প্রতিদিন এখন আগের দিনের চেয়েও বেশি খারাপ বোধ করি। এখন আর কেউ কোনো লেখা চাইলে দিতে পারি না। আশি বছর বয়স পর্যন্ত লেখালেখি করেছি। এর পর আর সম্ভব হয়ে ওঠে না। বর্তমানে আমার ঊননব্বই চলছে।
অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমরা সবসময় সোচ্চার। প্রতিবাদের ভাষা আমাদের বরাবরই ছিল। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে যতটা মনে করতে পারি, গ্রামের স্কুলে পড়তাম তখন। স্কুল থেকে মাইল খানেক দূরে একটা বাজার ছিল, বসুর বাজার। বায়ান্নার গুলি চলার ঘটনা জানতে পেরে আমি টিনের চোঙা নিয়ে সেই বাজারে প্রতিবাদে উপস্থিত হয়েছিলাম। হরতাল ডেকেছিলাম। সাধারণ মানুষেরা আমার, আমাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে হরতাল করেছিল। তারা বলছিল, আমাদের ছেলেদের আমরা শহরে লেখাপড়া করার জন্য পাঠাই, আর ওরা তাদের গুলি করে মারে। ওরা নাকি আবার ভোট চাইতে আসবে। এদের ভোট দেওয়া দূরের কথা, ভোটের বদলে ঝাঁটা দেওয়া হবে। সাধারণ হাটুরে ভাইয়েরা বলেছিল, আমরা কেউ আজকে হাট করব না, আজ হরতাল। সেদিন হাট উঠে গিয়েছিল।
এই তো গ্রামের সাধারণ মানুষের প্রতিবাদের ভাষা। আমি নিজে তখন ছাত্র। ঢাকার ঘটনা যখন বলছিলাম, সবাই আমাকে বিশ্বাস করেছিল। ক্ষিপ্ত ছিল সবাই। সাধারণ মানুষকে রক্ষার জন্য তাদেরই টাকায় কেনা বন্দুক চালিয়ে তাদেরই হত্যা করা হয়েছে, একটি ন্যায্য দাবির পক্ষে দাঁড়ানোর কারণে– এটা কেউ মেনে নিতে পারছিল না। অনেক ক্ষিপ্ত মন্তব্য করেছিল। সেসব এখন আর মনে নেই।
ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে আমি ছেলেবেলা থেকেই যুক্ত। ১৯৪৮ সালে যখন জিন্নাহ সাহেব বললেন– স্টেট ল্যাংগুয়েজ অব পাকিস্তান ইজ গোয়িং টু বি উর্দু অ্যান্ড নো আদার ল্যাংগুয়েজ, ছাত্ররা নো নো বলে প্রতিবাদ করল, তখন আমার পরিবেশ, পারিপার্শ্বিকতা আমাকে ক্রমশ তৈরি করছে। ছাত্রদের ওপর যখন পুলিশের হামলা হলো, আমার নেত্রকোনার স্কুলের নাইন-টেনের ছেলেরা আমাদের ক্লাসে এসে বলল, জিন্নাহ বলেছেন আমাদের রাষ্ট্রভাষা উর্দু হবে। রাষ্ট্রভাষা উর্দু হলে আমাদের অস্তিত্ব থাকবে না। সব পশ্চিম পাকিস্তানের হাতে চলে যাবে। আমাদের এর প্রতিবাদ করতে হবে। শুনে স্কুলের ছাত্ররা বের হয়ে এলাম। উত্তরপাড়ার মাঠে সবাই সমবেত হলো। বলা হলো, জিন্নাহকে আমরা জাতির পিতা, কায়েদে আজম বলি, কিন্তু তিনি যে অবস্থা সৃষ্টি করেছেন, এর পর আর তাঁকে কোনোভাবেই জাতির পিতা বলা যায় না।
এসব খেটে খাওয়া ও হাটুরে সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া। ছাত্র, ছাত্রনেতা, শিক্ষকদের প্রতিক্রিয়া এর চেয়ে খুব বেশি আলাদা কিছু ছিল না। তবে ঢাকায় যেমন প্রতিবাদের এই ভাষা আরও নানা মাত্রা ও রূপ পেয়েছিল, দেয়াল লিখনে, পোস্টারে, ওই দূর পাড়াগাঁয়ে তা হয়নি। ঢাকার খবর আমরা বঞ্চিত ছিলাম না। একটু দেরি হলেও খবর পৌঁছাত। তখনও কিছু কিছু কাগজ আসত। একই সঙ্গে অনেক কাগজপত্রই আসত না এবং এখনও তাই। এখন শুধু দুটি পত্রিকা আসে। যা হোক, কোনো পোস্টার-দেয়াল লিখন ছাড়াই বসুর বাজারসহ আরও চার-পাঁচটা বাজারে চোঙা হাতে আমাদের যাওয়া সার্থক হয়েছিল। বসুর বাজারে মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে হরতাল পালন করেছিল।
গ্রামে সেই সময় আলাপ-আলোচনা কিংবা উত্তেজনার খুব বেশি অনুষঙ্গ ছিল না। সবার দুশ্চিন্তার কেন্দ্রে ছিল ‘চা’। চাকে কেউ ভালো চোখে দেখে না তখন। নিকৃষ্ট কোনো নেশাদ্রব্যই মনে করে। মানুষ বলে, মদ খেয়ে মাতালের বদলে চা খেয়ে মানুষ চাতাল হয়ে যাচ্ছে। এই চাতাল যাতে না হওয়া লাগে, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। এমন সময় বায়ান্নর সেই হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটল।
ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে আমার শহীদ মিনার নির্মাণের স্মৃতি। যতটা মনে পড়ে গ্রামের স্কুলে আমরা শহীদ মিনার তৈরি করেছিলাম। পরবর্তী সময়ে ছাত্র অবস্থাতেই যখন আমি আঠার মাস জেলে ছিলাম, একুশে ফেব্রুয়ারি এলে বাকশোর ওপর বাকশো সাজিয়ে শহীদ মিনার বানিয়েছে আরও কয়েকজন মিলে, সেখানে যথাসাধ্য ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছি। আরও কত স্মৃতি।
ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে সারাদেশে একটা সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সূচনা ঘটেছিল। যে আন্দোলন পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রের রবীন্দ্র বিরোধিতার বিরুদ্ধে আমাদের দাঁড়াতে প্রস্তুত করেছে, নজরুলকে খণ্ডিত করার অপচেষ্টা রুখে দিয়েছে। আমাদের ভাষাকে উচ্চারণে, বর্ণমালায় বিকৃত করার যে অপপ্রয়াস চালিয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা। তাদের সেই চেষ্টাও রুখে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। এই প্রতিরোধ ও তার ফলাফলের সবই তৈরি হয়েছে ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায়।
প্রকৃত প্রস্তাবে ভাষা আন্দোলন একটা সাংস্কৃতিক আন্দোলন। সেই সাংস্কৃতিক আন্দোলনই ক্রমে রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল। ফলে আমরা একটা স্বাধীন রাষ্ট্র অর্জন করেছিলাম। আমি এখনও প্রগতিশীল নতুন সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে ওঠার স্বপ্ন দেখি।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ২১ ফ ব র য় র আম দ র কর ছ ল হরত ল
এছাড়াও পড়ুন:
স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত প্রতিরোধ চলবে: হামাস
স্বাধীন ও সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না হওয়ার প্রতিরোধ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে হামাস। গত মঙ্গলবার জাতিসংঘের সদর দপ্তর থেকে দেওয়া এক ঘোষণাপত্রের অস্ত্র ত্যাগের আহ্বানের জবাবে সংগঠনটি এই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।
বৃহস্পতিবার হামাসের সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, দখলদারির অবসান এবং জেরুজালেমকে রাজধানী করে একটি স্বাধীন ও সম্পূর্ণ সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত প্রতিরোধ থামবে না তারা।
মঙ্গলবার জাতিসংঘের সদর দপ্তর থেকে দেওয়া ঘোষণায় বলা হয়েছিল, ‘গাজায় যুদ্ধ বন্ধে হামাসকে (এই উপত্যকায়) তার শাসনের অবশ্যই অবসান ঘটাতে হবে এবং আন্তর্জাতিক অংশগ্রহণ ও সমর্থনের মাধ্যমে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে অস্ত্র সমর্পণ করতে হবে। সার্বভৌম ও স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যের সঙ্গে এটি সংগতিপূর্ণ।’
সৌদি আরব, কাতার, ফ্রান্স ও মিসরসহ ১৭টি দেশ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আরব লিগ ঘোষণাপত্রটি সমর্থন করেছে। এটি ‘দ্য নিউইয়র্ক’ ঘোষণাপত্র হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
বৃহস্পতিবার আলাদা এক বিবৃতিতে প্রতি শুক্রবার, শনিবার ও রোববার বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও তাদের মিত্র দেশগুলোর দূতাবাসের বাইরে বিক্ষোভ করার আহ্বান জানিয়েছে হামাস। ইসরায়েলের আগ্রাসন বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত তা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানিয়েছে তারা।
