করতে পারা গণতান্ত্রিক অধিকারের ইঙ্গিত বহন করে। গণঅসহযোগের প্রকাশ হতে পারে অনশন, মৌন বা সরব মিছিল, সমাবেশ কিংবা বক্তৃতায়। তবে যে মূলনীতি কখনোই উপেক্ষা করা যায় না, তা হলো অহিংসা। গণঅসহযোগ সহিংসতাকে কখনোই প্রশ্রয় দেয় না।
গণবিচার বা মব ট্রায়ালকে ‘ভিজিল্যান্টিজম’ও বলা হয়ে থাকে। এই পন্থা অনুসরণ করা মানেই আইনের লঙ্ঘন। রাষ্ট্রের, কোনো গোষ্ঠী বা ব্যক্তির ক্রিয়াকর্ম যদি অন্য গোষ্ঠীর কাছে পক্ষপাতদুষ্ট বা অন্যায় বলে প্রতীয়মান হয়, তবে গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে তার প্রতিবাদ করা বা তার বিরুদ্ধে কোনো সহিংস আচরণই গণবিচার। এই পন্থায় প্রায় সব সময় সহিংসতা জড়িয়ে থাকে।
অরাজকতা বা নৈরাজ্য কোনো আচরণ বা অভিজ্ঞতার প্রতিক্রিয়া নয়, বরং স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একটি গোষ্ঠী, প্রতিষ্ঠান বা একজন ব্যক্তির ওপর সহিংস আচরণ এর ভেতর পড়ে। এটি নিশ্চিতভাবে বেআইনি এবং আইনের শাসনসম্পন্ন কোনো সমাজে কখনোই তা কাম্য হতে পারে না।
প্রশ্ন ওঠে, কেন মানুষ এসব পন্থা বেছে নেয়? কোন যুক্তির ওপর ভর করে আইন নিজের হাতে তুলে নিতে উদ্যত হই আমরা? এর দার্শনিক ভিত্তি জানা থাকা দরকার। দর্শনে নৈতিকতাকে দুটি ক্ষেত্রে ভাগ করা হয়। প্রথমটি হলো জেরেমি বেনথামের পরিণামনির্ভর নৈতিকতা। একে উপযোগবাদিতাও আখ্যা দেওয়া হয়ে থাকে। দ্বিতীয়টি হলো, ইমানুয়েল কান্টের পরিণাম-নিরপেক্ষ নৈতিকতা। এটি ডিঅন্টোলজি হিসেবে পরিচিত।
১৭ শতকের ইংরেজ দার্শনিক বেনথাম বলেছেন: কোনো কাজের নৈতিকতা নির্ভর করে তার পরিণামের ওপর। অর্থাৎ কোনো ক্রিয়া যদি সামগ্রিক সুখ বা মঙ্গল সর্বোচ্চকরণে কাজ করতে পারে, তবে সেই কাজটি নৈতিক। রোমের কলোসিয়ামে গ্ল্যাডিয়েটরের জীবন বিসর্জন বা জীবন হরণকে নৈতিক ধরে নেওয়া যায়। কারণ তাঁর লড়াই সহস্র রোমান দর্শকের আনন্দের উৎস হিসেবে কাজ করে। বিচারের পাল্লাপাথরে রোমানদের সামষ্টিক সুখ একজন গ্ল্যাডিয়েটরের জীবনের চেয়ে বেশি ভার বহন করে বিধায় এই ক্রিয়াটি নৈতিক। নৈতিকতার এই ব্যাখ্যা কি আপনার কাছে গ্রহণযোগ্য? যদি তা না হয়, তবে প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির ওপর সহিংস আচরণ যদি তার অন্যায়ের বিরুদ্ধেও হয় কিংবা তা আমাদের অনেকের জন্য সুবিচারের ইঙ্গিতও বহন করে, তবুও কি এমন গোষ্ঠীবদ্ধ সহিংস আচরণ নৈতিক হতে পারে? আদতে কি কোনো ‘বিচার’ আমরা অর্জন করি এভাবে?
