মঙ্গলবার রাজধানীর এক অনুষ্ঠানে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান ‘মন খুলে’ কিছু কথা বলেছেন; জনপরিসরে সেগুলো ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। রিটায়ার্ড আর্মড ফোর্সেস অফিসার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন (রাওয়া) ক্লাব জাতীয় শহীদ সেনা দিবস উপলক্ষে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

সেনাপ্রধানের বক্তব্য শুনে মনে হয়েছে, দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে তিনি বিরক্ত। গত সাত মাসে দেশে ‘মব’ বা উচ্ছৃঙ্খল গোষ্ঠীর উৎপাত, নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তাহীনতা এবং ‘ফ্যাসিবাদের অবশেষ’ গুঁড়িয়ে দেওয়ার নামে যেসব কাণ্ড ঘটেছে, সেগুলো কেন ঘটছে, কারা ঘটাচ্ছে এবং কেন এগুলো প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না, তাও মোটামুটি সবিস্তার ব্যাখ্যা করেছেন জেনারেল ওয়াকার। তিনি বলেছেন, সেনাবাহিনী ছাড়া রাষ্ট্রের আর একটা প্রতিষ্ঠানও টিকে নেই। আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থার নামোল্লেখ করে তিনি বলেছেন, ‘এই অর্গানাইজেশনগুলোকে আন্ডারমাইন (হেয়) করে যদি আপনারা মনে করেন যে দেশে শান্তিশৃঙ্খলা বিরাজ করবে, সবাই শান্তিতে থাকবেন, এটা হবে না।’ এত সংস্থার কাজ সীমিত শক্তির সেনাবাহিনীর পক্ষে করা সম্ভব নয়– এটাও জানিয়ে দিয়েছেন তিনি। তিনি কার্যত বলেছেন–  যথেষ্ট হয়েছে; এবার ‘অবাধ, সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক’ নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিদের হাতে দেশের দায়িত্বভার তুলে দিয়ে সেনাবাহিনীকে নিজের কাজ করতে দিন।

সেনাপ্রধান বলেছেন, ‘আমরা দেশে একটা ফ্রি, ফেয়ার অ্যান্ড ইনক্লুসিভ ইলেকশনের জন্য (সামনের দিকে) ধাবিত হচ্ছি’ (সমকাল, ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫)। তাঁর এ অবস্থানের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকার বিশেষত প্রধান উপদেষ্টা ড.

মুহাম্মদ ইউনূসও যে একমত, সেটাও জানিয়েছেন। 

সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে জেনারেল ওয়াকার আগেও কথা বলেছেন। গত সেপ্টেম্বরে বার্তা সংস্থা রয়টার্স এবং গত ডিসেম্বরে প্রথম আলোকে দেওয়া তাঁর দুটো সাক্ষাৎকার এর প্রমাণ। কিন্তু তাঁর মঙ্গলবারের বক্তব্য আরও স্পষ্ট। 

জেনারেল ওয়াকার এমন সময়ে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট সময় এবং ধরন সম্পর্কে বলেছেন, যখন বিষয়গুলো নিয়ে এক প্রকার ঢাকঢাক গুড়গুড় চলছে। বিশেষত বিএনপি ও বিভিন্ন বামপন্থি রাজনৈতিক দল সরকারকে বারবার দ্রুত নির্বাচনের তাগিদ দিয়েও স্পষ্ট কোনো বার্তা পাচ্ছিল না।

আমরা সর্বশেষ, গত ১০ ফেব্রুয়ারি বিএনপি মহাসচিবকে দলের একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে ড. ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে উপস্থিত সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলতে শুনেছি, প্রধান উপদেষ্টা আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। গত বিজয় দিবসে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা বলেছিলেন, কম সংস্কার চাইলে ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে, আর বেশি সংস্কার চাইলে আরও ছয় মাস পর ২০২৬ সালের জুনে নির্বাচন হবে। প্রেস সচিব ১৪ ফেব্রুয়ারি সাংবাদিকদের এটিই শুনিয়েছেন। এমনকি গত ২৪ ফেব্রুয়ারিও এক প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি বলেছেন, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন চলতি বছরের ডিসেম্বর অথবা সর্বোচ্চ পরের বছরের মার্চের মধ্যে হবে। 

