বাংলাদেশের ২২ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল ১০ দিনের চীন সফর শুরু করেছেন। রাজনৈতিক নেতা, সুশীল সমাজের কর্মী, শিক্ষাবিদ ও সাংবাদিকদের নিয়ে গঠিত প্রতিনিধি দলটি চীন সফরকালীন সময়ে দেশটির সরকারি কর্মকর্তা এবং ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন।

মঙ্গলবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিনিধি দলের একজন নেতা সংবাদমাধ্যমটিকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। 

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্লেষকদের মতে- বিভিন্ন বিষয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে কূটনৈতিক উত্তেজনা বৃদ্ধি পাওয়ায় বেইজিং ঢাকার সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার চেষ্টা করছে। এর মধ্যে রয়েছে ভারতে নির্বাসিত বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ। ঢাকা তাকে প্রত্যর্পণের অনুরোধ করেছে কিন্তু দিল্লি তা প্রত্যাখ্যান করেছে।

আরো পড়ুন:

খ্যাতি সুন্দর একটি হাতব্যাগের মতো: শ্রুতি হাসান

‘কেমন সম্পর্ক চায়?’ ভারতের পাল্টা বাংলাদেশের

বেইজিংয়ে প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বদানকারী বিএনপির এক জ্যেষ্ঠ নেতা আব্দুল মঈন খান বিবিসিকে বলেন, “এটি মূলত একটি সৌজন্যমূলক সফর, যার উদ্যোগ বেইজিং নিয়েছে।” 

তিনি আরো বলেন, “উদ্যোগটি অনন্য, কারণ চীন এবার বাংলাদেশের বিভিন্ন গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী দলকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে।”

প্রতিনিধিদলে বিএনপি ও তাদের মিত্রদের নেতা ছাড়াও গত বছরের আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান শুরু করা ছাত্র আন্দোলনের বেশ কয়েকজন সদস্যও রয়েছেন। ওই অভ্যুত্থান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করে।

শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে দিল্লি ও ঢাকার মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। এ বিষয়টিকে তার সমালোচকরা ব্যাপকভাবে ভারতপন্থি হিসেবে দেখেছিলেন। শেখ হাসিনা ঢাকা-দিল্লির সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ রাখলেও, বেইজিংয়ের সঙ্গে সম্পর্কে ভারসাম্য বজায় রেখেছিলেন। 

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর, চীন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং ইসলামী দলগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ আরো বাড়িয়েছে।

চলতি সপ্তাহে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের এই সফরের আগে, জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র নীতি উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বেইজিং সফর করেন এবং চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই-এর সঙ্গে বৈঠক করেন।

গত বছরের শেষের দিকে বেইজিং বিএনপি প্রতিনিধিদলকে আতিথ্য দেওয়ার পর, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে এটি দ্বিতীয়বারের মতো বিএনপি কর্মকর্তাদের চীন সফর।

বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক শূন্যতা এবং ভারতের প্রভাবের অনুপস্থিতির কারণে বেইজিং প্রায় ১৭ কোটি জনসংখ্যার দেশ বাংলাদেশে নিজেদের প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করছে।

চীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার এবং দুই দেশের বার্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ২৪ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের সামরিক সরঞ্জামের ৭০ শতাংশ আসে চীন থেকে।

বেইজিংয়ের সদিচ্ছার তুলনায়, গত ছয় মাসে ভারতের বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে খুব সীমিত যোগাযোগ হয়েছে।  

শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারতের হস্তক্ষেপের অভিযোগে ডিসেম্বরে বিএনপি একটি বিক্ষোভ করেছে। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কিছু উপদেষ্টাও একই বিষয়ে দিল্লির সমালোচনা করেছেন।

এই সমালোচনার পর দিল্লি তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।

গত সপ্তাহে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রহ্মণ্যম জয়শঙ্কর বলেছেন, ‘তারা আমাদের সঙ্গে কী ধরনের সম্পর্ক চায়’ সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব বাংলাদেশের।

তিনি বাংলাদেশের কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদদের ভারতের সমালোচনা করার বিষয়টিকে ‘একেবারে হাস্যকর’ বলে আখ্যা দিয়েছেন।

বিশ্লেষকদের মতে, ঢাকা এবং দিল্লির মধ্যে এই ক্রমবর্ধমান উত্তেজনাপূর্ণ বক্তব্য বাংলাদেশকে চীনের দিকে ঠেলে দিতে পারে। যা নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের মতো দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর ক্ষেত্রে ইতোমধ্যেই দেখা গেছে।

বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র ফেলো বিবিসিকে বলেন, “ভারত যদি মনে করে পুরো উপমহাদেশ তার একচ্ছত্র প্রভাবাধীন, তাহলে এমন মনোভাব ভারতকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।” 

ঢাকা/ফিরোজ

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর র জন ত ক সরক র র ব এনপ

এছাড়াও পড়ুন:

এই সরকারও আমলাতন্ত্রের চাপে!