অন্যদিকে আমরা যদি কান্টের পরিণাম-নিরপেক্ষ নৈতিকতা বিবেচনা করি, তবে কিছু আদর্শগত ইঙ্গিত খুঁজে পাব। কান্টের মতে, একটি কর্ম নৈতিক, যদি তা পরিণামের কথা না ভেবে কর্তব্যবোধ থেকে পালন করা হয়। কান্ট প্রণীত এই নৈতিকতা পরম ও নিঃশর্ত। এটি প্রত্যেকের জন্য, সব পরিস্থিতিতে সমানভাবে প্রযোজ্য। এই মানদণ্ডে একজন ব্যক্তির প্রাণ হরণ অনৈতিক, হোক তিনি একজন শক্তিশালী গ্ল্যাডিয়েটর কিংবা দুর্বল বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। একজন শিক্ষকের মান হরণ নীতিবহির্ভূত, এমনকি সেই শিক্ষক যদি নিজে নীতিহীনও হয়ে থাকেন।
মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে ব্যক্তি কখন নীতিভঙ্গের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করায়? ব্যক্তি অবগত– যে কাজটি তিনি করতে চলেছেন, তা পরিণাম-নিরপেক্ষভাবে অনৈতিক। তাই সে কাজ সম্পাদনের যুক্তি হিসেবে তিনি বৃহত্তর অর্জনের তাগিদ সামনে রেখে তা সম্পাদন করেন। যেমন ধরুন, একজন ব্যক্তি আর্থিক টানাপোড়েনে পড়ে চুরি করেছে। বৃহত্তর সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার যুক্তি দেখিয়ে তাকে পিটিয়ে হত্যা করা হলো। যে বা যারা কাজটি করল, তারা জানত– এটি অনৈতিক। তবুও এতে সামষ্টিক বিচার প্রতিষ্ঠা পাবে এই যুক্তিতে, তারা এই কাজকে যথাযথ বলে ধরে নিলে এই মানসিক দ্বন্দ্বকে বলা হবে ‘কগনিটিভ ডিজোন্যান্স’।
অন্যদিকে একজন মানুষ আরেক মানুষকে হনন করে কী করে? গণহত্যাই বা কী করে সংঘটিত হয়? এর উত্তরে অনেক মনস্তাত্ত্বিক আলোচনা রয়েছে। তবে যে বিষয়টি সম্ভবত কেন্দ্রে বিরাজমান, তা হলো ‘অপর’ ধারণা বা অন্য গোত্র বা বিশ্বাসের মানুষকে উপমানব বা মানুষের চেয়ে অধম, যেমন প্রাণী বা কীট হিসেবে ধরে নেওয়া। এমনটি ধরে নিয়েছিল নাৎসিরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। এমনটি ধরে নেওয়া হয়েছিল রুয়ান্ডাতে। মানুষকে খাটো করে কিংবা কোনো বৃহৎ লক্ষ্যের দোহাই দিয়ে অন্যের ক্ষতিসাধন আর যা-ই হোক, সুবিচার প্রতিষ্ঠা করে না।
বাংলাদেশ এই মুহূর্তে তাৎপর্যপূর্ণ সময় অতিক্রম করছে। বাকরুদ্ধতার চাপ থেকে মুক্ত হয়ে গণবিচারের চর্চা আমাদের প্রলোভন দেখাচ্ছে। অন্যদিকে নৈতিক সমাজ গড়ার প্রেষণা রয়েছে সমাজের অধিকাংশের ভেতর। তথাকথিত সামষ্টিক বিচারের সুখ যেন এই সময়ে আমাদের প্রলুব্ধ না করে। আইন যেন নিজ হাতে তুলে না নিই। এ ধরনের আচরণ গণতন্ত্রায়নের পথে বাধা। সহিংসতা থেকে নিবৃত্ত হয়ে অহিংস গণঅসহযোগে গিয়ে যেন থামে আমাদের বিচারের রথ।
নাভিদ সালেহ: যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস অ্যাট অস্টিনে পুরকৌশল, স্থাপত্য ও পরিবেশ কৌশল অনুষদের অধ্যাপক
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: গণঅভ য ত থ ন র পর ণ ম গণব চ র স আচরণ আম দ র ন ত কত র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