যেখানে বিএনপি দলীয়ভাবে এ বছরের আগস্টের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন চেয়েছে; সিপিবি, বাসদসহ বাম গণতান্ত্রিক জোট নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ দাবি করেছে, সেখানে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক কমিটি বলেই চলেছে– আওয়ামী লীগের বিচারের আগে দেশে কোনো নির্বাচন হবে না। যদিও জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের অত্যন্ত পরিচিত মুখ সারা হোসেন ও ব্যারিস্টার রাশনা ইমামের মতো খ্যাতনামা আইনজীবীরাই বলছেন, এত অল্প সময়ে গ্রহণযোগ্য বিচার অনুষ্ঠান সম্ভব নয়। তড়িঘড়ি বিচার হলে তা দেশের বাইরে তো বটেই, ভেতরেও বিতর্কের জন্ম দেবে। রহস্যজনক হলো, সরকারও বিষয়টি পরিষ্কার করছে না। তাই আদৌ নির্বাচন হবে কিনা– এ সংশয়ও অনেকের মধ্যে বিরাজমান। 

এদিকে স্থানীয় সরকারবিষয়ক উপদেষ্টা একাধিকবার বলেছেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। জামায়াত নেতারাও নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করে কিছুদিন আগে একই কথা বলেছেন বলে সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে। অন্যদিকে বিএনপি নেতারা স্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে অন্য কোনো নির্বাচন আয়োজন হলে তারা তা ঠেকাবেন। এই নেতারা এমনও বলছেন, ছাত্রদের প্রস্তাবিত দলকে অন্যায্য সুবিধা দিতেই আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের কথা বলা হচ্ছে। 

সমস্যা হলো, ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলছে এবং এর মধ্যে স্থানীয় নির্বাচন করা সম্ভব নয়– নির্বাচন কমিশনের এমন ঘোষণা থাকলেও, সরকার কিন্তু এ বিষয়ে একেবারে স্পিকটিনট। তাই জনমনে নানা সন্দেহ দানা বাঁধছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতিও জটিল ও সংঘাতময় হয়ে পড়ছে ক্রমশ।

ছাত্রদের দল গঠনে তিনি নিজে উৎসাহ দিয়েছেন বলে প্রধান উপদেষ্টা লন্ডনের ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে (৩০ জানুয়ারি পত্রিকাটি এ সংক্রান্ত এক পডকাস্টের ট্রান্সক্রিপ্ট ছাপিয়েছে) যা বলেছেন, তাতেও অন্তত নির্বাচন পরিচালনায় অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। রাজনৈতিক মহলে এমনও কথা চালু আছে, জাতীয় নির্বাচনটি শেষমেশ হয়তো নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হবে। তেমনটি হলে যে নির্বাচনও পিছিয়ে যেতে পারে, তা বোঝার জন্য কারও বিশেষজ্ঞ হতে হয় না।

মনে আছে, গত সেপ্টেম্বরে রয়টার্সের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে সেনাপ্রধান ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচন হবে বলায় অন্তর্বর্তী সরকারের সদস্যসহ প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বলেছিলেন, নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার এখতিয়ার একমাত্র প্রধান উপদেষ্টার। তখন এ নিয়ে বিশেষত স্থিতিশীলতার স্বার্থে কথাবার্তা তেমন হয়নি। কিন্তু মঙ্গলবার সেনাপ্রধান ওই একই কথার পুনরাবৃত্তি করেছেন আগের চেয়ে স্পষ্ট করে। এ ক্ষেত্রে তিনি খোদ প্রধান উপদেষ্টাকেই সাক্ষী মেনেছেন। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর বড় অংশেরও এতে সায় আছে।

