চরাঞ্চলের ভাগ্য বদলাবে বাকৃবি উদ্ভাবিত নতুন তিন পদ্ধতি
Published: 1st, March 2025 GMT
বাংলাদেশের চরাঞ্চলের মাটি সাধারণত বেলে বা বেলে-দোঁয়াশ প্রকৃতির, যা পানির ধারণক্ষমতা ও জৈব পদার্থের পরিমাণ কম। পাশাপাশি, সেচের সমস্যা, আকস্মিক বন্যা, খরা ও আধুনিক প্রযুক্তির অভাবে চরাঞ্চলের কৃষি উৎপাদনশীলতা তুলনামূলক কম।
তবে এসব প্রতিকূলতা মোকাবিলায় নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) কৃষিতত্ত্ব বিভাগের একদল গবেষক।
গবেষকরা নতুন তিন শস্যবিন্যাস পদ্ধতির মাধ্যমে একই জমিতে বছরজুড়ে তিন ধরনের ফসল উৎপাদনের মাধ্যমে সাফল্য পেয়েছেন। এতে ফসলের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির পাশাপাশি কৃষকদের জন্য লাভজনক কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার চর গুজিমারী এলাকায় এ গবেষণা পরিচালিত হচ্ছে।
আরো পড়ুন:
কাশিয়ানীতে ৫ মাসে ২৩ ট্রান্সফরমার চুরি, সেচ ব্যাহত
‘টমেটো এখন পাখিদের খাদ্য’
গবেষণাটি ‘ফসলের উৎপাদনের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পরীক্ষণ এবং জলবায়ু সহনশীল ফসল ব্যবস্থার অভিযোজনের মাধ্যমে বাংলাদেশের চরাঞ্চলের ফসলের উৎপাদনশীলতার উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় পরিচালিত হচ্ছে।
এর নেতৃত্বে রয়েছেন বাকৃবির কৃষিতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড.
গবেষকরা চরাঞ্চলের কৃষকদের জন্য তিনটি লাভজনক শস্যবিন্যাস পদ্ধতি নির্ধারণ করেছেন। যার মধ্যে রয়েছে, ভুট্টা-পাট-রোপা আমন, আলু-পাট-রোপা আমন এবং মরিচ-চিনাবাদাম-রোপা আমন পদ্ধতি। আধুনিক জাত, উন্নত প্রযুক্তি ও কৃষিতাত্ত্বিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সবচেয়ে লাভজনক পদ্ধতিটি চিহ্নিত করে কৃষকদের জন্য সুপারিশ করা হবে।
প্রধান গবেষক ড. আহমেদ খায়রুল হাসান বলেন, “আকস্মিক বন্যা মোকাবিলায় জলমগ্ন সহনশীল বিনাধান-১১ এবং কম বয়সী চারা ভালো ফলন দিয়েছে। পাশাপাশি ভুট্টা ও মরিচ চাষের সঙ্গে আন্তঃফসল হিসেবে আলু, পেঁয়াজ, রসুন, গাজর, কালোজিরা, মেথি, ধনিয়া ও মটরশুঁটি চাষ করায় একক ফসলের তুলনায় অধিক লাভ হয়েছে।”
তিনি বলেন, “গবেষণায় দেখা গেছে, মালচিং ও ভার্মি কম্পোস্ট ব্যবহার করে আলুর উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। পাটের বীজ প্রাইমিং করায় অঙ্কুরোদগমের হার বেড়েছে। আগাছা দমনে আগাছানাশক ও হ্যান্ড উইডিংয়ের সমন্বিত ব্যবহারে ভালো ফলন পাওয়া গেছে। এছাড়াও বারি সরিষা-১৪, রঙিন ফুলকপি, বাঁধাকপি, মটরশুঁটি, গম, রসুন, কাউন ও সূর্যমুখীর ফলন সন্তোষজনক ছিল।”
গবেষণার সফল প্রয়োগ ইতোমধ্যে চরাঞ্চলের কৃষকদের মধ্যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার চর গুজিমারী এলাকার কৃষাণী নাছিমা খাতুন জানান, গবেষকদের পরামর্শে ৩৩ শতাংশ (১ বিঘা) জমিতে সূর্যমুখী, ভুট্টা ও রোপা আমন চাষ করে তিনি ভালো ফলন পেয়েছেন। ভবিষ্যতে আরো বেশি জমিতে এ শস্যবিন্যাসের মাধ্যমে চাষের পরিকল্পনা করছেন তিনি।
