ফাল্গুনী তানিয়া মূলত একজন গবেষক। ‘বাংলাদেশের নারী-লেখকদের উপন্যাস: নারীচরিত্রের স্বরূপ’ শিরোনামে পিএইচডি করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বাংলা একাডেমি থেকে গবেষণাবৃত্তি পেয়ে বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছরের মিশুসাহিত্যের ওপর গবেষণা করেছেন। চলতি বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে তার নতুন গবেষণাগ্রন্থ ‘পাঠ ও পর্যবেক্ষণে বাংলাদেশের সাহিত্য’। নতুন গবেষণার বিষয়বস্তুসহ নানা বিষয়ে রাইজিংবিডির সঙ্গে কথা বলেছেন এই গবেষক। সাক্ষাৎকার গ্রহণে স্বরলিপি।

রাইজিংবিডি: চলতি বইমেলায় আপনার গবেষণা গ্রন্থ ‘পাঠ ও বিশ্লেষণে বাংলাদেশের সাহিত্য’ প্রকাশিত হযেছে। বিশেষভাবে উপস্থাপন করেছেন নারীর মনো-সামাজিক অবস্থা। নারীর মনস্তত্ত্বের একাকিত্ব ও নৈঃসঙ্গের স্বরূপ সন্ধানের ব্রত নিলেন কেন?
ফাল্গুনী তানিয়া: 
পাঠ ও পর্‌যবেক্ষণে বাংলাদেশের সাহিত্য মূলত কিছু তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের সাহিত্যকে বিশ্লেষণ করার একটি প্রয়াস। এ্রর অংশ হিসেবে নারীর মনস্তত্ব ও সামাজিকীকরণের প্রক্রিয়াটি পাঠকের দৃষ্টিগোচর করতে চেয়েছি। একজন নারী গবেষক হিসেবে এটিকে আয়ত্ব করা ও উপস্থাপন করা আমি আমার দায়িত্ব মনে করেছি।

রাইজিংবিডি: এই গবেষণা শেষে সাহিত্যে নারীর উপস্থাপনের বিষয়ে আপনার প্রস্তাবনা কি কি?
ফাল্গুনী তানিয়া:
সাহিত্যে নারীর উপস্থাপন বরাবরই প্রান্তিক। পুরুষরা নারীকে প্রধান চরিত্র করেছে এমন উপন্যাসের সংখ্যা কম। এবং পুরুষরা নারীর একটি স্টেরিওটাইপ তৈরি করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লক্ষ্মী ও উর্বশী ছকে নারীচরিত্র তৈরি করেছেন তারা। এই ছকে মাতা, কন্যা, প্রিয়া ব্যতীত নারীর নিজস্ব পরিচয় নেই। এই ছকের বাইরে গেলেই সে ডাইনী, ছলনাময়ী। নারীলেখকরা এই ছকে পরিবর্তন আনছেন। স্বাধীন নারীচরিত্র আসছে। ইবসেনের নোরার মত চরিত্র দিন বদলের বার্তা পাঠাচ্ছে। নাসরীন জাহানের ‘উড়ুক্কু’র নীনা, সেলিনা হোসেনের ‘দীপান্বিতা’র সুনীতি, নসিরন, চন্দ্রভানু সবাই ব্যক্তিস্বাতন্ত্রে উজ্জ্বল চরিত্র। আকিমুন রহমানের উপন্যাসের প্রতিটি নারীচরিত্র প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে দীপ্যমান। তবে পুরুষ সাহিত্যিকরা যদি এই ধারাকে স্বাগত না জানান তবে নারীচরিত্রের প্রচলিত ভাবমূর্তির কোনো পরিবর্তন হবে না। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’র কুলসুমের মত চরিত্রের বাংলা সাহিত্যে খুব বেশি প্রয়োজন। 

আরো পড়ুন:

বইমেলায় আহমেদ শরীফের দুইটি বই প্রকাশিত হয়েছে

বইমেলায় বাংলা একাডেমির ‘গুণিজন স্মৃতি’ পুরস্কার ঘোষণা

রাইজিংবিডি: প্রবন্ধ রচনায় আপনি বর্ণনাত্মক রীতির আশ্রয় নিয়েছেন, কেন?
ফাল্গুনী তানিয়া:
আমার রচিত প্রবন্ধগুলো মূলত একাডেমিক তাই বর্ণনাত্মক রীতিই অনুসরণ করা হয়েছে। তবে, প্রবন্ধের প্রয়োজনে তুলনামূলক অন্বেষণ রয়েছে যথেষ্ট। শিরোনামের মধ্যেই এটা পাবেন। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’ ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘চিহ্ন ’উপন্যাসের তুলনামূলক আলোচনা করা হয়েছে। ‘লালসালু’ উপন্যাসের রহিমা, জমিলা, হাসুনির মা সব চরিত্রের মিল অমিল তুলে ধরা হয়েছে। এই তুলনার জন্য দুটো চাবি শব্দ আমি বেছে নিয়েছি। একটি ‘মাতৃত্ব’ অন্যটি ‘ভগ্নিত্ব’। শামসুর রাহমানের প্রবন্ধটিতে বাকস্বাধীনতার আলোচনার ক্ষেত্রে ব্রিটিশ উপনিবেশের সময়ের কাজী নজরুল ইসলাম  থেকে পেন ইন্টারন্যাশনালের সাম্প্রতিক লেখকরা তুলনামূলক আলোচনাতে এসেছেন। আবার বিশ্লেষণাত্মক রীতিও বেছে নিয়েছি কোনো কোনো প্রবন্ধে। এটা আসলে কোন বিষয়ের ওপর লিখছি তার গঠনকাঠামো ও পদ্ধতি কী হওয়া উচিৎ তা নির্ধারণ করে দেয়।

রাইজিংবিডি: সাহিত্য গবেষণা পরবর্তী সাহিত্য এবং সমাজকে কীভাবে প্রভাবিত করতে পারে বলে মনে করেন?
ফাল্গুনী তানিয়া:
সাহিত্য গবেষণা অথবা সমালোচনা সাহিত্যের ধারাটিকেও বদলে দিতে পারে। আমরা পঞ্চপাণ্ডবের কথা জানি যে তারা বাংলা সাহিত্যের বাঁক-বদলে কী রকম ভূমিকা রেখেছিলেন। বুদ্ধদেব বসু, সূধীন্দ্রনাথ দত্ত, জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু দে রবীন্দ্র প্রভাবের বাইরে আসার জন্য রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য ও বিশ্বসাহিত্যের আদ্যোপান্ত ঘাটাঘাটি করেছিলেন। সমালোচনা করতে গিয়েই তারা মুখের ভাষা, আঞ্চলিক ভাষা এমনকি স্ল্যাংকে পর্যন্ত সাহিত্যে স্থান দিলেন। সাহিত্য উচ্চবিত্ত থেকে দরিদ্র এমনকি বস্তিতে প্রবেশ করল। সাহিত্য আন্দোলনের কথাও এক্ষেত্রে অনস্বীকার্য। বিভিন্ন সাহিত্য আন্দোলন বাংলা সাহিত্যকে প্রভাবিত করেছে সেটা হোক প্রাচ্যের অথবা পাশ্চাত্যের।

