বার্ষিক পরীক্ষার পরের ছুটিতে ঢাকা থেকে দূরের কোনো শহরে বেড়াতে যাবার জন্য আপু প্রতিদিন আব্বার কাছে ঘ্যান ঘ্যান করতে লাগলো। আব্বা প্রতিদিনই বলেন, এই সময়ে সবাই বেড়াতে যাওয়ায় টিকিট পাওয়া যাবে না; ভালোভাবে কোথাও সময় কাটানো যাবে না। আমার কাছেও মনে হলো একটু ঘুরে এলে কী এমন হয়? শেষ পর্যন্ত আব্বা রাজি হয়ে গেলেন। আগের দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত আমরা জানতাম না, কোথায় যাবো? আব্বা যখন বললেন, কুমিল্লা পল্লী উন্নয়ন একাডেমিতে যাবেন, তখন আম্মু বিরক্ত হয়ে বলেন, ‘ওটাতো তোমাদের সরকারি অফিসারদের ট্রেনিং সেন্টার, সেখানে বাচ্চারা মজা পাবে না।’ আব্বা মুচকি হেসে বলেন, ‘বাংলার একটি প্রাচীন জনপদে গিয়ে বাচ্চারা অনেক কিছু শিখতে পারবে। পল্লী উন্নয়ন একাডেমি যাকে বার্ড বলে, সেটিও খুব সুন্দর আর নিরাপদ।’
আমরা সকালে মহানগর প্রভাতী ট্রেনে কুমিল্লা রওনা দিয়ে দুপুরের আগেই পৌঁছে গেলাম। এতো সুন্দর পাহাড়, লন টেনিসের কোর্ট, সুইমিং পুল, হাজার হাজার গাছ দেখে মনটা ভরে গেলো। আব্বা একে একে বার্ডের ভেতর ট্রেনিং সেন্টার, ক্লাসরুম, লাইব্রেরি, লাল-গোলাপি অসংখ্য রঙের ফুলের বাগান ঘুরিয়ে দেখালেন।
আপু মামুন দাদাকে মোবাইল ফোনে জানালো, আমরা বার্ডে এসেছি। মামুন দাদা আমাদের বললেন, ‘লালমাইয়ের ময়নামতি বিহার-যাদুঘর, নব শালবন বৌদ্ধ বিহার, রাণীদিঘি, শালবন অবশ্যই ঘুরে আসবে।’ তিনি কুমিল্লা রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলের একটা ছবি তুলে দিতে বলেন। কেননা, সেই স্কুলের ছাত্র ছিলেন তিনি। এই স্কুলটি বর্তমানে কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজ। ছোটবেলায় মামুন দাদা বার্ডের ঠিক পাশেই কোর্টবাড়িতে থাকতেন। আমরা বার্ডের নীলাচল পাহাড়ে উঠে ক্যাডেট কলেজের ছবি তুলে মামুন দাদাকে পাঠিয়ে দিলাম।
কয়দিনের বেড়ানোর সময় কুমিল্লার বিখ্যাত মাতৃভাণ্ডারের মজার রসমালাই, ছানামুড়কী খাই। আসার দিন আব্বাকে বললাম, ‘মামুন দাদার জন্য কী নেব?’ একটি বড় গাছের নিচে এসে সবুজ রঙের ফল দেখিয়ে বলেন, ‘বার্ডের এই ফলটি নিয়ে যাও। তোমার মামুন দাদা অনেক খুশি হবেন।’ এটা কী ফল, বলায় আব্বা হাসতে হাসতে বলেন, ‘মুচি’। আপু রাগ করে বলে, ‘তুমি কী আমাদের বাচ্চা পেয়েছো? মুচি, আবার কোনো ফল হতে পারে?’ শেষ পর্যন্ত আব্বা বুঝিয়ে বলেন, কাঁঠালের কচি অবস্থাকে মুচি বলে। আমি একটি আস্ত কাঁঠাল টিস্যুপেপার দিয়ে মুড়িয়ে পকেটে রেখে দিলাম মামুন দাদাকে দেবো বলে। আসলে এটি হচ্ছে আমার কাঁঠাল অভিযান!