এ ছাড়া আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষত ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের স্পষ্ট বক্তব্যও প্রণিধানযোগ্য। তারা উভয়েই বাংলাদেশে দ্রুত একটা নির্বাচিত সরকার দেখতে চায়।
এদিকে, জনজীবনের নানামুখী সংকট ইতোমধ্যে যতটা গভীরে গেছে, তাতে একদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের কর্মকাণ্ড ও কর্মপদ্ধতি নিয়ে ইতোমধ্যে জনপরিসরে প্রশ্ন উঠছে। সর্বোপরি, গণঅভ্যুত্থানের শক্তিগুলোও পরস্পর সংঘাত-সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে। সব মিলিয়ে নানামুখী নৈরাজ্যের হাত থেকে দেশ-জাতিকে বাঁচাতে হলে ডিসেম্বর বা পারলে তারও আগে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানই এখন সবার অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।

সাইফুর রহমান তপন: সহকারী সম্পাদক, সমকাল

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ড স ম বর অন ষ ঠ ন র জন ত ক সরক র র বল ছ ন ব এনপ

এছাড়াও পড়ুন:

রাখাইনে করিডোর কি রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আশার আলো দেখাবে

রোহিঙ্গা সংকট ঘিরে নতুন আলোচনা ও বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। এর সূত্রপাত হয় সম্প্রতি মিয়ানমার সীমান্তে হিউম্যানিটারিয়ান বা মানবিক করিডর গড়ে তুলতে অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টার মন্তব্যের মাধ্যমে, যেখানে তিনি বলেন, বাংলাদেশ এ বিষয়ে একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। 

গত দুই মাসে রোহিঙ্গা সংকটকে ঘিরে ক্রমাগত নানা আলোচনা ও সমালোচনা চলমান। রোহিঙ্গা সংকটকে ঘিরে সাম্প্রতিক সময়ে প্রথম ইতিবাচক আলোচনা শুরু হয় মার্চ মাসে, যখন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বাংলাদেশ ভ্রমণ করেন এবং বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরে পবিত্র রোজার মাসে তাদের সঙ্গে ইফতার করেন।

এ সময় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তাদের মেহমান উল্লেখ করে বলেন, তিনি প্রত্যাশা করেন আগামী রোজা রোহিঙ্গারা নিজ দেশে করতে পারবেন। 

পরবর্তী সময়ে ষষ্ঠ বিমসটেক সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়ে একটি পার্শ্ব আলোচনার পর মিয়ানমারের পক্ষ থেকে বলা হয়, তারা প্রাথমিকভাবে ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে নীতিগতভাবে সম্মত।

এ নিয়েও জনসাধারণের মধ্যে একধরনের ধোঁয়াশা কাজ করে। কেননা, আরাকান আর্মিকে উপেক্ষা করে এ ধরনের মন্তব্য রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে খুব বেশি আশার আলো দেখাবে না। এর বেশ কিছুদিন পরে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা উল্লেখ করেন, সাম্প্রতিক সময়ে আরাকান আর্মি ও মিয়ানমারের সঙ্গে যে সহিংস দ্বন্দ্ব চলমান, সে প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন এখনই সম্ভব নয়। 

এই চলমান আলোচনায় নতুন বিতর্ক তৈরি হয় রাখাইনে মানবিক করিডর গড়ে তোলার আলোচনার মাধ্যমে, যদিও এরপর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বলেছেন, এ বিষয়ে জাতিসংঘ বা অন্য কারও সঙ্গে তাঁদের এখনো কোনো আলোচনা হয়নি। এমন নানামুখী আলোচনায় জনমনে বিভ্রান্তি আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাখাইনে মানবিক করিডর গড়ে তোলার প্রধান যুক্তি হলো, এতে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে মিয়ানমারে অবস্থানরত জনগোষ্ঠীর সাহায্যার্থে ত্রাণ এবং অন্যান্য প্রয়োজনের সামগ্রী পাঠানো সম্ভব হবে। 

মানবিক করিডর ও রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়ে আলোচনার আগে একটু দেখে নেওয়া যাক মানবিক করিডর বলতে আসলে কী বোঝায়। 

জাতিসংঘের ব্যাখ্যা অনুযায়ী সশস্ত্র সংঘাতপূর্ণ এলাকায় সংঘাত বা যুদ্ধ পরিস্থিতির সাময়িক বিরতির জন্য অনেক ধরনের পন্থা অবলম্বন করা হয়, তার মধ্যে একটি হলো মানবিক করিডরের প্রস্তাব।

এই মানবিক করিডরের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এমন একটি জায়গা নির্ধারণ করা হয়, যেখানে সশস্ত্র সংঘাত যেন না ঘটে। সে বিষয়ে দুই পক্ষ জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে একমত হয়। মানবিক করিডরের পরবর্তী ধাপে সেই ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের অধিবাসীদের একটি নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয় অথবা সেখানে খাদ্য, ওষুধ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সেবার ব্যবস্থা হয়। 

এ ধরনের মানবিক করিডরের উদাহরণ আমরা ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে সংঘাতপূর্ণ বিভিন্ন দেশের প্রেক্ষাপটে দেখতে পাই। এখানে সামগ্রিক কর্মকাণ্ড জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে হবে, সেটাই প্রত্যাশা করা হয়। বিভিন্ন দেশের প্রেক্ষাপট থেকে আমরা দেখতে পাই, জাতিসংঘের ত্রাণবিষয়ক প্রতিষ্ঠান রেডক্রস এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলির মধ্যে অন্যতম হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ইহুদি শিশুদের যুক্তরাজ্যে স্থানান্তর, নব্বইয়ের দশকে সারায়েভো সংকট, ২০১৮ সালে সিরিয়ার জনগোষ্ঠীকে নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করা এবং সর্বশেষ দেখতে পাই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষেত্রে।

যদি আরও রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে হয়, তাহলে তাদের দায়দায়িত্ব নিতে বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত, সেটা ভেবে দেখা জরুরি। কেননা, এখনই এক মিলিয়নের ওপর রোহিঙ্গা বিভিন্ন শরণার্থীশিবিরে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এর সঙ্গে রয়েছে তাদের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার জন্য আন্তর্জাতিক মহলের অর্থনৈতিক সাহায্য কমিয়ে দেওয়া, যা বাংলাদেশের জন্য এক বড় অর্থনৈতিক বোঝা। 

রাখাইনকে ঘিরে মানবিক করিডর গড়ে তোলার এই নীতিগত সিদ্ধান্তের প্রেক্ষাপটে গবেষক, রাজনীতিবিদ, নীতিনির্ধারক ও সাধারণ জনগণের মধ্যে বেশ কিছু প্রশ্ন, আশঙ্কা ও দ্বিধা তৈরি হয়েছে।

তবে শঙ্কার পাশাপাশি কোনো কোনো গবেষক মনে করছেন, মানবিক করিডরের প্রস্তাব মেনে নেওয়ার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলার চলমান সংলাপ আরও জোরদার হবে, যা ভবিষ্যতে এই সংকট মোকাবিলায়, বিশেষ করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। 

তবে এই ইতিবাচক প্রত্যাশা ছাপিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকে কেন্দ্র করে যে দ্বিধা রয়েছে, সেটি হলো এই মানবিক করিডরের মাধ্যমে ভবিষ্যতে কি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত হবে, নাকি আরও বিলম্বিত হবে, নাকি আরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করার সুযোগ পাবে। 

ইতিমধ্যে আমরা দেখেছি, এক লাখের ওপরে রোহিঙ্গা শরণার্থী আবারও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলা কক্সবাজারে প্রবেশ করতে বাধ্য হয়েছে। মানবিক কারণে বাংলাদেশ এই দায় যেমন এড়িয়ে যেতে পারছে না, তেমনি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ব্যবস্থাপনার ভারও বহন করতেও হিমশিম খাচ্ছে। এ অবস্থায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনসহ তাদের অন্যান্য সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে মানবিক করিডর কতটা বাস্তবসম্মত হবে, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। কেননা, কোনো বিস্তারিত দিকনির্দেশনা আমাদের সামনে নেই। 