রাইজিংবিডি: চলতি বইমেলায় আপনার শিশুসাহিত্যের বইও প্রকাশিত হয়েছে। কোন বয়সী শিশুদের জন্য লিখলেন?
ফাল্গুনী তানিয়া: 
এবার গবেষণার পাশাপাশি দুটি শিশুদের বই নিয়ে পাঠকের সম্মুখে এসেছি। একটি ‘হারিয়ে গেল বানর ছানার মা ’অন্যটি ‘তুমিই সবার সেরা’। প্রথমটি একেবারে ছোট শিশুদের জন্য। এটা পড়লে শিশুরা বিভিন্ন প্রাণীর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানতে পারবে।
অপরটি ছয় থেকে আট বছর বয়সের উপযোগী। ‘তুমিই সবার সেরা’ বইটি প্রতিটি শিশুকে আত্মসচেতন করে তুলবে। এই বইয়ে আমি অভিভাবকদের জন্যও একটা বার্তা রেখেছি। বলতে চেয়েছি তুলনা নয় বরং প্রতিটি শিশুর স্বাতন্ত্রই তার প্রতিভা বিকাশে সহায়ক ভূমিকা রাখে। তাদের সামর্থ্য সম্পর্কে যে কোনো পরিস্থিতিতে ইতিবাচক মন্তব্য করা জরুরি। সুন্দর একটি পৃথিবী গড়ে তোলার জন্য শিশুদের আত্মবিশ্বাসী করে গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। 