গবেষণা দলের সদস্য কৃষিতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আব্দুস সালাম বলেন, “নির্দিষ্ট শস্যবিন্যাস অনুসরণ করলে একই জমিতে একাধিক ফসল উৎপাদনের মাধ্যমে আগাছার প্রভাব কমে, মাটির পুষ্টি উপাদান সংরক্ষিত থাকে এবং উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। ইতোমধ্যে গবেষণার ক্ষেতে প্রতি আধা শতাংশ জমিতে ৭৬ কেজি পর্যন্ত আলু উৎপাদনের নজির পাওয়া গেছে, যা কৃষকদের জন্য অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক।”
ঢাকা/মেহেদী
উৎস: Risingbd
এছাড়াও পড়ুন:
ক্ষুদ্র কৃষকদের উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন যেভাবে হতে পারে
বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তি কৃষি। এই খাত খাদ্য নিরাপত্তা, দারিদ্র্য বিমোচন এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে অধিকাংশ ক্ষুদ্র কৃষক উৎপাদনশীলতার অভাব, আধুনিক প্রযুক্তির সীমিত ব্যবহার, দুর্বল বাজার সংযোগ ও আর্থিক সংকটের মতো চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন। এসব সমস্যা দূর না হলে কৃষি খাতের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সম্ভব হবে না। সমাধান হিসেবে ব্যবসায়িক কৃষি কাজে লাগতে পারে, যেখানে কৃষিকে শুধু জীবনধারণের উপায় নয়, বরং লাভজনক উদ্যোগ হিসেবে দেখা হয়। উন্নত প্রযুক্তি, আধুনিক চাষাবাদ, প্রশিক্ষণ, বাজার সংযোগ এবং সহজ ঋণের সুযোগ পেলে ক্ষুদ্র কৃষকরা উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও কৃষিকে লাভজনক করতে পারবেন।
তাদের অর্থনৈতিক গুরুত্ব সত্ত্বেও বাংলাদেশের ক্ষুদ্র কৃষকরা নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হন। প্রচলিত ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ ঋণগ্রহীতা মনে করে। ফলে সহজ শর্তে ঋণ পেতে ব্যর্থ হন। কৃষিঋণের সুদের হার তুলনামূলক বেশি হওয়ায় অনেকে অনানুষ্ঠানিক ঋণদাতাদের কাছ থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হন, যা তাদের আরও আর্থিক সংকটে ফেলে।
অনেক কৃষক এখনও পুরোনো চাষাবাদ পদ্ধতিতে নির্ভরশীল। ফলে ফসলের উৎপাদন কম হয়। উন্নত বীজ, আধুনিক সেচ ব্যবস্থা ও মাটির স্বাস্থ্য সংরক্ষণের প্রযুক্তি ব্যবহারে সীমাবদ্ধতা থাকায় উৎপাদনশীলতা বাড়ে না। এ ছাড়া কৃষকরা মধ্যস্বত্বভোগীদের ওপর নির্ভরশীল, যারা ন্যায্যমূল্য প্রদান না করায় প্রকৃত লাভ থেকে বঞ্চিত হন। অনিয়মিত আবহাওয়া, জলবায়ু পরিবর্তন, বন্যা,
খরা ও লবণাক্ততার কারণে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হয়। সংরক্ষণ ও পরিবহন ব্যবস্থার দুর্বলতার ফলে কৃষিপণ্য নষ্ট হয়ে কৃষকদের লাভ কমে যায়। পাশাপাশি আধুনিক কৃষিবাজার ও সরবরাহ শৃঙ্খলে যুক্ত হতে না পারায় প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকতে অসুবিধায় পড়েন।
ব্যবসায়িক কৃষির মাধ্যমে ক্ষুদ্র কৃষকদের কৃষিকে একটি লাভজনক ও টেকসই ব্যবসায় পরিণত করা সম্ভব। এটি শুধু কৃষকদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি করবে না, বরং খাদ্য নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এ পদ্ধতি কার্যকর করতে বিভিন্ন কৌশল গ্রহণ করা যেতে পারে, যা ক্ষুদ্র কৃষকদের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, বাজারে প্রবেশাধিকার সম্প্রসারণ এবং আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে।