অতীতের বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষাপট থেকে আমরা দেখতে পাই, মানবিক করিডরের অন্যতম প্রধান ব্যবহার হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ জাতিগোষ্ঠীকে সংঘাতপূর্ণ স্থান থেকে নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করা। যেখানে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশে চলমান অনুপ্রবেশ কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না, সেখানে মানবিক করিডরের মাধ্যমে আরও বৃহৎ অংশের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় নিরাপত্তার স্বার্থে স্থানান্তর করার প্রক্রিয়ায় শুরু অস্বাভাবিক নয়। 

এ প্রেক্ষাপটে যদি আরও রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে হয়, তাহলে তাদের দায়দায়িত্ব নিতে বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত, সেটা ভেবে দেখা জরুরি। কেননা, এখনই এক মিলিয়নের ওপর রোহিঙ্গা বিভিন্ন শরণার্থীশিবিরে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এর সঙ্গে রয়েছে তাদের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার জন্য আন্তর্জাতিক মহলের অর্থনৈতিক সাহায্য কমিয়ে দেওয়া, যা বাংলাদেশের জন্য এক বড় অর্থনৈতিক বোঝা। 

এর বাইরে আরেকটি চিন্তার জায়গা হলো সীমান্ত এলাকা বাংলাদেশ কতটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে, সেটি। সাম্প্রতিক ঘটনাবলি দেখলে বোঝা যায়, সীমান্ত প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের বর্তমান প্রচেষ্টা খুব যে সুখকর, সেটি বলা যাবে না।

এ ছাড়া এই অঞ্চল বিভিন্ন কারণে মাদক ব্যবসা, মানব পাচার, সহিংসতা ও অন্যান্য নিরাপত্তাঝুঁকির জন্য একটি অন্যতম হটস্পট, যা নিয়ন্ত্রণ করতে আমাদের নানাভাবে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

এমন পরিস্থিতিতে সীমান্ত এলাকার নিয়ন্ত্রণ আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয় কি না, সেটা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। মানবিক করিডরের মাধ্যমে বাংলাদেশ কীভাবে লাভবান হতে পারে, সে বিষয়েও যথাযথ পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে এবং নিজেদের স্বার্থেই আমাদের স্বচ্ছ থাকতে হবে। 

এর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোসহ অন্য অংশীজনের সঙ্গে পরামর্শ করারও বিশেষ প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কেননা, এর পরবর্তী পরিণতি ও ব্যবস্থাপনার দায়দায়িত্ব ভবিষ্যতের নির্বাচিত সরকারকেই গ্রহণ ও বহন করতে হবে। যদিও জাতিসংঘের মানবিক করিডরের প্রস্তাব বেশ পুরোনো, কিন্তু তড়িঘড়ি করে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হিতে বিপরীত হতে পারে। শরণার্থী বিষয়ে একটি টেকসই রূপরেখা এবং পরিকল্পনানীতি না থাকার কারণে সরকারকে অ্যাডহক প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে হয়, যা অনেক ক্ষেত্রেই সমস্যাজনক হয়। 

এসব বিবেচনায় নিয়ে একজন গবেষক হিসেবে আমি বিভিন্ন সময় রোহিঙ্গাবিষয়ক একটি জাতীয় রোডম্যাপ বা রূপরেখা এবং শরণার্থীবিষয়ক নীতি প্রণয়ন করার পক্ষে কথা বলে আসছি। আমাদের সে ধরনের কোনো দৃশ্যমান পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি বিগত সময়ে ছিল না। বিশেষ করে যদি প্রত্যাবাসন ব্যর্থ হয় এবং জাতিসংঘের প্রস্তাবিত মানবিক করিডর আমাদের প্রত্যাশামতো কাজ না করে, তাহলে বিকল্প কী হবে, সে বিষয়ে বিস্তারিত পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি আমাদের থাকা উচিত। সেটি না হলে রোহিঙ্গা সংকট আরও জটিল আকার ধারণ করবে এবং তাদের নিজ দেশে স্বেচ্ছায় ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন একটি ‘মিথ’ হিসেবে থেকে যাবে, যা আমাদের ও রোহিঙ্গা উভয়ের জন্যই হতাশার একটি বিষয় হবে। 

বুলবুল সিদ্দিকী সহযোগী অধ্যাপক, রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়

সম্পর্কিত নিবন্ধ