রাইজিংবিডি: একজন নারী হিসেবে সাহিত্যকর্ম করা কতটা ‘চ্যালেঞ্জিং’ মনে করেন?
ফাল্গুনী তানিয়া: 
এই প্রশ্নের উত্তরে বহু প্রসঙ্গ আসবে। উত্তরটাও দীর্ঘ হবে। প্রথমত ভার্জিনিয়া উলফ শতাব্দীকাল পূর্বেই যা বলেছেন সেটি বলতেই হবে। ‘একজন নারীর যত দিন লেখার জন্য নিজের একটি ঘর ও পর্যাপ্ত অথর্নৈতিক স্বচ্ছলতা না থাকবে ততদিন সাহিত্যের পথটিতে চূড়ান্ত সফলতা পাবে না।’ যেহেতু আমি একজন গবেষক আমার জন্য পথটি আরো কঠিন। কারণ গবেষণার জন্য নিরবচ্ছিন্ন সাধনার প্রয়োজন হয়। কিছু কিছু কাজের ব্যয় অত্যন্ত বেশি। মাঠ পর্যায়ে কাজ না থাকলেও কিছু কিছু বইয়ের জন্য আমাকে দূর-দূরান্তে যেতে হয়। বাংলাদেশের নারীলেখকদের উপন্যাস নিয়ে যখন কাজ করেছি শৈলবালা ঘোষজায়া, ইন্দিরা দেবি, সরলা দেবি এদের উপন্যাসের জন্য হায়াৎ মামুদ স্যারসহ অনেকের ব্যক্তিগত লাইব্রেরি ব্যবহার করতে হয়েছে। যশোরের অনেক পুরনো কালেক্টরেট লাইব্রেরিতে কাজ করেছি। ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগরের সব লাইব্রেরিতে যেতে হয়েছে। যাতায়াত ভাড়া, ফটোকপি এগুলোর ব্যায় তো কম নয়। কিছু কিছু লাইব্রেরি ব্যবহারের জন্য ফি দিতে হয়। বাংলাদেশের নারী যোদ্ধাদের নিয়ে কাজ করার সময় আমাকে প্রায়ই আর্কাইভে যেতে হয়েছে। যেহেতু সংসার-সন্তান সব সামলিয়ে কাজ করতে হয় তাই বই ও কিনতে হয় প্রচুর। যদি রাষ্ট্রীয়ভাবে গবেষণার পর্যাপ্ত সুযোগ থাকত এবং গবেষকদের যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হত তাহলে গবেষণার মান উন্নয়ন সম্ভব ছিল। বাংলা একাডেমির একটি গবেষণা বৃত্তি পেয়ে ‘বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছরের শিশুসাহিত্য’ নিয়ে এক বছর মেয়াদের একটি কাজ করেছি। দুঃখজনক বিষয় হচেছ সময় এবং টাকা দুটোর পরিমাণই খুব কম। ভাল গবেষণার জন্য টিমওয়ার্ক ও খুব গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে পেশাদারী  মনোভাব নিয়ে লেখালিখি করার মূল অন্তরায়ও এটা।
একজন নারী গবেষকের প্রতিকূলতা অনেক। সহজ ভাবে আপনাকে বলি,মার্কেজের ‘নিঃসঙ্গতার একশো বছর’’ বিশ্বের বহুল পঠিত একটি বই। ধ্রপদী সাহিত্যের মর্যাদা পেয়েছে গ্রন্থটি। মার্কেজ যখন পরিবারের সঙ্গে ছুটি কাটাতে আকাপুলকো যাচ্ছিলেন তখন উপন্যাসটির থিম তার মাথায় আসে এবং তৎক্ষণাৎ তিনি গাড়ি ঘুরিয়ে মেক্সিকো সিটিতে ফিরে আসেন। পরবর্তী আঠারো মাস তিনি তার স্ত্রীর হাতে পরিবারের সমস্ত ভার চাপিয়ে এই কালজয়ী উপন্যাস রচনা করেন। এখন আপনি বলেন এই সহযোগিতা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কোনো নারীর পক্ষে পাওয়া সম্ভব কিনা? আমি আমার বড় সন্তানকে একটি খাতা ও রঙ পেন্সিল হাতে দিয়ে পাঠাগারে বসিয়ে রেখেছি। যখন ঘরে ফিরতাম বাসের মধ্যে ও ঘুমিয়ে পড়ত। ওর ক্লান্ত ঘুমন্ত মুখ দেখে খুব কষ্ট হত। আমার ছোট সন্তানকে বাম স্তন পান করিয়েছি কোলে বসিয়ে আর ডান হাতে লিখেছি। ওরা মায়ের হাতে ওদের পছন্দের খাবারের জন্য অনেক অনেক দিন অপেক্ষা করে থেকেছে। তাদের খাইয়েছি হাতে রেখেছি বই, তাদের ঘুম পাড়িয়েছি পাশে রেখেছি বই। তাদের অসুস্থতার সময় রাত জেগেছি বই হাতে নিয়ে। কত বার ভাত ও দুধ পুড়িয়েছি ঠিক নেই। এমনকি ডিম সিদ্ধও পুড়িয়েছি। একজন পুরুষ দরজা বন্ধ করে কাজ করতে পারেন অথচ আমার পড়ার ঘরটি এমন রেখেছি যেন আমি আমার সন্তানদের গতিবিধির ওপর নজর রাখতে পারি। মাছির মত আমার মাথার সব পাশে চোখ বানাতে হয়েছে। এই যাত্রাটা খুব কঠিন। অর্ন্তগত তাগিদ না থাকলে এই পথ পাড়ি দেওয়া অসম্ভব। গবেষণাকে আমি আমার আরেকটি সন্তানের মত দেখেছি। আমি ভেবেছি আমার যমজ মৃত সন্তানরা বেঁচে থাকলে ওদেরকেও তো আমার সময় দিতে হত। যখন সন্তানের মত ভেবেছি তখন কাজ করা অনেক সহজ হয়েছে।
আবার আপনি যদি পথটা অতিক্রম করেনও স্বীকৃতির পথটি আরো বন্ধুর। এখানে কাজ করে পুরুষতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় রাজনীতি। সোফিয়া তলস্তায়া ভালো লিখতেন। তবে তার লেখা তার মৃত্যুর এক শতাব্দী পরে প্রকাশিত হয়। কারণ তার লেখাতে লিউ তলস্তয়ের অনেক সমালোচনা ছিল। রুশ সরকার চাননি জনপ্রিয় একজন লেখকের জনপ্রিয়তায় ঘাটতি পড়ুক। আমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘শেষের কবিতা’ ও স্বর্ণৃকুমারী দেবীর ‘কাহাকে’ উপন্যাসের একটি তুলনামূলক আলোচনা করেছিলাম। কিন্তু সেটি কোথাও প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সামাজিক ও সাহিত্যিক ভাবমূর্তির সমালোচনা কোনো সম্পাদক প্রকাশ করতে চাননি। এক শতাব্দী পূর্বে যারা সাহিত্যকর্ম করতে এসেছিলেন তারাও নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছিলেন। তাদের লেখালিখিকে তুলনা করা তো ‘আরশোলার পাখি হবার’ সাধের সঙ্গে তুলনা করার মতো। আজ এটার পরিবর্তন ঘটেছে ঠিকই তবু লিঙ্গীয় বিভাজন থেকে এখনো মুক্ত হতে পারেনি আমাদের সাহিত্যজগৎ। পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব ও নিষ্পেষণ থেকে মুক্তি না পেলে আমাদের সাহিত্যের মুক্তি সম্ভব নয়।