প্রথমত, কৃষকদের সমবায় গঠনের মাধ্যমে একত্র করা গেলে তারা যৌথভাবে কৃষি উপকরণ কিনতে পারবেন, যা উৎপাদন খরচ কমাতে সাহায্য করবে। এ ছাড়া কৃষকরা নিজেদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে পারবেন এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের ওপর নির্ভরশীলতা কমবে। ফলে তারা বৃহৎ ক্রেতাদের সঙ্গে সরাসরি চুক্তিবদ্ধ হতে পারবেন, যা লাভজনক বাজারে প্রবেশের সুযোগ সৃষ্টি করবে।
দ্বিতীয়ত, আধুনিক কৃষি পদ্ধতির প্রচলন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উন্নত জাতের বীজ, অধিক ফলনশীল এবং জলবায়ু সহনশীল জাতের ফসল চাষ, কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে কৃষির স্থায়িত্বশীলতা নিশ্চিত
করা সম্ভব।
তৃতীয়ত, ক্ষুদ্র কৃষকদের সহজ শর্তে ও স্বল্প সুদে ঋণ সুবিধা প্রদান করা জরুরি। ক্ষুদ্র ঋণদান প্রতিষ্ঠান, সমবায় ব্যাংক এবং সরকারি ঋণ কর্মসূচির মাধ্যমে কৃষকদের জন্য সহজ ঋণের ব্যবস্থা করা দরকার। এর ফলে কৃষকরা উন্নত কৃষি প্রযুক্তি গ্রহণ করতে এবং উৎপাদন বাড়াতে পারবেন।
চতুর্থত, কৃষকদের বাজারের সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত করার উদ্যোগ নিতে হবে। বৃহৎ ক্রেতা, কৃষি-শিল্পপ্রতিষ্ঠান এবং রপ্তানিকারকদের সঙ্গে কৃষকদের সরাসরি চুক্তিবদ্ধ করা হলে তারা তাদের উৎপাদিত ফসলের সঠিক দাম পাবেন। কৃষিপণ্য সংরক্ষণ ও রপ্তানির জন্য কোল্ডস্টোরেজ, প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র এবং উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
পঞ্চমত, ক্ষুদ্র কৃষকদের উচ্চমূল্যের ফসল, জৈব কৃষি এবং কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের দিকে উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে, যা কৃষকদের জন্য অধিক লাভজনক হতে পারে।
সরকার, বেসরকারি খাত এবং এনজিওগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে কৃষকদের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, প্রশিক্ষণ এবং কৃষি উপকরণের সহজপ্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। কৃষিতে গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং কৃষকদের আধুনিক কৃষি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করাও গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশে ব্যবসায়িক কৃষির মাধ্যমে ক্ষুদ্র কৃষকদের ক্ষমতায়নে বেশ কিছু উদ্যোগ সফলভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য– আমার গ্রাম আমার দেশ প্রকল্প, যা গ্রামীণ কৃষকদের শহরের ভোক্তাদের সঙ্গে ডিজিটাল মার্কেটপ্লেসের মাধ্যমে সংযুক্ত করে, ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করে এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের ওপর নির্ভরশীলতা কমায়। মডেলটি কৃষকদের ঝুঁকি কমাতে এবং আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
বাংলাদেশে ক্ষুদ্র কৃষকদের ক্ষমতায়নের মাধ্যমে ব্যবসায়িক কৃষি শুধু তাদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নই করবে না, বরং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
মো. শহিদুল ইসলাম: কৃষিবিজ্ঞানী ও সাবেক মহাপরিচালক, বিএআরআই
dmsislam12@gmail.com