বিবাহবিচ্ছেদ ও খোরপোষ নিয়ে ক্ষুদ্ধ মাহি
কিছুদিন ধরে গুঞ্জন উড়ছে, ভেঙে যাচ্ছে ভারতীয় তারকা দম্পতি মাহি ভিজ ও জয় ভানুশালির ১৪ বছরের সংসার। এ খবর চাউর হওয়ার পরও নীরব ছিলেন এই দম্পতি। এর কিছুদিন পর খবর রটে, বিবাহবিচ্ছেদের পর ভরণপোষণের জন্য ৫ কোটি রুপি খোরপোষ দাবি করেছেন। এ নিয়ে শোবিজ অঙ্গনে যেমন জোর চর্চা চলছে, তেমনি সোশ্যাল মিডিয়াও সয়লাব। ফলে সমালোচনার মুখে পড়েছেন অভিনেত্রী মাহি ভিজ।
এ পরিস্থিতিতে নীরবতা ভেঙেছেন ‘বালিকা বধু’খ্যাত মাহি ভিজি। একটি ভিডিও বার্তায় এই অভিনেত্রী বলেন, “আমি কোথাও পড়েছি, আমি নাকি ডিভোর্স পেপারে সই করেছি, এখন আমাকে সেই কাগজ দেখান। আমরা যতক্ষণ না নিজেরা কিছু বলছি, ততক্ষণ আপনারা আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ করার কোনো অধিকার রাখেন না। আমি জানি, আমরা পাবলিক ফিগার। কিন্তু আমরা যা বলতে চাই, শুধু সেটাই বলব। বাড়িতে আমার অসুস্থ মা আর তিনটি সন্তান আছে। যার মধ্যে দুইজন এখন সবকিছু বোঝে। এমনকি, খুশি (কন্যা) আমাকে মেসেজ করে বলেছে, ‘মা, এসব কী হচ্ছে! ওরা কেন আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে নাক গলাচ্ছে?’ এসব নিয়ে বাচ্চারা স্কুলেও প্রশ্নের মুখে পড়ছে।”
আরো পড়ুন:
হাসপাতালে ধর্মেন্দ্র
মধ্যরাতে শাহরুখের বাড়ির সামনে ভক্তদের ভিড়
খোরপোষের বিষয়ে ক্ষুব্ধ মাহি ভিজ বলেন, “আমাদের বাঁচতে দিন। আমরা তারকা বলেই সবকিছু আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে হবে, এমন নয়। কেউ লিখেছে, ‘আমি নাকি ৫ কোটি রুপি খোরপোষ চেয়েছি।’ আমি বা জয় কি এটা বলেছি? যখন প্রমাণ হাতে পাবেন, তখন কথা বলবেন। আমি তো ঠিকমতো জানিই না খোরপোষ কী!”
খানিকটা ব্যাখ্যা করে খোরপোষের বিষয়ে মাহি ভিজ বলেন, “আমার মতে, যদি একজন পুরুষ নিজে পরিশ্রম করে অর্থ উপার্জন করে, তবে বিচ্ছেদের পর সেই অর্থে স্ত্রীর কোনো অধিকার নেই। খোরপোষ তখনই যুক্তিযুক্ত, যখন কোনো নারী সারাজীবন গৃহবধূ হিসেবে থেকেছেন এবং কখনো কাজ করেননি। কোনো নারী যদি কাজ করতে পারেন, তবে নিজেরই উপার্জন করা উচিত।”
স্বামীর প্রশংসা করে মাহি ভিজ বলেন, “এ বিষয়ে আমার মুখ থেকে না শোনা পর্যন্ত কোনো কিছু বিশ্বাস করবেন না। আমাদের, আমাদের সন্তানদের ও বাবা-মায়ের গোপনীয়তাকে সম্মান করুন। অনুরোধ করছি, আমাদের একা থাকতে দিন। যদি মনে করি কিছু জানাতে হবে, আমরা নিজেরাই বলব। জয় আমার পরিবার, সে সবসময় আমার পরিবারই থাকবে। সে আমার সন্তানের জন্য দারুণ বাবা এবং একজন অসাধারণ মানুষ।”
২০১১ সালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন মাহি ভিজ ও জয় ভানুশালি। খুব ঘরোয়া আয়োজনে বিয়ে করেন তারা। এ দম্পতির ‘তারা’ নামে একটি কন্যাসন্তান রয়েছে। ২০১৭ সালে রাজবীর ও খুশি নামে দুই সন্তান দত্তক নেন এই দম্পতি।
ঢাকা/শান্ত