ঢাকা/লিপি

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর উপন য স র র উপন য স একজন ন র প রবন ধ বইম ল য় এক ড ম র জন য কর ছ ন ক জ কর র সময় র একট

এছাড়াও পড়ুন:

৫০ শয্যার থানচি হাসপাতাল চলছে একজন চিকিৎসকে

বান্দরবানের থানচি উপজেলার প্রায় ৩০ হাজার মানুষের একমাত্র ভরসার জায়গা ৫০ শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সংকটে এই হাসপাতাল কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। বর্তমানে পুরো হাসপাতাল চালাচ্ছেন মাত্র একজন চিকিৎসক। গত পাঁচবছরে চিকিৎসাধীন ও রেফার্ড করা ২৪ জন রোগী মারা গেছেন।

হাসপাতাল সূত্র জানায়, ১৯৯৫ সালে ৩১ শয্যার থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স যাত্রা শুরু করে। পরে এটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হয়। এই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১২ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও কর্মরত আছেন মাত্র দুইজন। তাদের মধ্যে একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন। এ কারণে রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ১৮ জন নার্স পদে রয়েছেন মাত্র চারজন। চারজন মিডওয়াইফ থাকার কথা, নেই একজনও।

আরো পড়ুন:

ফরিদপুরে পাগলা ঘোড়ার কামড়ে আহত ২০

বক্তব্য দেওয়ার সময় অসুস্থ হয়ে পড়লেন কাদের সিদ্দিকী

প্রাথমিক থেকে শুরু করে জরুরি চিকিৎসার জন্য এই হাসপাতালে ছুটে যান পাহাড়ি ও বাঙালিরা। তাদের অভিযোগ, হাসপাতালটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও আধুনিক চিকিৎসা সুবিধা যোগ হয়নি। প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক না থাকায় গর্ভবতী নারী, শিশু ও বৃদ্ধ রোগীরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ছেন। 

দুর্গম এলাকার রোগীরা অনেক সময় নদীপথ কিংবা পাহাড়ি রাস্তা পাড়ি দিয়ে হাসপাতালে এলেও কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসা সেবা পান না। বরং তাদের বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। অনেক সময় বান্দরবানে যাওয়ার পথে রোগীরা মারা যান। এ কারণে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহের দাবি জানিয়েছেন তারা।

হাসপাতালের পরিসংখ্যানবীদ পঙ্কজ বড়ুয়া জানান, ২০২০ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত এখানে ভর্তি হয়েছেন ৫ হাজার ১৯৮ জন রোগী। এর মধ্যে ৪৫৬ জনকে রেফার্ড করা হয় বান্দরবান সদর হাসপাতালে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ১৭ জন রোগী। 

থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্স চালক মংক্যসিং মারমা বলেন, “২০১৯ সালে চাকরিতে যোগদান করার পর থেকে অন্তত সাতজন রেফার্ড করা রোগী মাঝপথে আমার গাড়িতেই মারা গেছেন।”

 

শৈসাই মং মারমা তিন বছর আগে বিনা চিকিৎসায় তার মাকে মারা যেতে দেখেছেন। তিনি জানান, তার মা শৈমেপ্রু মারমা (৩৪) অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর হঠাৎ তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। রেমাক্রী বাজার থেকে নদীপথে থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান মাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে জেলা সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। ভাড়া গাড়িতে জেলা হাসপাতালে যাওয়ার সময় চিম্বুক বারো মাইল এলাকায় তার মা মারা যান।

লেংরু ম্রো নামে চার সন্তানের মা হারিয়েছেন স্বামীকে। তিনি জানান, তার স্বামী রেং য়ুং ম্রো (৪৫) কিডনি জটিলতা নিয়ে থানচি হাসপাতালে যান। সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে তাকে বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। থানচি থেকে বান্দরবান যাওয়ার মাঝপথে মারা যান তার স্বামী।

স্থানীয় বাসিন্দা মংমে মারমা বলেন, ‍“হাসপাতালে চিকিৎসক, ওষুধ ও যন্ত্রপাতির সংকট দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বদলি হলেও অনেকেই থানচিতে যোগ দেন না, ডিপুটেশনে থেকে যান সদর হাসপাতালে। ফলে এ অঞ্চলের পাহাড়ি ও বাঙালি প্রায় ৩০ হাজার মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।”

রিয়েং ম্রো নামে অপর বাসিন্দা বলেন, “পাহাড়ে বসবাসকারীদের অধিকাংশ গরিব। জেলা সদর হাসপাতালে রোগী নিয়ে যাওয়া ব্যয়বহুল ও কষ্টকর। রেমাক্রি, বড় মোদক, তিন্দু থেকে থানচি সদরে রোগী আনতেই অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়। এরপর আবার বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করলে সাধারণ মানুষ কীভাবে চিকিৎসা করাবে?” 

থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএইচএফপিও) ডা. মো. ওয়াহিদুজ্জামান মুরাদ বলেন, “বর্তমানে হাসপাতালে আমিসহ দুইজন চিকিৎসক রয়েছেন। একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসাধীন। তিন রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ফলে পুরো হাসপাতাল পরিচালনার দায়িত্ব আমাকে একাই সামলাতে হচ্ছে।”

তিনি আরো বলেন, “জনবল ও সরঞ্জাম সংকটের কারণে গুরুতর রোগীদের রেফার্ড করা ছাড়া উপায় থাকে না। দীর্ঘ পথের কারণে অনেকেই জীবিত অবস্থায় সদর হাসপাতালে পৌঁছাতে পারেন না।”

বান্দরবান জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ শাহীন হোসাইন চৌধুরী বলেন, “শুধু বান্দরবান নয়, পুরো তিন পার্বত্য জেলাতেই চিকিৎসক সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। নতুন করে ৪৮তম বিসিএসের ডাক্তার পদায়ন না হওয়া পর্যন্ত এই সংকট পুরোপুরি সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না। তারপরও বিভাগীয় প্রধানকে বিষয়টি চিঠির মাধ্যমে জানানো হয়েছে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের আট-দশজন চিকিৎসককে বান্দরবানে বদলি করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”

ঢাকা/মাসুদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • গাজায় ২৬ হাজার শিশু তীব্র অপুষ্টির শিকার: জাতিসংঘ
  • গ্রাহকের কাছে পেয়ারা খেতে চায় জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তা
  • গল্পটা এই ক্লাসরুম থেকেই শুরু: ইরফান সাজ্জাদ
  • রাশিয়ায় এক বাঙালি বিপ্লবীর খোঁজে
  • আপনার এত সাহস হয় কী করে, সাংবাদিককে নায়িকা
  • দুবাইয়ে বিকৃত যৌন ব্যবসা চক্রের প্রধানকে চিহ্নিত করল বিবিসির এক অনুসন্ধান
  • মহানবী (সা.)–এর ইন্তেকালের পরে শাসন নিয়ে যা ঘটেছে
  • কুবিতে নতুন ১৮ বিভাগ ও ৪ ইনস্টিটিউট চালুর সুপারিশ
  • সংগীতশিল্পী দীপ মারা গেছেন
  • ৫০ শয্যার থানচি হাসপাতাল চলছে একজন চিকিৎসকে