অনাহারে মৃত্যু ১৫৪গাজায় কর্মরত চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, উপত্যকাটিতে অনাহারে আরও দুই শিশু এবং এক তরুণ মারা গেছে। এ নিয়ে সেখানে অনাহারে মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ১৫৪ জনে। তাদের মধ্যে শিশু ৮৯টি।
গাজায় প্রায় ২১ লাখ মানুষের বসবাস। উপত্যকাটিতে গত মার্চ থেকে নতুন করে অবরোধ শুরু করে ইসরায়েল। ফলে সেখানে ত্রাণবাহী কোনো ট্রাক প্রবেশ করতে পারছিল না। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে সম্প্রতি কিছুদিন ধরে গাজায় সীমিত পরিমাণে ত্রাণ প্রবেশ করতে দিচ্ছে ইসরায়েল। এই ত্রাণ প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত নগণ্য।
ত্রাণ নিতে প্রাণহানি ১৩৭৩জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় জানিয়েছে, গাজায় গত মে মাস থেকে এখন পর্যন্ত ত্রাণ আনতে গিয়ে মোট ১ হাজার ৩৭৩ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে ৮৫৯ জন মারা গেছেন বিতর্কিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের (জিএইচএফ) ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে। গত মে মাসের শেষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থাটি ইসরায়েলি সেনাদের সহায়তায় গাজার কয়েকটি স্থানে ত্রাণ দিচ্ছে।
বাকি ৫১৪ জন মারা গেছেন ত্রাণবাহী ট্রাকের আশপাশে। তাঁরা ত্রাণের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। অধিকাংশই ইসরায়েলের সেনাদের গুলিতে নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয়।
আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুক্রবার সকালে গাজায় অন্তত আরও ৪২ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ত্রাণ আনতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন ১৫ জন। এই নিয়ে প্রায় ২২ মাসের সংঘাতে গাজায় ইসরায়েলি সেনাদের হামলা নিহত হয়েছেন অন্তত ৬০ হাজার ৩৩২ জন।
গাজায় স্টিভ উইটকফশুক্রবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ গাজা সফর করেছেন। তিনি উপত্যকাটির রাফা এলাকায় জিএইচএফের একটি ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রও ঘুরে দেখেন। এ সময় ইসরায়েলে নিয়োজিত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মাইক হুকাবি তাঁর সঙ্গে ছিলেন। তাঁরা পাঁচ ঘণ্টার বেশি গাজায় ছিলেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে উইটকফ নিজেই এই কথা জানিয়েছেন। আগের দিন তিনি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। উইটকফ বলেছেন, ‘মাঠের পরিস্থিতি বুঝতে ও তথ্য সংগ্রহ করতে আমরা গাজায় গিয়েছিলাম। গাজার মানবিক পরিস্থিতির একটি স্পষ্ট ধারণা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে পৌঁছে দেওয়াই আমার উদ্দেশ্য, যাতে করে গাজাবাসীর জন্য খাদ্য ও চিকিৎসা সহায়তা পৌঁছাতে পরিকল্পনা প্রণয়নে সহায়তা করা যায়।’
গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য-বিষয়ক বিশেষ দূত ও আবাসন খাতের সাবেক আইনজীবী উইটকফের আন্তর্জাতিক নীতি ও মানবিক সহায়তা-সংক্রান্ত কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তা সত্ত্বেও তিনি মধ্যপ্রাচ্যের সংকট সমাধানের চেষ্টার পাশাপাশি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধেও কূটনীতি চালাচ্ছেন। এরই মধ্যে তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছেন।