‘প্রচণ্ড ঠান্ডা। ইয়ালা বেজক্যাম্পে গিয়ে মনে হচ্ছিল আমি হয়তো আর পারব না। ওই সময় নিশাত আপা (দেশের প্রথম এভারেস্টজয়ী নারী নিশাত মজুমদার) বললেন, আর মাত্র ২০০ মিটার। কিন্তু তখন ২০০ মিটারকে আমার ২০০০ মিটারের মতো মনে হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত এগোনো সম্ভব হয়েছিল নিশাত আপার অবিরাম উৎসাহের কারণে।’ কথাগুলো বলছিলেন প্রথমবারের মতো হিমালয় পর্বতমালায় পা রাখা পর্বতারোহী মৌসুমী আক্তার (এপি)। আজ সোমবার বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ আয়োজিত এক আলাপচারিতায় নিজের পাহাড় অভিযানকে এভাবেই তুলে ধরলেন এই শিক্ষার্থী। স্বপ্ন তৈরি, স্বপ্ন বাস্তবায়নের উদ্যোগ আর স্বপ্ন জয় করতে অনুপ্রেরণা দিলে পাহাড়সম প্রতিবন্ধকতা যে পার হওয়া যায়, তার আক্ষরিক অভিজ্ঞতাই তিনি লাভ করেছেন।

আজ সোমবার রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে ‘সুলতানার স্বপ্ন অবারিত: তরুণীর অগ্রযাত্রা’ শিরোনামে দেশের পাঁচ নারী পর্বতারোহীর সঙ্গে এই আলাপচারিতা অনুষ্ঠিত হয়। আলাপচারিতায় অংশ নেন নারীদের পাহাড় অভিযানের দলনেতা পর্বতারোহী নিশাত মজুমদার, ইয়াছমিন লিসা, মৌসুমী আক্তার এবং অনলাইনে যুক্ত হন তাহুরা সুলতানা রেখা। আরেক পর্বতারোহী অর্পিতা দেবনাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানের কারণে এই আলাপচারিতায় অংশ নিতে পারেননি। এ অভিযানে ট্রেকিং করেছেন মৌসুমি ও অর্পিতা। আর ক্লাইম্বিং করেন নিশাত মজুমদারসহ প্রশিক্ষিত দুই পর্বতারোহী ইয়াছমিন ও তাহুরা।

অভিযাত্রী সংগঠনের আয়োজনে নেপালের হিমালয় পর্বতমালার উদ্দেশে গত বছরের ২১ ডিসেম্বর যাত্রা শুরু করে নারীদের দলটি। ঢাকায় ফিরে আসে ১৪ জানুয়ারি। লাংটাং অঞ্চলের ইয়ালা, সুরিয়া ও গোসাইকুণ্ড চূড়ায় গিয়েছিল দলটি। ৪ হাজার ৭০৭ মিটার উচ্চতা অতিক্রম করে দলটি। এ অভিযানে সহায়তা করেছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও মাস্টারকার্ড। এ অভিযানের প্রতিপাদ্য ছিল নারী আন্দোলনের পথিকৃৎ রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের ‘সুলতানা’স ড্রিম’ বা ‘সুলতানার স্বপ্ন’ বইটি।

শত বছরের বেশি আগে লেখা ‘সুলতানা’স ড্রিম’ বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে ধ্রুপদি নারীবাদী কল্পকাহিনির অংশ। নারীমুক্তির আকাঙ্ক্ষায় পূর্ণ এই বইটি রোকেয়ার সময়ের ধর্মীয় ও সামাজিক বাস্তবতায় অসম্ভব সাহসী। বইয়ে এমন একটি দেশের কল্পনা করা হয়, যেখানে নারীরা দেশ পরিচালনা করবে। বিজ্ঞান কল্পগল্পের আদলে লেখা ‘সুলতানা’স ড্রিম’ ১৯০৮ সালে কলকাতার এস কে লাহিড়ী অ্যান্ড সন্স থেকে বই আকারে প্রকাশিত হয়। তবে লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯০৫ সালে, মাদ্রাজের দ্য ইন্ডিয়ান লেডিজ ম্যাগাজিনে। ‘সুলতানা’স ড্রিম’ নিয়ে ২০২৩ সালে স্পেনের নারী পরিচালক মিগেল হার্নান্দেজ পূর্ণদৈর্ঘ্য অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র তৈরি করেন। গত বছরের ১২ মে বইটিকে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো ‘বিশ্বস্মৃতি’ বা ‘ওয়ার্ল্ড মেমোরি’র তালিকায় স্থান দিয়েছে।

আলাপচারিতায় অংশ নিয়ে দেশের প্রথম এভারেস্টজয়ী নারী নিশাত মজুমদার বলেন, পাহাড় ডাকে। যাঁরা পাহাড়ে যান, তাঁরাই শুধু সেই ডাক অনুভব করতে পারেন। কেউ যখন তাঁর সামর্থ্যের সবটুকু শেষ করে নিঃস্ব হন, তখন তিনি প্রকৃতির কাছে আত্মসমর্পণ করেন। সেখান থেকে শুরু হয় তাঁর আরেকটা নতুন যাত্রা। বিশালাকৃতির পাহাড়ের কাছে গেলে এই অনুভূতিগুলো উপলব্ধি হয়। খুব কম পর্বতারোহী শীতকালে পর্বতারোহণে যান। এই সময়টা খুব ঝুঁকিপূর্ণ। শীতকালীন অভিযানের অভিজ্ঞতা নিতে এবার ৫ জন নারী যাত্রা করেন। দেশ থেকে প্রচণ্ড শীতে নারীদের দলের হিমালয়ে যাওয়ার ঘটনা এই প্রথম। এ অভিযান প্রমাণ করেছে, নারীরা চাইলে সবই করতে পারেন। তিনি বলেন, অভিযাত্রী সংগঠন এ ধরনের রোমাঞ্চকর কার্যকলাপের মাধ্যমে তরুণদের ক্ষমতায়নে কাজ করে।

পাহাড় অভিযানের মধ্যেই ২ জানুয়ারি জন্মদিন ছিল পর্বতারোহী ইয়াছমিন লিসার। একটি চকলেট দিয়ে সহযাত্রীরা তাঁর জন্মদিন পালন করেন। ইয়াছমিন বলেন, পাহাড় হচ্ছে একটি জীবনদর্শন। পাহাড় শেখায় কীভাবে কম জিনিস দিয়ে জীবনে চলা যায়। পকেটভর্তি ডলার নিয়ে উঠেও পাহাড়ের চূড়ায় উঠে কিছু কেনার সুযোগ নেই। অনেক কিছু বহন করে পাহাড়ে আরোহণ সম্ভব নয়। তিনি বলেন, ‘শীতকাল হওয়ায় মাইনাস ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ছিল। ইয়ালা পাহাড়চূড়ায় ওঠার সময় মনে হচ্ছিল হয়তো ওঠা যাবে না। এত বরফ!’ তিনি জানান, প্রান্তিক নারীদের জীবনসংগ্রাম থেকে তিনি পাহাড় জয়ের শক্তি পান।

অনলাইনে যুক্ত হয়ে পর্বতারোহী তাহুরা সুলতানা রেখা বলেন, মায়ের পরই তাঁর জীবনে পাহাড়ের স্থান। প্রতিবার পাহাড় থেকে ফিরে আসার পর তাঁর মনে হয় এর চেয়ে সুখের কিছু আর হতে পারে না। তিনি বলেন, ‘আমরা প্রত্যেকেই একেকজন সুলতানা। আমরা প্রত্যেকেই প্রত্যেককে স্বপ্ন দেখাই, পাহাড় থেকে ফিরে প্রতিবারই নিজেকে নতুনরূপে আবিষ্কার করি।’

অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম বলেন, প্রত্যেক নারী প্রতিদিন পাহাড়সম প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করেন। মানসিক দিক দিয়ে এর ব্যাপ্তি অনেক। তাই পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার জন্য কী পরিমাণ ত্যাগ স্বীকার করতে হয়, কতখানি মূল্য দিতে হয়, তা নারীরা জানেন। পাহাড়ে অভিযান করে আসা এই নারীরা বিজয়ের প্রতীক। তাঁদের পথ ধরে এগোতে হবে। এগিয়ে চলার আকাঙ্ক্ষায় নারীর যে স্বপ্ন, তা যেন পুরুষের চোখেও থাকে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মানবিক ও সমতাভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব।

শুভেচ্ছা বক্তব্যে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন বাংলার নারীসমাজকে পিতৃতন্ত্রের বেড়াজাল থেকে মুক্ত করার আকাঙ্ক্ষা পূরণে কাজ করেছেন। তাঁর এই আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে ‘সুলতানার স্বপ্ন’ বইটিতে। রোকেয়ার স্বপ্ন চোখে নিয়ে এই পাঁচ নারী দুর্গম স্বপ্নযাত্রা সফল করে ফিরেছেন। এই পর্বতারোহী নারীদের স্বপ্নযাত্রা দেশের ভবিষ্যৎ তরুণীদের অনুপ্রাণিত করবে। তাঁরা নিজেদের আকাঙ্ক্ষা পূরণে যে কষ্ট করেছেন, তা অনেক নারীর হৃদয় ছুঁয়ে যাবে।

অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সংগঠন সম্পাদক উম্মে সালমা বেগম এবং জ্যেষ্ঠ কর্মসূচি কর্মকর্তা ফজিলা খাতুন লতা। অনুষ্ঠানে পাঁচ পর্বতারোহীর পাহাড় অভিযান নিয়ে একটি তথ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: অন ষ ঠ ন কর ছ ন প রথম

এছাড়াও পড়ুন:

মোহাম্মদপুরে ডেকে নিয়ে হত্যার দুই ঘটনাকে গণপিটুনি বলছে পুলিশ, স্থানীয়রা কী বলছে

একই দিনে, একই জায়গায় হত্যাকাণ্ডের দুটি ঘটনা। একটি ঘটেছে ভোরে, আরেকটি সকালে।

ঘটনাস্থল রাজধানীর মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিং এলাকার হাক্কার পাড়ে। তারিখ ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫।

প্রথম ঘটনায় দুই যুবককে ঘুম থেকে উঠিয়ে রাস্তায় নিয়ে পেটানো হয়। ঘটনাস্থলেই মারা যান একজন।

দ্বিতীয় ঘটনার বিষয়ে প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী, দুই যুবককে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে পেটানো হয়। একপর্যায়ে ঘটনাস্থলেই একজনের মৃত্যু হয়।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনার পাশাপাশি পিটিয়ে হত্যার দুটি ঘটনারই একাধিক ভিডিও ফুটেজ প্রথম আলো পেয়েছে। যারা পিটিয়ে হত্যা করছে, ভিডিও ফুটেজে তাদের চেহারা স্পষ্ট।

প্রত্যক্ষদর্শী, ঘটনাস্থলের আশপাশের মানুষ ও ভুক্তভোগীদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ১০ জনের পরিচয় বের করেছে প্রথম আলো। পরিকল্পিত এই দুই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ধামাচাপা দিতে পুলিশ বিষয়টি গণপিটুনি বলে প্রচার করেছে বলে অভিযোগ করেছেন স্বজনেরা।

নিহত দুই যুবক হলেন মো. সুজন ওরফে বাবুল ও মো. হানিফ। আর আহত দুজন হলেন মো. শরীফ ও ফয়সাল। ঘটনার পর নিহত দুই যুবকের স্বজনেরা মোহাম্মদপুর থানায় গিয়ে পুলিশকে ভিডিও ফুটেজ দেখালেও মামলা নিতে চায়নি। পরে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পরামর্শ দেয়। এতে পরিবার রাজি হয়নি। পরে আদালতে মামলা করতে আবেদন করেছে দুই পরিবার।

পুলিশ বলছে, নিহত দুজন ছিনতাইকারী ছিলেন। তাঁদের বিরুদ্ধে থানায় ছিনতাইয়ের মামলা রয়েছে। আহত দুজন এখন ছিনতাইয়ের মামলায় কারাগারে আছেন। নিহত ও আহত ব্যক্তিরা ঢাকা উদ্যান এলাকায় কিশোর গ্যাং ও ছিনতাইকারী চক্রের অন্যতম প্রধান জনি ওরফে ‘রক্তচোষা’ জনির ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। তাঁর বিরুদ্ধে ছিনতাই-ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধে ২৭টি মামলা রয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শী, ঘটনাস্থলের আশপাশের মানুষ ও ভুক্তভোগীদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ১০ জনের পরিচয় বের করেছে প্রথম আলো। পরিকল্পিত এই দুই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ধামাচাপা দিতে পুলিশ বিষয়টি গণপিটুনি বলে প্রচার করেছে বলে অভিযোগ করেছেন স্বজনেরা।

স্থানীয় একাধিক দোকানি জানান, ওই চারজন সেদিন ছিনতাই করতে গিয়ে ধরা পড়েননি। কয়েকজন মিলে তাঁদের ধরে এনে পিটিয়েছে। এতে দুজনের মৃত্যু হয়। এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে রয়েছে এলাকার আধিপত্য বিস্তারের বিষয়টি।

ঘটনার ভিডিও ফুটেজ, প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা এবং প্রথম আলোর অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিং এলাকার হাক্কার পাড়ে ১০ সেপ্টেম্বর ভোরে ও সকালে গণপিটুনির কোনো ঘটনাই ঘটেনি। দুটি হত্যাকাণ্ডই হয়েছে পরিকল্পিতভাবে। এই দুটি হত্যাকাণ্ডে স্থানীয় ওয়ার্ড (১০০ নম্বর সাংগঠনিক ওয়ার্ড) বিএনপির সহছাত্রবিষয়ক সম্পাদক আক্তার হোসেনের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তাঁকে ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে।

গত ৫ অক্টোবর নবীনগর হাউজিংয়ের ১২ নম্বর সড়কে আক্তার হোসেনের বাসায় যান এই প্রতিবেদক। বাসার দরজার বাইরে থাকা কলিং বেল একাধিকবার চাপার পরও ভেতর থেকে কেউ সাড়া দেননি। পরে তাঁর মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করেন এই প্রতিবেদক। কিন্তু ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। সর্বশেষ গতকাল রোববার রাত আটটার দিকেও তাঁর মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তখনো ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

পুলিশ বলছে, নিহত দুজন ছিনতাইকারী ছিলেন। তাঁদের বিরুদ্ধে থানায় ছিনতাইয়ের মামলা রয়েছে। আহত দুজন এখন ছিনতাইয়ের মামলায় কারাগারে আছেন।

আক্তার হোসেনের ব্যবহার করা আরেকটি মুঠোফোন নম্বর গত রাত ১১টার দিকে নবীনগর হাউজিংয়ের স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা সূত্রে পাওয়া যায়। এই নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করে প্রথম আলো। কিন্তু রিং হলেও তিনি ফোন ধরেননি। পরে তাঁর হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে এবং মুঠোফোনে খুদে বার্তা (হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে বক্তব্য জানতে) পাঠানো হয়। কিন্তু কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।

প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র ও স্থানীয় একাধিক দোকানি জানান, গত বছরের ৫ আগস্টের পর নবীনগর হাউজিং ও ঢাকা উদ্যান এলাকায় চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতি ঠেকাতে নবীনগর হাউজিং এলাকায় স্থানীয়ভাবে একটি ‘টহল টিম’ গঠন করা হয়। আক্তার এই টহল টিমের প্রধান। দুটি হত্যাকাণ্ডে যাঁরা অংশ নিয়েছেন, তাঁরা এই টহল দলের সদস্য।

বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, গণপিটুনিতে নিহত দুজন ফ্যাসিস্টের দোসর বলে তিনি শুনেছেন। আর যদি গণপিটুনির ঘটনা না হয়, তবে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আইনগত ব্যবস্থা নিক।

ভিডিও ফুটেজ দেখে হত্যার সঙ্গে জড়িত আরও যাঁদের চিহ্নিত করেছেন স্থানীয় লোকজন, তাঁরা হলেন নবীনগর পশ্চিম ইউনিট বিএনপির সভাপতি মো. হাসনাইন, সদস্য মো. মালেক, সদস্য মো. জহিরুল, নবীনগর হাউজিংয়ের নৈশপ্রহরী হাবিবুর রহমান, ওই এলাকার বাসিন্দা শাহাবুদ্দিন, নুরু, শাহীন, চা-দোকানি জহিরুল ওরফে জাহিদ ও আল আমিন। তাঁরা ১০০ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। বিএনপির সাংগঠনিক এই ওয়ার্ডের মধ্যে নবীনগর হাউজিং, চন্দ্রিমা হাউজিং, ঢাকা উদ্যান হাউজিং, একতা হাউজিং, তুরাগ হাউজিং, শ্যামলি হাউজিং (দ্বিতীয় প্রকল্প) ও নবোদয় হাউজিং রয়েছে।

বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, গণপিটুনিতে নিহত দুজন ফ্যাসিস্টের দোসর বলে তিনি শুনেছেন। আর যদি গণপিটুনির ঘটনা না হয়, তবে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আইনগত ব্যবস্থা নিক।

ভিডিও ফুটেজে আক্তার, হাসনাইন, মালেকসহ কয়েকজনকে লাঠি-রড দিয়ে পেটাতে দেখা গেছে, তাঁরা আপনার অনুসারী বলে অভিযোগ রয়েছে—এ বিষয়ে জানতে চাইলে জামাল উদ্দিন বলেন, তাঁরা বিএনপির মিছিল-মিটিংয়ে যান। যে কেউ মিছিল–মিটিংয়ে যেতে পারেন।

ঘুম থেকে ডেকে তুলে হত্যা

১০ সেপ্টেম্বর ভোরের ঘটনায় নিহত যুবক সুজন ওরফে বাবুলের বাসা ঢাকা উদ্যান এলাকায়। এ ঘটনায় আহত শরীফের বাসা চন্দ্রিমা হাউজিং এলাকায়। এই দুজন ৯ সেপ্টেম্বর রাতে নবীনগর হাউজিংয়ে সাদিক অ্যাগ্রোর খামারে যান। রাতে সেখানে খামারের কর্মী মনির আলীর সঙ্গে একই কক্ষে ঘুমান। ভোর চারটার পর সেখান থেকে মালেক, হাবিবুরসহ কয়েকজন তাঁদের ধরে নিয়ে যায়। এ সময় খামারের ভেতরেই মনির আলীকে মারধর করা হয়।

গত ৫ অক্টোবর ওই খামারে গেলে একাধিক কর্মী প্রথম আলোকে এ তথ্য জানান। তাঁরা বলেন, ঘটনার পরদিন মনির ভয়ে চাকরি ছেড়ে চলে যান।

খামারের ব্যবস্থাপক নেছারউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, মনির পাঁচ বছর ধরে এখানে কাজ করতেন। সুজনের মৃত্যুর পর মনির চলে গেছেন। কারণ হিসেবে বলেছেন, এখানে তিনি নিরাপদ নন। তবে বিস্তারিত কিছু বলেননি। মনিরের কোনো খোঁজ তিনি দিতে পারেননি।

সুজন ও শরীফকে যেখানে পেটানো হয়, তার কাছেই টিনের একটি ঘরে থাকেন এক নারী (নিরাপত্তার স্বার্থে নাম প্রকাশ করা হলো না)। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার দিন ভোরে চিৎকার শুনে ঘর থেকে বের হন। দেখেন, দুই যুবককে কয়েকজন পেটাচ্ছেন। তাঁদের বাঁচাতে কেউ এগিয়ে আসেননি।

নিহত সুজনের বাবা জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তিনি বলেন, কীভাবে সুজনকে পিটিয়ে মারা হয়েছে, সেটি সবাই দেখেছে। আক্তার হোসেনের লোকজন তাঁর ছেলেকে সাদিক অ্যাগ্রোর খামার থেকে ধরে এনে পিটিয়ে হত্যা করেছে। এ ঘটনার পুরো ভিডিও আছে। খবর পেয়ে তিনি সেদিন ঘটনাস্থলে ছুটে যান। গিয়ে দেখেন, তাঁর ছেলেকে রাস্তার পাশের গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে। ছেলে তখন আর বেঁচে ছিলেন না।

জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ঘটনার ভিডিও পুলিশকে দেওয়া হয়েছে। অথচ মামলা নিল না। সুজন অবিবাহিত ছিলেন বলেও জানান তিনি।

নুপুর আক্তার বলেন, ফয়সাল ও হানিফকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যান আক্তার হোসেন (ওয়ার্ড বিএনপি নেতা) ও তাঁর লোকজন। তাঁর স্বামী ফয়সাল এবং হানিফ অপরাধী হলে আইন বিচার করবে। কিন্তু পিটিয়ে মারবে কেন?

রাস্তা থেকে তুলে এনে পিটিয়ে হত্যা

১০ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিং এলাকার হাক্কার পাড়ে মো. ফয়সাল ও মো. হানিফ নামের আরও দুই যুবককে পেটানো হয়। এ ঘটনার একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, ফয়সালকে পাঁচজন এবং হানিফকে তিনজন মিলে পেটাচ্ছে। আরেকটি ভিডিওতে দেখা গেছে, পেটানোর সময় হানিফ হাতজোড় করে মাফ চাইছেন।

ফয়সালের স্ত্রী নুপুর আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, যেখানে হানিফ ও ফয়সালকে পেটানো হয়, তার কাছেই তাঁদের বাসা। খবর পেয়ে তিনি ঘটনাস্থলে ছুটে যান। তিনি ঘটনাস্থলে যাওয়ার পর ফয়সালকে মারধর করা বন্ধ করা হয়। তবে হানিফকে তখনো পেটানো হচ্ছিল। একপর্যায়ে হানিফের মৃত্যু হয়। তিনি বলেন, যারা সেদিন পিটিয়েছে, এলাকার সবাই তাদের চেনে।

নুপুর আক্তার বলেন, ফয়সাল ও হানিফকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যান আক্তার হোসেন (ওয়ার্ড বিএনপি নেতা) ও তাঁর লোকজন। তাঁর স্বামী ফয়সাল এবং হানিফ অপরাধী হলে আইন বিচার করবে। কিন্তু পিটিয়ে মারবে কেন?

গত ৫ অক্টোবর নবীনগর হাউজিং এলাকায় গিয়ে কথা হয় হানিফের বড় ভাইয়ের সঙ্গে। তাঁর নামও আক্তার হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ভাই ছিনতাইয়ে জড়িত থাকতে পারে। কিন্তু ধরে নিয়ে হত্যা করার অধিকার কারও নেই। হানিফ বারবার হাতজোড় করে জীবন ভিক্ষা চেয়েছিল। তাঁর কথা কেউ শোনেনি। এ ঘটনায় মামলা করতে থানায় গেলে থানার ওসি (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) বলেছেন অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করতে। সব আসামিকে ভিডিওতে দেখা গেছে, এমন তথ্য জানালে ওসি বলেছেন, অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা না করলে চলে যান। পরে তাঁরা আদালতে মামলার আবেদন করেন।

আক্তার হোসেন জানান, হানিফের দেড় মাস বয়সী মেয়ে আছে। মেয়েসহ হানিফের স্ত্রী এখন বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জে থাকেন।

ধরে এনে হত্যা করা এবং ভিডিও ফুটেজেও দেখা গেছে গণপিটুনির ঘটনা ঘটেনি—এমন তথ্য তুলে ধরা হলে এসআই আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘আমি বলছি না আপনার তথ্য সঠিক নয়। আমি সেদিন যা জানতে পেরেছি, সে তথ্যই উল্লেখ করেছি।’

হত্যার ঘটনাকে গণপিটুনি বলে প্রচার

গত ১০ সেপ্টেম্বর ঘটনার দিনই মোহাম্মদপুর থানার ওসি কাজী রফিকুল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ছিনতাই করতে গিয়ে ধরা পড়ার পর গণপিটুনিতে ওই দুজন নিহত হন।

ওসির সঙ্গে এ বিষয়ে ৫ অক্টোবর আবার কথা বলেছে প্রথম আলো। মোহাম্মদপুর থানায় নিজ কক্ষে বসে ওসি বলেন, নিহত ওই দুজন ছিলেন পেশাদার ছিনতাইকারী। তাঁদের মৃত্যুর পর এলাকায় শান্তি ফিরে এসেছে। ছিনতাই কমে গেছে। তাঁরা গণপিটুনিতেই নিহত হন।

গণপিটুনিতে নয়, পরিকল্পিতভাবে দুজনকে হত্যা করা হয়েছে—প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ, স্থানীয় বাসিন্দাদের বক্তব্য ও ভিডিও ফুটেজেও বিষয়টি উঠে এসেছে, ওসিকে এ তথ্য জানানো হলে তিনি বলেন, তদন্তে এমন তথ্য পাওয়া গেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সুজন ও হানিফের লাশ ১০ সেপ্টেম্বর ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান মোহাম্মদপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আক্তারুজ্জামান। তাঁর সঙ্গে গতকাল বিকেলে কথা বলেছে প্রথম আলো। তিনি বলেন, সেদিন তিনি ওই এলাকায় টহল টিমের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। মুঠোফোনে সংবাদ পেয়ে তিনিই দুই দফায় চারজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান, যাঁদের দুজন মারা গেছেন। তিনি দাবি করেন, সেদিন গণপিটুনির ঘটনাই ঘটেছিল।

ধরে এনে হত্যা করা এবং ভিডিও ফুটেজেও দেখা গেছে গণপিটুনির ঘটনা ঘটেনি—এমন তথ্য তুলে ধরা হলে এসআই আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘আমি বলছি না আপনার তথ্য সঠিক নয়। আমি সেদিন যা জানতে পেরেছি, সে তথ্যই উল্লেখ করেছি।’

কোনো ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে পুলিশকে অবশ্যই মামলা নিতে হবে বলে প্রথম আলোকে জানান মানবাধিকারকর্মী নূর খান। তিনি বলেন, হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া ব্যক্তি বড় অপরাধী হলেও সেই হত্যাকাণ্ডের বিচার হতে হবে। আর হত্যাকাণ্ডকে গণপিটুনি হিসেবে পুলিশ প্রচার করে থাকলে কাজটি মোটেও ঠিক করেনি, এটি অপতৎপরতা।

সম্পর্কিত নিবন্ধ