বয়স : ১+২+২+৩+৪ বছর; ষষ্ঠ শ্রেণি, মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ঢাকা
.উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
সন্তানদের টানে বিচ্ছেদ থেকে বন্ধন, আদালত চত্বরে আবার বিয়ে
তিন বছর আট মাস আগে বিবাহবিচ্ছেদ হয় এক দম্পতির। পরে দুই কন্যাসন্তানের হেফাজত চেয়ে আদালতে পাল্টাপাল্টি মামলা করেন মা ও বাবা। শুনানির সময় বাবার সঙ্গে আদালতে সন্তানদের দেখা হতো। কিন্তু এতটুকু দেখাতে মন ভরত না সন্তানদের। সন্তানেরা মা-বাবাকে সব সময় একসঙ্গে কাছে পেতে চাইত। সাত বছর বয়সী বড় কন্যা প্রতিবার সাক্ষাতের সময় কান্নাকাটি করে মা-বাবাকে একসঙ্গে থাকার জন্য আকুতি জানাত।
পরে দুই কন্যার মানসিক অবস্থা বিবেচনা করে ব্যথা ও অভিমান ভুলে ওই দম্পতি আবার একসঙ্গে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। প্রায় তিন বছর মামলা চালানোর পর গত মার্চ মাসে আদালত চত্বরে তাঁদের বিয়ে সম্পন্ন হয়।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মলয় কুমার সাহা প্রথম আলোকে বলেন, শুধু কন্যাদের মানসিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে ওই দম্পতি আবার এক হয়েছেন। আপসের পর ধর্মীয় বিধান মেনে আদালত চত্বরে তাঁদের আবার বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। তাঁরা সংসার শুরু করেছেন।
যেভাবে দ্বন্দ্ব, যেভাবে আপস
২০১৭ সালে পারিবারিকভাবে এই দুজনের বিয়ে হয়। তাঁরা দুজনই উচ্চশিক্ষিত। দুজনই উচ্চপদে চাকরি করেন। বিয়ের পর নারীর বাবার বাড়িতে তাঁদের সংসার শুরু হয়। পরে রাজধানীতে একটি ভাড়া বাসা নিয়ে থাকা শুরু করেন। বিয়ের এক বছরের মাথায় তাঁদের কন্যাসন্তানের জন্ম হয়।
নারীর ভাষ্য, বিয়ের পর তাঁদের সংসার ভালোই চলছিল। স্বামী যৌতুক চেয়েছিলেন। এ কারণে মেয়ের সুখের কথা ভেবে যৌতুক হিসেবে ছয় লাখ টাকা ব্যয় করে টিভি, ফ্রিজ, খাট ও আলমারি উপহার দেন তাঁর বাবা।
মামলায় ওই নারী অভিযোগ করেন, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় তাঁর স্বামীর ভাড়া বাসায় ওঠার কয়েক মাস পর থেকে সংসারে অশান্তি শুরু হয়। ভাড়া বাসার পাশে তাঁর ননদের বাসা ছিল। শাশুড়ি কখনো তাঁদের সঙ্গে, আবার কখনো মেয়ের বাসায় থাকতেন। তুচ্ছ কারণে শাশুড়ির সঙ্গে তাঁর প্রায় সময় মনোমালিন্য হতো। এ নিয়ে স্বামী তাঁকে কটু কথা বলতেন। একপর্যায়ে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করতেন স্বামী। তবু সন্তানের কথা ভেবে অত্যাচার সহ্য করে সংসার করতে থাকেন তিনি।
মামলায় ওই নারী আরও অভিযোগ করেন, একপর্যায়ে বাবার কাছ থেকে জমি লিখে নিতে স্বামী তাঁকে চাপ দিতে শুরু করেন। এ প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন আরও বেড়ে যায়। একসময় তাঁদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়। পরে নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে বিয়ের চার বছরের মাথায় তিনি স্বামীকে তালাক দিয়ে সন্তান নিয়ে বাবার বাড়ি চলে যান।
তালাক কার্যকরের (তিন মাস) আগে স্বামীর পরিবারের সদস্যরা তালাকের নোটিশ প্রত্যাহারের অনুরোধ করতে থাকেন। স্বামী ও তাঁদের স্বজনেরা ওই নারীর কাছে অঙ্গীকার করেন, আর কখনোই শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন করা হবে না। স্বামীর অনুরোধ ও সন্তানের কথা ভেবে কার্যকর হওয়ার আগে ওই নারী তালাকের নোটিশ প্রত্যাহার করে নেন। আবার সংসার শুরু করেন।