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান নতুন যে জন-আকাঙ্ক্ষা তৈরি করেছে, সেখানে নিশ্চিত করেই জনপ্রশাসন সংস্কারের প্রশ্নটি নাগরিকদের কেন্দ্রীয় একটি চাহিদা। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার যেভাবে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মতোই পদ ছাড়া পদোন্নতি দিচ্ছে, তাতে উদ্বিগ্ন না হওয়ার কোনো কারণ নেই। কেননা, আগের সরকার কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছিল যে কয়টা স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে, তার অন্যতম আমলাতন্ত্র।

জনপ্রশাসনকে রাজনীতিকরণের বৃত্ত ভেঙে জনবান্ধব করার একটা বড় সুযোগ এনে দিয়েছিল অভ্যুত্থান। কিন্তু শুরু থেকেই অন্তর্বর্তী সরকার আমলাতন্ত্রের ওপর অতিনির্ভরশীল হয়ে ওঠায় সেই সুযোগ অনেকটাই হাতছাড়া হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের বিরোধিতার কারণে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের বড় কোনো সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। অন্যদিকে বেতন বাড়াতে গঠন করা হয়েছে বেতন কমিশন। কিছু মুখকে সরিয়ে দেওয়া ছাড়া জনপ্রশাসনে সেই পুরোনো চর্চা অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে পদ ছাড়া পদায়নের ক্ষেত্রে জনপ্রশাসনে যেভাবে আগের সরকারের চর্চার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়েছে, সেটা যারপরনাই দুঃখজনক।

প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, উপসচিব স্তরে যেখানে আগে থেকেই পদের চেয়ে ৬০০ কর্মকর্তা বেশি রয়েছেন, সেখানে আগস্ট মাসে নতুন করে ২৬৮ জনকে এই পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত সচিব পদেও পদোন্নতির আলোচনা শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক সরকারের আমলে জনপ্রশাসনে হরেদরে পদোন্নতি দেওয়ার অনেক নজির আছে। এর কারণ একটাই, আমলাতন্ত্রকে তুষ্ট রাখা। অন্তর্বর্তী সরকার এই চর্চায় ছেদ ঘটাতে পারবে, সেটাই সবাই প্রত্যাশা করেছিল।

পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়ার পর বেশির ভাগ কর্মকর্তাকে আগের জায়গাতেই রেখে দেওয়া হয়। এর মানে হচ্ছে তাঁরা আগের দায়িত্বই পালন করেন, কিন্তু মাঝখান থেকে বেতন-ভাতা বাড়ে। উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা তিন বছর চাকরি পাওয়ার পর বিনা সুদে গাড়ি কেনার জন্য ঋণসুবিধা পান। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে অবসরে যাওয়া সরকারি কর্মকর্তাদের যেভাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, তার দৃষ্টান্তও খুব বেশি নেই। অবসরে যাওয়া প্রশাসন ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ও অন্য ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৮ জন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির সুপারিশ করা হয়েছে।

জনপ্রশাসনের মেধাবী ও যোগ্য কর্মকর্তারা পদোন্নতি পেয়ে পরের ধাপে যাবেন, সেটা স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু পদ না থাকার পরও কেন পদায়ন করা হবে? এ ক্ষেত্রে সরকারকে পর্যালোচনা করে দেখা প্রয়োজন, জনপ্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে পদ বাড়ানো যায় কি না। আবার যেখানে এমনিতেই পদের বিপরীতে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সংখ্যা বেশি, সেখানে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া কতটা যৌক্তিক?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও জনপ্রশাসনবিশেষজ্ঞ সালাউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান বলেছেন, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়া যায় না। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে মেধাবীদের পদোন্নতি দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এরপরও কেন এমন পদোন্নতি—সেই ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, সরকার সম্ভবত আমলাতন্ত্রের চাপে রয়েছে। এই ধারণা শুধু তাঁর একার নয়, নাগরিক পরিসরের
বিস্তৃত একটি ধারণাও। অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই এর পরিষ্কার ব্যাখ্যা হাজির করা উচিত।

মাথাভারী আমলাতন্ত্র সরকারি সেবা নাগরিকের কাছে ঠিকভাবে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বড় একটা বাধা। অন্যদিকে সরকারকে এখানে বিশাল ব্যয়ের বোঝা বহন করতে হয়। ফলে মাঠ প্রশাসন থেকে শুরু করে সিনিয়র সচিব পর্যন্ত একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ ও গতিশীল জনপ্রশাসনই সবাই প্রত্যাশা করে। জনপ্রশাসনের সব স্তরে পদোন্নতি রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, মেধার ভিত্তিতেই হতে হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