আদালতের কাছে নারী দাবি করেন, আবার সংসার শুরুর পর থেকে কয়েক মাস তাঁর স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক বেশ ভালো ছিল। তবে দ্বিতীয় সন্তান গর্ভে আসার পর থেকে আবারও স্বামী নির্যাতন করা শুরু করেন। তিনি এতটাই উগ্র হয়ে ওঠেন যে নির্যাতন ঠেকাতে পরিবারের অন্য সদস্যরা এগিয়ে এলে স্বামী তাঁদের সঙ্গেও খারাপ ব্যবহার করতেন। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে আবারও স্বামীর বাসা ছেড়ে চলে যান বাবার বাসায়। ২০২১ সালের ৩০ আগস্ট তিনি আবার তাঁর স্বামীকে তালাকের নোটিশ দেন। তালাক কার্যকরও হয়। ছয় মাস পর একটি বেসরকারি হাসপাতালে তাঁর দ্বিতীয় কন্যাসন্তানের জন্ম হয়। স্বামী কখনো দ্বিতীয় সন্তানকে দেখতে আসেননি।
তবে এই নারীর সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তাঁর সাবেক স্বামী। সাবেক স্বামীর অভিযোগ, তাঁর মায়ের সঙ্গে স্ত্রীর বনিবনা হতো না। এ কারণে স্ত্রী প্রায় সময় তাঁর মায়ের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতেন। একদিন রাগ করে তাঁর স্ত্রী বড় মেয়েকে নিয়ে বাবার বাড়ি চলে যান। দ্বিতীয় সন্তান জন্মের পর কন্যাদের দেখতে তিনি শ্বশুরবাড়িতে গেলে শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাঁকে মারধর করেন। এ সময় তিনি জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯–এ ফোন দেন। পরে পুলিশ তাঁকে উদ্ধার করে।
এ ঘটনার পর তাঁদের দুজনের মধ্যে আর কোনো সমঝোতা হয়নি। পরে দুই কন্যার হেফাজত চেয়ে সাবেক স্ত্রীকে বিবাদী করে পারিবারিক আদালতে মামলা করেন সাবেক স্বামী। অন্যদিকে ওই নারীও সাবেক স্বামীকে বিবাদী করে একই ধারায় মামলা করেন।
আরও পড়ুনবিয়ের অনেক বছর পরও কেন বিচ্ছেদ হয়১০ জুলাই ২০২৪বিবাদীপক্ষের আইনজীবী মলয় কুমার সাহা প্রথম আলোকে বলেন, এই দম্পতির বড় সন্তানের বয়স প্রায় সাত বছর, আর ছোট সন্তানের বয়স চার বছর। পারিবারিক আদালতে মামলার শুনানি চলাকালে আদালতকক্ষে স্বামী-স্ত্রীর দেখা হতো। দুই কন্যা তখন মা–বাবা দুজনের সঙ্গেই কথা বলত। তারা কান্নাকাটি করত; সবাই মিলে একসঙ্গে থাকতে চাইত। একসময় স্বামী-স্ত্রী দুজনই সন্তানের মানসিক অবস্থার কথা চিন্তা করে আবার একসঙ্গে সংসার করার সিদ্ধান্ত নেন।
আইনজীবী মলয় কুমার সাহা বলেন, মা–বাবার বিচ্ছেদের পর সন্তানেরা মানসিক যন্ত্রণার মুখোমুখি হয়। শিশুর মানসিক বিকাশে মা–বাবার আদর-ভালোবাসা বিরাট ভূমিকা রাখে। বিচ্ছেদের কারণে আদর-ভালোবাসার ঘাটতি সন্তানদের জীবনে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে। এ কারণে দুই কন্যার মানসিক সুস্থতার কথা ভেবে গত মার্চ মাসে আপস করে ওই দম্পতি আবার বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাঁরা সংসার শুরু করেছেন। তাঁদের ব্যাপারে নিয়মিত খোঁজখবর রাখা হচ্ছে। তাঁরা এখন সুখে আছেন।
আরও পড়ুনবিচ্ছেদের ৫০ বছর পর আবার একসঙ্গে দুজন ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪আরও পড়ুনডিভোর্সের পরও সন্তানের কথা ভেবে এক ছাদের নিচে থাকা কি ঠিক২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